রঞ্জক প্রাচীন সৌন্দর্যবর্ধক
রঞ্জক প্রাচীন সৌন্দর্যবর্ধক
কনানীয় সেনাপতি সীষরার মা উৎসুকভাবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তার ছেলের ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি মনে মনে সেই সমস্ত মূল্যবান জিনিসপত্রের কথা কল্পনা করছিলেন, যা সীষরা যে-অঞ্চলগুলো জয় করেছিলেন, সেখান থেকে লুট করে নিয়ে আসবেন। তিনি যে-বিষয়গুলোর আশা করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে ছিল “চিত্রিত বস্ত্র, . . . চিত্রিত সূচিকার্য্যের বস্ত্র, . . . চিত্রিত দুই ধারি বাঁধা বস্ত্র লুটকারীর কণ্ঠে।” (বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ৫:৩০) মানুষ সবসময়ই সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করেছে আর সৌন্দর্যবর্ধকের মধ্যে এক সর্বপ্রধান বিষয় হচ্ছে রং। তাই, এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, কাপড়চোপড় ও গৃহস্থালীর বিভিন্ন জিনিসপত্রে রং দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। এভাবেই রঞ্জক শিল্পের জন্ম হয়েছিল।
রঞ্জিত করা হচ্ছে সুতা, কাপড় ও অন্যান্য বস্তুসামগ্রীর ওপর রঞ্জক উপাদান দিয়ে নির্দিষ্ট বর্ণ ও আভা তৈরি করার এক শিল্প। অব্রাহামের দিনের আগে এটা পরিচিত হয়েছিল ও চর্চা করা হতো আর এই শিল্পটা সম্ভবত বুনন শিল্পের মতোই পুরনো। ইস্রায়েলীয়রা আবাস ও যাজকীয় পোশাকের জন্য এই ধরনের সামগ্রী যেমন নীল, বেগুনি ও লাল সুতা ব্যবহার করত। (যাত্রাপুস্তক ২৫-২৮, ৩৫, ৩৮, ৩৯ অধ্যায়গুলো দেখুন) রঞ্জিতকরণ যা প্রাচীনকালে মোটামুটি গৃহস্থালীর কাজ ছিল, তা শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বেশ জনপ্রিয় এক ব্যাবসা হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশেষভাবে তাদের উজ্জ্বল রঞ্জিত সামগ্রীর জন্য বিশিষ্ট ছিল। যিহিষ্কেল ২৭ অধ্যায়ের ৭ পদে আমরা পড়ি: “তোমার পতাকা হইবার জন্য মিসর দেশ হইতে আনীত সূচী-কর্ম্মে চিত্রিত মসীনা-বস্ত্র তোমার পাইল ছিল; ইলীশার উপকূলসমূহ হইতে আনীত নীল ও বেগুনে বস্ত্র তোমার আচ্ছাদন ছিল।” মিশরের পতনের পর, সোর ও ফৈনিকিয়ার শহরগুলো রঞ্জকের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রঞ্জকগুলোকে কীভাবে উৎপাদন করা হতো?
প্রাথমিক প্রক্রিয়াগুলো
রঞ্জিত করার প্রক্রিয়া বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নরকম। কখনও কখনও সুতাকে রঞ্জিত করা হতো আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রস্তুতকৃত বস্ত্রে রঞ্জক প্রয়োগ করা হতো। মনে হয় সুতাকে দুবার রঞ্জকে ডুবানো হতো, দ্বিতীয় বার চৌবাচ্চা থেকে উঠানোর পর নিঙড়ানো হতো, যাতে মূল্যবান রঞ্জকটা অক্ষুণ্ণ থাকে। এরপর সুতাকে বিছিয়ে রাখা হতো, যাতে এটা শুকাতে পারে।
প্রত্যেকটা বস্তুকে আলাদাভাবে প্রক্রিয়া করা হতো। যদিও কদাচিৎ, তারপরও রঞ্জক উপাদানের কখনও কখনও রঞ্জিত তন্তুর প্রতি এক প্রাকৃতিক আকর্ষণ থাকত। কিন্তু, যখন সেইরকম হতো না, তখন বস্তুসামগ্রীকে রং-বন্ধক দিয়ে প্রথমে প্রক্রিয়া করা আবশ্যক ছিল আর এই রং-বন্ধক হল এমন এক পদার্থ যেটার তন্তু ও রঞ্জক দুটোর প্রতিই আকর্ষণ রয়েছে। রং-বন্ধক হিসেবে কাজ করার জন্য কোনো পদার্থের অন্তত রঞ্জক উপাদানের প্রতি আকর্ষণ থাকতে হবে, যাতে এগুলো পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক অদ্রবণীয় রঙিন যৌগ গঠন করে। আবিষ্কারগুলো দেখায় যে, মিশরীয়রা রঞ্জিত করার প্রক্রিয়াগুলোতে রং-বন্ধক প্রয়োগ করত। উদাহরণস্বরূপ, তাদের ব্যবহৃত তিনটে রং ছিল লাল, হলুদ এবং নীল আর কথিত আছে যে, এই ধরনের রঞ্জকগুলো রং-বন্ধক হিসেবে আর্সেনিক, আয়রন ও টিনের অক্সাইডগুলোকে ব্যবহার করা ছাড়া স্থায়ী করা যেত না।
স্পষ্টতই, পশুর চামড়াকে প্রথমে পাকা করা হতো এবং পরে রঞ্জিত করা হতো। এমনকি সম্প্রতি সিরিয়ায় ভেড়ার চামড়াকে শুমাকের (গুল্ম বা ছোট গাছ, যার শুকনো পাতা চামড়া পাকায় বা বস্ত্রের রঞ্জনে ব্যবহার করা হয়) মধ্যে পাকা করা হয় এবং এরপর রঞ্জক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। রঞ্জক শুকিয়ে যাওয়ার পর, চামড়াগুলো তেল দ্বারা ঘষা হয় ও এরপর পালিশ করা হয়। এভাবে বেদুইনদের দ্বারা ব্যবহৃত জুতো এবং অন্যান্য চামড়ার জিনিসগুলো লাল রঞ্জক দ্বারা রঞ্জিত করা হয় আর তা হয়তো আবাসের জন্য ‘রক্তীকৃত মেষচর্ম্মের’ বিষয় মনে করিয়ে দিতে পারে।—যাত্রাপুস্তক ২৫:৫.
রঞ্জিত বস্তুগুলোর বিষয়ে একটা আগ্রহজনক বিবরণ হচ্ছে, অশূরীয় রাজা ৩য় টিগলথ-পিলসেরের এক খোদিত নির্মিত বস্তু। প্যালেস্টাইন ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে তার সামরিক অভিযান সম্বন্ধে বলার পর, তিনি বলেন যে, তিনি সোরের নির্দিষ্ট একজন হীরম এবং অন্যান্য শাসকদের কাছ থেকে রাজস্ব লাভ করেছিলেন। তালিকাবদ্ধ বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত “বিভিন্ন রঙে সজ্জিত
মসীনা বস্ত্র, . . . নীল, বেগুনি পশমী কাপড়, . . . সেইসঙ্গে মেষশাবক, যেগুলোর বিস্তৃত চামড়াগুলোকে বেগুনি রং দিয়ে রঞ্জিত করা হয়েছিল, (আর) বুনো পাখি, যাদের প্রসারিত পালকগুলোকে নীল রং দিয়ে রঞ্জিত করা হয়েছিল।”—এনশিয়েন্ট নিয়ার ইস্টার্ন টেক্সট্, জে. প্রিচার্ড দ্বারা সম্পাদিত, ১৯৭৪, পৃ. ২৮২, ২৮৩.রঞ্জকের উৎসগুলো
বিভিন্ন উৎস থেকে রঞ্জক পদার্থগুলো সংগ্রহ করা হতো। প্যালেস্টাইনে, হলুদ রঞ্জকগুলো কাঠবাদাম গাছের পাতা ও ডালিম গাছের বাকল থেকে পাওয়া যেত, যদিও ফৈনিকীয়রা হলুদ ও স্যাফ্লাওয়ারও ব্যবহার করত। ইব্রীয়রা ডালিম গাছের বাকল থেকে কালো ও ম্যাডার (পীত বর্ণের লতাবিশেষ) (রুবিয়া টিংকটোরাম) উদ্ভিদের মূল থেকে লাল রঞ্জক সংগ্রহ করতে পারত। নীল গাছ (ইনডিগোফেরা টিংটোরিয়া) যেটাকে সম্ভবত মিশর বা সিরিয়া থেকে প্যালেস্টাইনে আনা হয়েছিল, তা নীল রঞ্জকের জন্য ব্যবহার করা যেত। পশমের মধ্যে বেগুনি রং দেওয়ার ব্যবহৃত পদ্ধতির একটার মধ্যে ছিল সারারাত আঙুরের রসের মধ্যে পশমকে ডুবিয়ে রাখা এবং ম্যাডারের গুঁড়ো এর ওপর ছিটিয়ে দেওয়া।
কক্কাস গাঢ় লাল এবং বেগুনি-লাল (ক্রিমসন) রঞ্জক তাদের উৎস হিসেবে পরিচিত সবচেয়ে প্রাচীন রঞ্জক উপাদান ককসিডি (কক্কাস ইলিসিস) গোত্রের এক পরজীবি হোমোটেরাস পোকা ব্যবহার করত। জীবিত স্ত্রী পোকা, যার আকার প্রায় একটা চেরি ফলের বীচির সমান, সেটা জামের মতো দেখায় বলে গ্রিকরা কক্কস শব্দটাকে ব্যবহার করত, যার অর্থ “জাম।” সেই পোকার নাম আরবি ভাষায় হল কিরমিজ বা কেরমেজ, যেখান থেকে ইংরেজি শব্দ “ক্রিমসন” এসেছে। এই পোকা পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে পাওয়া যায়। কেবলমাত্র এর ডিমগুলো বেগুনি-লাল রঞ্জক উপাদান বহন করত, যেটাতে প্রচুর পরিমাণে কেরমেসিক এসিড রয়েছে। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে, ডিমে পূর্ণ পক্ষহীন স্ত্রী হুল দ্বারা কেরমিস ওক (কুয়েরকাস ককিফেরা) গাছের কচি ডাল ও মাঝে মাঝে পাতার সঙ্গে লেগে থাকে। শূককীট অথবা কেরমিস সংগ্রহ করা হয় ও শুকানো হয় আর জলে ফুটিয়ে মূল্যবান রঞ্জক সংগ্রহ করা হয়। এটাই হল লাল রঞ্জক, যা আবাসের আনুষঙ্গিক বস্তু এবং ইস্রায়েলের মহাযাজকের পরিহিত পোশাক তৈরিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো।
এক ধরনের ঝিনুককে (নীল ঝিনুক) নীল রঞ্জকের উৎস হিসেবে মনে করা হয়। বেগুনি রঞ্জক ঝিনুক বা শামুক যেমন মিউরেক্স ট্রানকুলাস এবং মিউরেক্স ব্র্যানডারিস থেকে সংগ্রহ করা হতো। এই প্রাণীদের ঘাড়ে একটা ছোট গ্রন্থি রয়েছে, যেখানে মাত্র এক ফোঁটা তরল থাকে, যেটাকে ফুল বলা হয়। প্রথম দিকে এটা ক্রিমের মতো ও আঠালো থাকে কিন্তু বাতাস ও আলোর সংস্পর্শে এটা ধীরে ধীরে গাঢ় বেগুনি ও লালচে বেগুনি রং ধারণ করে। এই ঝিনুকগুলো ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার তীরে পাওয়া যায় এবং এগুলো থেকে সংগৃহীত বর্ণের আভা এদের স্থান অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের হয়। বড় নমুনা ঝিনুকগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে ভেঙে সেখান থেকে সতর্কতার সঙ্গে মূল্যবান তরল বের করা হতো আর ছোটগুলোকে হামানদিস্তায় চূর্ণ করা হতো।
এইরকম একেকটা ঝিনুকের মধ্যে থেকে সংগৃহীত তরলের পরিমাণ খুব কম, তাই বেশ কিছু পরিমাণ তরল সংগ্রহ করা এক ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া ছিল। ফলে, এই রঞ্জক খুবই দামী ছিল আর বেগুনি রংয়ের দ্বারা রঞ্জিত পোশাক ধনী ব্যক্তিদের বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের চিহ্ন হয়ে উঠেছিল। যখন রাজা অহশ্বেরসের দ্বারা মর্দখয় এক উচ্চপদে পদান্বিত হয়েছিলেন, তখন তিনি “নীল ও শুক্লবর্ণ রাজকীয় পরিচ্ছদপরিহিত, সুবর্ণময় বৃহৎ মুকুটে ভূষিত, এবং মসীনাসূত্রের বেগুনে বস্ত্রে বস্ত্রান্বিত হইয়া রাজার সম্মুখ হইতে বাহিরে গেলেন।” (ইষ্টের ৮:১৫) আবার লূক ১৬ অধ্যায় ১৯ থেকে ৩১ পদে পাওয়া যিশুর দৃষ্টান্তের “ধনবান্ লোক . . . বেগুনে কাপড় ও সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করিত, এবং প্রতিদিন জাঁকজমকের সহিত আমোদ প্রমোদ করিত।”
সোরের বেগুনি
প্রাচীন সোর বেগুনি বা গাঢ় বেগুনি-লালের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, যে-রঞ্জকটা সোরের বা রাজকীয় বেগুনি হিসেবে পরিচিত ছিল। যদিও সোর নিবাসীরা দ্বৈত রঞ্জিত করার পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়েছে বলে মনে করা হয়, তবে এই রং সংগ্রহ করার যথার্থ সূত্র জানা যায়নি। রঞ্জক উপাদানকে স্পষ্টতই মিউরেক্স এবং পারপুরা শামুক, মিউরেক্স ট্রানকুলাস ঝিনুকের খালি খোলসের স্তূপ থেকে সংগ্রহ করা হতো, যেগুলো সোরের তীরে এবং সিদোনের আশেপাশে তীরে পাওয়া যেত। সোরের ফৈনিকীয় শহরকে যিহোবা বেগুনি রঞ্জক ও অন্যান্য রংবেরঙের বস্তুসামগ্রী দ্বারা রঞ্জিত পশমের শহর ও সেইসঙ্গে এই ধরনের পণ্যের ব্যাবসা করে বলে বর্ণনা করেছেন।—যিহিষ্কেল ২৭:২, ৭, ২৪.
হ্যাঁ, শুধু সীষরার মা-ই নন কিন্তু অন্যান্য অনেক মহিলা ও তাদের পুরুষ সঙ্গীরা নিশ্চয়ই সূক্ষ্ম, সুন্দরভাবে রঞ্জিত পোশাক ও গৃহস্থালির জিনিসপত্রের জন্য আকাঙ্ক্ষা করত। আজকেও এটা সত্য যে, রং দ্বারা রঞ্জিত করা নিশ্চিতভাবেই সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে এবং দেখতেও ভাল লাগে।