সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তি ইউরোপে এক সন্ধিক্ষণ

ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তি ইউরোপে এক সন্ধিক্ষণ

ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তি ইউরোপে এক সন্ধিক্ষণ

 “ইউরোপীয় অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য একত্রে মিলিত হওয়া, যেমনটা আজকে এখানে মিলিত হয়েছে, নিশ্চিতভাবেই এক বিরল ঘটনা।” জার্মানির যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রোমান হার্টসোক ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে এই মন্তব্যটি করেছিলেন। তিনি যখন সেই মন্তব্য করেছিলেন, তখন তার শ্রোতাদের মধ্যে ছিল চার জন রাজা, চার জন রানি, দুজন যুবরাজ, একজন সর্বপ্রধান ডিউক এবং কয়েক জন রাষ্ট্রপতি। ইউরোপীয় পরিষদ দ্বারা পোষিত সেই ঘটনা আধুনিক জার্মানি রাষ্ট্রের ৫০ বছরের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। উপলক্ষটা কী ছিল?

১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাস ছিল ওয়েস্টফেলিয়ার শান্তি চুক্তির ৩৫০তম বার্ষিকী। শান্তি চুক্তিগুলো প্রায়ই সেই গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যেখানে ইতিহাস এক সংকটময় অবস্থা পার হয়ে আসে এবং এই ক্ষেত্রে ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তি ছিল বিশেষ কিছু। ১৬৪৮ সালে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ত্রিশ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর এক মহাদেশ হিসেবে আধুনিক ইউরোপের জন্মলগ্নের জন্য লক্ষণীয়।

এক প্রাচীন ব্যবস্থা আন্দোলিত হয়

মধ্যযুগে, ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল রোমান ক্যাথলিক গির্জা এবং পবিত্র রোমীয় সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্য বিভিন্ন আয়তনের শত শত ভূসম্পত্তি নিয়ে গঠিত ছিল এবং এমন এক এলাকা জুড়ে প্রসারিত ছিল, যেখানে বর্তমানে অস্ট্রিয়া, চেক গণপ্রজাতন্ত্র, পূর্ব ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, নিম্নপ্রদেশ—নেদারল্যান্ডস, হল্যান্ড, বেলজিয়াম—এবং ইতালির কিছু অংশ রয়েছে। যেহেতু এর বেশির ভাগ অংশ জার্মান এলাকা নিয়ে গঠিত, তাই এই সাম্রাজ্য জার্মান জাতির পবিত্র রোমীয় সাম্রাজ্য নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। প্রতিটা এলাকা একজন যুবরাজের দ্বারা স্বশাসিত ছিল। সম্রাট নিজে অস্ট্রিয়ার হ্যাবস্‌বার্গ পরিবারের একজন রোমান ক্যাথলিক ছিলেন। তাই, পোপ এবং সম্রাটের শাসনে ইউরোপ দৃঢ়ভাবে রোমান ক্যাথলিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

কিন্তু, ১৬ এবং ১৭ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা আন্দোলিত হয়। পুরো ইউরোপ জুড়ে রোমান ক্যাথিলক গির্জার বাড়াবাড়িরকম আচরণের ফলে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। মার্টিন লুথার এবং জন ক্যালভিনের মতো ধর্মীয় সংস্কারকরা বাইবেলের মূল্যবোধগুলোতে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে বলেছিল। লুথার এবং ক্যালভিন ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিল এবং এই আন্দোলনের ফলে সংস্কারমূলক এবং প্রটেস্টান্ট ধর্মগুলোর সূত্রপাত হয়েছিল। এই সংস্কারসাধন পুরো সাম্রাজ্যকে তিনটে বিশ্বাসে বিভক্ত করেছিল—ক্যাথলিক, লুথারেন এবং ক্যালভিনিস্ট।

ক্যাথলিকরা প্রটেস্টান্টদের অবিশ্বাসের চোখে দেখত আর প্রটেস্টান্টরা তাদের ক্যাথলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবজ্ঞার চোখে দেখত। এই অবস্থা ১৭ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রটেস্টান্ট ইউনিয়ন এবং ক্যাথলিক লিগের গঠনের দিকে পরিচালিত করেছিল। সাম্রাজ্যের কিছু যুবরাজ ইউনিয়নে আবার অন্যেরা লিগে যোগ দিয়েছিল। ইউরোপ—এবং নির্দিষ্ট করে সেই সাম্রাজ্য—সংশয়ের এক অগ্নিগর্ভ ছিল, যাতে আগুন জ্বালানোর জন্য মাত্র একটা স্ফুলিঙ্গের দরকার ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই স্ফুলিঙ্গ যখন এসেছিল, তখন তা এক সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিল, যা পরবর্তী ৩০ বছর ধরে স্থায়ী ছিল।

এক মারাত্মক স্ফুলিঙ্গ ইউরোপকে জ্বালিয়ে দেয়

প্রটেস্টান্ট শাসকরা উপাসনার ক্ষেত্রে আরও স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য ক্যাথলিক হ্যাবস্‌বার্গ পরিবারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু, সেই অধিকারগুলো অনিচ্ছার সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল এবং ১৬১৭-১৮ সালে বহিমিয়ার (চেক প্রজাতন্ত্রের) দুটো লুথারেন গির্জা জোরপূর্বক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই বিষয়টা প্রটেস্টান্ট অভিজাত সম্প্রদায়কে অসন্তুষ্ট করেছিল, যারা প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ত্বরিত গতিতে প্রাগ রাজপ্রাসাদে গিয়েছিল এবং তিন জন ক্যাথলিক কর্মকর্তাকে আটক করে তাদেরকে ওপরের তলার জানালা দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এই কাজটাই ছিল সেই স্ফুলিঙ্গ, যা ইউরোপকে জ্বালিয়ে দেয়।

তাদের যদিও শান্তিরাজ, যিশু খ্রিস্টের অনুসারী হওয়ার কথা ছিল কিন্তু বিরোধী ধর্মের সদস্যরা তখন একে অপরের বিরুদ্ধে হিংস্র লড়াইয়ে মেতে উঠেছিল। (যিশাইয় ৯:৬) হোয়াইট মাউন্টেনের যুদ্ধে ইউনিয়নকে লিগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল, যা নানা অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। প্রটেস্টান্ট অভিজাত ব্যক্তিদের প্রাগের বাজারের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পুরো বহিমিয়ায় সেই সমস্ত প্রটেস্টান্টদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে তা ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল, যারা তাদের বিশ্বাস পরিত্যাগ করেনি। ১৬৪৮—ক্রিক উন্ত ফ্রিদেন ইন অইরোপা (১৬৪৮—ইউরোপে যুদ্ধ এবং শান্তি) (ইংরেজি) বই এই বাজেয়াপ্তকে “মধ্য ইউরোপের মালিকানায় অন্য যেকোনো সময়ের সর্ববৃহৎ পরিবর্তন” বলে বর্ণনা করেছিল।

বহিমিয়ায় যা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা ক্রমান্বয়ে এক আন্তর্জাতিক ক্ষমতার লড়াই হয়ে ওঠে। পরবর্তী ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডেনমার্ক, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং সুইডেন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্ট শাসকরা প্রায়ই লোভের দ্বারা পরিচালিত হতো এবং ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা করত, রাজনৈতিক আধিপত্য এবং বাণিজ্যিক মুনাফার জন্য কৌশলের আশ্রয় নিত। ৩০ বছরের যুদ্ধকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে, প্রত্যেকটাকে সম্রাটের প্রধান বিরোধীদের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। কয়েকটি তথ্যগ্রন্থ এইরকম চারটে পর্যায়ের কথা উল্লেখ করে: বহিমিয়া এবং প্যালেটাইন যুদ্ধ, ড্যানিশ-লোয়ার স্যাক্সনি যুদ্ধ, সুইডিশ যুদ্ধ এবং ফ্রেঞ্চ-সুইডিশ যুদ্ধ। বেশির ভাগ যুদ্ধই সম্রাটের অধিকারভুক্ত এলাকায় হয়েছে।

সেই যুগের অস্ত্রশস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল পিস্তল, মাস্কেট বন্দুক, মর্টার এবং কামান আর সুইডেন ছিল প্রধান অস্ত্রসরবরাহকারী দেশ। ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। সৈন্যরা এই বলে চিৎকার করে যুদ্ধে যেত, “স্যান্টা মারিয়া” অথবা “ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন।” জার্মান এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় সৈন্যদল লুটপাট করত এবং বিরোধী ও নাগরিকদের সঙ্গে পশুর মতো ব্যবহার করত। যুদ্ধ নিষ্ঠুর বর্বরতায় রূপ নিয়েছিল। বাইবেলের এই ভবিষ্যদ্বাণীর কত বিপরীত: “এক জাতি অন্য জাতির বিপরীতে আর খড়্গ তুলিবে না, তাহারা আর যুদ্ধ শিখিবে না”!—মীখা ৪:৩.

জার্মানের এক প্রজন্ম যুদ্ধময় এক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে উঠেছিল এবং এই পরিশ্রান্ত জনগণ শান্তির জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করত। স্পষ্টতই, শান্তি সম্ভবপর ছিল যদি শাসকরা রাজনৈতিক বিষয়গুলোর সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়ত। যুদ্ধ যতই এর ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে, ততই রাজনীতি দিন দিন আরও বেশি অগ্রভাগে চলে আসে এবং ধীরে ধীরে জাগতিক হয়ে ওঠে। আশ্চর্যের বিষয় হল, যে-ব্যক্তি এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছিলেন, তিনি হলেন ক্যাথলিক গির্জার উচপদস্থ কর্মকর্তা।

কার্ডিনাল রিশেলু রাজদণ্ড ব্যবহার করেন

আরমাঁ দু ঝাঁ প্লিসির সরকারি নাম ছিল কার্ডিনাল দি রিশেলু। এ ছাড়া, তিনি ১৬২৪ থেকে ১৬৪২ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রিশেলু ফ্রান্সকে ইউরোপের বৃহত্তর শক্তিতে পরিণত করতে মনস্থ করেছিলেন। সেইজন্য তিনি তার সহক্যাথলিক, হ্যাবস্‌বার্গদের ক্ষমতা ধ্বংস করে দিতে চেষ্টা করেছিলেন। কীভাবে তিনি তা করেছিলেন? জার্মান এলাকা, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং সুইডেনের প্রটেস্টান্ট সৈন্যদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করে, যারা সকলে হ্যাবস্‌বার্গদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল।

১৬৩৫ সালে রিশেলু প্রথমবারের মতো ফরাসি সৈন্যদের যুদ্ধে পাঠান। ভিভাত পাক্‌স—এস লেবে দার ফ্রিদি! (শান্তি দীর্ঘজীবি হোক!) (ইংরেজি) বই ব্যাখ্যা করে যে, এর চূড়ান্ত পর্যায়ে “ত্রিশ বছরের যুদ্ধ ধর্মীয় দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ বন্ধ হয়েছিল। . . . যুদ্ধ ইউরোপে রাজনৈতিক প্রাধান্যের এক লড়াই হয়ে উঠেছিল।” যা ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘর্ষ হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা প্রটেস্টান্টদের সঙ্গে ক্যাথলিকরা মিলে অন্য ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দিয়ে শেষ হয়েছিল। ১৬৩০ এর দশকে ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়া ক্যাথলিক লীগ ১৬৩৫ সালে ভেঙে গিয়েছিল।

ওয়েস্টফেলিয়ায় শান্তি সম্মেলন

ইউরোপ লুটতরাজ, হত্যা, ধর্ষণ এবং রোগব্যাধির দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছিল। ধীরে ধীরে শান্তির জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা এই সচেতনতার দ্বারা তীব্র হয়েছিল যে, এটা এমন এক যুদ্ধ যেখানে কেউই জয়ী হতে পারবে না। ভিভাত পাক্‌স—এস লেবে দার ফ্রিদি! বইটি বলে যে, “১৬৩০ এর দশকের শেষের দিকে দায়িত্বপ্রাপ্ত যুবরাজরা অবশেষে স্বীকার করেছিল যে, সামরিক শক্তি কখনোই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাদেরকে আর সাহায্য করতে পারবে না।” কিন্তু, সকলে যদি শান্তিই চায়, তা হলে তা কীভাবে পাওয়ার কথা ছিল?

পবিত্র রোমীয় সাম্রাজ্যের সম্রাট ৩য় ফারডিনান্ড, ফ্রান্সের রাজা ত্রয়োদশ লুইস এবং সুইডেনের রানি ক্রিস্টিনা একমত হয়েছিল যে, এমন একটা সম্মেলন অনুষ্ঠিত করা উচিত, যেখানে যুদ্ধের সমস্ত দল একত্রিত হবে এবং শান্তির শর্তাবলি আলোচনা করবে। কথা বলার জন্য দুটো স্থান—ওয়েস্টফেলিয়া অঞ্চলের অজনাব্রুক এবং মুনস্টারকে—বাছাই করা হয়েছিল। এই স্থানগুলোকে বাছাই করা হয়েছিল কারণ এগুলো সুইডেন এবং ফ্রান্সের রাজধানীর মাঝামাঝিতে অবস্থিত ছিল। ১৬৪৩ সাল থেকে শুরু করে প্রায় ১৫০ জনের প্রতিনিধি দল—কেউ কেউ উপদেষ্টাদের এক বিরাট দল নিয়ে—দুটো শহরে উপস্থিত হয়েছিল, ক্যাথলিক উপরাষ্ট্রদূতরা মুনস্টারে এবং প্রটেস্টান্ট প্রতিনিধিরা অজনাব্রুকে মিলিত হয়েছিল।

প্রথমত, রাষ্ট্রদূতদের উপাধি ও পদমর্যাদা, আসন বিন্যাস ও কার্যপ্রণালীর মতো বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করার জন্য আচরণবিধি স্থাপন করা হয়েছিল। এরপর মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে একজন প্রতিনিধির কাছ থেকে আরেক জন প্রতিনিধির কাছে প্রস্তাবগুলো পাঠানোর মাধ্যমে শান্তি চুক্তির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। প্রায় পাঁচ বছর পর—যে-সময়ে তখনও যুদ্ধ চলছিল—শান্তির শর্তাবলিকে মেনে নেওয়া হয়েছিল। ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তি একাধিক দলিলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্রাট ৩য় ফার্ডিনান্ড এবং সুইডেনের মধ্যে একটা চুক্তিতে স্বাক্ষর করা হয় এবং আরেকটা সম্রাট এবং ফ্রান্সের মধ্যে করা হয়।

চুক্তির খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্‌যাপনের ধূম পড়ে যায়। মারাত্মক স্ফুলিঙ্গের মতো শুরু হওয়া বিষয়টা আক্ষরিকভাবে আতশবাজি দিয়ে শেষ হয়। বিভিন্ন শহরের আকাশে সেগুলোকে জ্বলতে দেখা গিয়েছিল। গির্জার ঘন্টা বেজে ওঠে, অভিবাদনের ধ্বনিতে কামান গর্জে ওঠে এবং লোকেরা রাস্তায় রাস্তায় গান গাইতে থাকে। এখন কি ইউরোপ স্থায়ী শান্তি আশা করতে পারে?

স্থায়ী শান্তি কি সম্ভব?

ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তি সার্বভৌমত্বের নীতিকে স্বীকার করেছিল। এর অর্থ ছিল যে, চুক্তির প্রতিটা দল অন্যান্য সমস্ত দলের এলাকাভিত্তিক অধিকারকে সম্মান করতে এবং আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে একমত হয়। এভাবে সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর এক মহাদেশ হিসেবে আধুনিক ইউরোপের সূত্রপাত হয়েছিল। সেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কয়েকটা সেই চুক্তি থেকে অন্যদের চেয়ে আরও বেশি লাভবান হয়েছিল।

ফ্রান্স এক বৃহত্তর শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ড প্রত্যেকে আলাদা আলাদাভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। জার্মান এলাকাগুলো, যেগুলোর অনেক এলাকা যুদ্ধের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, সেগুলো চুক্তি থেকে কোনো সুবিধা পায়নি। জার্মানির পরিণতি এমন হয়েছিল যে তা অন্যদের দ্বারা স্থিরীকৃত হয়েছিল। দ্যা নিউ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলে: “জার্মানির যুবরাজদের লাভ এবং লোকসান ধার্য হয়েছিল সেই প্রধান প্রধান শক্তির সুবিধার দ্বারা যেমন: ফ্রান্স, সুইডেন এবং অস্ট্রিয়া।” একটা জাতি হিসেবে মিলিত এবং একতাবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে, জার্মানির এলাকাগুলো ঠিক আগের মতোই বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া, কিছু কিছু এলাকা বিদেশি শাসকদের নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তর করা হয়েছিল, যেগুলো জার্মানির প্রধান নদীগুলোর—রাইন, এলবি এবং ওডার—দ্বারা বিভক্ত করা হয়েছিল।

ক্যাথলিক, লুথারেন এবং ক্যালভিনিস্ট ধর্মকে সম স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এটা সকলকে সন্তুষ্ট করেনি। ১০ম পোপ ইনোসেন্ট সেই চুক্তির ঘোর বিরোধী ছিলেন, সেটাকে আইনত অকার্যকর ও বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও, যে-ধর্মীয় সীমাগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা পরবর্তী তিন শতাব্দী ধরে অপরিবর্তিত ছিল। যদিও প্রত্যেকের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা তখন আসেনি, তবুও তা প্রায় এক ধাপ এগিয়ে এসেছিল।

সেই চুক্তি ত্রিশ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল এবং এর মাধ্যমে বেশির ভাগ শত্রুতা শেষ হয়ে গিয়েছিল। এটা ইউরোপের সর্বশেষ বৃহত্তর ধর্মীয় যুদ্ধ ছিল। যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু সেগুলোর মূল কারণ ধর্ম থেকে রাজনীতি অথবা বাণিজ্যের দিকে স্থানান্তরিত হয়েছিল। বলাই বাহুল্য যে, ধর্ম ইউরোপীয় শত্রুদের ওপর তার সমস্ত প্রভাব হারিয়ে ফেলেছিল। ১ম এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সৈন্যরা কোমরে একটা বেল্ট পরেছিল, যেখানে এই সুপরিচিত কথাগুলো খোদাই করা ছিল, “ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন।” সেই ভয়ংকর সংঘর্ষগুলোতে ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টরা আবারও এক পক্ষ হয়ে বিরোধী দল ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।

স্পষ্টতই, ওয়েস্টফেলিয়ার চুক্তি স্থায়ী শান্তি নিয়ে আসেনি। কিন্তু, বাধ্য মানবজাতি খুব শীঘ্রই সেই শান্তি উপভোগ করবে। যিহোবা ঈশ্বর তাঁর পুত্র, যিশু খ্রিস্টের মশীহ রাজ্যের মাধ্যম মানবজাতির জন্য স্থায়ী শান্তি নিয়ে আসবেন। সেই সরকারের অধীনে একমাত্র সত্য ধর্ম একতার দিকে নিয়ে যাবে, বিভক্তের দিকে নয়। কেউই ধর্মীয় বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, যুদ্ধে যাবে না। পৃথিবীর ওপর যখন রাজ্যের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং “শান্তির সীমা থাকিবে না,” তখন তা কী এক স্বস্তিই না হবে!—যিশাইয় ৯:৬, ৭.

[২১ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

যা ক্যাথলিক এবং প্রটেস্টান্টদের মধ্যে ধর্মীয় সংঘর্ষ হিসেবে শুরু হয়েছিল, তা প্রটেস্টান্টদের সঙ্গে ক্যাথলিকরা মিলে অন্য ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দিয়ে শেষ হয়েছিল

[২২ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

সৈন্যরা এই বলে চিৎকার করে যুদ্ধে যেত, “স্যান্টা মারিয়া” অথবা “ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে আছেন”

[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]

কার্ডিনাল রিশেলু

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

ষোড়শ শতাব্দীর চিত্র লুথার, ক্যালভিন এবং পোপের মধ্যে দ্বন্দ্বকে তুলে ধরছে

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

From the book Spamers Illustrierte Weltgeschichte VI

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

ধর্মীয় নেতারা লড়াই করছে: From the book Wider die Pfaffenherrschaft; মানচিত্র: The Complete Encyclopedia of Illustration/J. G. Heck