সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

পাদরিদের কি রাজনীতি প্রচার করা উচিত?

পাদরিদের কি রাজনীতি প্রচার করা উচিত?

পাদরিদের কি রাজনীতি প্রচার করা উচিত?

 “রাজনীতি করলে গরিবদের সাহায্য করা যেতে পারে, কানাডার একজন আর্চবিশপ তীর্থযাত্রীদের বলেছিলেন . . . এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে না-ও হয়, তবুও ‘আমাদের রাজনীতিতে জড়িত হওয়া দরকার, যাতে আমরা গরিবদের জন্য ন্যায়বিচার আনতে পারি।’”—ক্যাথলিক নিউজ।

রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার পক্ষে উচ্চপদস্থ পাদরিদের মন্তব্য করা সম্বন্ধে বিভিন্ন রিপোর্ট পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়; এমনকি ধর্মীয় নেতাদের রাজনৈতিক পদ থাকাটাও এক সাধারণ ব্যাপার। তাদের কেউ কেউ রাজনীতিতে সংস্কার-সাধন করারও চেষ্টা করেছে। অন্যদের জাতিগত সমতা এবং দাসপ্রথা বিলোপ করার মতো বিষয়গুলোতে তাদের অভিযানের জন্য প্রশংসা ও স্মরণ করা হয়।

তা সত্ত্বেও, গির্জার সাধারণ সদস্যদের অনেকে অস্বস্তি বোধ করে যখন তাদের প্রচারকরা রাজনৈতিক বিষয়গুলোর পক্ষ নেয়। “প্রটেস্টান্ট গির্জার সদস্যরাই তাদের পাদরিদের সরকারি বিষয়গুলোতে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে মাঝেমধ্যে প্রশ্ন তুলেছিল,” রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের ওপর এক প্রবন্ধ খ্রিস্টীয় শতাব্দী (ইংরেজি) বলেছিল। অনেক ধর্মপ্রাণ লোক মনে করে যে, গির্জা হল অতি পবিত্র এক স্থান, যেখানে রাজনীতির কোনো স্থান নেই।

এই বিষয়টা কিছু আগ্রহজনক প্রশ্ন উত্থাপন করে, যেগুলো সেই সমস্ত লোকের এক চিন্তার বিষয় যারা এক উত্তম জগৎ দেখার ইচ্ছা পোষণ করে। খ্রিস্টধর্মের প্রচারকরা কি রাজনীতিতে সংস্কার-সাধন করতে পারে? * রাজনীতি প্রচার করা কি আরও উত্তম সরকার ও আরও উত্তম এক জগৎ আনার জন্য ঈশ্বরের পথ? খ্রিস্টধর্ম কি রাজনীতি করার এক নতুন উপায় হিসেবে শুরু হয়েছিল?

খ্রিস্টের নামে রাজনীতি যেভাবে শুরু হয়েছিল

ইতিহাসবেত্তা হেনরি চ্যাডউইক প্রাথমিক গির্জা (ইংরেজি) নামের বইয়ে বলেন যে, প্রাথমিক খ্রিস্টীয় মণ্ডলী “এই জগতে ক্ষমতা অধিকারের প্রতি নিরপেক্ষ থাকার” জন্য সুপরিচিত ছিল। এটা ছিল এক “নির্দলীয়, অহিংসাবাদী ও শান্তিপ্রিয় সম্প্রদায়।” খ্রিস্টধর্মের ইতিহাস (ইংরেজি) বলে: “খ্রিস্টানদের মধ্যে এক দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তাদের মধ্যে কারোরই সরকারি কোনো পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকা উচিত নয় . . . তৃতীয় শতাব্দীর শুরুর দিকে হিপ্পোলাইটাস বলেছিলেন যে, ঐতিহাসিক খ্রিস্টীয় প্রথা অনুযায়ী, রাষ্ট্রের একজন বিচারককে গির্জার যাজকীয় সম্প্রদায়ে যোগ দিতে হলে পদত্যাগ করার প্রয়োজন ছিল।” কিন্তু, ধীরে ধীরে ক্ষমতালোভী পুরুষরা অনেক মণ্ডলীতে নেতৃত্ব নিতে শুরু করেছিল ও নিজেদের বড় বড় উপাধি দিয়েছিল। (প্রেরিত ২০:২৯, ৩০) কেউ কেউ ধর্মীয় নেতা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিবিদও হতে চেয়েছিল। রোমীয় সরকারে হঠাৎ এক পরিবর্তন ঘটায় এই পাদরিরা তাদের খুশি মতো কাজ করার সুযোগ পেয়েছিল।

সাধারণ কাল ৩১২ সালে পৌত্তলিক রোমীয় সম্রাট কনস্ট্যানটিন নামধারী খ্রিস্টধর্মের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ দৃষ্টি দিয়েছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, পৌত্তলিক সম্রাট গির্জার বিশপদের যে-সুযোগগুলো প্রদান করেছিলেন, সেগুলোর বিনিময়ে তারা তার সঙ্গে আপোশ করে সন্তুষ্ট ছিল। “গির্জা উচ্চ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার ব্যাপারে দিন দিন আরও বেশি জড়িয়ে পড়েছিল,” হেনরি চ্যাডউইক লিখেছিলেন। পাদরিদের রাজনীতিতে জড়িত হওয়া কীভাবে তাদের প্রভাবিত করেছিল?

রাজনীতি যেভাবে প্রচারকদের প্রভাবিত করেছিল

ঈশ্বর পাদরিদেরকে রাজনীতিবিদ হিসেবে ব্যবহার করবেন, এই ধারণাটা বিশেষ করে অগাস্টিন প্রবর্তন করেছিলেন, যিনি পঞ্চম শতাব্দীর একজন প্রভাবশালী ক্যাথলিক ধর্মতত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি জাতিগুলোর ওপর গির্জার শাসন করার ও মানবজাতির জন্য শান্তি নিয়ে আসার বিষয়টা মনশ্চক্ষে দেখেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসবেত্তা এইচ. জি. ওয়েলস লিখেছিলেন: “পঞ্চম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের ইতিহাসের বেশির ভাগ অংশ জুড়েই, এক ঐশিক বিশ্ব সরকার আনার ব্যাপারে সেই মহৎ ধারণার ব্যর্থতার বিবরণ পাওয়া যায়।” খ্রিস্টীয়জগৎ এমনকি ইউরোপের জন্যই শান্তি আনতে পারেনি আর বিশ্বের জন্য তো নয়ই। খ্রিস্টধর্ম বলতে যেটাকে মনে করা হয়েছিল সেটা অনেকের দৃষ্টিতে এর সুনাম হারিয়েছিল। কোথায় ভুলটা হয়েছিল?

অনেকে যারা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে বলে দাবি করেছিল, তারা ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল কিন্তু পরে তারা মন্দ কাজগুলোতে জড়িয়ে পড়েছিল। একজন প্রচারক ও বাইবেল অনুবাদক, মার্টিন লুথার ক্যাথলিক গির্জায় সংস্কার-সাধন করার বিভিন্ন প্রচেষ্টার জন্য বিখ্যাত। কিন্তু, গির্জার মতবাদগুলোর বিরুদ্ধে তার সাহসী পদক্ষেপ তাকে সেই সমস্ত লোকের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল, যাদের বিদ্রোহ করার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। লুথার অনেকের কাছ থেকে সম্মান হারিয়েছিলেন যখন তিনিও রাজনৈতিক বিতর্কিত বিষয়গুলোতে তার মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। শুরুর দিকে তিনি সেই কৃষকদের পক্ষ নিয়েছিলেন, যারা অত্যাচারী সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছিল। এরপর বিদ্রোহ যখন হিংস্রতার দিকে মোড় নিয়েছিল, তখন তিনি বিদ্রোহ দমন করার জন্য সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করেছিলেন আর এই সম্প্রদায় হাজার হাজার লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করে তা করেছিল। তাই কোনো সন্দেহ নেই যে, কৃষকরা তাকে একজন বিশ্বাসঘাতক বলে মনে করেছিল। এ ছাড়া, লুথার সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়কে ক্যাথলিক সম্রাটের বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব বিদ্রোহ চালিয়ে যাওয়ার জন্যও উৎসাহিত করেছিলেন। বস্তুতপক্ষে, প্রটেস্টান্ট বলে পরিচিত লুথারের অনুসারীরা শুরু থেকেই এক রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ক্ষমতা লুথারকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল? সেটা তাকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, যদিও তিনি ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তিদের ওপর বল খাটিয়ে তাদের প্রত্যয়ী করার বিষয়টাকে প্রথম প্রথম বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু পরে তিনি তার রাজনৈতিক বন্ধুবান্ধবদের সেই ব্যক্তিদের পুড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন, যারা শিশু বাপ্তিস্মের বিরোধিতা করেছিল।

জন ক্যালভিন ছিলেন জেনেভার একজন বিখ্যাত পাদরি কিন্তু একসময় তিনি রাজনৈতিক দিক দিয়েও খুব প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। মাইকেল সারভিটাস যখন ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, ত্রিত্বের কোনো শাস্ত্রীয় ভিত্তি নেই, তখন ক্যালভিন সারভিটাসের হত্যায় সমর্থন করতে তার রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন, যাকে কাষ্ঠদণ্ডে ঝুলিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। যিশুর শিক্ষাগুলো থেকে কী এক ভয়ংকর বিচ্যুতি!

সম্ভবত এই ব্যক্তিরা বাইবেলে ১ যোহন ৫:১৯ পদে বলা কথাগুলো ভুলে গিয়েছিল: “সমস্ত জগৎ সেই পাপাত্মার মধ্যে শুইয়া রহিয়াছে।” তাদের কি আসলে সেই সময়কার রাজনীতিতে সংস্কার-সাধন করার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, নাকি ক্ষমতা ও উচ্চপদস্থ বন্ধুবান্ধব পাওয়ার প্রত্যাশাই তাদের আকৃষ্ট করেছিল? যাই হোক না কেন, তাদের যিশুর শিষ্য যাকোবের এই অনুপ্রাণিত বাক্যগুলো স্মরণে রাখা উচিত ছিল: “তোমরা কি জান না যে, জগতের মিত্রতা ঈশ্বরের সহিত শত্রুতা? সুতরাং যে কেহ জগতের মিত্র হইতে বাসনা করে, সে আপনাকে ঈশ্বরের শত্রু করিয়া তুলে।” (যাকোব ৪:৪) যাকোব জানতেন যে, যিশু তাঁর শিষ্যদের সম্বন্ধে এই কথাগুলো বলেছিলেন: “তাহারা জগতের নয় যেমন আমিও জগতের নই।”—যোহন ১৭:১৪.

খ্রিস্টানদের জগতের মন্দতার কোনো অংশ হওয়া উচিত নয়, এই বিষয়টা এমনকি উপলব্ধি করা সত্ত্বেও অনেকে রাজনৈতিক দিক দিয়ে নিরপেক্ষ থাকার, সত্যি করে বলতে গেলে ‘জগতের না হইবার’ বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়। তারা দাবি করে যে, এই ধরনের নিরপেক্ষতা অন্যদের প্রতি সক্রিয়ভাবে ভালবাসা দেখানোর ক্ষেত্রে খ্রিস্টানদের বাধা দেয়। তারা মনে করে যে, গির্জার নেতাদের নির্দ্বিধায় নিজের মতামত প্রকাশ করা এবং দুর্নীতি ও অন্যায়ের সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নেওয়া উচিত। কিন্তু যিশু যেধরনের নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা কি সত্যিই অন্যদের প্রতি সক্রিয়ভাবে চিন্তা দেখানোর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ? একজন খ্রিস্টান কি বিভক্ত রাজনৈতিক বিতর্কিত বিষয়গুলো থেকে পৃথক থাকতে পারে ও একই সময়ে ব্যবহারিকভাবে অন্যদের সাহায্যও করতে পারে? পরের প্রবন্ধটি এই প্রশ্নগুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে।

[পাদটীকা]

^ রাজনীতিকে কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, অধিকার সংক্রান্ত যেকোনো সাংগঠনিক প্রক্রিয়া বা নীতি বা বিচার-বিবেচনা ও বিশেষ করে কোনো গোষ্ঠী বা সংগঠনের মধ্যে ক্ষমতালাভ বা সুবিধা আদায়ের জন্য কুচক্র, দলবাজি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

[৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার জন্য গির্জার নেতারা সম্রাট কনস্ট্যানটিনের মতো শাসকদের সঙ্গে আপোশ করেছিল

[সৌজন্যে]

Musée du Louvre, Paris

[৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

কেন বিখ্যাত ধর্মীয় নেতারা রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল?

অগাস্টিন

লুথার

ক্যালভিন

[সৌজন্যে]

অগাস্টিন: ICCD Photo; ক্যালভিন: Portrait by Holbein, from the book The History of Protestantism (Vol. II)