সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমরা যিহোবার শক্তিতে বেঁচে ছিলাম

আমরা যিহোবার শক্তিতে বেঁচে ছিলাম

জীবন কাহিনী

আমরা যিহোবার শক্তিতে বেঁচে ছিলাম

বলেছেন এরজেবেট হফনার

“তোমাকে বিতাড়িত করার সুযোগ আমি তাদেরকে দেব না,” টিবর হফনার বলেছিল যখন সে জানতে পারে যে, আমাকে চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে যেতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। এরপর সে আরও বলেছিল: “তুমি যদি রাজি থাকো, তা হলে আমি তোমাকে বিয়ে করব আর চিরকাল তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।”

 এই অপ্রত্যাশিত বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার মাত্র অল্প কয়েক সপ্তাহ পরে, ১৯৩৮ সালের ২৯শে জানুয়ারি আমি খ্রিস্টান ভাই টিবরকে বিয়ে করেছিলাম, যে আমার পরিবারের কাছে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ ছিল না। আমি সবেমাত্র ১৮-তে পা দিয়েছিলাম এবং যিহোবার সাক্ষিদের একজন পূর্ণসময়ের পরিচারক হিসেবে আমি পুরোপুরিভাবে ঈশ্বরের সেবায় নিজের যৌবনকালকে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলাম। আমি কেঁদেছিলাম ও প্রার্থনা করেছিলাম। শান্ত হওয়ার পরই আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, টিবর যে-প্রস্তাব আমাকে দিয়েছিল তা এক দয়ার প্রকাশ ছাড়াও বেশি কিছু ছিল আর আমি অনুভব করেছিলাম যে, এই ব্যক্তির সঙ্গে আমি থাকতে চাই, যে কিনা সত্যিই আমাকে ভালবাসে।

কিন্তু কীসের জন্য আমি বিতাড়িত হওয়ার বিপদের মধ্যে ছিলাম? সব কথা বিবেচনা করলে, আমি এমন এক দেশে বাস করছিলাম যে-দেশ এর গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য গর্ব করত। তবে, মনে হয় এই সময়ে আমার পটভূমি সম্বন্ধে আপনাদেরকে আরও বেশি কিছু বলা দরকার।

আমি ১৯১৯ সালের ২৬শে ডিসেম্বর হাঙ্গারির শাইয়সেন্টপেটের গ্রামে জন্মগ্রহণ করি, যা বুডাপেস্ট থেকে ১৬০ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত ছিল। আমার বাবামা গ্রিক-ক্যাথলিক গির্জার সদস্য ছিল। দুঃখের বিষয় যে, আমার জন্মের আগেই বাবা মারা যান। শীঘ্রই আমার মা একজন বিপত্নীককে বিয়ে করেছিলেন, যার চার জন ছেলেমেয়ে ছিল আর আমরা লুচেনয়েটজ্‌ নামে এক অপূর্ব শহরে চলে গিয়েছিলাম, যা সেই সময়ে যেটা চেকোস্লোভাকিয়া ছিল, সেখানে অবস্থিত ছিল। সেই সময়ে এক সৎপরিবারে বাস করা অতটা সহজ ছিল না। পাঁচ জন ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় আমার মনে হতো যেন আমি পরিবারের অংশ নই। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল এবং আমি শুধুমাত্র বস্তুগত জিনিস থেকেই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে বাবামার স্বাভাবিক যত্ন ও ভালবাসা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলাম।

কেউ কি উত্তরটা জানে?

আমার বয়স যখন ১৬ বছর, কয়েকটা গুরুগম্ভীর প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। আমি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস গভীর আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম এবং খ্রিস্টান বলে দাবি করে এমন সভ্য দেশগুলোর মধ্যে হওয়া হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে পড়ে হতভম্ব হয়েছিলাম। এ ছাড়া আমি দেখতে পেয়েছিলাম যে, চারিদিকে সামরিকশক্তির ওপর নির্ভরশীলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। প্রতিবেশীর প্রতি ভালবাসা সম্বন্ধে আমি গির্জায় যা শিখেছিলাম, সেটার সঙ্গে কোনো মিলই দেখতে পাইনি।

তাই, আমি একজন রোমান ক্যাথলিক পাদরির কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: “খ্রিস্টান হিসেবে আমাদের কোন আদেশের বাধ্য হওয়া উচিত—যুদ্ধে যাওয়া ও প্রতিবেশীদের হত্যা করা, নাকি তাদের প্রতি ভালবাসা দেখানো?” আমার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, উচ্চতর কর্তৃপক্ষদের কাছ থেকে তিনি যা জেনেছেন তা-ই তিনি শেখান। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল, যখন আমি একজন ক্যালভিনিস্ট পরিচারক এবং পরে একজন যিহুদি রব্বির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। আমি কোনো উত্তরই পাইনি, তারা কেবলমাত্র আমার অদ্ভূত প্রশ্ন শুনে হতবাকই হয়েছিল। শেষে, আমি একজন লুথারন পরিচারকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি বিরক্ত হয়েছিলেন কিন্তু সেখান থেকে আমার চলে আসার আগে তিনি বলেছিলেন: “তুমি যদি এই সম্বন্ধে সত্যিই জানতে চাও, তা হলে যিহোবার সাক্ষিদের জিজ্ঞেস করো।”

আমি সাক্ষিদের খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সফল হইনি। অল্প কিছু দিন পর, আমি কাজ থেকে ঘরে ফিরে আসার সময় দেখেছিলাম যে, ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা রয়েছে। একজন সুদর্শন যুবক আমার মাকে বাইবেলে থেকে পড়ে শোনাচ্ছে। হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা চিন্তা আসে, ‘নিশ্চয়ই, ইনি যিহোবার একজন সাক্ষি!’ আমরা টিবর হফনার নামের এই ব্যক্তিকে বাড়িতে আসতে বলেছিলাম আর আমি আবার আমার প্রশ্নগুলো করেছিলাম। তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উত্তর না দিয়ে, তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন যে, সত্য খ্রিস্টানদের শনাক্তিকরণ চিহ্ন ও সেইসঙ্গে আমরা যে-সময়ে বাস করছি সেই সম্বন্ধে বাইবেল কী বলে।—যোহন ১৩:৩৪, ৩৫; ২ তীমথিয় ৩:১-৫.

কয়েক মাসের মধ্যে, ১৭ বছর হওয়ার আগেই, আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। আমি অনুভব করেছিলাম যে, এই মূল্যবান সত্যগুলো প্রত্যেকের শোনা দরকার, যেগুলো আমি এত কষ্ট করে পেয়েছিলাম। আমি পূর্ণসময় ধরে প্রচার কাজ শুরু করেছিলাম, যেটা ১৯৩০ এর দশকের শেষ দিকে চেকোস্লোভাকিয়াতে করা খুব কঠিন ছিল। যদিও আমাদের কাজ সরকারিভাবে নিবন্ধভুক্ত ছিল, তবুও আমরা পাদরিদের দ্বারা উসকে দেওয়া প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলাম।

তাড়নার প্রথম অভিজ্ঞতা

১৯৩৭ সালের শেষ দিকে একদিন, আমি আরেকজন খ্রিস্টান বোনের সঙ্গে লুচেনয়েটজের কাছে একটা গ্রামে প্রচার করছিলাম। হঠাৎ, আমাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাদের মুখের ওপর সজোরে কারাকক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কারারক্ষক বলেছিলেন, “তোমরা এখানেই মরবে।”

সন্ধ্যে নাগাদ আমাদের কারাকক্ষে আরও চার জনকে বন্দি করা হয়েছিল। আমরা তাদের সান্ত্বনা ও সাক্ষ্য দিতে শুরু করেছিলাম। তারা শান্ত হয়েছিল এবং সারারাত ধরে আমরা তাদের বাইবেলের সত্য জানাতে ব্যস্ত ছিলাম।

সকাল ছটায় কারারক্ষক আমাকে কারাকক্ষ থেকে বের হয়ে আসতে বলেছিলেন। আমি আমার সঙ্গীকে বলেছিলাম: “ঈশ্বরের রাজ্যে আবার আমাদের দেখা হবে।” আমি তাকে বলেছিলাম যে, সে যদি বেঁচে থাকে, তা হলে যা ঘটেছে সেই বিষয়ে আমার পরিবারকে যেন জানায়। আমি মনে মনে প্রার্থনা করে, কারারক্ষকের সঙ্গে গিয়েছিলাম। তিনি কারাগারের এলাকায় অবস্থিত তার আ্যপার্টমেন্টে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। “এই মেয়ে, আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই,” তিনি বলেছিলেন। “গতকাল রাতে তুমি বলেছিলে যে, ঈশ্বরের নাম হল যিহোবা। বাইবেল থেকে কি তুমি আমাকে তা দেখাতে পার?” কত আশ্চর্যই না আমি হয়েছিলাম ও কত স্বস্তিই না পেয়েছিল! তিনি তার বাইবেলটা নিয়ে এসেছিলেন আর আমি তাকে ও তার স্ত্রীকে যিহোবা নামটা দেখিয়েছিলাম। এই বিষয়বস্তুর ওপর তার আরও অনেক প্রশ্ন ছিল, যেগুলো আমরা রাতভর সেই চার জন মহিলার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। উত্তরগুলোর দ্বারা সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তার স্ত্রীকে আমার ও আমার সঙ্গীর জন্য সকালের জলখাবার বানাতে বলেছিলেন।

কয়েকদিন পর, আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু একজন বিচারক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, যেহেতু আমি হাঙ্গারির একজন নাগরিক ছিলাম, তাই আমাকে চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই ঘটনার পরই টিবর হফনার আমাকে তার স্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা বিয়ে করেছিলাম আর তার বাবামার বাড়িতে আমরা চলে গিয়েছিলাম।

তাড়না তীব্রতর হয়

আমরা এক দম্পতি হিসেবে প্রচার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম, যদিও টিবরকে সংগঠনের কাজও করতে হয়েছিল। ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে হাঙ্গারির সৈনিকরা আমাদের শহরে দল বেঁধে ঢোকার কিছু দিন আগে, আমার ছেলে, টিবর জুনিয়রের জন্ম হয়েছিল। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দোরগোড়ায় ছিল। হাঙ্গারি চেকোস্লোভাকিয়ার এক বিরাট অংশ দখল করে ফেলেছিল, ফলে সেই দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী যিহোবার সাক্ষিদের ওপর প্রচণ্ড তাড়না এসেছিল।

১৯৪২ সালের ১০ই অক্টোবর টিবর কিছু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে ডেবরেটসেনে চলে গিয়েছিল। কিন্তু, এবার সে ফিরে আসেনি। পরবর্তী সময়ে সে আমাকে জানিয়েছিল যে, কী ঘটেছিল। ব্রিজের ওপরে যেখানে মিলিত হওয়ার কথা ছিল সেখানে ভাইদের পরিবর্তে, শ্রমিকদের পোশাক পরা কিছু পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা আমার স্বামী ও পল নাজপলের জন্য অপেক্ষা করছিল, যাদের সবচেয়ে শেষে আসার কথা ছিল। পুলিশ তাদেরকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল এবং লাঠি দিয়ে তাদের নগ্ন পায়ে ততক্ষণ পর্যন্ত মেরেছিল, যতক্ষণ না তারা ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।

এরপর তাদের বুট পরে দাঁড়াতে আদেশ করা হয়েছিল। ব্যথা সত্ত্বেও, তাদের রেলওয়ে স্টেশনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। পুলিশ এমন আরেকজন ব্যক্তিকে নিয়ে এসেছিল, যার মাথায় এমনভাবে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল যে, তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না বলেই চলে। সেই ব্যক্তিটি ছিলেন ভাই অন্ড্রশ পিলিঙ্ক, তিনিও ভাইদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আমার স্বামীকে ট্রেনে করে বুডাপেস্টের কাছে আলাগে বন্দি শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কারারক্ষকদের একজন যিনি টিবরের আহত পাটা দেখেছিলেন, তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন: “কিছু কিছু লোক কত নিষ্ঠুরই না হয়! ভয় পেয়ো না, আমরা তোমাকে সুস্থ করে তুলব।” অন্য দুজন কারারক্ষক টিবরের পায়ে মারতে শুরু করেছিল, সর্বত্র রক্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। কয়েক মিনিট পর, সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল।

পরের মাসে, টিবর এবং ৬০ জনেরও বেশি ভাই ও বোনের বিচার হয়েছিল। ভাই অন্ড্রশ বার্টা, ডেনেশ ফালুভেগি ও ইয়নশ কনরাডকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মারার দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। ভাই অন্ড্রশ পিলিঙ্ক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছিলেন এবং আমার স্বামীকে ১২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তাদের অপরাধ কী ছিল? সরকারি পক্ষের উকিল রাষ্ট্রদ্রোহের, সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতে অস্বীকার করার, গুপ্তচর হওয়ার এবং অতি পবিত্র গির্জাকে অপবাদ দেওয়ার অভিযোগে তাদের অভিযুক্ত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মৃত্যুদণ্ডগুলোর পরিবর্তে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

আমার স্বামীকে অনুসরণ করা

টিবর ডেবরেটসেনে মিলিত হওয়ার জন্য চলে যাওয়ার দুই দিন পর, আমি সকাল ছটার আগে উঠে আমাদের জামাকাপড় ইস্ত্রি করছিলাম। হঠাৎ দরজায় কেউ জোরে জোরে কড়া নেড়েছিল। আমি ভেবেছিলাম ‘তারা চলে এসেছে।’ ছয় জন পুলিশ ভিতরে ঢুকে পড়ে আর আমাকে জানায় যে, তাদের কাছে বাড়ির তল্লাশি করার অনুমতি রয়েছে। আমাদের তিন বছরের ছেলেসহ বাড়ির সবাইকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেদিনই আমাদের হাঙ্গারির পেটেরভশরার এক কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

সেখানে পৌঁছানোর পর আমার জ্বর এসেছিল আর আমাকে অন্যান্য বন্দিদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। আমি যখন সুস্থ হয়েছিলাম, দুজন সৈনিক আমার কারাকক্ষে ছিল, তারা আমাকে নিয়ে ঝগড়া করছিল। “তাকে আমাদের অবশ্যই গুলি করে মেরে ফেলা উচিত! আমি তাকে গুলি করব!” একজন বলেছিলেন। কিন্তু অন্য জন এটা করার আগে আমার শরীরের অবস্থা কী, তা দেখে নিতে চেয়েছিলেন। আমাকে মেরে না ফেলার জন্য আমি তাদের কাছে কাকুতিমিনতি করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত, তারা আমার কারাকক্ষ থেকে চলে গিয়েছিল আর আমাকে সাহায্য করার জন্য আমি যিহোবাক ধন্যবাদ দিয়েছিলাম।

জেরা করার জন্য কারারক্ষকদের এক বিশেষ পদ্ধতি ছিল। তারা আমাকে মেঝেতে মুখ উবুড় করে শোয়ার আদেশ দিয়েছিল, আমার মুখের ভিতরে মোজা চেপে দিয়েছিল, আমার হাত ও পা বেঁধে দিয়েছিল এবং চাবুক দিয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত মেরেছিল, যতক্ষণ না আমি রক্তে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। তারা একমাত্র তখনই থেমেছিল, যখন সৈনিকদের মধ্যে একজন বলেছিলেন যে, তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, আমার স্বামী যেদিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেদিন তার কার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। আমি তাদের তা বলিনি আর তাই তিন দিন ধরে আমার ওপর চাবুক মারা চলেছিল। চতুর্থ দিনে, আমার ছেলেকে আমার মার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কনকনে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায়, আমি আমার ক্ষতবিক্ষত পিঠে করে আমার ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে, রেলওয়ে স্টেশনে যেতে কমপক্ষে ১৩ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলাম। সেখান থেকে ট্রেনে করে আমি ঘরে গিয়েছিলাম কিন্তু সেদিনই আমাকে আবার শিবিরে ফিরে আসতে হয়েছিল।

বুডাপেস্টে একটা কারাগারে আমাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পৌঁছানোর পর আমি জানতে পেরেছিলাম যে, টিবরও সেখানে রয়েছে। একে অপরের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি পাওয়ায় আমরা কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম, যদিও এক লোহার বেড়ার মধ্যে দিয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য তা করতে দেওয়া হয়েছিল! আমরা উভয়ই যিহোবার ভালবাসা অনুভব করেছিলাম আর এই মূল্যবান মুহূর্তগুলোর দ্বারা শক্তি লাভ করেছিলাম। আমাদের আবারও দেখা হওয়ার আগে, উভয়কেই ভয়ংকর পরীক্ষাগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল, বার বার মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েও বেঁচে গিয়েছিলাম।

এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে

আমরা প্রায় ৮০ জন বোন একটা কারাকক্ষে গাদাগাদি করে ছিলাম। কিছু আধ্যাত্মিক খাদ্য পাওয়ার লালসায় আমরা ছিলাম কিন্তু কারাগারে কিছু নিয়ে আসা একেবারেই অসম্ভব ছিল। কারাগারের ভিতর থেকেই কি আমরা কিছু জোগাড় করতে পারি? আসুন, আপনাদের বলি, আমরা কী করেছিলাম। আমি কারাগারের ক্লার্কদের মোজা সেলাই করে দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে গিয়েছিলাম। মোজাগুলোর একটাতে, আমি কাগজের একটা চিরকুট ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম, যেটাতে কারাগারের লাইব্রেরি থেকে বাইবেলের ক্যাটালগ নম্বরটি জানার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। যেকোনো সন্দেহ এড়ানোর জন্য আমি আরও দুটো বইয়ের নাম যোগ করে দিয়েছিলাম।

পরের দিন, আমি ক্লার্কদের কাছ থেকে একগাদা মোজা পেয়েছিলাম। সেগুলোর একটাতে উত্তরটা ছিল। এরপর আমি একজন কারারক্ষককে সেই নম্বরগুলো দিয়েছিলাম ও বইগুলো পাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। বাইবেলসহ অন্য বইগুলো পেয়ে আমরা কতই না খুশি হয়েছিলাম! অন্য বইগুলো আমরা প্রতি সপ্তাহে পালটাতাম কিন্তু বাইবেলটি সঙ্গেই রেখেছিলাম। কারারক্ষক যখন বাইবেল সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতেন, তখন সবসময় আমরা এই উত্তর দিতাম: “এটি খুব বড় বই ও প্রত্যেকেই পড়তে চায়।” এভাবে আমরা বাইবেল পড়তে পেরেছিলাম।

একদিন, একজন অফিসার তার অফিসে আমাকে ডেকেছিলেন। তাকে অস্বাভাবিক রকমে ভদ্র মনে হচ্ছিল।

“মিসেস হফনার, আপনার জন্য একটা সুখবর রয়েছে,” তিনি বলেছিলেন। “আপনি বাড়ি যেতে পারেন। হয়তো আগামী কালই। যদি কোনো ট্রেন থাকে, তা হলে এমনকি আজকেই।”

“তা হলে তো খুব ভালই হয়,” আমি উত্তর দিয়েছিলাম।

“অবশ্যই,” তিনি বলেছিলেন। “আপনার একটা বাচ্চা রয়েছে আর আমি জানি যে, আপনি তাকে লালনপালন করতে চান।” এরপর তিনি আরও বলেছিলেন, “শুধু এই চিঠিতে সই করে দিন।”

“এটাতে কী লেখা আছে?” আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।

“কী লেখা আছে, সেই বিষয়ে ভাববার দরকার নেই,” তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। “শুধু সই করুন আর আপনি যেতে পারেন।” এরপর তিনি আমাকে বলেছিলেন: “বাড়ি ফিরে, আপনি যা খুশি তা-ই করতে পারেন। কিন্তু, এখন আপনাকে অবশ্যই সই করতে হবে যে, আপনি যিহোবার সাক্ষিদের একজন সদস্য নন।”

আমি পিছিয়ে গিয়ে, দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।

“তা হলে, তুই এখানেই মরবি!” তিনি রেগে চিৎকার করে, আমাকে যেতে বলেছিলেন।

১৯৪৩ সালের মে মাসে, আমাকে বুডাপেস্টের অন্য আরেকটা কারাগারে এবং পরে মরিয়ানস্ট্রা গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল যেখানে আমরা প্রায় ৭০ জন নানের সঙ্গে একটা মঠে ছিলাম। ক্ষুধা ও নানা ধরনের কষ্ট সত্ত্বেও, আমরা তাদের কাছে আমাদের আশা সম্বন্ধে জানাতে আকুল আকাঙ্ক্ষী ছিলাম। নানদের মধ্যে একজন আমাদের বার্তার প্রতি প্রকৃত আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ও বলেছিলেন: “এই শিক্ষাগুলো অপূর্ব। আমি কখনও এই ধরনের কথা শুনিনি। দয়া করে, আমাকে আরও কিছু বলুন।” আমরা তাকে নতুন জগৎ ও সেখানে পাওয়া এক চমৎকার জীবন সম্বন্ধে বলেছিলাম। যখন আমরা এই বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম, সেই মুহূর্তে মহিলা মঠাধ্যক্ষা সেখানে এসেছিলেন। আগ্রহী নানকে সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার জামাকাপড় খুলে ফেলা হয়েছিল এবং এক চাবুক দিয়ে নিদারূণভাবে মারা হয়েছিল। তার সঙ্গে যখন আমাদের আবার দেখা হয়েছিল, তখন তিনি কাকুতিমিনতি করে বলেছিলেন: “দয়া করে, যিহোবার কাছে প্রার্থনা করুন, যেন তিনি আমাকে বাঁচান ও এখান থেকে আমাকে বের করে নিয়ে যান। আমি আপনাদের একজন হতে চাই।”

আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল ছিল কোমারোমে এক পুরনো কারাগার, যে-শহরটি দানিয়ূব নদীর ধারে ছিল এবং বুডাপেস্ট থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে ছিল। সেখানকার জীবনধারণ ছিল শোচনীয়। অন্যান্য বোনদের মতো, আমি টাইফাস রোগে আক্রান্ত হয়ে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, রক্ত বমি করছিলাম ও ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কাছে কোনো ওষুধও ছিল না আর তাই ভেবেছিলাম যে, আমি মারা যাব। কিন্তু সেই সময়ে অফিসাররা এমন কাউকে খুঁজছিলেন যিনি অফিসের কাজ করতে পারবেন। বোনেরা আমার নাম সুপারিশ করেছিল। তাই, আমাকে কিছু ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল ও আমি সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম।

আমার পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলন

সোভিয়েত সৈন্যদল যখন পূর্বদিক থেকে আক্রমণ করেছিল, তখন আমাদের পশ্চিমে চলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল। যে-আতঙ্কজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল সেগুলোর সমস্ত বর্ণনা করতে অনেক সময়ের দরকার। আমি বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম কিন্তু যিহোবার সুরক্ষা ছিল বলে আমি বেঁচে গিয়েছি। যুদ্ধ যখন শেষ হয়েছিল, তখন আমরা চেকোস্লোভাকিয়ার টাবর শহরে ছিলাম, যেটা প্রাগ থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯৪৫ সালের ৩০শে মে, আমাদের বাড়ি লুচেনয়েটজে পৌঁছাতে আমার ননদ ম্যাগডলেনা ও আমার আরও তিন সপ্তাহ লেগেছিল।

দূর থেকে আমি আমার শাশুড়ি ও আমার আদরের ছেলে টিবরকে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে আমি ডেকেছিলাম, “টিবিকি!” সে দৌঁড়ে আমার কোলে ঝাঁপ দিয়ে বসেছিল। “মা, তুমি আবার চলে যাবে না তো, যেও না মা?” আমার জন্য এগুলো ছিল তার প্রথম কথা আর আমি কখনও তা ভুলব না।

এ ছাড়া, যিহোবা আমার স্বামী টিবরের প্রতিও করুণা দেখিয়েছিলেন। বুডাপেস্টের কারাগার থেকে তাকে প্রায় আরও ১৬০ জন ভাইয়ের সঙ্গে বর্‌ শহরে শ্রমিক শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেকবার তারা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল কিন্তু একটা দল হিসেবে তারা বেঁচে গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালের ৮ই মে, আমার চেয়ে প্রায় এক মাসে আগে টিবর বাড়ি ফিরেছিল।

যুদ্ধের পর, তখনও আমাদের যিহোবার শক্তির প্রয়োজন ছিল, যাতে পরবর্তী ৪০ বছর চেকোস্লোভাকিয়ায় সাম্যবাদী শাসনাধীনে আসা সমস্ত পরীক্ষার মধ্যে টিকে থাকতে পারি। টিবরকে আবারও দীর্ঘ সময়ের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল আর তাকে ছাড়াই আমাকে আমাদের ছেলের যত্ন নিতে হয়েছিল। টিবর ছাড়া পাওয়ার পর, একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছিল। ৪০ বছরের সাম্যবাদী শাসনের সময়, আমরা আমাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে জানাতে প্রত্যেকটা সুযোগের সদ্‌ব্যবহার করেছিলাম। আমরা অনেককে সত্য শেখার জন্য সাহায্য করতে পেরেছিলাম। এভাবে, তারা আমাদের আধ্যাত্মিক ছেলেমেয়ে হয়ে উঠেছিল।

১৯৮৯ সালে ধর্মীয় স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমরা কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম! পরের বছর আমরা নিজের দেশে প্রথম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম, যেটা বহু বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা যখন হাজার হাজার ভাইবোনকে দেখেছিলাম যারা বহু দশক ধরে তাদের নীতিনিষ্ঠাকে বজায় রেখেছে, তখন আমরা জেনেছিলাম যে, এই সমস্ত ভাইবোনের জন্য যিহোবা ছিলেন শক্তির এক মহান উৎস।

আমার স্বামী টিবর ১৯৯৩ সালের ১৪ই অক্টোবর ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে মারা গিয়েছে এবং আমি এখন স্লোভাকিয়ার জিলিনা শহরে আমার ছেলের সঙ্গে বাস করছি। শারীরিকভাবে আমি আর ততটা সবল নই কিন্তু যিহোবার শক্তিতে আমার মনোবল সবল। নিঃসন্দেহে, আমি বিশ্বাস করি যে, এই পুরনো বিধিব্যবস্থায় আমি তাঁর শক্তিতে যেকোনো পরীক্ষা সহ্য করতে পারি। এ ছাড়া, আমি এমন এক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি, যখন যিহোবার অযাচিত দয়ায় আমি চিরকাল বেঁচে থাকতে পারব।

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার ছেলে টিবর, জুনিয়র (৪ বছর বয়সে), যাকে আমার ছেড়ে যেতে হয়েছিল

[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]

বর্‌ শহরে অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে টিবর, সিনিয়র

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৭ সালে, বর্নোতে টিবর ও আমার ননদ ম্যাগডলেনার সঙ্গে

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

আমি বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলাম কিন্তু যিহোবার সুরক্ষা ছিল বলে আমি বেঁচে গিয়েছি