সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থার পক্ষে আমরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম

ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থার পক্ষে আমরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম

জীবন কাহিনী

ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থার পক্ষে আমরা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম

বলেছেন মিখল জবরাক

নির্জন কারাবাসে এক মাস কাটানোর পর, আমাকে টেনেহিঁচড়ে একজন জিজ্ঞাসাবাদকারীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে, তিনি রেগে আগুন হন এবং চিৎকার করে বলেন: “তোরা হচ্ছিস গুপ্তচর! আমেরিকার গুপ্তচর!” কী কারণে তিনি এত রেগে গিয়েছিলেন? তিনি শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমি কোন ধর্মের আর উত্তরে আমি বলেছিলাম: “আমি যিহোবার সাক্ষিদের একজন।”

 এটা পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে ঘটেছিল। সেই সময়, আমি যে-দেশে থাকতাম সেটা সাম্যবাদী শাসনাধীনে ছিল। কিন্তু, তারও অনেক আগে থেকেই আমরা আমাদের খ্রিস্টীয় শিক্ষামূলক কাজের জন্য ইতিমধ্যে নিদারুণ তাড়না ভোগ করেছিলাম।

আমরা যুদ্ধের যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত অনুভব করি

১৯১৪ সালে যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমার বয়স ছিল আট বছর। সেই সময়ে, আমার গ্রাম জালুজিটস্‌ অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্যের রাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। যুদ্ধ কেবল বিশ্বের দৃশ্যপটকেই উলটে ফেলেনি কিন্তু আকস্মিকভাবেই আমার ছেলেবেলাকেও শেষ করে দিয়েছিল। আমার বাবা, যিনি একজন সৈনিক ছিলেন, তিনি যে-বছর যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই বছরই মারা যান। এর ফলে, আমার মা, আমার ছোট দুই বোন এবং আমি দারিদ্রের কবলে পড়ে যাই। বাড়ির বড় ও একমাত্র ছেলে হিসেবে, শীঘ্রই আমাদের ছোট্ট খামার ও বাড়ির চারপাশের অনেক দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে পড়ে। একেবারে ছেলেবেলা থেকেই, আমি খুব ধার্মিক প্রকৃতির ছিলাম। এমনকি আমাদের রিফর্মড (ক্যালভিনিস্ট) গির্জার পরিচারক আমাকে তার বিকল্প হিসেবে কাজ করতে এবং তার অনুপস্থিতিতে আমার সহপাঠীদের শিক্ষা দিতে বলেছিলেন।

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় আর আমরা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম। অস্ট্রো-হাঙ্গারীয় সাম্রাজ্য পরাস্ত হয়েছিল এবং আমরা চেকোস্লোভাকিয়া প্রজাতন্ত্রের নাগরিক হয়েছিলাম। শীঘ্রই, আমাদের এলাকার অনেকেই যারা অভিবাসী হওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিল তারা দেশে ফিরে এসেছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন মিখল পেট্রিক, যিনি ১৯২২ সালে আমাদের গ্রামে আসেন। তিনি যখন আমাদের পাড়ার একটা পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তখন আমার মা এবং আমিও সেখানে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।

ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থা আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে ওঠে

মিখল ছিলেন একজন বাইবেল ছাত্র, যিহোবার সাক্ষিরা সেই সময়ে এই নামেই পরিচিত ছিল আর তিনি বাইবেলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন, যেগুলো আমাকে অত্যন্ত কৌতূহলী করে তুলেছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা ছিল যিহোবার রাজ্যের আগমন। (দানিয়েল ২:৪৪) যখন তিনি বলেছিলেন যে, পরের রবিবার জাহর গ্রামে একটা খ্রিস্টীয় সভা হবে, তখন আমি সেখানে যাব বলে ঠিক করেছিলাম। আমি ভোর ৪টের সময় ঘুম থেকে উঠি এবং একটা সাইকেল ধার করার জন্য প্রায় আট কিলোমিটার পথে হেঁটে আমার এক আত্মীয়র বাড়িতে যাই। সাইকেলের চাকায় হাওয়া ভরার পর, আমি আরও ২৪ কিলোমিটার দূরে জাহরে যাই। সভা কোথায় হবে তা আমি জানতাম না, তাই একটা রাস্তা ধরে আমি ধীরে ধীরে এগোতে থাকি। এরপর আমি বুঝতে পারি যে, কোনো একটা বাড়িতে রাজ্যের গান হচ্ছে। আমার মন খুশিতে ভরে ওঠে। আমি সেই বাড়িতে প্রবেশ করি এবং আমার আসার কারণ বুঝিয়ে বলি। আমাকে সেই পরিবারের সঙ্গে সকালের খাবার খাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তারপর তারা আমাকে সভায় নিয়ে যায়। বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য যদিও আমাকে আরও ৩২ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে ও হেঁটে যেতে হয়েছিল কিন্তু আমি একটুও ক্লান্ত বোধ করিনি।—যিশাইয় ৪০:৩১.

যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা শেখানো স্পষ্ট, বাইবেলভিত্তিক ব্যাখ্যাগুলো শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থার অধীনে এক পরিপূর্ণ ও পরিতৃপ্তিদায়ক জীবন উপভোগ করার আশা আমার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিল। (গীতসংহিতা ১০৪:২৮) আমার মা ও আমি উভয়েই আমাদের গির্জায় একটা পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এটা আমাদের গ্রামে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কেউ কেউ বেশ কিছুদিন আমাদের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেনি, তা সত্ত্বেও আমাদের এলাকায় অনেক সাক্ষির সঙ্গে আমাদের উত্তম মেলামেশা ছিল। (মথি ৫:১১, ১২) এর অল্প কিছুদিন পরেই আমি য়ু নদীতে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

পরিচর্যা আমাদের জীবনের পথ হয়ে ওঠে

যিহোবার রাজ্য সম্বন্ধে প্রচার করার জন্য আমরা প্রতিটা সুযোগকে কাজে লাগিয়েছি। (মথি ২৪:১৪) আমরা বিশেষ করে রবিবারগুলোতে সুসংগঠিত প্রচার অভিযানের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেছি। সাধারণত, সেই সময়ে লোকেরা খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠত, তাই আমরা বেশ সকাল সকালই প্রচার শুরু করতে পারতাম। দিনের শেষে, জনসাধারণের উদ্দেশে সভার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অধিকাংশ সময়েই বাইবেলের শিক্ষকরা কোনো নোট ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বক্তৃতা দিত। আগ্রহী ব্যক্তিদের সংখ্যা, তাদের ধর্মীয় পটভূমি এবং যে-বিষয়গুলো নিয়ে তারা চিন্তা করত, সেগুলো সেই শিক্ষকরা মাথায় রেখেছিল।

বাইবেলের যে-সত্যগুলো আমরা প্রচার করেছিলাম, সেগুলো অনেক সৎহৃদয়ের লোকের চোখ খুলে দিয়েছিল। আমার বাপ্তিস্মের অল্প কিছুদিন পরেই, আমি ট্রহভিশটে গ্রামে প্রচার করি। একটা বাড়িতে, আমি মিসেস জুজানা মসকাল নামে খুব দয়ালু ও বন্ধুত্বপরায়ণ একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি ও তার পরিবার আমার মতোই ক্যালভিনিস্ট ছিলেন। যদিও তিনি বাইবেল জানতেন কিন্তু বাইবেল সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন ছিল, যেগুলোর উত্তর তিনি পাননি। আমরা দীর্ঘ এক ঘন্টা আলোচনা করেছিলাম এবং আমি তার কাছে ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) বইটি অর্পণ করেছিলাম। *

মসকাল পরিবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিয়মিত বাইবেল পাঠের সময়ে বীণা বইটি পড়া অন্তর্ভুক্ত করেছিল। সেই গ্রামের আরও কয়েকটা পরিবার আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং আমাদের সভাগুলোতে যোগদান করতে শুরু করেছিল। তাদের ক্যালভিনিস্ট পরিচারক আমাদের এবং আমাদের সাহিত্যাদির বিরুদ্ধে কড়াকড়িভাবে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তাই আগ্রহী ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েক জন সেই পরিচারককে আমাদের সভায় আসার এবং এক খোলাখুলি বিতর্কের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাগুলোকে খণ্ডন করার প্রস্তাব দিয়েছিল।

পরিচারক এসেছিলেন কিন্তু তিনি তার শিক্ষাগুলোকে সমর্থন করার জন্য বাইবেল থেকে একটা যুক্তিও তুলে ধরতে পারেননি। আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য তিনি বলেছিলেন: “আমরা বাইবেলের প্রত্যেকটা বিষয় বিশ্বাস করতে পারি না। এটি মানুষের দ্বারা লেখা হয়েছে আর তাই ধর্মীয় প্রশ্নগুলোকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।” এই বিষয়টা অনেকের মধ্যে পরিবর্তন এনেছিল। কেউ কেউ সেই পরিচারককে বলেছিল যে, তিনি যদি বাইবেলে বিশ্বাসই না করেন, তা হলে তারা আর তার ধর্মোপদেশগুলো শোনার জন্য আসবে না। ফলে তারা ক্যালভিনিস্ট গির্জা থেকে তাদের সদস্যপদ বাতিল করেছিল এবং সেই গ্রাম থেকে প্রায় ৩০ জন লোক বাইবেলের সত্যের পক্ষে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছিল।

রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করা আমাদের জীবনের পথ হয়ে উঠেছিল, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি আধ্যাত্মিকভাবে দৃঢ় এক পরিবার থেকে একজন সাথি খুঁজছিলাম। পরিচর্যায় আমার সহকর্মীদের মধ্যে একজন ছিলেন ইয়ান পেটরুশকা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে সত্য শিখেছিলেন। তার মেয়ে মারিয়ার ঠিক তার বাবার মতো, প্রত্যেকের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তৎপর মনোভাব আমার ওপর ছাপ ফেলেছিল। ১৯৩৬ সালে আমরা বিয়ে করি এবং ১৯৮৬ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ৫০ বছর যাবৎ মারিয়া আমার বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিল। ১৯৩৮ সালে, আমাদের একমাত্র ছেলে এডুয়ার্ট জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সেই সময়ে ইউরোপে আরেকটা যুদ্ধ আসন্ন বলে মনে হচ্ছিল। আমাদের প্রচার কাজে এটা কেমন প্রভাব ফেলবে?

আমাদের খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতা পরীক্ষিত হয়

যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন স্লোভাকিয়া, যেটা একটা স্বতন্ত্র দেশ হয়ে উঠে সেটা নাৎসি প্রভাবাধীনে ছিল। কিন্তু, একটা সংগঠন হিসেবে যিহোবার সাক্ষিদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অবশ্যই, আমাদের গোপনে কাজ করতে হয়েছিল আর আমাদের সাহিত্যাদি তল্লাশ করা হয়েছিল। তবুও, আমরা বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাদের কাজকর্ম চালিয়ে গিয়েছিলাম।—মথি ১০:১৬.

যুদ্ধ যখন তীব্রতর হয়ে উঠেছিল, তখন আমাকে জোর করে সেনাবাহিনীতে কাজ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যদিও আমার বয়স তখন ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে ছিল। আমার খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতার কারণে, আমি যুদ্ধে অংশ নিতে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। (যিশাইয় ২:২-৪) আনন্দের বিষয় যে, আমাকে নিয়ে কী করবে সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই, যারা আমার সমবয়সী ছিল তাদের সকলকেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমরা উপলব্ধি করেছিলাম যে, আমরা যারা গ্রামাঞ্চলগুলোতে বাস করতাম আমাদের চাইতে শহরগুলোতে বসবাসরত আমাদের ভাইদের জন্য জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জোগানো আরও বেশি কঠিন ছিল। আমাদের যা ছিল আমরা তা ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। (২ করিন্থীয় ৮:১৪) তাই, আমরা যত বেশি সম্ভব খাদ্যসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলাম এবং ব্রাটিস্লাভা শহরে যাওয়ার জন্য ৫০০ কিলোমিটারের বেশি পথ যাত্রা করেছিলাম। যুদ্ধের বছরগুলোতে খ্রিস্টীয় বন্ধুত্বের এবং ভালবাসার যে-বন্ধনে আমরা একতাবদ্ধ ছিলাম, তা আমাদেরকে সামনের কঠিন বছরগুলোতে শক্তি জুগিয়েছিল।

প্রয়োজনীয় উৎসাহ পাওয়া

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, স্লোভাকিয়া আবারও একবার চেকোস্লোভাকিয়ার অংশ হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত, যিহোবার সাক্ষিদের দেশজুড়ে সম্মেলনগুলো বার্নো অথবা প্রাগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সম্মেলন অভ্যাগতদের জন্য আয়োজিত বিশেষ ট্রেনগুলোতে করে আমরা পূর্ব স্লোভাকিয়া থেকে যাত্রা করেছিলাম। আপনারা হয়তো এই ট্রেনগুলোকে গানের ট্রেন বলতে পারেন, কারণ আমরা সারারাস্তা গান গেয়েছিলাম।—প্রেরিত ১৬:২৫.

আমার বিশেষ করে ১৯৪৭ সালের বার্নোর সম্মেলনের কথা মনে পড়ে, যেখানে বিশ্বপ্রধান কার্যালয় থেকে ভাই নেথেন নরসহ তিন জন খ্রিস্টান অধ্যক্ষ উপস্থিত ছিল। জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার বিষয়ে ঘোষণা করার জন্য আমরা অনেকেই মূলভাব ঘোষণা করার প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলাম। আমাদের ছেলে এডুয়ার্ট, যার বয়স সেই সময় মাত্র নয় বছর ছিল, সে কোনো প্ল্যাকার্ড পায়নি বলে খুব মনঃক্ষুন্ন হয়েছিল। তাই ভাইয়েরা কেবল তার জন্যই নয় কিন্তু অন্য অনেক ছোট ছেলেমেয়ের জন্যও ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড বানিয়েছিল। ছোট ছেলেমেয়েদের এই দল বক্তৃতার বিষয়ে ঘোষণা করার ব্যাপারে এক উত্তম কাজ করেছিল!

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাম্যবাদীরা ক্ষমতায় আসে। আমরা জানতাম যে, আগে হোক বা পরে হোক, সরকার আমাদের পরিচর্যা কাজে বাধা দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ নেবে। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, প্রাগে একটা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় আর সম্মেলন করার স্বাধীনতা পাওয়ার মাত্র তিন বছর পর যেহেতু আমরা জনসমাবেশগুলোর ওপর আরেকটা নিষেধাজ্ঞা আশা করছিলাম, তাই আমরা খুবই মনমরা হয়ে পড়েছিলাম। সম্মেলন ছেড়ে যাওয়ার আগে, আমরা একটা সংকল্প গ্রহণ করেছিলাম, যেটার কিছুটা অংশ এভাবে বলে: “আমরা যিহোবার সাক্ষিরা, যারা একত্রে সমবেত হয়েছি . . . পরিতৃপ্তিদায়ক এই পরিচর্যা এখনও আরও বেশি করে বৃদ্ধি করতে এবং প্রভুর অযাচিত দয়ায় পরীক্ষার সময়ে তাতে অটল থাকতে এবং আরও বেশি উদ্যোগের সঙ্গে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার ঘোষণা করতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ।”

“রাষ্ট্রের শত্রু”

প্রাগ শহরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের মাত্র দুমাস পরে, গোয়েন্দা পুলিশ প্রাগের কাছে বেথেল হোমে হানা দেয়। তারা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, যে-সাহিত্যই তারা দেখতে পেয়েছিল সেগুলোও বাজেয়াপ্ত করে এবং সমস্ত বেথেলকর্মী ও অন্য কয়েক জন ভাইকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু সামনে আরও কিছু ঘটতে চলেছিল।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৩-৪ তারিখ রাতে, নিরাপত্তাবাহিনী দেশজুড়ে তল্লাশি চালায় এবং ১০০ জনের বেশি সাক্ষিকে গ্রেপ্তার করে। আমি ছিলাম তাদের মধ্যে একজন। প্রায় ভোর তিনটের সময়, পুলিশ আমার পুরো পরিবারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। কোনোকিছু ব্যাখ্যা না করেই, তারা আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। আমাকে হাতকড়া পরানো হয় এবং কাপড় দিয়ে আমার চোখ বেঁধে অন্য আরও কয়েক জনের সঙ্গে ধাক্কা মেরে একটা ট্রাকের পিছন দিকে উঠানো হয়। শেষ পর্যন্ত আমাকে নির্জন কারাবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।

কারও সঙ্গে কোনো কথা বলা ছাড়াই পুরো একটা মাস কেটে যায়। পাহারাদারই ছিল একমাত্র ব্যক্তি যাকে আমি দেখেছিলাম আর তিনি দরজার একটা ফুটো দিয়ে অল্প কিছু খাবার ঠেলে দিতেন। এরপর আমাকে শুরুতে উল্লেখিত জিজ্ঞাসাবাদকারীর কাছে ডেকে পাঠানো হয়। আমাকে গুপ্তচর বলে সম্বোধন করার পর, তিনি আরও বলেন: “ধর্ম হল অজ্ঞতা। ঈশ্বর বলে কেউ নেই! আমরা তোকে আমাদের শ্রমিক-শ্রেণীকে বোকা বানাতে দিতে পারি না। হয় তোর ফাঁসি হবে নতুবা এই জেলেই তুই মরবি। আর তোর ঈশ্বর যদি এখানে আসেন, তা হলে আমরা তাঁকেও মেরে ফেলব!”

যেহেতু কর্তৃপক্ষরা জানত যে, আমাদের খ্রিস্টীয় কাজকর্মকে নিষেধ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই, তাই তারা আমাদেরকে “রাষ্ট্রের শত্রু” এবং বিদেশি গুপ্তচর বলে বর্ণনা করে আমাদের কাজকর্ম প্রচলিত আইন অনুযায়ী সংগত কি না, তা পুনরায় পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিল। তা করার জন্য, তাদেরকে আমাদের মনোবল ভেঙে ফেলার এবং আমাদের সম্বন্ধে করা মিথ্যা অভিযোগগুলোকে “স্বীকার” করিয়ে নেওয়ার দরকার ছিল। সেই রাতে জেরা করার পর, আমাকে ঘুমাতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমাকে আবারও জেরা করা হয়। এই সময় জিজ্ঞাসাবাদকারী চেয়েছিলেন আমি যেন একটা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করি, যেখানে বলা ছিল: “চেকোস্লোভাকিয়ার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের একজন শত্রু হিসেবে আমি [যৌথ খামারে] যোগ দিইনি কারণ আমি আমেরিকার লোকেদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।” আমি যখন এইরকম এক মিথ্যা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করি, তখন আমাকে একটা সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

সেখানে আমাকে ঘুমাতে, শুতে অথবা এমনকি বসতেও নিষেধ করা হয়েছিল। আমার কেবল দাঁড়িয়ে থাকার অথবা হাঁটার অনুমতি ছিল। আমি যখন অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন আমি পাকা মেঝেতে শুয়ে পড়ি। তারপর পাহারাদাররা আমাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদকারীর অফিসে নিয়ে যায়। “এখন কি তুই স্বাক্ষর করবি?” জিজ্ঞাসাবাদকারী জিজ্ঞেস করেছিলেন। যখন আমি আবারও প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তখন তিনি আমার মুখে আঘাত করেছিলেন। এতে রক্ত ঝরতে শুরু করেছিল। এরপর তিনি পাহারাদারদের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলেছিলেন: “ও আত্মহত্যা করতে চাচ্ছে। এর ওপর নজর রাখো যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে!” আমাকে পুনরায় নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয়। ছয় মাস ধরে জেরা করার এই কৌশলগুলো বেশ কয়েক বারই পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। আমি যে রাষ্ট্রের একজন শত্রু সেটা স্বীকার করানোর জন্য কোনো ভাবাদর্শ অথবা প্রচেষ্টা আমাকে যিহোবার প্রতি আমার নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখার দৃঢ়সংকল্পকে হ্রাস করতে পারেনি।

এক মাস আগে একটা বিচারের কারণে আমাকে আদালতে যেতে হয়েছিল, প্রাগ থেকে একজন সরকারি উকিল এসেছিলেন এবং আমাদের ১২ জন ভাইয়ের দলের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “পশ্চিমা জাতিগুলো যদি আমাদের দেশকে আক্রমণ করে, তা হলে আপনি কী করবেন?” “হিটলারের সঙ্গে এই দেশ যখন ইউএসএসআর-কে (সোভিয়েত ইউনিয়নকে) আক্রমণ করেছিল, তখন আমি যা করেছিলাম, তা-ই করব। আমি তখন যুদ্ধ করিনি আর এখনও আমি যুদ্ধ করব না কারণ আমি একজন খ্রিস্টান এবং নিরপেক্ষ।” তারপর তিনি আমাকে বলেছিলেন: “আমরা যিহোবার সাক্ষিদের প্রশ্রয় দিতে পারি না। যদি পশ্চিমা জাতিগুলো আমাদের আক্রমণ করে, সেই ক্ষেত্রে আমাদের সৈন্য দরকার আর দেশের পশ্চিমের শ্রমিক-শ্রেণীকে মুক্ত করার জন্য আমাদের সৈন্য দরকার।”

১৯৫৩ সালের ২৪শে জুলাই আমাদেরকে আদালত কক্ষে নিয়ে আসা হয়। একের পর এক, আমাদের ১২ জনকে বিচারক মণ্ডলীর সামনে ডাকা হয়। আমরা আমাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করি। আমাদের বিরুদ্ধে আনা মিথ্যা অভিযোগগুলো সম্বন্ধে আমাদের প্রতিক্রিয়া জানানোর পর, একজন আইনজীবি উঠে দাঁড়ান এবং বলেন: “আমি এই আদালত কক্ষে অনেকবারই এসেছি। সাধারণত, এখানে অনেক স্বীকারোক্তি, অনুতাপ এবং এমনকি কান্নাকাটিও হয়ে থাকে। কিন্তু এই লোকেরা যখন এখানে এসেছিল, তার চেয়ে আরও বেশি দৃঢ় হয়ে এখান থেকে ফিরে যাবে।” এরপর, আমাদের ১২ জনকেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার অভিযোগে অভিযুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। আমার তিন বছরের জেল হয় এবং রাষ্ট্র আমার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে।

বৃদ্ধ বয়স আমাকে থামাতে পারেনি

বাড়ি আসার পরও গোয়েন্দা পুলিশ আমার ওপর নজর রেখেছিল। তা সত্ত্বেও, আমি পুনরায় আমার ঈশতান্ত্রিক কাজকর্ম শুরু করি আর আমার ওপর আস্থা সহকারে আমাদের মণ্ডলীর আধ্যাত্মিক বিষয় দেখাশোনা করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যদিও আমাদেরকে আমাদের বাজেয়াপ্ত করা বাড়িতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু প্রায় ৪০ বছর পরে, সাম্যবাদের পতনের পর আমাদেরকে আইনগতভাবে এটা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমার পরিবারের মধ্যে জেল খাটার অভিজ্ঞতা শুধু আমারই হয়নি। আমি বাড়িতে ফিরে আসার মাত্র তিন বছর পরেই এডুয়ার্টকে সেনাবাহিনীতে কাজ করার জন্য জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার বাইবেল শিক্ষিত বিবেকের কারণে, সে তা প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তার জেল হয়েছিল। বেশ কয়েক বছর পর, আমার নাতি পিটারের স্বাস্থ্য ততটা ভাল না থাকা সত্ত্বেও তাকে জেল খাটতে হয়েছে।

১৯৮৯ সালে, চেকোস্লোভাকিয়ার সাম্যবাদী শাসনব্যবস্থার পতন হয়। আমি কতই না খুশি হয়েছিলাম যখন নিষেধাজ্ঞার চার দশক পরে, আমি স্বাধীনভাবে ঘরে ঘরে প্রচার করতে পেরেছিলাম! (প্রেরিত ২০:২০) আমার স্বাস্থ্য যতদিন সুযোগ দিয়েছে, ততদিন পর্যন্ত আমি এই পরিচর্যা উপভোগ করেছি। এখন আমার বয়স ৯৮ বছর, আমার স্বাস্থ্য আগের মতো তত ভাল নয় কিন্তু আমি আনন্দিত যে আমি এখনও ভবিষ্যতের জন্য যিহোবার গৌরবময় প্রতিজ্ঞাগুলো সম্বন্ধে লোকেদের কাছে সাক্ষ্য দিতে পারি।

আমি পাঁচটা দেশের ১২ জন নেতার সংখ্যা গণনা করতে পারি, যারা আমার নিজের শহরের ওপর শাসন করেছে। তাদের মধ্যে ছিল একনায়ক শাসকরা, কয়েকজন রাষ্ট্রপতি এবং একজন রাজা। তারা কেউই তাদের শাসনাধীনে অসুস্থতার দ্বারা যন্ত্রণাগ্রস্ত লোকেদের স্থায়ী সমাধান এনে দিতে পারেনি। (গীতংহিতা ১৪৬:৩, ৪) আমি যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞ যে, তিনি ছোটবেলাতেই আমাকে তাঁর সম্বন্ধে জানার সুযোগ দিয়েছিলেন। তাই, আমি মশীহ রাজ্যের মাধ্যমে তাঁর সমাধানকে এবং ঈশ্বরবিহীন জীবনের অসারতাকে এড়িয়ে চলাকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমি সক্রিয়ভাবে সর্বোত্তম সংবাদটি প্রচার করেছি এবং এটা আমাকে জীবনের এক উদ্দেশ্য, পরিতৃপ্তি ও পৃথিবীতে অনন্তজীবনের এক উজ্জ্বল আশা এনে দিয়েছে। এর চেয়ে ভাল আর কীই বা আমি চাইতে পারতাম? *

[পাদটীকাগুলো]

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।

^ দুঃখের বিষয় যে, ভাই মিখল জবরাকের শক্তি অবশেষে নিঃশেষ হয়ে যায়। এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করার জন্য যখন প্রস্তুত করা হচ্ছিল, সেই সময় পুনরুত্থানের আশার ওপর আস্থা নিয়ে তিনি বিশ্বস্তভাবে মারা যান।

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪০ এর দশকের প্রথমদিকে এডুয়ার্টের সঙ্গে

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৭ সালে বার্নোতে সম্মেলনের বিষয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে