সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবার প্রেমময় যত্নের ওপর নির্ভর করা

যিহোবার প্রেমময় যত্নের ওপর নির্ভর করা

জীবন কাহিনী

যিহোবার প্রেমময় যত্নের ওপর নির্ভর করা

বলেছেন আ্যনা ডেন্টস্‌ টারপিন

“সারাক্ষণ জিজ্ঞেস করো ‘এটা কেন ওটা কেন’!” মা মৃদু হেসে বলে ওঠেন। এক ছোট্ট মেয়ে হিসেবে আমি আমার বাবামাকে নানারকম প্রশ্ন করতেই থাকতাম। কিন্তু, আমার এই শিশুসুলভ কৌতূহলের জন্য বাবামা কখনও আমাকে বকুনি দেয়নি। বরং, তারা আমাকে যুক্তি করতে এবং বাইবেল শিক্ষিত বিবেকের ওপর ভিত্তি করে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছিল। সেই প্রশিক্ষণ কতই না মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছিল! একদিন, যখন আমার বয়স ১৪ বছর, নাৎসিরা আমার প্রিয় বাবামাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং আমি তাদের আর কখনও দেখিনি।

 আমার বাবা অস্কার ডেন্টস্‌ এবং মা আ্যনা মারিয়া সুইস সীমান্তের নিকটবর্তী জার্মানির এক শহর লুরাকে বাস করত। তাদের তরুণ বয়সে তারা পুরোদমে রাজনীতি করত আর সমাজের লোকেরা তাদের চিনত ও তাদের সম্মান করত। কিন্তু, ১৯২২ সালে তারা বিয়ে করার কিছুদিন পরেই, বাবামা রাজনীতি সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের জীবনের লক্ষ্যগুলো পরিবর্তন করে। মা বাইবেল ছাত্রদের সঙ্গে, যিহোবার সাক্ষিদের তখন যে-নামে ডাকা হতো, বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন এবং ঈশ্বরের রাজ্য যে পৃথিবীতে শান্তি নিয়ে আসবে, সেটা জেনে রোমাঞ্চিত হন। শীঘ্রই বাবাও মার সঙ্গে অধ্যয়নে যোগ দেন এবং তারা বাইবেল ছাত্রদের সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করে। এমনকি সেই বছর বড়দিনে বাবা মাকে ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) নামে বাইবেল অধ্যয়নের একটা বই দেন। তাদের একমাত্র সন্তান, আমি ১৯২৩ সালের ২৫শে মার্চ জন্মগ্রহণ করি।

আমাদের পারিবারিক জীবনের কত সুন্দর সুন্দর স্মৃতিই না আমার রয়েছে—গরমের সময়ে নিরিবিলি ব্ল্যাক ফরেস্টে দীর্ঘ সময়ের জন্য প্রমোদভ্রমণ করতে যাওয়া এবং ঘরের কাজকর্মের বিষয়ে মায়ের শিক্ষা দেওয়া! রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মা তার ছোট্ট বাবুর্চিকে রান্না শেখাচ্ছেন, সেই দৃশ্য এখনও আমার চোখে ভাসে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল যে, বাবামা আমাকে যিহোবা ঈশ্বরকে ভালবাসতে এবং তাঁর ওপর নির্ভর করতে শিখিয়েছিল।

আমাদের মণ্ডলীতে প্রায় ৪০ জন্য অধ্যবসায়ী রাজ্য প্রচারক ছিল। বাবামা রাজ্য সম্বন্ধে কথা বলার সুযোগ করে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ দক্ষ ছিল। পূর্বের সামাজিক কাজগুলো করার দরুণ তারা অন্যদের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পারত এবং অন্যেরাও তাদের সাদরে গ্রহণ করত। আমার বয়স যখন ৭ বছর, তখন আমিও ঘরে ঘরে প্রচারে যেতে চেয়েছিলাম। প্রচারের প্রথম দিন আমার সহযোগী আমার হাতে কিছু সাহিত্য দিয়ে, একটা ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে শুধু বলেছিলেন, “গিয়ে দেখ যে তারা এগুলো নিতে চায় কি না।” ১৯৩১ সালে আমরা সুইজারল্যান্ডের বাজলের বাইবেল ছাত্রদের এক সম্মেলনে যোগ দিই। সেখানে আমার বাবামা বাপ্তিস্ম নেয়।

বিক্ষোভ থেকে নিপীড়ন

সেই সময়ে জার্মানি বিক্ষোভে পূর্ণ ছিল আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল রাস্তাঘাটে মারপিট শুরু করে দিত। একদিন রাতে আমি প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে আসা চিৎকার শুনে জেগে উঠি। দুজন কিশোর তাদের দাদাকে একটা লম্বা হাতল সহ কাঁটা লাগানো দণ্ড দিয়ে খুন করে কারণ তারা তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত হতে পারেনি। যিহুদিদের বিরুদ্ধে শত্রুতাও লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। স্কুলে একটা মেয়েকে একা একা এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল শুধু এই কারণে যে, সে যিহুদি ছিল। তার জন্য আমার অনেক দুঃখ লেগেছিল, যদিও আমি জানতাম না যে শীঘ্রই আমাকেও একঘরে করলে কেমন লাগে, সেই সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে।

১৯৩৩ সালের ৩০শে জানুয়ারি এডল্ফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হন। দুটো ব্লক দূর থেকে আমরা দেখতে পাই যে, নাৎসিরা উল্লাসে নগরভবনের ওপর স্বস্তিকা-চিহ্নের পতাকা উত্তোলন করছে। স্কুলে আমাদের উদ্যমী শিক্ষক “হেল হিটলার!” বলে সম্ভাষণ জানানোর বিষয়টা শিখিয়েছিলেন। সেই দিন দুপুরে আমি বাবাকে এই সম্বন্ধে বলি। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। “এটা ঠিক নয়,” তিনি বলেন। “‘হেল’ মানে পরিত্রাণ। আমাদের যদি ‘হেল হিটলার’ বলতে হয়, তা হলে এর অর্থ হবে যে আমরা যিহোবার পরিবর্তে তার কাছে পরিত্রাণ আছে বলে মনে করি। আমার কাছে এটা সঠিক বলে মনে হয় না, তবে তোমার কী করা উচিত সেটা তুমিই সিদ্ধান্ত নাও।”

আমি হিটলারকে অভিবাদন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বলে আমার সহপাঠীরা আমার সঙ্গে সমাজচ্যুত ব্যক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। কিছু ছেলে এমনকি আমাকে মারধর করত, যখন শিক্ষকের দৃষ্টি সেই দিকে থাকত না। পরে অবশ্য, তারা আমাকে আর জ্বালাতন করেনি কিন্তু এমনকি আমার বন্ধুরা আমাকে বলেছিল যে, তাদের বাবা আমার সঙ্গে তাদেরকে খেলতে বারণ করেছে। আমি নাকি খুব বিপদজনক হয়ে উঠেছিলাম।

জার্মানিতে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার দুমাস পর তারা যিহোবার সাক্ষিদের রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদজনক ভেবে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নির্দয় সৈন্যবাহিনী ম্যাগডেবার্গের অফিস বন্ধ করে দেয় এবং আমাদের সভাগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু, আমরা যেহেতু সীমান্তের নিকটে বাস করতাম, তাই বাবা আমাদের জন্য সীমান্তের ওপারে বাজলে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন, যেখানে আমরা রবিবারের সভাগুলোতে যোগ দিতাম। তিনি প্রায়ই বলতেন যে, জার্মানিতে আমাদের ভাইয়েরা যদি এইরকম আধ্যাত্মিক খাবার পেত, যা তাদের ভবিষ্যৎকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে, তা হলে ভাল হতো।

ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণ

ম্যাগডেবার্গের অফিস বন্ধ করে দেওয়ার পর, সেখানকার একজন প্রাক্তন সদস্য ইউলিয়ুস রিফল গোপনে প্রচার কাজ সংগঠিত করার জন্য তার নিজ শহর লুরাকে আসেন। বাবা অবিলম্বে সাহায্য করার প্রস্তাব দেন। মা ও আমার সঙ্গে বসে বাবা ব্যাখ্যা করেন যে, তিনি সুইজারল্যান্ড থেকে জার্মানিতে বাইবেল সাহিত্যাদি আনার জন্য সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন যে, এটা অত্যন্ত বিপদজনক কাজ হবে আর যেকোনো সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তিনি চাননি যাতে এর সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য আমরা চাপ অনুভব করি কারণ এটা আমাদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হবে। সঙ্গে সঙ্গে মা বলেছিলেন, “আমি তোমার সঙ্গে আছি।” তারা দুজনেই আমার দিকে তাকায় এবং আমি বলেছিলাম “আমিও তোমাদের সঙ্গে আছি।”

প্রায় প্রহরীদুর্গ পত্রিকার আকারে একটা ব্যাগ মা হাতে বুনে তৈরি করেন। তিনি ব্যাগের এক পাশে থাকা খোলা মুখ দিয়ে সাহিত্যাদি ঢুকিয়ে দিতেন ও এরপর ক্ষুদ্র থলি সেলাই করে বন্ধ করে দিতেন। তিনি বাবার কাপড়চোপড়ে গোপন পকেট তৈরি করেন এবং দুটো কোমর বন্ধনী তৈরি করেন, যেগুলোর মধ্যে মা এবং আমি সতর্কতার সঙ্গে ছোট আকারের বিভিন্ন বাইবেল অধ্যয়ন সহায়ক বহন করতে পারতাম। প্রতিবার আমরা যখন আমাদের গুপ্তধনগুলো বাড়িতে নিয়ে আসতে সফল হতাম, তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম এবং যিহোবাকে ধন্যবাদ জানাতাম। আমরা সাহিত্যাদি আমাদের চিলেকোঠার মধ্যে লুকিয়ে রাখতাম।

প্রথম প্রথম নাৎসিরা কোনো কিছুর জন্য আমাদের সন্দেহ করেনি। তারা আমাদের কোনো প্রশ্ন বা আমাদের বাড়ি তল্লাশি কোনোটাই করেনি। তবে, সমস্যা আসলে আমাদের আধ্যাত্মিক ভাইবোনদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য আমরা একটা কোড নম্বর ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিই—৪৭১১, একটি বিখ্যাত সুগন্ধির নাম। ঘরে আসা যদি বিপদজনক হতো, তা হলে আমরা তাদের সতর্ক করে দিতাম—যেকোনোভাবেই হোক সেই নম্বর ব্যবহার করে। বাবা তাদের এও বলে দিয়েছিলেন, যাতে তারা বিল্ডিংয়ে ঢোকার আগে আমাদের বসার ঘরের জানালাগুলোর দিকে তাকায়। বাঁদিকের জানালা যদি খোলা থাকে, তা হলে এর অর্থ হবে যে, কিছু সমস্যা হয়েছে আর তাদের আসা উচিত নয়।

১৯৩৬ এবং ১৯৩৭ সালে, গেসটাপো (জার্মানির গোয়েন্দা পুলিশ) দলে দলে লোকদের গ্রেপ্তার করে এবং হাজার হাজার সাক্ষিদের জেলে ভরে ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে পাঠায়, যেখানে তারা সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং নির্মম আচরণ সহ্য করে। সুইজারল্যান্ডের বার্নের শাখা অফিস নাৎসিদের বিভিন্ন অপরাধকে উন্মোচন করতে ক্রয়িটস্‌সুগ গেগেন ডাস ক্রিসটেনটুম (খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ) বইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে, এগুলোর মধ্যে কিছু তথ্য গোপনে ক্যাম্পগুলো থেকে পাঠানো হতো। আমরা সেই গোপন তথ্যগুলো সীমান্তের ওপারে বাজলে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করি। নাৎসিরা যদি সেই গরম গরম তথ্যগুলোসহ আমাদের ধরে ফেলত, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জেলে ভরা হতো। আমাদের ভাইয়েরা যে-অত্যাচার সহ্য করছিল, সেগুলো পড়ে আমি কাঁদতাম। কিন্তু, আমি ভয় পাইনি। আমার আস্থা ছিল যে, আমার প্রিয় বন্ধু যিহোবা এবং আমার বাবামা আমাকে দেখবেন।

আমি ১৪ বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েট হই এবং ধাতব সামগ্রীর দোকানে একজন ক্লার্কের কাজ করি। সাধারণত আমরা শনিবার বিকেলে অথবা রবিবারে সংবাদ বহনকারী ভ্রমণের কাজ করতাম, যখন বাবার কাজের ছুটি থাকত। গড়ে আমরা প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর যেতাম। আমাদের দেখতে অন্যান্য পরিবারের মতো মনে হতো, যারা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোত বেড়াতে বের হতো আর প্রায় চার বছর ধরে সীমান্তের রক্ষীরা আমাদের কখনও থামায়নি অথবা আমাদের তল্লাশি চালানোর চেষ্টা করেনি—অর্থাৎ, ১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সেই দিনের আগে পর্যন্ত।

আবিষ্কৃত হয়!

আমরা যখন বাজেলের নিকটবর্তী আমাদের সাহিত্য নেওয়ার জায়গায় পৌঁছাই এবং সেখানে আমাদের জন্য বিরাট বান্ডিল করে রাখা সাহিত্যাদি দেখি, তখন আমার বাবার চেহারার যা হয়েছিল, তা আমি কখনও ভুলতে পারব না। সংবাদ বহনকারী আরেকটা পরিবারকে যেহেতু গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাই আমাদের আরও বেশি বইপত্র বহন করার কথা ছিল। সীমান্তে একজন কাস্টমস কর্মকর্তা আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাদের তল্লাশি করার আদেশ দেন। বইগুলো পাওয়ার পর, তিনি বন্দুক তাক করে আমাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়ির দিকে নিয়ে যান। অফিসাররা যখন আমাদেরকে গাড়িতে করে নিয়ে যেতে থাকে, তখন বাবা আমার হাতে চাপ দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন: “বিশ্বাসঘাতকতা করো না। কারও নাম বলে দিও না!” আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম, “আমি বলব না।” আমরা যখন লুরাকে ফিরে আসি, তখন তারা আমার প্রিয় বাবাকে নিয়ে চলে যায়। আমি তাকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম, যখন জেলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

চার ঘন্টা ধরে, চারজন গেসটাপো আমাকে জেরা করে, যাতে আমি তাদেরকে অন্যান্য সাক্ষিদের নাম এবং ঠিকানা জানাই। আমি যখন বলতে অসম্মত হই, তখন একজন কর্মকর্তা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে হুমকি দিয়ে বলেন, “তোমার পেট থেকে কথা বের করার আরও অনেক পন্থা আমাদের রয়েছে!” আমি কোনো কিছু প্রকাশ করিনি। এরপর তারা মাকে ও আমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যায়, যেখানে তারা প্রথম বারের মতো তল্লাশি চালায়। তারা মাকে কারাগারে নিয়ে যায় এবং আমাকে মাসির বাড়িতে তার তত্ত্বাবধানে রাখে, তবে তারা জানত না যে, মাসিও একজন সাক্ষি ছিলেন। যদিও আমাকে কাজে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু চার জন গেসটাপো বাড়ির সামনে দাঁড় করানো গাড়িতে বসে আমার প্রতিটা গতিবিধির ওপর নজর রাখত ও সেইসঙ্গে একজন পুলিশ ফুটপাথে ঘোরাফেরা করত।

কয়েক দিন পর দুপুরের খাবারের সময়, আমি ঘর থেকে বাইরে আসি এবং একজন যুবতী বোনকে আমার দিকে সাইকেল চালিয়ে আসতে দেখি। সে কাছে আসায় আমি দেখতে পাই যে, সে আমার দিকে এক টুকরো কাগজ ছুঁড়ে মারতে যাচ্ছে। সেটা ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুরে দেখি যে, আমি যা করেছি তা গেসটাপো দেখেছে কি না। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, সেই মুহূর্তে তারা সকলে প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়েছিল!

বোনের সেই নোটে বলা হয়েছিল যাতে আমি দুপুরের সময় তার বাবামার বাড়িতে যাই। কিন্তু, গেসটাপো যেহেতু আমার ওপর নজর রাখছিল, তাই কীভাবে আমি তার বাবামাকেও এতে জড়িয়ে ফেলার ঝুঁকি নিতে পারি? আমি চার জন গেসটাপোকে গাড়িতে এবং একজন পুলিশকে রাস্তায় পায়চারি করতে দেখি। আমি জানতাম না যে, কী করব এবং আমি সাহায্যের জন্য যিহোবার কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি। হঠাৎ করে সেই পুলিশ গেসটাপোর গাড়ির দিকে হেঁটে যায় এবং তাদের সঙ্গে কথা বলে। এরপর তিনি গাড়িতে ওঠেন এবং তারা গাড়িতে করে চলে যায়!

ঠিক সেই সময় আমার মাসি রাস্তার মোড়ের দিকে হেঁটে আসেন। তখন ইতিমধ্যেই দুপুর হয়ে গিয়েছিল। তিনি নোটটা পড়েন ও মনে করেন যে, নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের সেই বাড়িতে যাওয়া উচিত, এই অনুমান করে যে, ভাইয়েরা আমাকে সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন সেই পরিবার আমাকে হাইনরিখ রাইফ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যাকে আমি চিনতাম না। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমি নিরাপদে বের হয়ে আসতে পেরেছি বলে তিনি আনন্দিত এবং তিনি আমাকে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করতে এসেছেন। তার সঙ্গে এক বনের মধ্যে দেখা করার জন্য তিনি আমাকে আধ ঘন্টা সময় দেন।

নির্বাসিত জীবন

অশ্রু ভরা চোখে আমি ভাই রাইফের সঙ্গে দেখা করি কারণ আমার বাবামাকে ফেলে যাচ্ছি ভেবে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। এই সমস্তকিছুই অত্যন্ত দ্রুত ঘটে। কিছু উদ্বিগ্ন মুহূর্তের পর আমরা একদল পর্যটকের মাঝে ঢুকে পড়ি এবং নিরাপদে সুইস সীমান্ত অতিক্রম করি।

বার্নের শাখা অফিসে পৌঁছে আমি জানতে পারি যে, সেখানকার ভাইবোনেরা আমার পালিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিল। তারা সদয়ভাবে আমাকে থাকার এক জায়গা দেয়। আমি রান্নাঘরে কাজ করি, যা আমি খুবই উপভোগ করতাম। কিন্তু আমার বাবামা, যাদের দুজনকেই দুবছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল তাদের কী হতে চলেছে তা না জেনে নির্বাসনে জীবন কাটানো কতই না কঠিন ছিল! মাঝে মাঝে দুঃখ ও উদ্বিগ্নতায় আমি ভারগ্রস্ত হয়ে পড়তাম আর আমি বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কাঁদতাম। কিন্তু, আমি আমার বাবামার সঙ্গে নিয়মিতভাবে চিঠির দ্বারা যোগাযোগ করতে পারতাম আর তারা আমাকে অনুগত থাকার জন্য উৎসাহ দিত।

আমার বাবামার বিশ্বাসের উদাহরণের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমি যিহোবার কাছে আমার নিজের জীবন উৎসর্গ করে ১৯৩৮ সালের ২৫শে জুলাই বাপ্তিস্ম নিই। বেথেলে এক বছর থাকার পর আমি শানেলা ফার্মে কাজ করতে যাই, যে-ফার্মটা বেথেল পরিবারের জন্য খাবার জোগানোর জন্য এবং তাড়নার কারণে পালিয়ে বেড়ানো ভাইদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সুইস শাখা অফিস ক্রয় করেছিল।

১৯৪০ সালে আমার বাবামার কারাবরণের সময় যখন শেষ হয়, তখন নাৎসিরা তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যদি তারা তাদের বিশ্বাস পরিত্যাগ করে। তারা দৃঢ় থাকে আর এরপর তাদেরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়, বাবাকে ডাকাতে এবং মাকে রেভেন্সব্রুকে। ১৯৪১ সালের শীতকালে আমার মা এবং ক্যাম্পের অন্যান্য সাক্ষি বোনেরা সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতে প্রত্যাখ্যান করে। শাস্তি হিসেবে, তাদেরকে তিন দিন এবং তিন রাত ঠাণ্ডার মধ্য দাঁড় করিয়ে রাখা হয় আর এরপর তাদেরকে অন্ধকার ক্ষুদ্র কক্ষগুলোর মধ্যে বন্দি করে রাখা হয় এবং ৪০ দিন পর্যন্ত না খাইয়ে রাখা হয়। পরে তাদেরকে প্রচণ্ড মারা হয়। প্রচণ্ডভাবে মারার তিন সপ্তাহ পরে, ১৯৪২ সালের ৩১শে জানুয়ারি মা মারা যান।

বাবাকে ডাকা থেকে অস্ট্রিয়ার মাউথাউসেন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এই ক্যাম্পে নাৎসিরা পর্যায়ক্রমে ক্ষুধায় ও কষ্টকর শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলো করানোর মাধ্যমে বন্দিদের হত্যা করত। কিন্তু, মা মারা যাওয়ার ছয় মাস পর, নাৎসিরা এক ভিন্ন পন্থায় বাবাকে হত্যা করে—চিকিৎসাগত গবেষণার মাধ্যমে। ক্যাম্পের ডাক্তাররা ইচ্ছাকৃতভাবে গবেষণায় ইদুর ব্যবহার না করে মানুষকে ব্যবহার করে তাদেরকে যক্ষ্মা রোগের দ্বারা আক্রান্ত করে। এরপর বন্দিদের হৃদপিণ্ডে এক প্রাণনাশক ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। সরকারি রেকর্ড বলে যে, বাবা “এক দুর্বল হার্টের” কারণে মারা গিয়েছে। তার বয়স ছিল ৪৩ বছর। আমি এই নির্মম হত্যাগুলোর কথা কয়েক মাস পরে জানতে পারি। আমার প্রিয় বাবামার স্মৃতি মনে পড়লে এখনো আমার চোখ জলে ভরে ওঠে। কিন্তু তখন ও এখন আমি এটা জেনে সান্ত্বনা পাই যে, মা এবং বাবা যাদের স্বর্গীয় জীবনের আশা রয়েছে তারা যিহোবার কাছে নিরাপদে রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমার নিউ ইয়র্কের ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েড এর ১১তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়। পাঁচ মাস ধরে শাস্ত্র অধ্যয়নে রত থাকা কতই না আনন্দদায়ক ছিল! ১৯৪৮ সালে গ্র্যাজুয়েশনের পর আমাকে সুইজারল্যান্ডে মিশনারি হিসেবে সেবা করতে পাঠানো হয়। এর কিছু দিন পরেই জেমস এল. টারপিন নামে এক বিশ্বস্ত ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়, যিনি গিলিয়েড এর ৫তম ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। তুরস্কে যখন প্রথম শাখা অফিস স্থাপিত হয়, তখন তিনি সেখানকার অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করতেন। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে আমরা বিয়ে করি আর শীঘ্রই আমরা জানতে পারি যে, আমরা বাবামা হতে যাচ্ছি! আমরা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই এবং আমাদের মেয়ে মারলিন ডিসেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করে।

বছরের পর বছর ধরে জিম এবং আমি আমাদের রাজ্য সেবার কাজে অনেক আনন্দ পেয়েছি। আমার এখনও পেনি নামে একজন চাইনিজ যুবতীর কথা মনে পড়ে, যিনি বাইবেল অধ্যয়ন করতে খুবই ভালবাসতেন। তিনি বাপ্তাইজিত হন এবং পরে গায় পিয়ার্সকে বিয়ে করেন, যিনি এখন যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালক গোষ্ঠীতে সেবা করছেন। এই ধরনের প্রিয় ব্যক্তিরা আমাকে আমার বাবামাকে হারানোর শূন্যতা পূরণ করতে সাহায্য করেছিল।

২০০৪ সালের প্রথম দিকে, আমার বাবামার নিজের শহর লুরাকের ভাইয়েরা শিট্‌খ স্ট্রিটে একটা নতুন কিংডম হল নির্মাণ করে। যিহোবার সাক্ষিরা যা করেছে তার স্বীকৃতি হিসেবে, শহরের পরিষদবর্গ আমার বাবামার সম্মানে সেই রাস্তার নাম ডেন্টস শাট্রাসি (ডেন্টস্‌ স্ট্রিট) রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। স্থানীয় সংবাদপত্র বাডিশি সাইটুং “হত্যাকৃত ডেন্টস্‌ দম্পতির স্মরণে: নতুন রাস্তার নাম” এই শিরোনামের নিচে বলেছিল যে, আমার বাবামাকে “তাদের বিশ্বাসের কারণে নাৎসি আমলে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছে।” শহরের পরিষদবর্গের দ্বারা নেওয়া এই পদক্ষেপটা আমার জন্য এক অপ্রত্যাশিত কিন্তু হৃদয়গ্রাহী ঘটনা ছিল।

বাবা সবসময় বলতেন যে, আমাদের আগে থেকে পরিকল্পনা করা উচিত এই ভেবে যে, হর্‌মাগিদোন আমাদের সময়ে আসছে না কিন্তু আমাদের এমনভাবে জীবনযাপন করা উচিত যেন তা আগামীকাল আসছে—এক বহুমূল্য উপদেশ যা আমি সবসময় কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। ভারসাম্যপূর্ণ ধৈর্য এবং আকুল প্রত্যাশা বজায় রাখা সবসময় সহজ নয়, বিশেষ করে বার্ধক্যের মারাত্মক প্রভাবগুলোর কারণে এখন আমাকে ঘরেই বন্দি থাকতে হয়। কিন্তু, বিশ্বস্ত দাসদের কাছে করা যিহোবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমি কখনও সন্দেহ করিনি: “তুমি সমস্ত চিত্তে সদাপ্রভুতে বিশ্বাস [“নির্ভর,” NW] কর; . . . তোমার সমস্ত পথে তাঁহাকে স্বীকার কর; তাহাতে তিনি তোমার পথ সকল সরল করিবেন।”—হিতোপদেশ ৩:৫, ৬.

[২৯ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

অতীতের বহুমূল্য কথাগুলো

১৯৮০-র দশকে একজন মহিলা বেশ দূরের একটা গ্রাম থেকে লুরাকে বেড়াতে আসেন। সেই সময় শহরের লোকেরা সর্বসাধারণের এলাকায় তাদের অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসছিল, যেখানে অন্যেরা সেগুলো ঘেঁটে দেখতে ও চাইলে নিয়ে যেতে পারত। এই মহিলা একটা সেলাইয়ের বাক্স পান এবং সেটা বাড়িতে নিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে, বাক্সের নিচে তিনি এক ছোট্ট মেয়ের কিছু ছবি এবং চিঠি পান, যা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কাগজগুলোতে লেখা। সেই মহিলা চিঠিগুলো পড়ে মুগ্ধ হন এবং বিনুনি করা ছোট্ট মেয়ের পরিচয় নিয়ে ভাবতে থাকেন।

২০০০ সালের একদিন, সেই মহিলা লুরাকে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক প্রদর্শনীর বিষয়ে একটা খবরের কাগজে দেখেন। সেই প্রবন্ধ নাৎসি আমলে যিহোবার সাক্ষিদের ইতিহাস সম্বন্ধে বর্ণনা করে, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল আমাদের পরিবারের বর্ণনাও। সেখানে আমার কিশোরী বয়সের কিছু ছবি ছিল। সবকিছু মিলিয়ে দেখে সেই মহিলা সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাকে চিঠিগুলো—সব মিলিয়ে ৪২টা—সম্বন্ধে বলেন! কয়েক সপ্তাহ পরে সেগুলো আমি হাতে পাই। আমার বাবামার হাতে লেখা চিঠিগুলোতে, অনবরত মাসির কাছে আমার সম্বন্ধে তাদের খবরাখবর নেওয়ার বিষয়গুলো ছিল। আমার জন্য তাদের প্রেমময় চিন্তা কখনও শেষ হয়নি। এটা এক আশ্চর্যের বিষয় যে, এই চিঠিগুলো সুরক্ষিত আছে এবং ৬০ বছরেরও বেশি সময় পর আবারও পাওয়া গিয়েছে!

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

আমাদের সুখী পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যখন হিটলার ক্ষমতায় আসেন

[সৌজন্যে]

হিটলার: U.S. Army photo

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১. ম্যাগডেবার্গ অফিস

২. গেসটাপো হাজার হাজার সাক্ষিকে গ্রেপ্তার করে

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

জিম এবং আমি আমাদের রাজ্যের সেবায় প্রচুর আনন্দ খুঁজে পেয়েছি