সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমরা যিহোবার ওপর পূর্ণরূপে নির্ভর করতে শিখেছিলাম

আমরা যিহোবার ওপর পূর্ণরূপে নির্ভর করতে শিখেছিলাম

জীবন কাহিনী

আমরা যিহোবার ওপর পূর্ণরূপে নির্ভর করতে শিখেছিলাম

বলেছেন নাট্‌লি হলটর্ফ

সময়টা ছিল ১৯৪৫ সালের জুন মাস। সেই মাসের কোনো একদিন একজন দুর্বল ফ্যাকাশে ব্যক্তি আমাদের বাড়িতে হাজির হন এবং শান্তভাবে বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। আমার ছোট মেয়ে রূৎ কিছুটা অবাক হয়ে চিৎকার করে বলে উঠেছিল: “মা, দেখো দরজায় এক অপরিচিত লোক এসেছেন!” সে জানত না যে, সেই অপরিচিত ব্যক্তিটি ছিল তারই বাবা—আমার প্রিয় স্বামী, ফারডিনান্ট। দুই বছর আগে, রূতের জন্মের মাত্র তিনদিন পর ফারডিনান্ট ঘর ত্যাগ করেছিল কারণ তাকে গ্রেফতার করে শেষ পর্যন্ত নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর রূৎ তার বাবাকে দেখেছিল আর আমাদের পরিবার পুনরায় একত্রিত হয়েছিল। ফারডিনান্ট এবং আমার মধ্যে পরস্পরকে বলার মতো অনেক কথাই জমে ছিল!

 ফারডিনান্টের জন্ম হয় ১৯০৯ সালে জার্মানির কিল শহরে আর আমার জন্ম হয় ১৯০৭ সালে জার্মানির ড্রেজডেন শহরে। আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন আমাদের পরিবারের সঙ্গে প্রথম বাইবেল ছাত্রদের সাক্ষাৎ হয়, যিহোবার সাক্ষিরা তখন এই নামেই পরিচিত ছিল। আর আমার বয়স যখন ১৯ বছর, তখন আমি ইভানজেলিক্যাল গির্জা পরিত্যাগ করি এবং আমার জীবন যিহোবার কাছে উৎসর্গ করি।

অন্যদিকে, ফারডিনান্ট নৌচালনার কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে একজন নাবিক হয়ে ওঠে। সমুদ্রযাত্রার সময়গুলোতে সে একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন সম্বন্ধে চিন্তা করেছিল। সমুদ্রযাত্রা থেকে ফিরে এসে ফারডিনান্ট তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, যিনি একজন বাইবেল ছাত্র ছিলেন। যে-প্রশ্নগুলো তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল, সেগুলোর উত্তর যে বাইবেলেই রয়েছে সেই বিষয়ে তাকে দৃঢ়প্রত্যয়ী করার জন্য এই সাক্ষাৎই যথেষ্ট ছিল। সে লুথারিয়ান গির্জা পরিত্যাগ করেছিল আর নাবিকের কাজ ছেড়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রথম দিন প্রচার করার পর, সে তার বাকি জীবনে এই কাজ করার গভীর আকাঙ্ক্ষা বোধ করেছিল। সেই রাতেই ফারডিনান্ট নিজেকে যিহোবার কাছে উৎসর্গ করেছিল। সে ১৯৩১ সালের আগস্ট মাসে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল।

একজন নাবিক এবং এক প্রচারক

প্রচার কাজে সহযোগিতা করার জন্য ফারডিনান্ট ১৯৩১ সালের নভেম্বর মাসে ট্রেনে করে নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশে রওনা হয়। যে-ভাই সেই দেশের কাজকে সংগঠিত করেছিলেন তাকে ফারডিনান্ট যখন বলে যে সে একজন নাবিক ছিল, তখন সেই ভাই বিস্ময়ে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন: “আপনাকেই তো আমাদের দরকার!” ভাইয়েরা একটা নৌকা ভাড়া করেছিল, যাতে অগ্রগামীদের (পূর্ণসময়ের পরিচারকদের) একটা দল সেই লোকেদের কাছে প্রচার করতে পারে, যারা দেশের উত্তরাংশের জলপথের তীরবর্তী জায়গাগুলোতে বাস করে। সেই নৌকায় পাঁচ জনের এক চালকদল ছিল কিন্তু তাদের কেউই পাল তুলে এটা চালাতে পারত না। তাই ফারডিনান্টকে নৌকার প্রধান চালক হতে হয়েছিল।

ছয় মাস পরেই ফারডিনান্টকে দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসের টিলবার্গে একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য বলা হয়। সেই সময়ে একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য আমিও টিলবার্গে আসি এবং ফারডিনান্টের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। কিন্তু, ঠিক সেই সময়ই আমাদেরকে দেশের উত্তরাংশের গ্রোনিনগেনে যাওয়ার জন্য বলা হয়। সেখানে আমরা ১৯৩২ সালের অক্টোবর মাসে বিয়ে করি এবং বিভিন্ন অগ্রগামীদের দ্বারা ব্যবহৃত একটা বাড়িতে মধুচন্দ্রিমা যাপন করি আর একই সঙ্গে অগ্রগামীর কাজও করে চলি!

১৯৩৫ সালে আমাদের মেয়ে এস্টা জন্মগ্রহণ করে। যদিও আমাদের উপার্জন সীমিত ছিল, তবুও আমরা অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। আমরা একটা গ্রামে চলে গিয়েছিলাম, যেখানে আমরা একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকতাম। যখন আমি ঘরে বাচ্চার যত্ন নিতাম, তখন আমার স্বামী পরিচর্যায় দিনের দীর্ঘ সময় ব্যয় করত। পরের দিন আমরা আমাদের কাজ পরিবর্তন করতাম। এস্টা আমাদের সঙ্গে পরিচর্যায় বের হওয়ার মতো যথেষ্ট বড় না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই চলেছিল।

এর অল্প কিছুদিন পরই ইউরোপের রাজনৈতিক দিগন্তে অশুভ মেঘ পুঞ্জীভূত হয়। আমরা জার্মানিতে সাক্ষিদের তাড়নার বিষয়ে জেনেছিলাম আর বুঝতে পেরেছিলাম যে, শীঘ্রই আমাদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটবে। কীভাবে আমরা প্রচণ্ড তাড়না সহ্য করব, সেই বিষয়ে আমরা চিন্তিত হয়েছিলাম। ১৯৩৮ সালে ডাচ কর্তৃপক্ষ একটা আদেশ জারি করে ধর্মীয় প্রকাশনাদি বিতরণের মাধ্যমে বিদেশিদেরকে ধর্মপুস্তক বিক্রির কাজ নিষেধ করে। আমাদের পরিচর্যা নিয়মিত চালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্য ডাচ সাক্ষিরা আমাদেরকে সেই লোকেদের নামগুলো দিয়েছিল, যারা আমাদের কাজের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল আর আমরা তাদের কয়েক জনের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করতে পেরেছিলাম।

সেই সময়ে যিহোবার সাক্ষিদের একটা সম্মেলন এগিয়ে আসছিল। যদিও সম্মেলনস্থলে যাওয়ার মতো ট্রেনের টিকেট কেনার টাকা আমাদের ছিল না, তবুও আমরা সেখানে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলাম। তাই আমরা ছোট্ট এস্টাকে সাইকেলের হাতলের সিটে বসিয়ে তাকে নিয়ে তিন দিনের পথ যাত্রা শুরু করেছিলাম। যাত্রার সময়ের রাতগুলো আমরা পথের পাশে যে-সাক্ষিরা থাকত, তাদের সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। আমাদের প্রথম জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত থেকে আমরা কতই না আনন্দিত হয়েছি! সম্মেলনের কার্যক্রম আমাদের আসন্ন পরীক্ষাগুলোর জন্য শক্তিশালী করেছিল। সর্বোপরি, আমাদেরকে ঈশ্বরের ওপর আস্থা রাখার বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গীতসংহিতা ৩১:৬ পদের কথাগুলো আমাদের আদর্শবাণী হয়ে উঠেছিল: “আমি সদাপ্রভুতে [“যিহোবাতে,” NW] নির্ভর করি।”

নাৎসিদের শিকার

১৯৪০ সালের মে মাসে নাৎসিরা নেদারল্যান্ডস আক্রমণ করে। এর অল্প সময় পরেই গেস্টাপো বা গুপ্ত পুলিশ অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের ঘরে হানা দেয় যখন আমরা জাহাজে আসা বাইবেল সাহিত্যাদি বাছাই করছিলাম। ফারডিনান্টকে গেস্টাপো হেডকোয়াটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি আর এস্টা নিয়মিত তার সঙ্গে সেখানে দেখা করতাম আর কখনও কখনও আমাদের সামনেই তাকে জেরা ও প্রহার করা হতো। ডিসেম্বর মাসে হঠাৎ করেই ফারডিনান্টকে মুক্তি দেওয়া হয় কিন্তু তার স্বাধীনতা ছিল সীমিত সময়ের জন্য। এক সন্ধ্যায় আমরা ঘরে ফিরে এসে দেখতে পাই, বাড়ির সামনে গেস্টাপোদের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি এবং এস্টা ঘরে প্রবেশ করার সময় ফারডিনান্ট পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। গেস্টাপো আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারা ফারডিনান্টকে চেয়েছিল। গেস্টাপো চলে যাওয়ার পর সেই রাতেই ডাচ পুলিশ আসে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আমাকে নিয়ে যায়। পরের দিন আমি এবং এস্টা এক নতুন বাপ্তাইজিত দম্পতি, নরডার পরিবারে লুকিয়ে থাকার জন্য চলে যাই, যারা আমাদের আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছিল।

১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এক অগ্রগামী দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়, যারা বসবাসের উপযোগী নৌকায় থাকত। পরদিন একজন সীমা অধ্যক্ষ (ভ্রমণ পরিচারক) এবং আমার স্বামী সেই দম্পতিদের কিছু জিনিসপত্র আনার জন্য সেই নৌকায় গিয়েছিল কিন্তু গেস্টাপোর সহকারীরা তাদেরকে ধরে ফেলে। ফারডিনান্ট কৌশলে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হয় এবং তার সাইকেলে করে পালিয়ে যায়। কিন্তু, সীমা অধ্যক্ষকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।

দায়িত্বশীল ভাইয়েরা ফারডিনান্টকে সেই সীমা অধ্যক্ষের কাজের দায়িত্ব নিতে বলে। এর মানে ছিল সে এক মাসের মধ্যে তিন দিনের বেশি ঘরে আসতে পারবে না। এটা আমাদের জন্য এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল কিন্তু তারপরও আমি অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম। গেস্টাপো সাক্ষিদের খোঁজার কাজ আরও বৃদ্ধি করেছিল, তাই আমাদের সবসময়ই থাকার জায়গা বদল করতে হতো। ১৯৪২ সালেই আমরা তিনবার জায়গা বদল করি। শেষে আমরা রোটার্ডাম শহরে আসি, যেটা ফারডিনান্ট যেখানে গোপন পরিচর্যা কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল, সেখান থেকে অনেক দূরে ছিল। সেই সময়ের মধ্যে আমি দ্বিতীয় বারের মতো মা হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। ক্যাম্প পরিবার আমাদেরকে দয়া দেখিয়ে তাদের ঘরে থাকতে দিয়েছিল, যাদের দুই ছেলেকে সেই সময়ে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

গেস্টাপো আমাদের পিছনে আঠার মতো লেগেছিল

১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান রূতের জন্ম হয়। রূতের জন্মের পর ফারডিনান্ট তিন দিনের জন্য আমাদের সঙ্গে থাকতে পেরেছিল কিন্তু এরপর তাকে চলে যেতে হয়েছিল আর দীর্ঘ সময় ধরে সেটাই ছিল তার সঙ্গে আমাদের শেষ দেখা। এর তিন সপ্তাহ পরেই আমস্টারডামে ফারডিনান্টকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে গেস্টাপো স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তার পরিচিতি নিশ্চিত করা হয়। গেস্টাপো আমাদের প্রচার কাজের বিষয়ে জোরপূর্বক তথ্য আদায়ের উদ্দেশ্যে তাকে তীব্রভাবে জেরা করে। কিন্তু ফারডিনান্ট স্বেচ্ছায় যা প্রকাশ করেছিল তা হল, সে একজন যিহোবার সাক্ষি আর সে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়। গেস্টাপো কর্মকর্তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল যে, ফারডিনান্ট একজন জার্মান নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর কাজের জন্য রিপোর্ট করেনি আর তারা তাকে একজন রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।

পরের পাঁচ মাস ফারডিনান্টকে একটা কারাকক্ষে রাখা হয়েছিল, যেখানে সে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের হুমকি সহ্য করেছিল। তারপরও সে যিহোবার প্রতি তার আনুগত্যে অটল ছিল। কী তাকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী থাকতে সাহায্য করেছিল? ঈশ্বরের বাক্য বাইবেল। অবশ্য একজন সাক্ষি হিসেবে ফারডিনান্টকে বাইবেল রাখার অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু, অন্য বন্দিরা একটি কপির জন্য আবেদন করতে পারত। তাই ফারডিনান্ট তার কারাকক্ষের সঙ্গীকে রাজি করিয়েছিল, যাতে তার পরিবারকে একটা বাইবেল পাঠাতে বলেন আর লোকটি তা করেছিলেন। অনেক বছর পর, যখনই ফারডিনান্ট এই ঘটনাটা বলত, তখন তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠত আর সে বিস্ময়ে বলে উঠত: “বাইবেল আমাকে কতই না সান্ত্বনা দিয়েছিল!”

১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে, হঠাৎ করেই ফারডিনান্টকে নেদারল্যান্ডসের ভুয়েখ্‌ট কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। অপ্রত্যাশিতভাবেই এই স্থানান্তর তার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ হয় কারণ সেখানে সে আরও ৪৬ জন সাক্ষির সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। আমি তার নতুন জায়গা সম্বন্ধে শুনেছিলাম আর তখনও সে বেঁচে আছে শুনে খুবই খুশি হয়েছিলাম!

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ক্ষান্ত না হয়ে প্রচার করা

ক্যাম্পের মধ্যে জীবন খুবই কঠিন ছিল। চরম অপুষ্টি, শীতবস্ত্রের অভাব এবং কনকনে ঠাণ্ডা ছিল স্বাভাবিক বিষয়। ফারডিনান্ট গুরুতরভাবে টনিসলে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে নাম ডাকা হলে পর, ফারডিনান্ট অসুস্থ ব্যক্তিদের রাখার স্থানে থাকার জন্য আবেদন করে। যেসব রোগীর ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা এর চেয়ে বেশি জ্বর ছিল, তাদেরকে সেখানে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ফারডিনান্টকে সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি কারণ তার শরীরে তাপমাত্রা ছিল ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট! তাকে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু, সহানুভূতিশীল সহবন্দিরা তাকে একটা উষ্ণ জায়গায় স্বল্প সময় লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করেছিল। পরে আবহাওয়া ধীরে ধীরে উষ্ণ হওয়ায় তা স্বস্তিদায়ক হয়েছিল। এ ছাড়া, যখন কিছু ভাইয়েরা খাবারের প্যাকেট পেয়েছিল, তখন তারা সেই খাবার অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিত, ফলে ফারডিনান্ট তার শক্তি কিছুটা ফিরে পেয়েছিল।

আমার স্বামী বন্দি হওয়ার আগে, প্রচার কাজ ছিল তার জীবনের অঙ্গ আর ক্যাম্পের ভিতরেও সে অন্যদের কাছে তার বিশ্বাস সম্বন্ধে বলা অব্যাহত রেখেছিল। ক্যাম্পের কর্মকর্তারা প্রায়ই তার বেগুনি ত্রিভুজ চিহ্নের বিষয়ে বিদ্রূপসূচক মন্তব্য করেছিল, যে-চিহ্ন একজন বন্দিকে সাক্ষি হিসেবে শনাক্ত করেছিল। কিন্তু ফারডিনান্ট এই ধরনের মন্তব্যকে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করার এক সুযোগ হিসেবে দেখেছিল। প্রথম দিকে, ভাইদের প্রচারের এলাকা ছিল সৈন্যদের ব্যারাকের সীমার মধ্যে, যা মূলত সাক্ষিদেরই ঘর ছিল। তাই ভাইয়েরা নিজেদের জিজ্ঞেস করেছিল যে, ‘আমরা কীভাবে আরও বেশি বন্দিদের কাছে পৌঁছাতে পারি?’ ক্যাম্পের পরিচালকবর্গ নিজেদের অজান্তেই এক সমাধান দিয়েছিল। কীভাবে?

ভাইদের কাছে গোপনে বাইবেল সাহিত্যাদি আসত এবং ১২টি বাইবেলও ছিল। একদিন নিরাপত্তারক্ষীরা কিছু সাহিত্যাদি খুঁজে পায় কিন্তু এগুলো কাদের সেটা তারা খুঁজে পায়নি। তাই ক্যাম্পের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, যিহোবার সাক্ষিদের একতাকে ভেঙে ফেলতে হবে। অতএব, শাস্তি হিসেবে সব ভাইকে ন-সাক্ষিদের নতুন ব্যারাকগুলোতে রাখা হয়। এ ছাড়া, খাবারের সময়ে ভাইদের ন-সাক্ষিদের পাশে বসতে হয়েছিল। এই ব্যবস্থা এক আশীর্বাদ প্রমাণিত হয়েছিল। ভাইয়েরা প্রথমেই যা করতে চেয়েছিল, তা তখন করতে পেরেছিল—আশেপাশের যত জনের কাছে সম্ভব প্রচার করা।

একা একা দুই মেয়েকে মানুষ করা

এই সময়ের মধ্যে আমার দুই মেয়ে এবং আমি রোটার্ডামেই বাস করছিলাম। ১৯৪৩/৪৪ সালের শীতকাল অপ্রতাশিতভাবে তীব্র ছিল। শত্রুবিমান ভূপাতিত করার জন্য আমাদের বাড়ির একবারে পিছনেই জার্মান সৈন্যদের এক গোলন্দাজ বাহিনী ছিল। আমাদের একেবারে সামনেই ভাল্‌ পোতাশ্রয় ছিল, যেটা যৌথবাহিনীর বোমা নিক্ষেপকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল। তাই সত্যিকার অর্থে লুকিয়ে থাকার জন্য জায়গাটা নিরাপদ ছিল না। এ ছাড়া, খাবারও ছিল দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু, আগের চেয়ে এখন আমরা আরও বেশি যিহোবার ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস বা নির্ভর করতে শিখেছিলাম।—হিতোপদেশ ৩:৫, ৬.

আট বছরের এস্টা সুপ ও রুটি সংগ্রহের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের ছোট্ট পরিবারকে সাহায্য করত। কিন্তু প্রায়ই খাবার সংগ্রহের জন্য যখন তার পালা আসত, তখন আর কোনো খাবারই অবশিষ্ট থাকত না। একবার এভাবে খাবার সংগ্রহ করার সময় সে বিমান আক্রমণের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। বিস্ফোরণের শব্দে আমি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু শীঘ্রই আমার উদ্বেগ আনন্দাশ্রুতে পরিণত হয়েছিল, যখন এস্টা অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছিল আর সেই অবস্থায়ও সে কিছু বিট নিয়ে এসেছিল। “কী হয়েছে?” এটাই ছিল আমার প্রথম কথা। শান্তভাবে সে উত্তর দিয়েছিল: “বোমাগুলো যখন পড়েছিল, তখন আমি ঠিক তা-ই করেছিলাম যা বাবা আমাকে করতে বলেছিলেন, ‘মাটিতে শুয়ে পড়বে, সেখানে শুয়ে থাকবে এবং প্রার্থনা করবে।’ আর তা সত্যিই কাজে লেগেছিল!”

আমার ভাষায় জার্মান বাচনভঙ্গি থাকার কারণে এস্টা যে ছোটখাটো কেনাকাটা করতে পারত, তা আরও নিরাপদ ছিল। কিন্তু এটা জার্মান সৈন্যদের মনোযোগ এড়ায়নি, তারা এস্টাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। কিন্তু সে কোনো গোপন তথ্য ফাঁস করেনি। ঘরে, আমি এস্টাকে বাইবেল শিক্ষা দিয়েছিলাম আর যেহেতু সে স্কুলে যেতে পারেনি, তাই আমি তাকে পড়তে, লিখতে এবং অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ হতে শিখিয়েছিলাম।

এ ছাড়া, এস্টা আমাকে পরিচর্যায়ও সাহায্য করেছিল। আমি কারও সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করাতে যাওয়ার আগে, এস্টা আমার আগে আগে যেত এটা দেখতে যে, কেউ আমাদের লক্ষ করছে কি না। সে যাচাই করত যে, বাইবেল ছাত্রদের যে-সংকেতচিহ্নগুলোর সঙ্গে আমি একমত হয়েছিলাম, সেগুলো সত্যিই সেখানে আছে কি না। উদাহরণস্বরূপ, যে-ব্যক্তির সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ করতে যেতাম তিনি আগে থেকেই জানালার নির্দিষ্ট স্থানে একটা ফুলদানি রেখে দিতেন, যা আমাকে বুঝতে সাহায্য করত যে আমি ভিতরে আসতে পারি। বাইবেল অধ্যয়ন চলাকালীন কোনো বিপদের লক্ষণ আছে কি না, তা দেখার জন্য এস্টা ঘরের বাইরে থাকত আর সেই সময় সে ছোট্ট রূৎকে বহনকারী গাড়িটা ঠেলে রাস্তার এপাশে ওপাশে নিয়ে যেত।

জাক্‌সেনহোজেনে

ফারডিনান্টের অবস্থা কেমন ছিল? ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাকে এবং আরও অনেককে একটা রেল স্টেশনের দিকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ৮০ জন করে বন্দিকে অপেক্ষারত বক্সকারগুলোতে জোর করে ঢোকানো হয়েছিল। প্রত্যেকটা কারে শৌচাগারের জন্য একটা বালতি ছিল ও পানীয় জলের জন্য একটা বালতি ছিল। এই ভ্রমণ শেষ হয়েছিল তিন দিন ও তিন রাত পর আর সেখানে কেবলমাত্র দাঁড়িয়ে থাকার মতো জায়গা ছিল! বাতাস চলাচলের কোনো ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। বক্সকারগুলোর এখানে সেখানে সামান্য উঁকি দেওয়ার মতো ছিদ্র ছাড়া চারিদিকটাই বন্ধ ছিল। তাদেরকে গরম, ক্ষুধা এবং পিপাসা—আর বলাই বাহুল্য দুর্গন্ধ—সহ্য করতে হয়েছিল, যা বর্ণনাতীত।

সেই ট্রেন কুখ্যাত জাক্‌সেনহোজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে এসে থেমেছিল। সমস্ত বন্দি তাদের কাছে থাকা ব্যক্তিগত জিনিসপত্র থেকে বঞ্চিত হয়েছিল—শুধুমাত্র ১২টি ছোট বাইবেল ছাড়া, যা সাক্ষিরা তাদের ভ্রমণে সঙ্গে এনেছিল!

ফারডিনান্টসহ আরও আট জন ভাইকে যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনের কাজ করার জন্য রাটেনো শহরের স্যাটেলাইট ক্যাম্পে পাঠানো হয়। যদিও তাদেরকে প্রায়ই মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেওয়া হয়েছিল, তবুও ভাইয়েরা এই ধরনের কাজ করতে প্রত্যাখ্যান করে। পরস্পরকে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে উৎসাহিত করার জন্য সকালবেলা তারা বাইবেল থেকে একটা পদ আলোচনা করত যেমন গীতসংহিতা ১৮:২ পদ, যাতে দিনভর তারা এই পদটির ওপর ধ্যান করতে পারে। এটা তাদের আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো ধ্যান করতে সাহায্য করেছিল।

অবশেষে, গোলন্দাজ বাহিনী ঘোষণা করেছিল যে, মিত্র বাহিনী ও রাশিয়ান সেনারা এগিয়ে আসছে। ফারডিনান্ট এবং তার সঙ্গীরা যে-ক্যাম্পে ছিল সেখানেই রাশিয়ানরা প্রথমে উপস্থিত হয়। তারা বন্দিদের কিছু খাবার দিয়েছিল এবং ক্যাম্প ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিল। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে রাশিয়ার সেনাবাহিনী তাদেরকে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল।

অবশেষে পরিবারগতভাবে একসঙ্গে

জুন মাসের ১৫ তারিখে ফারডিনান্ট নেদারল্যান্ডসে এসে পৌঁছায়। গ্রোনিনগেনের ভাইয়েরা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। সে শীঘ্রই জানতে পারে যে আমরা বেঁচে আছি এবং দেশের কোনো এক জায়গায় বাস করছি আর আমরা শুধু এইটুকুই জানতে পারি যে সে ফিরে এসেছে। তার জন্য অপেক্ষার পালাকে দীর্ঘ মনে হয়েছিল। কিন্তু, অবশেষে একদিন ছোট্ট রূৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠেছিল: “মা দেখো, দরজায় এক অপরিচিত লোক এসেছেন!” সে ছিল আমার প্রিয় স্বামী আর তাদের বাবা!

আবার স্বাভাবিকভাবে এক পরিবার হিসেবে থাকার আগে আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করা দরকার ছিল। আমাদের থাকার কোনো জায়গা ছিল না আর সবচেয়ে প্রধান সমস্যা ছিল নেদারল্যান্ডসে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে আমাদের নাগরিকত্ব পুনরাধিকার করা। যেহেতু আমরা ছিলাম জার্মানির, তাই ডাচ কর্মকর্তারা বেশ কয়েক বছর আমাদেরকে সমাজ থেকে বহিষ্কৃত ব্যক্তি হিসেবে দেখেছিল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত আমরা স্থায়ী হয়েছিলাম এবং সেই জীবন আবার শুরু করেছিলাম, যেজন্য বহুদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম—পরিবারগতভাবে একসঙ্গে যিহোবাকে সেবা করা।

“আমি যিহোবাতে নির্ভর করি”

পরবর্তী বছরগুলোতে ফারডিনান্ট ও আমি যখনই সেইসব বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়েছি যারা আমাদের মতোই সেই কষ্টের দিনগুলো সহ্য করেছিল, তখন আমরা ওই কঠিন সময়গুলোতে যিহোবার প্রেমপূর্ণ পরিচালনার বিষয়ে স্মরণ করেছি। (গীতসংহিতা ৭:১) আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম যে, যিহোবা বছরের পর বছর ধরে আমাদেরকে রাজ্যের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দিয়েছেন। এ ছাড়া, আমরা প্রায়ই বলেছি যে, আমরা আমাদের যৌবনকে যিহোবার পবিত্র সেবায় ব্যবহার করেছি বলে কতই না সুখী।—উপদেশক ১২:১.

নাৎসিদের তাড়নার দিনগুলোর পর, ১৯৯৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর ফারডিনান্ট তার পার্থিব জীবন শেষ করার আগে, সে এবং আমি ৫০ বছরের বেশি সময় একসঙ্গে যিহোবাকে সেবা করেছি। শীঘ্রই আমার বয়স ৯৮ হতে চলেছে। প্রতিদিন আমি যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই যে আমাদের সন্তানরা সেই কষ্টকর বছরগুলোতে যথেষ্ট সমর্থন জুগিয়েছিল আর তাই আমি এখনও তাঁর নামের গৌরবার্থে তাঁর সেবায় যতটুকু সম্ভব তা করছি। যিহোবা আমার জন্য যা কিছু করেছেন, সেটার জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ আর আমার হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা এই যে, আমি যেন সবসময় এই আদর্শবাণী অনুযায়ী চলি: “আমি যিহোবাতে নির্ভর করি।”—গীতসংহিতা ৩১:৬.

[১৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৩২ সালের অক্টোবরে ফারডিনান্টের সঙ্গে

[১৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

চালকসহ সুসমাচার প্রচারের নৌকা “আলিমিনা”

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]

ফারডিনান্ট এবং সন্তানদের সঙ্গে