জ্যোতিষীগণ এবং বাইবেল
জ্যোতিষীগণ এবং বাইবেল
বাইবেল প্রায়ই জ্যোতিষীদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে উল্লেখ করে। উদাহরণস্বরূপ, সা.কা.পূ. অষ্টম শতাব্দীতে ভাববাদী যিশাইয় দণ্ডপ্রাপ্ত নগরের তারা নিরীক্ষণকারী জ্যোতির্বিদ্যার মন্ত্রণাকারীদের সেই নগরকে রক্ষা করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান জানিয়েছিলেন: “তুমি [বাবিল] আপনার অনেক মন্ত্রণায় ক্লান্ত হইয়াছ; তবে জ্যোতিষীরা, নক্ষত্রদর্শীরা, মাসদৈবজ্ঞেরা উঠিয়া দাঁড়াউক, তোমার প্রতি যাহা যাহা ঘটিবে, তাহা হইতে তোমাকে নিস্তার করুক।”—যিশাইয় ৪৭:১৩.
কিন্তু, ইব্রীয় শাস্ত্রপদগুলোতে ‘জ্যোতিষী’ হিসেবে অনুবাদিত গ্যাজেরিন শব্দটি কেবল দানিয়েল বইয়ের সেই অংশে পাওয়া যায়, যা অরামীয় ভাষায় লেখা হয়েছে। (দানিয়েল ২:৪খ–৭:২৮) এর মূল অর্থ হচ্ছে “ভাগ করা” আর এই উল্লেখিত তথ্যটি সেই ব্যক্তিদের নির্দেশ করে বলে মনে করা হয়, যারা গ্রহগুলোর আপেক্ষিক অবস্থান অনুযায়ী আকাশমণ্ডলকে বিভক্ত করে। জ্যোতির্বিদ্যার এই দলটি সেই সমস্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত, “যারা বিভিন্ন গণনা এবং ভবিষ্যৎ কথনের মাধ্যমে জন্মের মুহূর্তে তারাগুলোর অবস্থান থেকে . . . ব্যক্তিবিশেষের ভাগ্য নির্ধারণ করে।” (গেসেনিয়াসের রচিত ইব্রীয় এবং কলদীয় শব্দকোষ, ইংরেজি, ১৬৬, ১৬৭) জ্যোতির্বিদ্যা মূলত বহুদেববাদী; এর উৎপত্তি সম্ভবত দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার উপত্যকায়, জলপ্লাবনের কিছু সময় পরে হয়েছিল, যে-সময়ে মানুষ যিহোবার শুদ্ধ উপাসনা থেকে সরে গিয়েছিল। পরে, সময়ের ধারায় কলদীয় নামটি মূলত “জ্যোতিষী” শব্দের সমার্থ শব্দ হয়ে উঠেছিল।
জ্যোতির্বিদ্যার এই মিথ্যা বিজ্ঞানে, আকাশমণ্ডলের প্রতিটা বিভাগে ভিন্ন ভিন্ন দেবতা শাসন করে বলে মনে করা হতো। প্রতিটা গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি এবং বিস্ময়কর ঘটনা যেমন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত, বিষুব ও অয়নান্ত, চন্দ্রকলা, গ্রহণ এবং উল্কা, এই দেবতাদের কাজ বলে মনে করা হতো। তাই নিখিলবিশ্বের এই গতিবিধিকে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করে সেই ঘটানাগুলোর বিভিন্ন রেখাচিত্র এবং ছক তৈরি করা হতো আর এগুলো দেখে মানুষের ভাগ্য ও পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনা সম্বন্ধে আগেই বলে দেওয়া হতো। জনসাধারণ এবং ব্যক্তিবিশেষ সকলে সমস্তকিছু আকাশমণ্ডলের এই দেবতারা নিয়ন্ত্রণ করে বলে মনে করত। এর ফলে, পূর্বলক্ষণগুলো পড়ে ও সেগুলো ব্যাখ্যা করে পরামর্শ দেওয়ার জন্য যতক্ষণ না জ্যোতিষীদের ডাকা হতো ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক বা সামরিক ব্যাপারে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হতো না। এভাবেই পুরোহিত শ্রেণী লোকেদের জীবনে প্রচণ্ড ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাদের অতিপ্রাকৃত শক্তি, অন্তর্দৃষ্টি এবং প্রচুর প্রজ্ঞা ছিল বলে তারা দাবি করত। বাবিলীয়দের মধ্যে এমন কোনো বিশাল মন্দির বাদ ছিল না যেখানে তাদের নিজস্ব মানমন্দির নেই।
কালক্রমে, দানিয়েল এবং তার তিন বন্ধু জ্যোতিষীদের এই দেশে বন্দি হয়। বাবিল-রাজ দেখেছিলেন যে, এই ইব্রীয় ব্যক্তিরা “তাঁহার সমগ্র রাজ্যস্থ সমুদয় মন্ত্রবেত্তা ও গণক হইতে . . . দশগুণ অধিক বিজ্ঞ।” (দানিয়েল ১:২০) তাই, এরপর থেকে দানিয়েলকে “মন্ত্রবেত্তাগণের অধ্যক্ষ” বলে ডাকা হতো (দানিয়েল ৪:৯) কিন্তু তিনি কখনও তারা নিরীক্ষণকারী, ‘আকাশমণ্ডলের বিভক্তকারী’ হওয়ার জন্য যিহোবার উপাসনা করা ছেড়ে দেননি। জ্যোতিষী এবং বাকি ‘বিদ্বান্ লোকেরা’ যখন নবূখদ্নিৎসরকে তার স্বপ্ন ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল, তখন দানিয়েলকে রাজার সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল আর তাকে তিনি বলেছিলেন: “ঈশ্বর স্বর্গে আছেন, তিনি নিগূঢ় বিষয় প্রকাশ করেন” কিন্তু “আমার সম্বন্ধে ইহা বক্তব্য, অন্য কোন জীবিত লোক অপেক্ষা আমার অধিক জ্ঞান আছে বলিয়া যে আমার কাছে এই নিগূঢ় বিষয় প্রকাশিত হইল তাহা নয়।”—দানিয়েল ২:২৮, ৩০.
মোলক এবং ইস্রায়েলে জ্যোতির্বিদ্যা
কখনো কখনো ষাঁড়ের মাথা দ্বারা চিত্রিত মোলক দেবতার উপাসনার সঙ্গে যে জ্যোতির্বিদ্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল, সেই বিষয়ে প্রমাণ রয়েছে। বাবিলীয়, কনানীয়, মিশরীয় এবং অন্যেরা তাদের দেবতাদের—মার্দুক, মোলক, বাল ও ইত্যাদির—প্রতীক হিসেবে ষাঁড়ের উপাসনা করত। রাশিচক্রে, বৃষ রাশির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা চিহ্ন হল ষাঁড়। সূর্যদেবতাকে প্রায়ই ষাঁড় দ্বারা চিত্রিত করা হতো, যার শিঙ রশ্মিকে এবং ষাঁড়ের পুনরুৎপাদনের শক্তিশালী ক্ষমতা, “জীবনদাতা” হিসেবে সূর্যের ক্ষমতাকে চিত্রিত করত। গাভীকে ইশ্টার অথবা আ্যসটার্টির, যাকে এইরকম বিভিন্ন নামে ডাকা হতো, তার প্রতীক হিসেবে সমরূপ সম্মান দেওয়া হতো। তাই হারোণ এবং যারবিয়াম যখন ইস্রায়েলের মধ্যে এই ধরনের ষাঁড়ের উপাসনা (বাছুরের উপাসনা) শুরু করেছিল, তখন তা নিঃসন্দেহে যিহোবার চোখে মহাপাপ ছিল।—যাত্রাপুস্তক ৩২:৪, ৮; দ্বিতীয় বিবরণ ৯:১৬; ১ রাজাবলি ১২:২৮-৩০; ২ রাজাবলি ১০:২৯.
২ রাজাবলি ১৬:৩, ৪; ২১:৩, ৬; ২ বংশাবলি ২৮:৩, ৪; ৩৩:৩, ৬) কিন্তু, ভাল রাজা যোশিয় সেই সমস্ত ‘পুরোহিতদের নিবৃত্ত করিলেন,’ যারা “বালের, সূর্য্যের ও চন্দ্রের এবং গ্রহগণের ও আকাশের সমস্ত বাহিনীর উদ্দেশে ধূপ জ্বালাইত।”—২ রাজাবলি ২৩:৫, ১০, ২৪.
ইস্রায়েলের ধর্মভ্রষ্ট দশ বংশের রাজ্যকে এই জ্যোতির্বিদ্যার দলটিতে যুক্ত হওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল এবং দুই বংশের রাজ্যের দক্ষিণে দুষ্ট রাজা আহস ও তার নাতি মনঃশি তারাগণের দেবতাদের উপাসনা করায় নেতৃত্ব নিয়েছিল এবং নিষ্ঠুরভাবে তাদের সন্তানদের জীবন্ত বলি হিসেবে উৎসর্গ করেছিল। (মোলকের উপাসনা, বাছুর উপাসনা এবং জ্যোতির্বিদ্যার মধ্যে সংযোগ দেখানোই ছিল প্রান্তরে ইস্রায়েলীয়দের বিদ্রোহের বিষয়ে স্তিফানের বিবরণের উদ্দেশ্য। তারা যখন হারোণকে চিৎকার করে বলেছিল, “আমাদের নিমিত্ত দেবতা নির্ম্মাণ কর,” তখন যিহোবা “তাঁহাদিগকে আকাশের বাহিনী পূজা করিবার জন্য সমর্পণ করিলেন; যেমন ভাববাদীগণের গ্রন্থে লেখা আছে, ‘. . . তোমরা কি আমার উদ্দেশে পশুবলি ও উপহার উৎসর্গ করিয়াছিলে? তোমরা বরং মোলকের তাম্বু ও রিফন্ দেবতার তারা তুলিয়া বহন করিয়াছিলে।’”—প্রেরিত ৭:৪০-৪৩.
ম্যাজাই যারা ছোট্ট যিশুকে দেখতে গিয়েছিল
জ্যোতিষীরা ছোট্ট যিশুর জন্য বিভিন্ন উপহার নিয়ে এসেছিল। গ্রিক ভাষায় তাদেরকে ম্যাগোই বলা হতো। (মথি ২:১) এই ম্যাগোই কারা ছিল, সেই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে দি ইমপেরিয়াল বাইবেল-ডিকশনারি (খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩৯) বলে: “হিরোডিটাসের মতানুসারে ম্যাজাই ছিল মাদীয়দের একটা বংশ, যারা স্বপ্ন ব্যাখ্যা করত বলে দাবি করত এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য সরকারিভাবে দায়িত্ব ছিল . . . সংক্ষেপে বললে, তারা পণ্ডিত এবং পুরোহিত শ্রেণী ছিল আর যেমন মনে করা হতো যে, বিভিন্ন পুস্তক থেকে ও তারা পর্যবেক্ষণ করে আসন্ন ঘটনাগুলো সম্বন্ধে এক অতিপ্রাকৃত বিচক্ষণতা অর্জন করার ব্যাপারে দক্ষ ছিল . . . পরবর্তী সময়ে করা পর্যবেক্ষণগুলো, মাদীয় এবং পারস্যের পরিবর্তে বাবিলকে সব ধরনের ম্যাজাই কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র করে তোলার প্রবণতা দেখিয়েছিল। ‘কিন্তু, পুরোহিত শ্রেণীর হওয়ায় তারা কলদীয়দের কাছ থেকে ম্যাজাই নাম লাভ করেছিল আর ম্যাজাই যে এক মাদীয় বংশের ছিল সেই বিষয়ে হিরোডিটাসের কথাগুলোকে এভাবে আমাদের ব্যাখ্যা করতে হবে।’”
তাই প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্যপ্রমাণ জোরালো কারণ জোগায় যে, ম্যাগোই যারা ছোট্ট যিশুকে দেখতে গিয়েছিল তারা ছিল জ্যোতিষী। সত্যিকার অর্থে, তারা মিথ্যা দেবতাদের দাস ছিল এবং জেনেই হোক বা অজান্তেই হোক, তারা সেটার দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, যেটা তাদের কাছে চলমান “তারা” বলে মনে হয়েছিল। তারা হেরোদকে এই বিষয় সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিল যে, ‘যিহূদীদের রাজা’ জন্মগ্রহণ করেছে আর আর এর ফলে হেরোদ যিশুকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কারণ যিহোবা জ্যোতিষীদের উপদেবতাদের থেকে শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছিলেন; হেরোদের কাছে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে জ্যোতিষীরা ‘ঈশ্বরের স্বপ্ন’ পেয়ে অন্য পথ দিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিল।—মথি ২:২, ১২, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ।
জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি ঐশিক নিন্দা
এক মহান সত্য সহজভাবে বলা হয়েছে: “আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন,” যার অন্তর্ভুক্ত হল আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো এবং নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে নিশ্চল তারাগুলো। (আদিপুস্তক ১:১, ১৬; ইয়োব ৯:৭-১০) কিন্তু, এই ধরনের মহান সৃষ্টির বিষয়ে যিহোবার ইচ্ছা এই ছিল না যে, মানুষরা এগুলো থেকে তাদের দেবতা তৈরি করুক। তাই তিনি তাঁর লোকেদের “উপরিস্থ স্বর্গে, . . . যাহা যাহা আছে, তাহাদের কোন মূর্ত্তি” উপাসনা না করতে দৃঢ়ভাবে নিষেধ করেছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ২০:৩, ৪) যেকোনো ধরনের জ্যোতির্বিদ্যা আইনবিরুদ্ধ ছিল।—দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১০-১২.