নিজের উদ্দেশে আর জীবনধারণ না করা
নিজের উদ্দেশে আর জীবনধারণ না করা
‘[খ্রিস্ট] সকলের জন্য মরিলেন, যেন, যাহারা জীবিত আছে, তাহারা আর আপনাদের উদ্দেশে জীবন ধারণ না করে।’—২ করিন্থীয় ৫:১৫.
১, ২. কোন শাস্ত্রীয় আজ্ঞা যিশুর প্রথম শতাব্দীর অনুসারীদের স্বার্থপরতা কাটিয়ে উঠতে প্রেরণা দিয়েছিল?
এটাই ছিল পৃথিবীতে যিশুর শেষ রাত। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে তিনি সেই সমস্ত ব্যক্তির জন্য জীবন দান করবেন, যারা তাঁর ওপর বিশ্বাস দেখিয়ে চলবে। সেই রাতে, যিশু তাঁর বিশ্বস্ত প্রেরিতদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় বলেছিলেন। এগুলোর মধ্যে একটা আজ্ঞা ছিল সেই গুণ সম্বন্ধে, যা তাঁর অনুসারীদের শনাক্তিকরণ চিহ্ন হিসেবে প্রমাণিত হবে। “এক নূতন আজ্ঞা আমি তোমাদিগকে দিতেছি,” তিনি বলেছিলেন, “তোমরা পরস্পর প্রেম কর; আমি যেমন তোমাদিগকে প্রেম করিয়াছি, তোমরাও তেমনি পরস্পর প্রেম কর। তোমরা যদি আপনাদের মধ্যে পরস্পর প্রেম রাখ, তবে তাহাতেই সকলে জানিবে যে, তোমরা আমার শিষ্য।”—যোহন ১৩:৩৪, ৩৫.
২ সত্য খ্রিস্টানদের পরস্পরের প্রতি আত্মত্যাগমূলক প্রেম দেখাতে এবং নিজেদের পরিবর্তে তাদের সহবিশ্বাসীদের প্রয়োজনগুলোকে প্রথমে রাখতে হবে। তাদের এমনকি “আপন বন্ধুদের নিমিত্ত নিজ প্রাণ সমর্পণ” করার বিষয়েও দ্বিধাবোধ করা উচিত নয়। (যোহন ১৫:১৩) প্রাথমিক খ্রিস্টানরা নতুন আজ্ঞার প্রতি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? দ্বিতীয় শতাব্দীর লেখক টারটুলিয়ান ক্ষমা চাওয়া (ইংরেজি) নামক তার বিখ্যাত বইয়ে খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে অন্য লোকেদের কথা উদ্ধৃতি করে লিখেছিলেন: ‘দেখ, তারা কীভাবে একে অপরকে ভালবাসে; কীভাবে তারা একে অপরের জন্য মরতেও প্রস্তুত।’
৩, ৪. (ক) কেন আমাদের স্বার্থপরতাকে প্রতিরোধ করা উচিত? (খ) এই প্রবন্ধে আমরা কী বিবেচনা করব?
৩ আমাদেরও ‘পরস্পর এক জন অন্যের ভার বহন করিতে; এই রূপে খ্রীষ্টের ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে পালন করিতে’ হবে। (গালাতীয় ৬:২) কিন্তু, খ্রিস্টের দেওয়া আইন পালন করা এবং ‘আমাদের সমস্ত অন্তঃকরণ, সমস্ত প্রাণ ও সমস্ত মন দিয়া আমাদের ঈশ্বর প্রভুকে [“যিহোবাকে,” NW] এবং আমাদের প্রতিবাসীকে আপনার মত প্রেম করিবার’ জন্য স্বার্থপরতা হল সবচেয়ে বড় বাধাগুলোর মধ্যে একটা। (মথি ২২:৩৭-৩৯) অসিদ্ধ হওয়ায় আমাদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। অধিকন্তু, রোজকার জীবনের চাপ, স্কুলে অথবা কাজের জায়গায় প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ এবং জীবনের প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য সংগ্রাম করার সঙ্গে সঙ্গে এই সহজাত প্রবণতা আরও প্রকট হয়। স্বার্থপরতার প্রতি এই প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে না। প্রেরিত পৌল সাবধান করেছিলেন: “শেষ কালে . . . মানুষ কেবল নিজেকেই ভালবাসবে।”—২ তীমথিয় ৩:১, ২, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন।
৪ পার্থিব পরিচর্যার শেষ দিকে, যিশু তাঁর শিষ্যদের তিন পদক্ষেপ বিশিষ্ট এক প্রক্রিয়ার কথা বলেছিলেন, যা তাদের স্বার্থপরতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারত। সেটা কী ছিল এবং তাঁর নির্দেশনা থেকে আমরা কীভাবে উপকৃত হতে পারি?
এক নিশ্চিত প্রতিষেধক!
৫. উত্তর গালীলে প্রচার করার সময় যিশু তাঁর শিষ্যদের কী জানিয়েছিলেন আর কেন সেটা তাদেরকে আঘাত দিয়েছিল?
৫ যিশু উত্তর গালীলের কৈসরিয়া-ফিলিপীতে প্রচার করছিলেন। শান্তিপূর্ণ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এই এলাকাকে স্বার্থত্যাগ করার চেয়ে বরং অবসর সময় কাটানোর জন্য আরও বেশি উপযোগী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, সেখানে থাকাকালীন যিশু তাঁর শিষ্যদের জানাতে শুরু করেছিলেন যে, “তাঁহাকে যিরূশালেমে যাইতে হইবে, এবং প্রাচীনবর্গের, প্রধান যাজকদের ও অধ্যাপকদের হইতে অনেক দুঃখ ভোগ করিতে হইবে, ও হত হইতে হইবে, আর তৃতীয় দিবসে উঠিতে হইবে।” (মথি ১৬:২১) এই কথাগুলো শুনে যিশুর শিষ্যরা নিশ্চয়ই কত আঘাতই না পেয়েছিল কারণ তখন পর্যন্ত তারা আশা করছিল যে, তাদের নেতা পৃথিবীতে তাঁর রাজ্য স্থাপন করবেন!—লূক ১৯:১১; প্রেরিত ১:৬.
৬. কেন যিশু পিতরকে কড়াভাবে অনুযোগ করেছিলেন?
৬ পিতর সঙ্গে সঙ্গে “[যিশুকে] কাছে লইয়া অনুযোগ করিতে লাগিলেন, বলিলেন, প্রভু, ইহা আপনা হইতে দূরে থাকুক, ইহা আপনার প্রতি কখনও ঘটিবে না।” যিশু কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? “তিনি মুখ ফিরাইয়া পিতরকে কহিলেন, আমার সম্মুখ হইতে দূর হও, শয়তান, তুমি আমার বিঘ্নস্বরূপ; কেননা যাহা ঈশ্বরের, তাহা নয়, কিন্তু যাহা মনুষ্যের, তাহাই তুমি ভাবিতেছ।” এই দুটো মনোভাবের মধ্যে কত বৈসাদৃশ্যই না ছিল! যিশু স্বেচ্ছায় সেই আত্মত্যাগমূলক পথ গ্রহণ করেছিলেন, যে-কাজে ঈশ্বর তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন—যা কয়েক মাসের মধ্যে তাঁকে যাতনাদণ্ডে মৃত্যুবরণ করার দিকে পরিচালিত করেছিল। পিতর এক আরামদায়ক পথের বিষয়ে সুপারিশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “ইহা আপনা হইতে দূরে থাকুক” নিজের প্রতি সদয় হোন। নিঃসন্দেহে পিতরের মনোভাব ভাল ছিল। তা সত্ত্বেও, যিশু পিতরকে অনুযোগ করেছিলেন কারণ সেই সময়টাতে পিতর নিজেকে শয়তানের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। পিতর ‘যাহা ঈশ্বরের, তাহা নয়, কিন্তু যাহা মনুষ্যের, তাহাই ভাবিতেছিল।’—মথি ১৬:২২, ২৩.
৭. মথি ১৬:২৪ পদে লিপিবদ্ধ কোন পথের কথা যিশু বলেছিলেন, যা তাঁর অনুসারীদের নিতে হবে?
৭ যিশুকে বলা পিতরের কথাগুলোর মতো একই কথা আজকেও শোনা যেতে পারে। জগৎ প্রায়ই একজন ব্যক্তিকে ‘নিজের জীবন উপভোগ করার’ অথবা ‘সহজ পথ অনুসরণ করার’ জন্য উৎসাহ দেয়। অন্যদিকে, যিশু সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মনোভাবের বিষয়ে সুপারিশ করেছিলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন: “কেহ যদি আমার পশ্চাৎ আসিতে ইচ্ছা করে, তবে সে আপনাকে অস্বীকার করুক, আপন ক্রুশ [“যাতনাদণ্ড,” NW] তুলিয়া লউক, এবং আমার পশ্চাদগামী হউক [“ক্রমাগতভাবে আমাকে অনুসরণ করে চলুক,” NW]।” (মথি ১৬:২৪) “এই কথাগুলো শিষ্য হয়নি এমন ব্যক্তিদের প্রতি বলা এক আমন্ত্রণ নয়,” দ্যা নিউ ইন্টারপ্রিটার বাইবেল বলে, “বরং যারা ইতিমধ্যেই খ্রিস্টের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে, তাদের জন্য শিষ্যত্বের অর্থ নিয়ে চিন্তা করার এক আমন্ত্রণ।” শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ যে-তিনটে পদক্ষেপের কথা যিশু বলেছিলেন, সেগুলো বিশ্বাসীদের নিতে হবে। আসুন, আমরা প্রত্যেকটা পদক্ষেপ আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করি।
৮. নিজেকে অস্বীকার করার মানে কী, তা ব্যাখ্যা করুন।
৮ প্রথমত, আমাদের নিজেকে অস্বীকার করতে হবে। ‘নিজেকে অস্বীকার করিবার’ জন্য ব্যবহৃত গ্রিক শব্দটি, স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা অথবা ব্যক্তিগত সুবিধাগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার ইচ্ছাকে ইঙ্গিত করে। নিজেকে অস্বীকার করার অর্থ কেবল মাঝেমধ্যে নির্দিষ্ট আমোদপ্রমোদ পরিহার করে চলার মতো কোনো বিষয় নয়; অথবা এর অর্থ এটাও নয় যে, আমরা সন্ন্যাসী হয়ে যাব অথবা আত্মধ্বংসকারী হব। আমরা আর ‘নিজের নই’ এই অর্থে যে, আমরা আমাদের সম্পূর্ণ জীবন এবং এর সমস্তকিছু স্বেচ্ছায় যিহোবার কাছে সঁপে দিচ্ছি। (১ করিন্থীয় ৬:১৯, ২০) আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার পরিবর্তে আমাদের জীবন ঈশ্বরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। নিজেদের অস্বীকার করা ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করার এক দৃঢ়সংকল্পের ইঙ্গিত দেয়, যদিও এটা হয়তো আমাদের নিজেদের অসিদ্ধ প্রবণতার বিপরীত হতে পারে। আমরা যখন ঈশ্বরের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করি এবং বাপ্তিস্ম নিই, তখন আমরা দেখাই যে, আমরা পুরোপুরিভাবে তাঁর প্রতি নিয়োজিত। তখনই আমরা বাকি জীবনে আমাদের উৎসর্গীকরণের যোগ্যরূপে চলার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা করি।
৯. (ক) যিশু যখন পৃথিবীতে ছিলেন, তখন যাতনাদণ্ড কোন বিষয়কে চিত্রিত করত? (খ) কোন উপায়ে আমরা আমাদের যাতনাদণ্ড তুলে নিই?
৯ দ্বিতীয় পদক্ষেপ হল, আমাদের আপন যাতনাদণ্ড তুলে নিতে হবে। প্রথম শতাব্দীতে যাতনাদণ্ড কষ্ট, লজ্জা এবং মৃত্যুকে চিত্রিত করত। সাধারণত, কেবল অপরাধীদের যাতনাদণ্ডে বিদ্ধ করা হতো অথবা তাদের মৃতদেহকে একটা দণ্ডের ওপর ঝুলিয়ে রাখা হতো। এই অভিব্যক্তির মাধ্যমে, যিশু দেখিয়েছিলেন যে একজন খ্রিস্টানকে তাড়না, অবজ্ঞা অথবা এমনকি মৃত্যুকে মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, যেহেতু তিনি জগতের অংশ নন। (যোহন ১৫:১৮-২০) আমাদের খ্রিস্টীয় মানগুলো আমাদের জগৎ থেকে পৃথক করে আর তাই জগৎ হয়তো ‘আমাদের নিন্দা করিতে’ পারে। (১ পিতর ৪:৪) এটা স্কুলে, কাজের জায়গায় অথবা এমনকি পরিবারের মধ্যেও হতে পারে। (লূক ৯:২৩, NW) তা সত্ত্বেও, আমরা জগতের অবজ্ঞা সহ্য করতে ইচ্ছুক কারণ আমরা নিজেদের উদ্দেশে আর জীবনধারণ করি না। যিশু বলেছিলেন: “ধন্য তোমরা, যখন লোকে আমার জন্য তোমাদিগকে নিন্দা ও তাড়না করে, এবং মিথ্যা করিয়া তোমাদের বিরুদ্ধে সর্ব্বপ্রকার মন্দ কথা বলে। আনন্দ করিও, উল্লাসিত হইও, কেননা স্বর্গে তোমাদের পুরস্কার প্রচুর।” (মথি ৫:১১, ১২) সত্যিই, ঈশ্বরের অনুগ্রহ পাওয়াই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
১০. যিশুকে ক্রমাগতভাবে অনুসরণ করে চলার সঙ্গে কী জড়িত?
১০ তৃতীয়ত, যিশু খ্রিস্ট বলেছিলেন যে, আমাদের ক্রমাগতভাবে তাঁকে অনুসরণ করে চলতে হবে। ডব্লু. ই. ভাইনের আ্যন এক্সপজিটরি ডিকশনারি অভ নিউ টেস্টামেন্ট ওয়ার্ডস্ অনুসারে, অনুসরণ করার অর্থ হল একজন সহযোগী হওয়া—“যিনি একই পথে চলেন।” প্রথম যোহন ২:৬ পদ জানায়: “যে বলে, আমি [ঈশ্বরে] থাকি, তাহার উচিত যে [খ্রিস্ট] যেরূপ চলিতেন, সেও তদ্রূপ চলে।” যিশু কীভাবে চলতেন? তাঁর স্বর্গীয় পিতা এবং তাঁর শিষ্যদের জন্য যিশুর যে-প্রেম রয়েছে, তাতে স্বার্থপরতার কোনো স্থান নেই। “খ্রীষ্টও আপনাকে তুষ্ট করিলেন না,” পৌল লিখেছিলেন। (রোমীয় ১৫:৩) এমনকি তিনি যখন ক্লান্ত অথবা ক্ষুধার্ত বোধ করতেন, তখনও তিনি নিজের চেয়ে বরং অন্যদের চাহিদাগুলোকে প্রথমে রাখতেন। (মার্ক ৬:৩১-৩৪) এ ছাড়াও, যিশু পুরোদমে রাজ্য প্রচার এবং শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ‘সমুদয় জাতিকে শিষ্য করিবার, যিশু যাহা যাহা আজ্ঞা করিয়াছেন সে সমস্ত পালন করিতে তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়ার’ দায়িত্ব উদ্যোগের সঙ্গে পরিপূর্ণ করার সময় আমাদের কি তাঁকে অনুকরণ করা উচিত নয়? (মথি ২৮:১৯, ২০) এই সমস্ত ক্ষেত্রে খ্রিস্ট আমাদের জন্য এক আদর্শ রেখে গিয়েছেন আর আমাদের “তাঁহার পদচিহ্নের অনুগমন” করতে হবে।—১ পিতর ২:২১.
১১. নিজেদের অস্বীকার করা, আপন যাতনাদণ্ড তুলে নেওয়া এবং ক্রমাগতভাবে যিশু খ্রিস্টকে অনুসরণ করে চলা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
১১ নিজেদের অস্বীকার করা, আপন যাতনাদণ্ড তুলে নেওয়া এবং ক্রমাগতভাবে আমাদের আদর্শ ব্যক্তিকে অনুসরণ করে চলা গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি তা করি, তা হলে তা স্বার্থপরতাকে—আত্মত্যাগমূলক প্রেম দেখানোর ক্ষেত্রে এক নিশ্চিত বাধাকে—প্রতিরোধ করে। অধিকন্তু, যিশু বলেছিলেন: “যে কেহ আপন প্রাণ রক্ষা করিতে ইচ্ছা করে, সে তাহা হারাইবে, আর যে কেহ আমার নিমিত্তে আপন প্রাণ হারায়, সে তাহা পাইবে। বস্তুতঃ মনুষ্য যদি সমুদয় জগৎ লাভ করিয়া আপন প্রাণ হারায়, তবে তাহার কি লাভ হইবে? কিম্বা মনুষ্য আপন প্রাণের পরিবর্ত্তে কি দিবে?”—মথি ১৬:২৫, ২৬.
আমরা দুই কর্তার দাসত্ব করতে পারি না
১২, ১৩. (ক) যে-যুবক শাসক যিশুর কাছে উপদেশ চেয়েছিলেন, তার জন্য চিন্তার বিষয় কী ছিল? (খ) যিশু সেই যুবককে কোন পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং কেন?
১২ যিশু তাঁর শিষ্যদের নিজেকে অস্বীকার করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জোর দেওয়ার কয়েক মাস পরে, একজন ধনী যুবক শাসক তাঁর কাছে এসে বলেছিলেন: “হে গুরু, অনন্ত জীবন পাইবার জন্য আমি কিরূপ সৎকর্ম্ম করিব?” যিশু তাকে ‘[“ক্রমাগতভাবে,” NW] আজ্ঞা সকল পালন করিতে’ বলেছিলেন এবং এরপর কিছু আজ্ঞা উদ্ধৃতি করেছিলেন। সেই যুবক বলেছিলেন: “আমি এ সকলই পালন করিয়াছি।” স্পষ্টতই সেই ব্যক্তি আন্তরিক ছিলেন এবং ব্যবস্থার আজ্ঞাগুলো পালন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। তাই, তিনি জিজ্ঞেস করেন: “এখন আমার কি ত্রুটি আছে?” উত্তরে যিশু সেই যুবকের প্রতি এই কথাগুলো বলে এক অদ্বিতীয় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, “যদি সিদ্ধ [“সম্পূর্ণ নিখুঁত,” বাংলা ইজি-টু-রিড ভারসন] হইতে ইচ্ছা কর, তবে চলিয়া যাও, তোমার যাহা যাহা আছে, বিক্রয় কর, এবং দরিদ্রদিগকে দান কর, তাহাতে স্বর্গে ধন পাইবে; আর আইস, আমার পশ্চাদগামী হও।”—মথি ১৯:১৬-২১.
১৩ যিশু দেখেছিলেন যে, যিহোবাকে সমস্ত প্রাণ দিয়ে সেবা করার জন্য সেই যুবকের জীবনের সবচেয়ে বড় বিক্ষেপ—তার বস্তুগত সম্পদ—থেকে মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। খ্রিস্টের একজন প্রকৃত শিষ্য দুই কর্তার দাসত্ব করতে পারে না। তিনি ‘ঈশ্বর এবং ধন উভয়ের দাসত্ব করিতে পারেন না।’ (মথি ৬:২৪) তার এক ‘সরল চক্ষু’ প্রয়োজন, যা আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর ওপর কেন্দ্রীভূত। (মথি ৬:২২) কারও বিষয়সম্পত্তি থেকে মুক্ত হওয়া এবং সেগুলো দরিদ্র ব্যক্তিদের দিয়ে দেওয়া এক আত্মত্যাগমূলক কাজ। এই বস্তুগত ত্যাগস্বীকারের বিনিময়ে, যিশু সেই যুবক শাসককে স্বর্গে ধন সঞ্চয় করার অমূল্য সুযোগ দিয়েছিলেন—এমন এক ধন, যার অর্থ হবে তার জন্য অনন্তজীবন এবং যা অবশেষে স্বর্গে খ্রিস্টের সঙ্গে শাসন করার প্রত্যাশার দিকে পরিচালিত করবে। সেই যুবক নিজেকে অস্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন না। “সেই যুবক দুঃখিত হইয়া চলিয়া গেল, কারণ তাহার বিস্তর সম্পত্তি ছিল।” (মথি ১৯:২২) কিন্তু, যিশুর অন্যান্য অনুসারীরা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।
১৪. যিশুকে অনুসরণ করার বিষয়ে তাঁর আমন্ত্রণে চার জন জেলে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল?
১৪ প্রায় দুবছর আগে, পিতর, আন্দ্রিয়, যাকোব এবং যোহন নামে চার জন জেলেকে যিশু একই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই সময় তাদের মধ্যে দুজন মাছ ধরছিল এবং অন্য দুজন তাদের জাল মেরামত করায় ব্যস্ত ছিল। যিশু তাদের বলেছিলেন: “আমার পশ্চাৎ আইস। আমি তোমাদিগকে মনুষ্যধারী করিব।” চার জনই অবশেষে তাদের মাছ ধরার ব্যাবসা ছেড়ে দিয়ে তাদের বাকি জীবনে যিশুকে অনুসরণ করেছিল।—মথি ৪:১৮-২২.
১৫. কীভাবে যিহোবার আধুনিক দিনের একজন সাক্ষি যিশুকে অনুসরণ করার জন্য ত্যাগস্বীকার করেছিলেন?
১৫ আজকে অনেক খ্রিস্টান সেই ধনী যুবক শাসকের পরিবর্তে চার জন জেলের উদাহরণ অনুকরণ করেছে। যিহোবাকে সেবা করার জন্য তারা এই জগতের ধনসম্পদ এবং সুযোগগুলোকে বিসর্জন দিয়েছে। দেবোরা বলেন, “আমার বয়স যখন ২২ বছর ছিল, তখন আমাকে এক বিরাট সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল।” তিনি ব্যাখ্যা করেন: “আমি প্রায় ছয় মাস ধরে বাইবেল অধ্যয়ন করেছিলাম এবং যিহোবার কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার পরিবার অনেক বিরোধিতা করেছিল। তারা কোটিপতি ছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, আমি যদি একজন সাক্ষি হই, তা হলে সেটা তাদেরকে সমাজের চোখে ছোট করবে। তারা আমাকে আমি কোনটা বেছে নেব—বিলাসী জীবনযাপন অথবা সত্য—সেই সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ২৪ ঘন্টা সময় দিয়েছিল। আমি যদি সাক্ষিদের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে না দিই, তা হলে আমার পরিবার আমাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবে। যিহোবা আমাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সাহায্য করেছিলেন এবং সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করার জন্য শক্তি জুগিয়েছিলেন। আমি বিগত ৪২ বছর ধরে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা করছি এবং এটা নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। স্বার্থপর এবং আমোদপ্রমোদে ভরা জীবনধারা প্রত্যাখ্যান করার ফলে আমি সেই শূন্যতা এবং দুঃখকে পরিহার করতে পেরেছি, যা আমি আমার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দেখতে পাই। আমার স্বামীর সঙ্গে আমি একশো জনেরও বেশি লোককে সত্য শেখাতে সাহায্য করেছি। এই আধ্যাত্মিক সন্তানরা যেকোনো বস্তুগত ধনসম্পদের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।” যিহোবার সাক্ষিদের আরও লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি একইরকম অনুভূতি প্রকাশ করে থাকে। আপনার সম্বন্ধে কী বলা যায়?
১৬. কীভাবে আমরা দেখাতে পারি যে, আমরা আর নিজেদের উদ্দেশে জীবনধারণ করি না?
১৬ নিজের উদ্দেশে আর জীবনধারণ না করার আকাঙ্ক্ষা হাজার হাজার যিহোবার সাক্ষিকে অগ্রগামী অথবা পূর্ণসময়ের রাজ্য ঘোষণাকারী হিসেবে সেবা করতে পরিচালিত করেছে। অন্যান্য যে-ব্যক্তিরা তাদের পরিস্থিতির কারণে পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করতে পারে না, তারা অগ্রগামীর মনোভাব গড়ে তোলে এবং তাদের সাধ্যমতো রাজ্য প্রচার কাজে সমর্থন করে। বাবামারাও একই মনোভাব দেখায়, যখন তারা তাদের সন্তানদের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করে এবং ব্যক্তিগত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ত্যাগস্বীকার করে। কোনো না কোনোভাবে আমরা সকলে দেখাতে পারি যে, রাজ্যের বিষয়গুলোকে আমরা আমাদের জীবনে প্রথমে রাখছি।—মথি ৬:৩৩.
কার প্রেম আমাদের অনুপ্রাণিত করে?
১৭. কী আমাদের বিভিন্ন ত্যাগস্বীকার করতে অনুপ্রাণিত করে?
১৭ আত্মত্যাগমূলক প্রেম প্রদর্শন, অনুসরণ করার মতো সহজ পথ নয়। কিন্তু, সেই বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করুন, যা আমাদের বশে রাখে বা অনুপ্রাণিত করে। পৌল লিখেছিলেন: “খ্রীষ্টের প্রেম আমাদিগকে বশে রাখিয়া চালাইতেছে; কেননা আমরা এরূপ বিচার করিয়াছি যে, এক জন সকলের জন্য মরিলেন, . . . আর তিনি সকলের জন্য মরিলেন, যেন, যাহারা জীবিত আছে, তাহারা আর আপনাদের উদ্দেশে নয়, কিন্তু তাঁহারই উদ্দেশে জীবন ধারণ করে, যিনি তাহাদের জন্য মরিয়াছিলেন, ও উত্থাপিত হইলেন।” (২ করিন্থীয় ৫:১৪, ১৫) খ্রিস্টের প্রতি প্রেমই আমাদের নিজেদের উদ্দেশে আর জীবনধারণ না করতে অনুপ্রাণিত করে। সেটা কতই না শক্তিশালী এক চালিকাশক্তি! যেহেতু খ্রিস্ট আমাদের জন্য মারা গিয়েছেন, তাই আমরা কি তাঁর উদ্দেশে জীবনধারণ করার জন্য নৈতিক বাধ্যবাধকতা বোধ করি না? বাস্তবিকই, ঈশ্বর এবং খ্রিস্ট আমাদের জন্য যে-গভীর প্রেম দেখিয়েছেন, সেটার জন্য কৃতজ্ঞতা আমাদেরকে ঈশ্বরের কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে এবং খ্রিস্টের শিষ্য হতে অনুপ্রাণিত করে।—যোহন ৩:১৬; ১ যোহন ৪:১০, ১১.
১৮. কেন এক আত্মত্যাগমূলক পথ যথার্থ?
১৮ নিজেদের উদ্দেশে আর জীবনধারণ না করা কি যথার্থ? ধনী যুবক শাসক খ্রিস্টের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে চলে যাওয়ার পর পিতর যিশুকে বলেছিলেন: “দেখুন, আমরা সমস্তই পরিত্যাগ করিয়া আপনার পশ্চাদগামী হইয়াছি; আমরা তবে কি পাইব?” (মথি ১৯:২৭) পিতর এবং অন্যান্য প্রেরিতরা সত্যিই নিজেদের অস্বীকার করেছিল। তাদের পুরস্কার কী হবে? যিশু প্রথমে স্বর্গে তাঁর সঙ্গে শাসন করার যে-বিশেষ সুযোগ তাদের থাকবে, সেই বিষয়ে বলেছিলেন। (মথি ১৯:২৮) সেই একই সময়ে যিশু তাঁর প্রত্যেক অনুসারী যে-আশীর্বাদগুলো উপভোগ করতে পারবে, সেই বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “এমন কেহ নাই, যে আমার নিমিত্ত ও সুসমাচারের নিমিত্ত বাটী কি ভ্রাতৃগণ কি ভগিনী কি মাতা কি পিতা কি সন্তানসন্ততি কি ক্ষেত্র ত্যাগ করিয়াছে, কিন্তু এখন ইহকালে তাহার শতগুণ না পাইবে; . . . এবং আগামী যুগে অনন্ত জীবন পাইবে।” (মার্ক ১০:২৯, ৩০) আমরা যে-ত্যাগস্বীকার করেছি, সেটার চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু আমরা লাভ করি। আমাদের আধ্যাত্মিক বাবা, মা, ভাই, বোন এবং সন্তানরা কি রাজ্যের জন্য আমরা যা কিছু পরিত্যাগ করেছি, সেগুলোর চেয়ে আরও বেশি মূল্যবান নয়? কার সবচেয়ে পরিতৃপ্তিদায়ক জীবন ছিল—পিতরের নাকি সেই ধনী যুবক শাসকের?
১৯ যিশু তাঁর কথা এবং কাজের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে, সুখ আসে দান করা এবং সেবা করার মাধ্যমে, স্বার্থপরতার মাধ্যমে নয়। (মথি ২০:২৮; প্রেরিত ২০:৩৫, NW) নিজেদের উদ্দেশে আর জীবনধারণ না করে বরং খ্রিস্টকে ক্রমাগতভাবে অনুসরণ করে চললে আমরা এখনই জীবনে অনেক পরিতৃপ্তি পাই আর সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে আমাদের অনন্তজীবনের প্রত্যাশা থাকে। অবশ্য, আমরা যখন নিজেদের অস্বীকার করি, তখন যিহোবা আমাদের মালিক হয়ে ওঠেন। এভাবে আমরা ঈশ্বরের দাস হই। কেন এই দাসত্ব পরিতৃপ্তিদায়ক? জীবনে আমরা যে-সিদ্ধান্তগুলো নিই, তাতে এটা কীভাবে প্রভাব ফেলে? পরের প্রবন্ধে এই প্রশ্নগুলো আলোচনা করা হবে।
আপনার কি মনে আছে?
• কেন আমাদের স্বার্থপর প্রবণতাগুলোকে প্রতিরোধ করা উচিত?
• নিজেকে অস্বীকার করা, আপন যাতনাদণ্ড তুলে নেওয়া এবং ক্রমাগতভাবে যিশুকে অনুসরণ করে চলার অর্থ কী?
• কী আমাদেরকে নিজেদের উদ্দেশে আর জীবনধারণ না করতে অনুপ্রাণিত করে?
• কেন এক আত্মত্যাগমূলক জীবনযাপন করা যথার্থ?
[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]
১৯. (ক) কীসের ওপর প্রকৃত সুখ নির্ভর করে? (খ) পরের প্রবন্ধে আমরা কী বিবেচনা করব?
[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]
“প্রভু, ইহা আপনা হইতে দূরে থাকুক”
[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
কোন বিষয়টা যুবক শাসককে যিশুকে অনুসরণ করতে বাধা দিয়েছিল?
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
প্রেমই যিহোবার সাক্ষিদের উদ্যোগী রাজ্য প্রকাশক হিসেবে সেবা করতে অনুপ্রাণিত করে