সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

এক পরিত্যক্ত অনাথ একজন প্রেমময় পিতা খুঁজে পান

এক পরিত্যক্ত অনাথ একজন প্রেমময় পিতা খুঁজে পান

জীবন কাহিনী

এক পরিত্যক্ত অনাথ একজন প্রেমময় পিতা খুঁজে পান

বলেছেন দিমিত্রিস সিডির্‌পুলস্‌

“এগিয়ে গিয়ে ওই অস্ত্রটা তুলে গুলি চালাও,” অফিসার আমার সামনে একটা বন্দুক ছুঁড়ে মেজাজ দেখিয়ে বলেছিলেন। আমি শান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। অন্যান্য সৈনিকরা এটা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, যখন অফিসারের বন্দুক থেকে চালানো গুলিগুলো আমার কাঁধের ওপর দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছিল। মৃত্যু আসন্ন বলে মনে হয়েছিল। আনন্দের বিষয় যে, আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার জীবনের ওপর এটাই প্রথম বিপদ ছিল না।

 আমার পরিবার এক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অংশ ছিল যারা তুরস্কের কাপ্পাদকিয়ায় কাইসেরীর কাছে বসবাস করত। স্পষ্টতই, সা.কা. প্রথম শতাব্দীতে এই এলাকার কিছু ব্যক্তি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। (প্রেরিত ২:৯) কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, সময়কাল পুরোপুরিভাবে পালটে গিয়েছিল।

শরণার্থী থেকে অনাথ

১৯২২ সালে আমার জন্মের কয়েক মাস পরে, জাতিগত দ্বন্দ্ব আমার পরিবারকে শরণার্থী হিসেবে গ্রিসে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল। আমার আতঙ্কিত বাবামা তাদের কয়েক মাস বয়সী শিশুটিকে অর্থাৎ আমাকে ছাড়া আর সমস্তকিছুই পিছনে ছেড়ে চলে এসেছিল। অবর্ণনীয় কষ্টভোগের পর, তারা দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় গ্রিসের উত্তরাঞ্চলে ড্রামার কাছে কিরিয়া গ্রামে পৌঁছায়।

আমার চার বছর বয়সে এবং আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের পর আমার বাবা মারা যান। তার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর কিন্তু সেই দুর্দশাজনক সময়ের যন্ত্রণা তাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। মা নিদারুণ কষ্টভোগ করেন আর শীঘ্রই তিনিও মারা যান। আমার ভাই ও আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলাম। আমাদেরকে এক অনাথ আশ্রম থেকে আরেক অনাথ আশ্রমে পাঠানো হয়েছিল আর ১২ বছর বয়সে থিষলনীকীতে এক অনাথ আশ্রমে আমি একজন মেকানিকের প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেছিলাম।

নিষ্প্রাণ অনাথ আশ্রমগুলোর চৌহদ্দির মধ্যে বড় হয়ে ওঠার সময় আমি ভাবতাম যে, কেন কিছু লোক এত কষ্ট ও অন্যায় ভোগ করে। আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম যে, ঈশ্বর কেন এইরকম দুঃখজনক অবস্থা থাকতে দেন। ধর্মীয় শিক্ষার ক্লাসগুলোতে আমাদের শেখানো হয়েছিল যে, ঈশ্বর হলেন সর্বশক্তিমান কিন্তু সর্বত্র বিদ্যমান মন্দতা সম্বন্ধে কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এক জনপ্রিয় মন্ত্রে বলা আছে, গ্রিক অর্থোডক্স গির্জা হল সবচেয়ে ভাল ধর্ম। যখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, “অর্থোডক্স ধর্মই যদি সবচেয়ে ভাল ধর্ম হয়, তা হলে কেন সকলে অর্থোডক্স নয়?” আমি কোনো সন্তোষজনক উত্তর পাইনি।

কিন্তু, আমাদের শিক্ষকের বাইবেলের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ছিল আর তাই তিনি আমাদের কাছে এই বিষয়টা জোর দিয়ে বলতেন যে, এটি হল একটি পবিত্র বই। অনাথ আশ্রমের পরিচালকও একই মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন কিন্তু কোনো অজানা কারণে তিনি ধর্মীয় কাজকর্মে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতেন। এই বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, তিনি এক সময় যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছিলেন, যে-ধর্মটা আমার কাছে অপরিচিত ছিল।

থিষলনীকী আশ্রমে আমার শিক্ষা যখন সম্পূর্ণ হয়েছিল, তখন আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল আর গ্রিস নাৎসিদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। রাস্তায় রাস্তায় লোকেরা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছিল। বেঁচে থাকার তাগিদে আমি একজন শ্রমিক হিসেবে খুব সামান্য বেতনের জন্য কাজ করতে পল্লী অঞ্চলে পালিয়ে গিয়েছিলাম।

বাইবেল উত্তরগুলো জোগায়

১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে আমি যখন থিষলনীকীতে ফিরে আসি, তখন আমার ছেলেবেলার বন্ধুদের এক বন্ধুর দিদি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, যার সঙ্গে আমি বেশ কয়েকটা অনাথ আশ্রমে থেকেছিলাম। পাশালিয়া আমাকে বলেছিলেন যে, তার ভাই হারিয়ে গিয়েছে আর আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, সে কোথায় থাকতে পারে সেই সম্বন্ধে আমি কিছু জানি কি না। কথোপকথনের সময় তিনি বলেছিলেন যে, তিনি যিহোবার সাক্ষিদের একজন আর মানুষের প্রতি ঈশ্বরের আগ্রহের বিষয়ও উল্লেখ করেছিলেন।

প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আমি অনেক অভিযোগ তুলেছিলাম। সেই ছেলেবেলা থেকে কেন আমি এত কষ্টভোগ করছি? কেন আমাকে একজন অনাথ হতে হয়েছে? যখন আমাদের সবচেয়ে বেশি তাঁকে প্রয়োজন, তখন ঈশ্বর কোথায় থাকেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “তুমি কি নিশ্চিত যে, এই পরিস্থিতিগুলোর জন্য ঈশ্বরই দায়ী?” তার বাইবেল ব্যবহার করে তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর লোকেদের কষ্ট দেন না। আমাকে দেখতে সাহায্য করা হয়েছিল যে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালবাসেন এবং শীঘ্রই পরিস্থিতিগুলোর উন্নতি করবেন। যিশাইয় ৩৫:৫-৭ এবং প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪ পদের মতো শাস্ত্রপদগুলো ব্যবহার করে তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন যে, শীঘ্রই যুদ্ধ, বিবাদ, অসুস্থতা এবং মৃত্যু দূরীভূত হবে এবং বিশ্বস্ত লোকেরা চিরকাল পৃথিবীতে বাস করবে।

এক সমর্থনকারী পরিবার খুঁজে পাওয়া

আমি জানতে পারি যে, পাশালিয়ার ভাই গেরিলা বাহিনীর এক যুদ্ধে মারা গিয়েছে। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আমি তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাই কিন্তু পরিবর্তে তারা আমাকে শাস্ত্র থেকে সান্ত্বনা প্রদান করে। বাইবেল থেকে আরও সান্ত্বনাজনক চিন্তাধারা লাভ করার জন্য আমি আবারও তাদের বাড়িতে যাই আর শীঘ্রই আমি যিহোবার সাক্ষিদের ছোট একটা দলের অংশ হয়ে উঠি, যারা অধ্যয়ন ও উপাসনা করার জন্য গোপনে মিলিত হতো। যিহোবার সাক্ষিদেরকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা সত্ত্বেও, আমি তাদের সঙ্গে ক্রমাগত মেলামেশা চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম।

নম্র খ্রিস্টানদের সেই দলটিতে আমি উষ্ণ, প্রেমময় পরিবারসুলভ পরিবেশ খুঁজে পাই যেটা থেকে আমি বঞ্চিত ছিলাম। তারা আধ্যাত্মিক সমর্থন ও সহযোগিতা জোগায়, যেটা আমার খুবই দরকার ছিল। তাদের মাঝে আমি নিঃস্বার্থ ও যত্নবান বন্ধুবান্ধব খুঁজে পাই, যারা আমাকে সাহায্য করতে ও সান্ত্বনা দিতে প্রস্তুত এবং ইচ্ছুক ছিল। (২ করিন্থীয় ৭:৫-৭) আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, আমাকে যিহোবার আরও নিকটবর্তী হতে সাহায্য করা হয়েছিল যাঁকে এখন আমি আমার একজন প্রেমময় স্বর্গীয় পিতা বলে মনে করি। তাঁর প্রেম, সমবেদনা এবং গভীর চিন্তা এই গুণগুলো খুবই হৃদয়গ্রাহী ছিল। (গীতসংহিতা ২৩:১-৬) শেষ পর্যন্ত, আমি এক আধ্যাত্মিক পরিবার ও একজন প্রেমময় পিতাকে খুঁজে পাই! আমার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠেছিল। শীঘ্রই আমি নিজেকে যিহোবার কাছে উৎসর্গ করার জন্য অনুপ্রাণিত হই এবং ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাপ্তিস্ম নিই।

খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগদান করা কেবল আমার জ্ঞানকেই বৃদ্ধি করেনি কিন্তু সেইসঙ্গে আমার বিশ্বাসকেও আরও গভীর করেছিল। যেহেতু আমাদের গ্রামে কোনো পরিবহণ ছিল না, তাই আমরা কয়েক জন গ্রাম থেকে সভাস্থলে পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতাম ও রাস্তায় যেতে যেতে আধ্যাত্মিক আলোচনাগুলো করতাম, যা ভোলা যায় না। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে, আমি যখন পূর্ণসময় সুসমাচার প্রচার কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ সম্বন্ধে জেনেছিলাম, তখন অগ্রগামীর কাজ শুরু করেছিলাম। যিহোবার সঙ্গে এক দৃঢ় সম্পর্ক অত্যাবশ্যক ছিল, কারণ শীঘ্রই আমার বিশ্বাস ও নীতিনিষ্ঠার সহ্যের সীমা পরীক্ষিত হবে।

বিরোধিতার পরিণামগুলো উলটো হয়েছিল

পুলিশ প্রায়ই আমাদের সভাস্থলে হানা দিয়ে আমাদেরকে মেরে ফেলার ভয় দেখাতো। দেশে তখন সামরিক আইন বলবৎ ছিল, কারণ গ্রিসে গৃহযুদ্ধ দুর্বার গতিতে চলছিল। বিরোধী দলগুলো প্রচণ্ড ঘৃণায় একে অপরকে আক্রমণ করেছিল। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে, পাদরিশ্রেণী কর্তৃপক্ষদের এই বিশ্বাস করিয়েছিল যে, আমরা সাম্যবাদী আর আমাদের প্রচণ্ডভাবে তাড়না করতে পরিচালিত করেছিল।

দুই বছরের সময়কালে, আমাদের অনেকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আর তাই আমরা ছয় বার চার মাসের কারাদণ্ড পেয়েছিলাম। কিন্তু, জেলখানাগুলো ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক বন্দিদের দ্বারা পূর্ণ ছিল, তাই আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতাকে প্রচার চালিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিলাম কিন্তু কিছুদিন পরে আমাদের আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল—একই সপ্তাহে তিন বার। আমরা জানতাম যে, আমাদের অনেক ভাইবোনকে নির্জন দ্বীপগুলোতে নির্বাসিত করা হয়েছিল। এই ধরনের এক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে আমার বিশ্বাস কি আমার জন্য যথেষ্ট দৃঢ় থাকবে?

পরিস্থিতি একেবারে কঠিন হয়ে উঠেছিল যখন আমাকে পুলিশের নজরাধীনে রাখা হয়েছিল। আমার ওপর নজর রাখার জন্য, কর্তৃপক্ষরা আমাকে থিষলনীকীর কাছে ইভজ্‌মস গ্রামে পাঠিয়েছিল, যেখানে একটা থানা ছিল। আমি কাছাকাছি একটা ঘর ভাড়া নিই আর নিজের ভরণপোষণ করার জন্য আমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে তামার তৈরি রান্নার বাসনপত্র পালিশ করার কাজ শুরু করেছিলাম। আশেপাশের গ্রামগুলোতে অগ্রগামীর কাজ করার সময়, এই পেশা আমাকে পুলিশকে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ না দিয়ে সহজেই বাড়িগুলোতে ঢোকার সুবিধা করে দিয়েছিল। এর ফলে, বেশ কয়েক জন লোক সুসমাচার শুনেছিল এবং অনুকূলভাবে সাড়া দিয়েছিল। অবশেষে, তাদের মধ্যে দশ জনেরও বেশি যিহোবার উৎসর্গীকৃত উপাসক হয়েছিল।

দশ বছরে আটটা জেলে

১৯৪৯ সালের শেষ পর্যন্ত আমি পুলিশের নজরাধীনে থাকি আর তারপর পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে আমি থিষলনীকীতে ফিরে আসি। ঠিক যখন আমি মনে করেছিলাম যে, আমার পরীক্ষাগুলো শেষ হয়ে গিয়েছে, তখনই ১৯৫০ সালে, সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য আমাকে অপ্রত্যাশিত আদেশ দেওয়া হয়েছিল। আমার খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতার কারণে, আমি ‘যুদ্ধ শিখিব’ না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। (যিশাইয় ২:৪) ফলে এক দীর্ঘ, যন্ত্রণাদায়ক যাত্রা শুরু হয় যা আমাকে গ্রিসের সবচেয়ে কুখ্যাত জেলগুলোতে নিয়ে গিয়েছিল।

এই সমস্তই ড্রামা শহরে শুরু হয়েছিল। আমার জেলে থাকার প্রথম সপ্তাহে, বাধ্যতামূলকভাবে নিযুক্ত নতুন সৈন্যরা গুলি চালানোর অনুশীলন পর্ব শুরু করে। একদিন, আমাকে গুলি চালানোর অনুশীলন করার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। অফিসারদের একজন আমার সামনে একটা বন্দুক ছুঁড়ে গুলি চালানোর আদেশ দেন। যখন আমি তা প্রত্যাখ্যান করি, তখন তিনি আমার দিকে গুলি চালাতে শুরু করেন। অন্য অফিসাররা যখন দেখে যে আমি আপোশ করব না, তখন তারা আমাকে প্রচণ্ডভাবে ঘুসি মারতে শুরু করে। তারা সিগারেট জ্বালিয়ে সেগুলো আমার হাতের তালুতে ঘষে দেয়। এরপর, তারা আমাকে নির্জন কারাগারে নিক্ষেপ করে। তিন দিন ধরে এভাবে চলতে থাকে। সিগারেটে হাত পোড়ার যন্ত্রণা তীব্র ছিল আর অনেক বছর ধরে আমার হাত দুটোতে সেগুলোর দাগ থেকে গিয়েছিল।

সামরিক আদালতে আমার বিচার হওয়ার আগে, আমাকে ক্রীটের ইরাক্লিয়নে একটা সৈন্য শিবিরে পাঠানো হয়। সেখানে আমার নীতিনিষ্ঠাকে ভাঙার প্রচেষ্টায়, তারা আমাকে প্রচুর মারধর করে। আমি হয়তো আপোশ করে ফেলতে পারি এই ভয়ে, শক্তি পাওয়ার জন্য আমি আমার স্বর্গীয় পিতার কাছে আকুলভাবে প্রার্থনা করি। যিরমিয় ১:১৯ পদের কথাগুলো আমার মনে আসে: “তাহারা তোমার সহিত যুদ্ধ করিবে, কিন্তু তোমাকে পরাজয় করিতে পারিবে না, কারণ তোমার উদ্ধারার্থে আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে আছি, ইহা সদাপ্রভু কহেন।” সান্ত্বনাকারী “ঈশ্বরের শান্তি” স্বস্তি ও প্রশান্তি এনেছিল। আমি যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করার প্রজ্ঞাকে বুঝেছিলাম।—ফিলিপীয় ৪:৬, ৭; হিতোপদেশ ৩:৫.

এরপরে যে-বিচার হয়, তাতে আমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যিহোবার সাক্ষিদের “রাষ্ট্রের” চরম “শত্রু” বলে মনে করা হতো। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ক্যানিয়ার বাইরে ইসিডিনের অপরাধীদের জেলে শুরু হয়, যেখানে আমাকে নির্জন কারাগারে রাখা হয়। ইসিডিন ছিল একটা পুরনো দুর্গ আর আমার কক্ষটা ইঁদুরে ভরা ছিল। আমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা পুরনো কম্বল দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে রাখতাম, যাতে ইঁদুরগুলো যখন আমার ওপর দিয়ে চলাফেরা করে, তখন সেগুলো যেন আমার শরীরকে স্পর্শ করতে না পারে। আমি নিউমোনিয়াতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। ডাক্তার বলেছিলেন যে, আমার বাইরে রোদ পোহানো উচিত আর এর ফলে প্রাঙ্গণে অনেক বন্দিদের সঙ্গে আমি আলোচনা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু, আমার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে আর আমার ফুসফুস থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায়, আমাকে ইরাক্লিয়ন হাসপাতালে পাঠানো হয়।

আমার সহখ্রিস্টানদের আত্মিক পরিবার আবারও আমার প্রয়োজনের সময় আমার পাশে ছিল। (কলসীয় ৪:১১) ইরাক্লিয়নের ভাইয়েরা নিয়মিতভাবে আমার সঙ্গে দেখা করত এবং আমাকে সান্ত্বনা ও উৎসাহ জোগাত। আমি তাদের বলেছিলাম যে, আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আমার সাহিত্যের প্রয়োজন। তারা আমার জন্য দ্বিতল বিশিষ্ট একটা সুটকেস এনেছিল যার মধ্যে আমি নিরাপদে সাহিত্য লুকিয়ে রাখতে পারতাম। আমি কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম যে, সেই জেলখানাগুলোতে থাকার সময়ে, অন্ততপক্ষে ছয় জন সহবন্দিকে সত্য খ্রিস্টান হতে সাহায্য করা হয়েছিল!

ইতিমধ্যে গৃহযুদ্ধ শেষ হয় এবং আমার কারাদণ্ড কমিয়ে দশ বছর করা হয়। আমি আমার কারাদণ্ডের বাকি দিনগুলো রিথিমনো, জেন্টি কুলি এবং কাসান্দ্রা জেলখানায় কাটাই। আটটা জেলখানায় প্রায় দশ বছর কাটানোর পর, আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয় আর আমি থিষলনীকীতে ফিরে আসি, যেখানে আমার প্রিয় খ্রিস্টান ভাইবোনেরা আমাকে উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানায়।

খ্রিস্টীয় ভ্রাতৃসমাজের মাঝে সমৃদ্ধি লাভ করা

সেই সময়ে গ্রিসে সাক্ষিদের উপাসনা করার ক্ষেত্রে কিছুটা স্বাধীনতা ছিল। দেরি না করে আমি পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগটা নিয়েছিলাম। শীঘ্রই আরেকটা আশীর্বাদ পাই, যখন একজন বিশ্বস্ত খ্রিস্টান বোন কাটিনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যে যিহোবাকে ভালবাসত এবং প্রচার কাজে খুবই সক্রিয় ছিল। আমরা ১৯৫৯ সালের অক্টোবর মাসে বিয়ে করি। আমাদের মেয়ে আগাপের জন্ম এবং আমার নিজস্ব খ্রিস্টীয় পরিবার থাকা, আমার অনাথ অবস্থার ক্ষতকে আরও খানিকটা সারিয়ে তুলেছিল। সর্বোপরি, আমাদের পরিবার আমাদের প্রেমময় স্বর্গীয় পিতা যিহোবার রক্ষামূলক যত্নের অধীনে সেবা করে সন্তুষ্ট ছিল।—গীতসংহিতা ৫:১১.

নিদারুণ আর্থিক কষ্টের কারণে, আমি অগ্রগামীর কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হই কিন্তু আমি আমার স্ত্রীকে তার পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলাম। ১৯৬৯ সালে আমার জীবনে সত্যিকারের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ এসেছিল, যখন জার্মানির নুরেমবার্গে যিহোবার সাক্ষিদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় আমি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি। দুই মাসের বেশি সময়ে কেটে যায় কিন্তু তবুও আমার পাসপোর্টটা না পাওয়ায় আমার স্ত্রী যখন থানায় এর কারণ জানতে সেখানে যায়, তখন একজন অফিসার তার ড্রয়ার থেকে মোটা একখানা ফাইল বের করে বলেছিলেন: “আপনি এই ব্যক্তির পাসপোর্ট চাইছেন, যাতে সে জার্মানিতে লোকেদের ধর্মান্তরিত করে? সেটা কখনোই পাবেন না! সে বিপদজনক ব্যক্তি।”

যিহোবার সাহায্যে এবং কিছু ভাইয়ের সহযোগিতায়, আমাকে একটা দলের পাসপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আর পরিশেষে আমি সেই অপূর্ব সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পেরেছিলাম। উপস্থিতির শীর্ষ সংখ্যা ১,৫০,০০০ জনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং আমি স্পষ্টতই দেখতে পেয়েছিলাম যে, যিহোবার আত্মা এই আন্তর্জাতিক আত্মিক পরিবারকে পরিচালনা এবং ঐক্যবদ্ধ করেছিল। জীবনের পরবর্তী সময়ে, আমি খ্রিস্টীয় ভ্রাতৃসমাজের মূল্যকে আরও বেশি করে উপলব্ধি করি।

১৯৭৭ সালে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী এবং বিশ্বস্ত সঙ্গী মারা যায়। বাইবেলের নীতি অনুসারে আমার মেয়েকে মানুষ করে তুলতে আমি আমার যথাসাধ্য করি কিন্তু আমি একা ছিলাম না। আবারও, আমার আধ্যাত্মিক পরিবার আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। সেই কঠিন সময়ে ভাইবোনেরা যে-সমর্থন জুগিয়েছে তার জন্য আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব। তাদের কেউ কেউ আমার মেয়ের দেখাশোনা করার জন্য এমনকি আমাদের বাড়িতে চলে এসেছিল। তাদের আত্মত্যাগমূলক প্রেমকে আমি কখনো ভুলব না।—যোহন ১৩:৩৪, ৩৫.

আগাপে বড় হয়ে ওঠে এবং ইলিয়াস নামে একজন ভাইকে বিয়ে করে। তাদের চারটে ছেলে রয়েছে আর তারা সকলেই সত্যে আছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আমার বেশ কয়েকবার স্ট্রোক হয়েছে এবং আমার স্বাস্থ্য দিনের পর দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমার মেয়ে ও তার পরিবার আমার উত্তম যত্ন নেয়। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া সত্ত্বেও, এখনও আমার আনন্দ করার অনেক কারণ রয়েছে। আমার এখনও সেই সময়ের কথা মনে পড়ে, যখন পুরো থিষলনীকীতে মাত্র একশো জনের মতো ভাইবোন ছিল যারা নিজেদের ঘরগুলোতে গোপনে মিলিত হতো। এখন সেই এলাকায় দশ হাজারেরও বেশি উদ্যোগী সাক্ষি রয়েছে। (যিশাইয় ৬০:২২) সম্মেলনগুলোতে, কমবয়সী ভাইয়েরা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে: “আপনি আমাদের বাড়িতে পত্রিকাগুলো দিয়ে যেতেন, সেই কথা কি আপনার মনে আছে?” যদিও বাবামারা হয়তো সেই পত্রিকাগুলো পড়ত না কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েরা পড়েছিল আর তারা আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করেছে!

আমি যখন যিহোবার সংগঠনের বৃদ্ধি লক্ষ্য করি, তখন আমি মনে করি যে, আমি যে-সমস্ত পরীক্ষা সহ্য করেছি তার মূল্য রয়েছে। আমি সবসময় আমার নাতি এবং অন্যান্য অল্পবয়স্কদের তাদের যৌবনকালে তাদের স্বর্গীয় পিতাকে মনে রাখার বিষয়ে বলি এবং তিনি কখনো তাদের ছেড়ে দেবেন না। (উপদেশক ১২:১) যিহোবা আমার কাছে “পিতৃহীনদের পিতা” হয়ে তাঁর কথাকে সত্য বলে প্রমাণ করেছেন। (গীতসংহিতা ৬৮:৫) যদিও আমি ছেলেবেলা থেকে একজন পরিত্যক্ত অনাথ ছিলাম কিন্তু পরিশেষে আমি একজন যত্নশীল পিতাকে খুঁজে পেয়েছি!

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]

ড্রামা জেলে আমি রান্নার কাজ করতাম

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৯ সালে আমাদের বিয়ের দিনে কাটিনার সঙ্গে

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬০ দশকের শেষে থিষলনীকীর কাছে একটা জঙ্গলের মধ্যে এক সম্মেলন

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের মেয়ের সঙ্গে, ১৯৬৭ সালে