সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

বিজ্ঞান এবং ধর্ম এক দ্বন্দ্বের শুরু

বিজ্ঞান এবং ধর্ম এক দ্বন্দ্বের শুরু

বিজ্ঞান এবং ধর্ম এক দ্বন্দ্বের শুরু

 সত্তর বছর বয়সী এক জ্যোতির্বিদ মৃত্যুশয্যায় খুব কষ্ট করে পড়ার চেষ্টা করছিলেন। তার হাতে নিজের লেখা একটা দলিল রয়েছে, যা ছাপানোর জন্য তৈরি। তিনি জানুন কিংবা না-ই জানুন, তার বইটি নিখিলবিশ্ব সম্বন্ধে মানবজাতির দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। এ ছাড়া, এটি খ্রিস্টীয়জগতের মধ্যে এক প্রচণ্ড মতবিরোধের সূত্রপাত করবে, যার প্রভাব আজও বোঝা যায়।

মৃত্যুশয্যায় থাকা সেই ব্যক্তিটি ছিলেন একজন পোলিশ ক্যাথলিক নিকোলেয়াস কোপারনিকাস আর সময়টা ছিল ১৫৪৩ সাল। কোপারনিকাসের জ্যোতিষ্ক গোলকে আমূল পরিবর্তন সম্বন্ধীয় (ইংরেজি) নামক বইটি বলে যে, পৃথিবী নয় কিন্তু সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে। এই একটি বইয়ের মাধ্যমেই কোপারনিকাস, পৃথিবীকেন্দ্রিক এই চরম জটিল ধারণার জায়গায় এক চমৎকার সহজ ধারণা তুলে ধরেছিলেন।

ভবিষ্যতে যে-দ্বন্দ্ব হতে চলেছে, সেই সম্বন্ধে শুরুর দিকে খুব একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। একটা কারণ হল, কোপারনিকাস তার ধারণাগুলো উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ছিলেন। অধিকন্তু, ক্যাথলিক গির্জা, যা এই পৃথিবীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেছিল, তা সেই সময়কার বৈজ্ঞানিক অনুমানকে সহজেই মেনে নিয়েছিল বলে মনে হয়। এমনকি পোপ নিজে কোপারনিকাসকে তার বইটি প্রকাশ করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। অবশেষে কোপারনিকাস যখন সেটি প্রকাশ করেছিলেন, তখন একজন ভীতু সম্পাদক তার নিজের লেখা ভূমিকায় সূর্যকেন্দ্রিক ধারণাকে এক গাণিতিক ধারণা হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত সত্য হিসেবে নয়।

দ্বন্দ্ব আরও প্রচণ্ড হয়ে ওঠে

এরপর সেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন ইতালির জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও পদার্থবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলে (১৫৬৪-১৬৪২), যিনি একজন ক্যাথলিকও ছিলেন। গ্যালিলিও নিজের নির্মিত দূরবিনে নতুন উদ্ভাবিত লেন্স লাগিয়ে আকাশমণ্ডলকে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেছিলেন যেভাবে এর আগে কেউ কখনও দেখেনি। তার পর্যবেক্ষণ তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল যে, কোপারনিকাস সঠিক ছিলেন। এ ছাড়া, গ্যালিলিও সূর্যে দাগ দেখেছিলেন, যেটাকে বর্তমানে বলা হয় সৌরকলঙ্ক আর এভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা দর্শনিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যেটা হচ্ছে সূর্য পরিবর্তনশীল নয় অথবা ক্ষয় পায় না।

কোপারনিকাসের বিপরীতে গ্যালিলিও তার ধারণাগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহসী এবং উদ্যোগী ছিলেন। আর তিনি তা আরও শত্রুতাপূর্ণ ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে করেছিলেন কারণ সেই সময় অবদি ক্যাথলিক গির্জা খোলাখুলিভাবে কোপারনিকাসের ধারণার প্রতি বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছিল। তাই, গ্যালিলিও যখন তর্ক করেছিলেন যে, সূর্যকেন্দ্রিক ধারণাটি শুধুমাত্র সঠিকই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে শাস্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তখন গির্জা ধর্মবিরোধিতার আভাস পেয়েছিল। *

গ্যালিলিও আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য রোমে গিয়েছিলেন কিন্তু একেবারেই সফল হতে পারেননি। ১৬১৬ সালে গির্জা তাকে কোপারনিকাসের হয়ে কথা বলা বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিল। কিছু সময়ের জন্য গ্যালিলিও মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। এরপর ১৬৩২ সালে তিনি কোপারনিকাসকে সমর্থন করে আরেকটি বই প্রকাশ করেছিলেন। এর পরের বছরই ধর্মীয় বিচারসভা তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। কিন্তু, তার বয়সের কথা বিবেচনা করে তারা শীঘ্রই সেই শাস্তি কমিয়ে দিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে।

অনেকে গির্জার সঙ্গে গ্যালিলিওর দ্বন্দ্বকে ধর্মের ওপর এবং আরও ব্যাপক অর্থে বাইবেলের ওপর বিজ্ঞানের এক বিরাট জয় হিসেবে দেখেছিল। কিন্তু পরের প্রবন্ধে যেমন আমরা দেখতে পাব, এই সহজ ধারণাটি বেশ কিছু সত্যকে উপেক্ষা করে।

[পাদটীকা]

^ গ্যালিলিও উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন সমুচিত জবাব এবং রুক্ষ ব্যাঙ্গোক্তি করার দ্বারা নিজের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী শত্রুদের তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়া, সূর্যকেন্দ্রিক ধারণাটি শাস্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, এই বিষয়ে তর্ক করার দ্বারা তিনি নিজেকে ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বলে তুলে ধরেছিলেন, যা গির্জাকে আরও ক্রুদ্ধ করেছিল।

[৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

কোপারনিকাস

[সৌজন্যে]

Taken from Giordano Bruno and Galilei (German edition)

[৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

রোমীয় ধর্মীয় বিচারসভার সামনে গ্যালিলিও আত্মপক্ষ সমর্থন করেন

[সৌজন্যে]

From the book The Historian’s History of the World, Vol. IX, ১৯০৪

[৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

পটভূমি: Chart depicting Copernicus’ concept of the solar system