হতাশার মাঝে আশা এক শরণার্থী শিবিরে একটা সম্মেলন
হতাশার মাঝে আশা এক শরণার্থী শিবিরে একটা সম্মেলন
কাকুমা শরণার্থী শিবির সুদান সীমান্তের কাছে, কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এখানে ৮৬,০০০রেরও বেশি লোক বাস করে। অঞ্চলটি খুবই শুষ্ক, যেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা থাকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই উদ্বাস্তু লোকেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। অনেকের জন্য এই শিবিরটা হচ্ছে হতাশাপূর্ণ এক জায়গা। কিন্তু, অন্যদের জন্য সেটা হচ্ছে আশার।
এই শরণার্থীদের মধ্যে অনেক যিহোবার সাক্ষিও রয়েছে, যারা উদ্যোগের সঙ্গে রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করে। তারা ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত লডওয়ারের এক ছোট্ট মণ্ডলীর অংশ। সবচেয়ে কাছের মণ্ডলীতে গাড়ি করে যেতে আট ঘন্টা সময় লাগে।
যেহেতু শরণার্থীরা শিবিরের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না, তাই অনেকে যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা অনুষ্ঠিত সম্মেলনগুলোতে যোগ দিতে পারে না। এই কারণে, শিবিরের সীমানার ভিতরেই এক বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
উত্তরাঞ্চলে যাত্রা করা
সম্মেলনকে সমর্থন করার জন্য শিবির থেকে ৪৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এলডোরেট শহরের ১৫ জন সাক্ষি স্বেচ্ছায় শুষ্ক উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার জন্য কষ্টসাধ্য যাত্রা করেছিল, যাদের সঙ্গে একজন বাইবেল ছাত্রও ছিলেন, যিনি তার মিনিবাস ও চালককে কাজে লাগিয়েছিলেন। তাদের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল তাদের ভাইবোনদের উৎসাহিত ও শক্তিশালী করা।
এই যাত্রা কেনিয়ার পশ্চিমের পার্বত্যাঞ্চল থেকে শীতের এক ভোরবেলায় শুরু হয়েছিল। এবড়োখেবড়ো রাস্তা উত্তপ্ত মরুভূমির ঝোপঝাড়ের দিকে নেমে যাওয়ার আগে চাষের জমি ও বনের মধ্যে দিয়ে ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে। ছাগল ও উটের পালকে এই অনুর্বর জমিতে ঘাস খেতে দেখা যায়। ঐতিহ্যগত পোশাক-আশাক পরিহিত উপজাতির লোকেদের হাতে মুগুর, তীর ও ধনুক নিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়। ১১ ঘন্টা যাত্রা করার পর সাক্ষিরা লডওয়ারে এসে পৌঁছেছিল, যেটা ছিল প্রায় ২০,০০০ লোককে নিয়ে গঠিত এক শুষ্ক ও ধুলোবালি পূর্ণ জায়গা। তাদের সাক্ষি আমন্ত্রণকর্তাদের দ্বারা উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে ভ্রমণকারীরা একটু বিশ্রাম নিয়েছিল, যাতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পুরোদমে কাজ করার জন্য তৈরি থাকতে পারে।
পরের দিন সকালে অতিথিরা সেই জায়গার কিছু দর্শনীয় স্থান দেখতে গিয়েছিল। কেনিয়ার সবচেয়ে বড় হ্রদ, তুরকানা হ্রদ পর্যটকরা অবশ্যই দেখতে
যায়। মাইলের পর মাইল জুড়ে মরুভূমির ঝোপঝাড় দিয়ে ঘেরা এই জায়গা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কুমিরের আবাস। এখানকার ক্ষারযুক্ত জল সেই অল্প সংখ্যক লোককে বাঁচিয়ে রেখেছে যারা এর আশেপাশে বসবাস করে। স্থানীয় মণ্ডলীর সঙ্গে ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয় এবং পরিচর্যা সভায় যোগ দিয়ে সেদিন সন্ধ্যাটা আনন্দে কেটে গিয়েছিল। তাদের একটা সুন্দর কিংডম হল রয়েছে, যা ২০০৩ সালে সাক্ষিদের নির্মাণ প্রকল্পের সাহায্যে নির্মিত হয়েছিল, যা সীমিত অর্থ রয়েছে এমন দেশগুলোর জন্য এক ব্যবস্থা।বিশেষ সম্মেলন দিন
বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল রবিবার। লডওয়ার মণ্ডলী ও সেখানে আসা অতিথি ভাইবোনেরা সকাল ৮টায় শিবিরে ঢোকার অনুমতি পেয়েছিল, তাই সাক্ষিরা তাড়াতাড়ি শুরু করতে চেয়েছিল। আঁকাবাঁকা রাস্তা আমাদেরকে অনুর্বর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে সুদান সীমান্তের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। উঁচু-নিচু পাহাড়গুলো রাস্তাকে ঘিরে ছিল। ধীরে ধীরে কাকুমা গ্রামের চমৎকার দৃশ্যগুলো দেখা যায়। বৃষ্টি হয়েছিল আর তাই শিবিরে যাওয়ার ধুলিময় রাস্তার কিছু কিছু জায়গায় জল জমে গিয়েছিল। অধিকাংশ বাড়ি মাটির তৈরি এবং ছাদগুলো টিন বা ত্রিপল দিয়ে ছাওয়া। ইথিওপিয়, সোমালী, সুদান এবং অন্যান্য দেশের লোকেদের দলগুলো প্রত্যেকে তাদের নিজ নিজ এলাকায় থাকে। শরণার্থীরা ভ্রমণকারীদের উৎসাহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
সেই সম্মেলন একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই
প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলো শরণার্থী জীবনের বীভৎসতাকে বর্ণনা করেছিল কিন্তু সেদিন হলের মধ্যে অবস্থিত পরিবেশ আশা জুগিয়েছিল। প্রত্যেকটা বক্তৃতা ইংরেজি ও সোয়াহিলি ভাষায় দেওয়া হয়েছিল। কিছু বক্তা দুটো ভাষাই সাবলীলভাবে বলতে পারায় তারা এমনকি নিজেরাই তাদের বক্তৃতাকে অনুবাদ করেছিল। সুদানের একজন শরণার্থী ভাই শুরুর বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন, “আমাদের রূপক হৃদয়ের পরীক্ষা করা।” অন্যান্য বক্তৃতাগুলো অতিথি প্রাচীনরা দিয়েছিল।প্রত্যেকটা সম্মেলনের মুখ্য বিষয় হল বাপ্তিস্ম। বাপ্তিস্মের বক্তৃতার শেষে, সকলের দৃষ্টি উঠে দাঁড়ানো একজন প্রার্থীর দিকে চলে যায়। ১৯৯৪ সালে উপজাতিগত বিলোপসাধনের সময়ে ঝিলবের তার বাবার সঙ্গে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন। প্রথমে, তারা বুরুণ্ডিতে সুরক্ষা পাওয়ার আশা করেছিল কিন্তু শীঘ্রই তারা বুঝতে পারে যে, তারা তখনও বিপদের মধ্যে রয়েছে। ঝিলবের জাইরেতে পালিয়ে যান ও তারপর তাঞ্জানিয়ায়—মাঝেমধ্যে বনজঙ্গলে লুকিয়েছিলেন—এবং শেষ পর্যন্ত কেনিয়াতে চলে আসেন। বক্তা যখন তাকে মণ্ডলীর একজন ভাই হিসেবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, তখন অনেকের চোখ ছলছল করছিল। ৯৫ জন ব্যক্তিকে নিয়ে অনুষ্ঠিত এক ছোট্ট সম্মেলনে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে, ঝিলবের বক্তার করা দুটো প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট ও দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, “নদিয়ো!”—সোয়াহিলি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে “হ্যাঁ!” তিনি এবং আরও কিছু ভাই হাতে খুঁড়ে একটা ছোট্ট জলাশয় তৈরি করে সেটাকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকেছিল যেটা দিয়ে আগে শিবিরে তার নিজের ঘরকে ঢাকা হতো। বাপ্তিস্ম নেওয়ার জন্য তার উৎসুক মনোভাব প্রদর্শন করে সেদিন সকালে তিনি একাই বালতির পর বালতি জল ঢেলে জলাশয়টাকে ভরে ফেলেছিলেন!
দুপুরের অধিবেশনের মুখ্য বিষয়গুলোর মধ্যে একটা ছিল সাক্ষি শরণার্থীদের অসাধারণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে বলা অভিজ্ঞতাগুলো। একজন ভাই ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, কীভাবে তিনি একটা গাছের নীচে বসে বিশ্রাম করতে থাকা ব্যক্তির কাছে গিয়ে কথা বলেছিলেন।
“আমাকে বলুন তো, গাছের নীচে বসা কি সবসময় নিরাপদ?”
“হ্যাঁ” ব্যক্তিটি উত্তর দেন। এরপর তিনি আরও বলেন “না না, রাতের বেলায় নয়।”
ভাই তাকে মীখা ৪:৩, ৪ পদ পড়ে শোনান: “প্রত্যেকে আপন আপন দ্রাক্ষালতার ও আপন আপন ডুমুরবৃক্ষের তলে বসিবে; কেহ তাহাদিগকে ভয় দেখাইবে না।” “আপনি কি দেখেছেন যে,” ভাই ব্যাখ্যা করেন “ঈশ্বরের নতুন জগতে, তা সবসময় নিরাপদ থাকবে।” ব্যক্তিটি একটা বাইবেলভিত্তিক পত্রিকা গ্রহণ করেছিলেন।
একজন বোন যিনি কাকুমাতে এসেছিলেন, তিনি সম্প্রতি তার তিন জন নিকট আত্মীয়কে মৃত্যুতে হারিয়েছিলেন। শিবিরের ভাইবোনদের সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেছিলেন: “এই জায়গায় অনেক অনেক সমস্যা রয়েছে; কিন্তু, তারা তাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় রেখেছে। তারা এক দুর্দশাপূর্ণ জায়গায় বাস করে কিন্তু তারা আনন্দের সঙ্গে যিহোবাকে সেবা করছে। তারা ঈশ্বরের সঙ্গে শান্তিতে রয়েছে। আমাকে শান্তি বজায় রাখার এবং যিহোবাকে সেবা করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। আমার কোনো অভিযোগ নেই!”
দেখতে দেখতে সম্মেলন দিন শেষ হয়ে এসেছিল। শেষ বক্তৃতায় বক্তা উল্লেখ করেছিলেন যে, আটটা দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা উপস্থিত রয়েছে। সাক্ষি শরণার্থীদের একজন লক্ষ করেছিলেন যে, এই সম্মেলন এক বিভক্ত জগতে যিহোবার সাক্ষিদের মধ্যে অবস্থিত একতা ও ভালবাসার প্রমাণ দেয়। তাদের ভ্রাতৃসমাজ প্রকৃতই এক খ্রিস্টীয় ভ্রাতৃসমাজ।—যোহন ১৩:৩৫.
[২৫ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
সুদানের হারিয়ে যাওয়া কিশোররা
১৯৮৩ সালে সুদানে গৃহযুদ্ধের আরম্ভ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ লোক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। এদের মধ্যে প্রায় ২৬,০০০ বাচ্চা তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। শত শত লোক ইথিওপিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোতে পালিয়ে গিয়েছিল, যেখানে তারা তিন বছর কাটিয়েছিল। সেখান থেকেও তাদের জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে তারা এক বছর ধরে পায়ে হেঁটে আবার সুদানের মধ্যে দিয়ে উত্তর কেনিয়াতে যাত্রা করেছিল, সৈনিক, দস্যু, রোগব্যাধি এবং বন্যপশুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছিল। এই কষ্টসাধ্য ভ্রমণে মাত্র অর্ধেক সংখ্যক বাচ্চা রক্ষা পেয়েছিল যারা শেষ পর্যন্ত কাকুমা শিবিরের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। ত্রাণ সংস্থাগুলোর কাছে এরা সুদানের হারিয়ে যাওয়া কিশোর নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।
বর্তমানে কাকুমা শরণার্থী শিবির হল সুদান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের এক বহুজাতিক গৃহ। শিবিরে এসে পৌঁছানোর পর একজন শরণার্থীকে ঘর তৈরি করার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং ছাউনির জন্য একটা ত্রিপল দেওয়া হয়। প্রত্যেক শরণার্থীকে মাসে দুবার ছয় কিলোগ্রাম আটা, এক কিলোগ্রাম ডাল ও কিছু পরিমাণ তেল ও লবণ দেওয়া হয়। অনেক শরণার্থী তাদের ভাগে পাওয়া জিনিসগুলো বিক্রি করে আরও অন্যান্য সামগ্রী কিনে থাকে।
এই হারিয়ে যাওয়া কিশোরদের মধ্যে কয়েক জন তাদের পরিবারের সঙ্গে আবারও মিলিত হতে পেরেছে অথবা অন্য দেশে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছে। কিন্তু, শরণার্থী পুনঃস্থাপন দপ্তর অনুযায়ী, “এখনও আরও হাজার হাজার শরণার্থী ধুলিময়, মশামাছিপূর্ণ কাকুমার শরণার্থী শিবিরে রয়ে গেছে, যেখানে তাদেরকে খাদ্যের জন্য হাহাকার করতে হয় এবং শিক্ষা লাভের জন্য সংগ্রাম করতে হয়।”
[সৌজন্যে]
Courtesy Refugees International
[২৩ পৃষ্ঠার মানচিত্র]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
কাকুমা শিবির
তুরকানা হ্রদ
লডওয়ার
এলডোরেট
নাইরোবি
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
শিবিরে জীবনযাত্রার মান খুবই কঠিন
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
কাকুমা শিবিরে জল জন প্রতি মেপে দেওয়া হয়
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
কেনিয়ার সাক্ষিরা তাদের ভাইবোনদের উৎসাহিত করতে উত্তরাঞ্চলের দিকে কষ্টসাধ্য যাত্রা করে
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
একজন মিশনারি এক স্থানীয় বিশেষ অগ্রগামীর দেওয়া বক্তৃতাকে অনুবাদ করছেন
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
বাপ্তিস্মের জলাশয়
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
জল জন প্রতি মেপে দেওয়া হচ্ছে এবং কাকুমা শরণার্থী শিবির: Courtesy Refugees International