কেন বিশ্ব একতা নেই?
কেন বিশ্ব একতা নেই?
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রথম বারের মতো আন্তর্জাতিক সংঘ একতাবদ্ধ হয়। . . . তাই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এক নতুন জগতের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করার জন্য বিশ্ব এই সুযোগকে গ্রহণ করতে পারে।”
এই মন্তব্যটি বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে যুক্তরাষ্ট্রের একজন রাষ্ট্রপতি করেছিলেন। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক ঘটনাগুলো এইরকম ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, বিশ্ব একতা খুবই সন্নিকট। একটার পর একটা একনায়কতন্ত্র সরকারের পতন ঘটেছিল। বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, যেটা ইউরোপের জন্য এক নতুন যুগের সূচনার সংকেত দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যেটাকে পশ্চিমের অনেকে বিশ্ব সংঘাতের প্ররোচক হিসেবে মনে করত, সেটার বিলুপ্তি বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল। ঠাণ্ডা লড়াই শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং নিরস্ত্রীকরণ সম্বন্ধে আশাবাদী আলোচনা হয়েছিল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ। এই কথা ঠিক যে, পারস্য উপসাগরে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল কিন্তু সেটাকে এক ক্ষণস্থায়ী সমস্যা বলে মনে হয়েছিল, যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে এক শান্তিপূর্ণ যুগ নিয়ে আসার ব্যাপারে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছিল।
ইতিবাচক সংকেতগুলো কেবল রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয় কিন্তু জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল। বিশ্বের অনেক জায়গায় জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছিল। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিভিন্ন অগ্রগতি ডাক্তারদের জন্য সেই কাজগুলো করাকে সম্ভবপর করেছিল, যেগুলোকে মাত্র কয়েক দশক আগে অলৌকিক বলে মনে হতো। অনেক দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এমন এক গতিতে এগিয়ে চলেছিল, যা দেখে মনে হয়েছিল সেটা বিশ্বব্যাপী সমৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করবে। মনে হয়েছিল যেন, সবকিছু ঠিক পথেই এগোচ্ছে।
আজকে, মাত্র অল্প কয়েক বছর পর আমরা জিজ্ঞেস না করে পারি না যে: ‘কী হল? প্রতিজ্ঞাত বিশ্ব একতা কোথায়?’ এর বিপরীতে, বিশ্ব উলটো দিকেই এগিয়ে চলেছে বলে মনে হয়। আত্মঘাতী বোমাহামলা, সন্ত্রাসী হামলা, ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের বৃদ্ধি এবং অন্যান্য বিশৃঙ্খল
ঘটনাগুলো প্রকাশিত সংবাদের নিত্যদিনের বিষয় হয়ে উঠেছে। এইরকম ঘটনাগুলো, বিশ্বকে একতা থেকে দিনের পর দিন আরও দূরে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে হয়। একজন বিশিষ্ট অর্থসংস্থানকারী সম্প্রতি বলেছিলেন: “ধাপে ধাপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত দৌরাত্ম্যের দুষ্টচক্রে আমরা আটকা পড়ে যাচ্ছি।”বিশ্ব একতা, নাকি বিশ্বব্যাপী বিভক্তি?
রাষ্ট্রসংঘ যখন গঠিত হয়েছিল, তখন ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটা ছিল “লোকেদের সমান অধিকার ও স্বশাসন প্রতিষ্ঠার নীতিকে সম্মান করার ওপর ভিত্তি করে জাতিগুলোর মধ্যে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলা।” প্রায় ৬০ বছর পরে, সেই মহৎ লক্ষ্যে কি পৌঁছানো গিয়েছে? কখনোই না! “বন্ধুসুলভ সম্পর্ক” অভিব্যক্তিটির পরিবর্তে, জাতিগুলো “স্বশাসন প্রতিষ্ঠার” ব্যাপারে বেশি আগ্রহী বলে মনে হয়। জাতি ও উপজাতিগত দলগুলো তাদের নিজেদের পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠি করতে সংগ্রাম করে চলেছে, যা বিশ্বকে ক্রমবর্ধমানভাবে বিভক্ত করেছে। রাষ্ট্রসংঘ যখন গঠিত হয়েছিল, তখন এর সদস্য জাতিগুলোর সংখ্যা ছিল ৫১টা। আজকে, এর সদস্য সংখ্যা ১৯১টা।
আমরা যেমন দেখেছি, বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, এক ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের আশা বিদ্যমান ছিল। তখন থেকে, সেই আশা এক আতঙ্কে পরিণত হয়েছে কারণ মানবজাতি বিশ্বসমাজের মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিভক্তি প্রত্যক্ষ করেছে। যুগোস্লাভিয়ার দৌরাত্ম্যপূর্ণভাবে বিভক্ত হওয়া, চেচনিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘর্ষ, ইরাকের যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমাগত ব্যাপক হত্যাকাণ্ড—এই সমস্তকিছু এযাবৎ কালের বিরাট অনৈক্যের প্রমাণ দিয়েছে।
কোনো সন্দেহ নেই যে, শান্তির জন্য অনেক প্রচেষ্টাই অকৃত্রিম ছিল এবং তা সদুদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও, বিশ্ব একতা দুর্লভ বলেই মনে হয়। অনেকেই ভাবে: ‘কেন বিশ্ব একতা ধরাছোঁয়ার বাইরে? বিশ্ব কোন দিকে এগিয়ে চলেছে?’
[৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
AP Photo/Lionel Cironneau
Arlo K. Abrahamson/AFP/ Getty Images