বিশ্বব্যাপী বাইবেল শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পেরে আমি আনন্দিত
জীবন কাহিনী
বিশ্বব্যাপী বাইবেল শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পেরে আমি আনন্দিত
বলেছেন আনা মাথেয়াকিস
ফেরিটা আগুনে জ্বলছিল। এটা যদি ডুবে যেত, তা হলে ১৭১ মিটার লম্বা বড় জাহাজটা আমাকে সলিলসমাধির দিকে টেনে নিয়ে যেত। আমি প্রবল ঢেউগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে প্রাণপণে সাঁতার কাটছিলাম। ভেসে থাকার একমাত্র উপায় ছিল একটা লাইফজ্যাকেট আঁকড়ে ধরা, যেটা অন্য একজন মহিলা পরে ছিলেন। আমি শক্তি এবং সাহসের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম। এটা ছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।
সময়টা ছিল ১৯৭১ সাল এবং আমি ইতালিতে, আমার তৃতীয় মিশনারি কার্যভারে ফিরে যাচ্ছিলাম। সেই জাহাজডুবিতে, আমার যা ছিল তার প্রায় সবকিছুই আমি হারিয়েছিলাম। কিন্তু, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো—আমার জীবন, প্রেমময় খ্রিস্টীয় ভ্রাতৃসমাজ এবং যিহোবাকে সেবা করার বিশেষ সুযোগ—আমি হারাইনি। সেই সেবা আমাকে ইতিমধ্যেই তিনটে মহাদেশে নিয়ে গিয়েছিল আর জাহাজডুবির ঘটনাটা ছিল আমার ঘটনাবহুল জীবনের মধ্যে কেবল একটা।
আমার জন্ম হয়েছিল ১৯২২ সালে। আমার পরিবার জেরুসালেমের প্রায় ১৬ কিলিমিটার উত্তরে, রাম আল্লায় বাস করত। আমার বাবামা দুজনেই ক্রীট দ্বীপে ছিলেন কিন্তু আমার বাবা নাজারেথে বড় হয়েছিলেন। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট ছিলাম। আমার পরিবার মেজদার মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছিল, যে স্কুলের শিক্ষাসফরে গিয়ে জর্ডন নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিল। এই দুঃখজনক ঘটনার পর আমার মা আর রাম আল্লাতে থাকতে চাননি আর তাই আমার বয়স যখন তিন বছর, তখন আমরা গ্রিসের এথেন্সে চলে যাই।
আমাদের পরিবার বাইবেলের সত্য পায়
গ্রিসে চলে আসার কিছুদিন পরই, আমার বড়দা নিকস, যার বয়স তখন ২২ বছর ছিল, তার সঙ্গে বাইবেল ছাত্রদের সাক্ষাৎ হয়, যে-নামে যিহোবার সাক্ষিরা সেই সময় পরিচিত ছিল। বাইবেলের জ্ঞান অর্জন করা তাকে অনেক আনন্দ দিয়েছিল এবং
খ্রিস্টীয় পরিচর্যার জন্য অত্যন্ত উদ্যোগী করে তুলেছিল। এতে আমার বাবা খুবই রেগে গিয়েছিলেন এবং তিনি নিকসকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা যখন প্যালেস্টাইনে যেতেন, তখন আমার মা, আমার দিদি এবং আমি নিকসের সঙ্গে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যেতাম। আমি এখনও যেন শুনতে পাই যে, আমার মা সেই সভাগুলোতে যা যা শুনতেন, সেগুলো উদ্যমের সঙ্গে বলছেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই, তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ৪২ বছর বয়সে মারা যান। সেই কঠিন সময়ে, আমার দিদি আ্যরিয়াদনি প্রেমের সঙ্গে আমাদের পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। বয়স অল্প হলেও, অনেক বছর ধরে আমার কাছে সে আমার মায়ের মতোই ছিল।এথেন্সে থাকাকালীন আমার বাবা আমাকে সবসময় অর্থোডক্স গির্জায় নিয়ে যেতেন এবং তার মৃত্যুর পরও আমি সেই গির্জায় যেতাম, তবে খুব কম। যেহেতু আমি গির্জায় ঈশ্বরীয় ভক্তির কোনো প্রমাণই দেখতে পাইনি, তাই আমি সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দিই।
আমার বাবার মৃত্যুর পর, আমি অর্থ-মন্ত্রণালয়ে একটা স্থায়ী চাকরি পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার দাদা রাজ্যের প্রচার কাজে তার জীবন উৎসর্গ করেছিল, গ্রিসে অনেক বছর ধরে কাজ করেছিল। ১৯৩৪ সালে সে সাইপ্রাসে চলে যায়। সেই সময়, ওই দ্বীপে যিহোবার কোনো বাপ্তাইজিত সাক্ষি ছিল না, তাই তার সেখানে প্রচার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল। সে বিয়ে করার পর, তার স্ত্রী গালাতিয়াও অনেক বছর ধরে পূর্ণসময়ের পরিচারক হিসেবে কাজ করেছিল। * নিকস প্রায়ই আমাদেরকে বাইবেলভিত্তিক বিভিন্ন বই ও পত্রিকা পাঠাত কিন্তু আমরা সেগুলো খুব কমই খুলে দেখতাম। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে সাইপ্রাসেই ছিল।
বাইবেলের সত্যকে নিজের করে নেওয়া
১৯৪০ সালে, জর্জ ডুরাস নামে এথেন্সের একজন উদ্যোগী সাক্ষি, যিনি নিকসের বন্ধু, তিনি আমাদের সঙ্গে দেখা করেন এবং আমাদেরকে তার বাড়িতে একটা ছোট দলের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়নে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমরা খুশিমনে তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। শীঘ্রই, আমরা যা শিখছিলাম, তা অন্যদের কাছে বলতে শুরু করেছিলাম। বাইবেল থেকে জ্ঞান নেওয়া আমার দিদি এবং আমাকে যিহোবার উদ্দেশে আমাদের জীবন উৎসর্গ করতে পরিচালিত করেছিল। আ্যরিয়াদনি ১৯৪২ সালে এবং আমি ১৯৪৩ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, নিকস আমাদেরকে সাইপ্রাসে আসার আমন্ত্রণ জানায়, তাই ১৯৪৫ সালে আমরা নিকোসিয়াতে যাই। গ্রিসের মতো সাইপ্রাসে প্রচার কাজ নিষিদ্ধ ছিল না। আমরা কেবল ঘরে ঘরে পরিচর্যায়ই যেতাম না কিন্তু সেইসঙ্গে রাস্তায়ও সাক্ষ্য দিতাম।
দুবছর পর আ্যরিয়াদনিকে গ্রিসে ফিরে যেতে হয়েছিল। সেখানেই তার ভাবী স্বামীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়, যিনি যিহোবার একজন সহউপাসক ছিলেন আর তাই আ্যরিয়াদনি এথেন্সেই থেকে গিয়েছিল। শীঘ্রই আমার দাদাবাবু ও আমার দিদি আমাকে গ্রিসে ফিরে যেতে এবং রাজধানীতে পূর্ণসময়ের পরিচর্যার কাজ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছিল। যেহেতু অগ্রগামীর কাজ সবসময়ই আমার লক্ষ্য ছিল, তাই আমি এথেন্সে ফিরে গিয়েছিলাম, যেখানে প্রয়োজন আরও বেশি ছিল।
সুযোগের নতুন নতুন দ্বার খুলে গিয়েছিল
১৯৪৭ সালের ১লা নভেম্বর আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করেছিলাম এবং প্রত্যেক মাসে প্রচার কাজে ১৫০ ঘন্টা ব্যয় করতাম। আমাদের মণ্ডলীর এলাকা বিশাল ছিল আর আমাকে অনেক হাঁটতে হতো। তবুও আমি অনেক আশীর্বাদ উপভোগ করেছিলাম। কোনো সাক্ষিকে প্রচার কাজে রত থাকতে অথবা খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দিতে দেখলে পুলিশ প্রায়ই তাকে গ্রেপ্তার করত, তাই অল্পদিনের মধ্যে আমাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
আমাকে ধর্মান্তরিত করার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, যেটা সেই সময়ে এক গুরুতর অপরাধ ছিল। আমাকে এথেন্সের আভেরফ্ মহিলা কারাগারে দুই মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ইতিমধ্যেই আরেকজন মহিলা সাক্ষি ছিলেন, তাই বন্দি থাকা সত্ত্বেও আমরা দুজনে আনন্দময় ও গঠনমূলক খ্রিস্টীয়
মেলামেশা উপভোগ করতাম। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, আমি আনন্দের সঙ্গে অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময় যাদেরকে আমি বাইবেল অধ্যয়ন করাতাম, তাদের অনেকে এখনও পর্যন্ত যিহোবার বিশ্বস্ত সেবক আর সেটা আমাকে অনেক আনন্দ দেয়।১৯৪৯ সালে, আমি যুক্তরাষ্ট্রে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েড এর ১৬তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পাই, যেখানে পূর্ণসময়ের পরিচারকদের মিশনারি কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আমি এবং আমার আত্মীয়স্বজন অনেক রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। আমি ১৯৫০ সালের গ্রীষ্মকালে নিউ ইয়র্ক সিটির একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার পর গিলিয়েডে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর পর, নিউ ইয়র্ক সিটিতে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে কয়েক মাসের জন্য একজন হাউসকিপার হিসেবে কাজ করার বিশেষ সুযোগ আমার হয়েছিল। সেখানকার পরিবেশ খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আনন্দদায়ক ও গঠনমূলক ছিল এবং আমার চারিদিকে হাসিখুশি ভাইবোনেরা ছিল। যে-ছয় মাস আমি সেখানে কাটিয়েছিলাম, তা আমি সবসময় আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করব। এরপর গিলিয়েড স্কুলে যোগ দেওয়ার সময় এসেছিল, যেখানে পাঁচ মাসের গভীর অধ্যয়ন এবং নির্দেশনা খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শাস্ত্রীয় জ্ঞান যে কতটা মূল্যবান এবং চমৎকার, তা আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম আর সেটাই আমাদের মধ্যে অন্যদের সঙ্গে জীবনদানকারী সত্যের জ্ঞান বন্টন করার আনন্দ ও আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করেছিল।
আমার প্রথম মিশনারি কার্যভার
গিলিয়েড স্কুলে, মিশনারি কার্যভার পাওয়ার আগে আমাদেরকে ভাবী সঙ্গী বেছে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো। রূত হেমিগ (এখন বশার্ট) নামে একজন চমৎকার বোন, আমার সঙ্গী ছিলেন। রূত এবং আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম, যখন আমাদের তুরস্কের ইস্তানবুলে—এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যেকার এক সংযোগস্থলে—কার্যভার দেওয়া হয়েছিল! আমরা জানতাম যে সেই দেশে তখনও পর্যন্ত প্রচার কাজ স্বীকৃত ছিল না কিন্তু আমাদের কোনো সন্দেহ ছিল না যে, যিহোবা আমাদের সমর্থন করবেন।
ইস্তানবুল হল মিশ্রসংস্কৃতির এক চমৎকার শহর। সেখানে আমরা প্রচুর বাজার, সারা বিশ্বের বিভিন্ন রন্ধনপ্রণালীর সমারোহ, আগ্রহজনক জাদুঘর, বন্ধুসুলভ প্রতিবেশী এবং চির আকর্ষণীয় সমুদ্র উপকূল, দেখতে পেয়েছিলাম। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আমরা আন্তরিক ব্যক্তিদের খুঁজে পেয়েছিলাম, যারা ঈশ্বর সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিল। ইস্তানবুলে সাক্ষিদের ছোট দলটি মূলত আর্মেনীয়, গ্রিক এবং যিহুদিদের নিয়ে গঠিত ছিল। তবে, সেখানে আরও অনেক জাতির লোক ছিল আর তুর্কিসহ বিভিন্ন ভাষা সম্বন্ধে অবগত থাকা আমাদের জন্য উপকারী হয়েছিল। বিভিন্ন জাতি থেকে আসা সেই লোকেদের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম, যারা সত্যের জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করে চলেছে।
দুঃখের বিষয় হল যে, রূতের জন্য সেই দেশে থাকার অনুমতিপত্র নবায়ন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল আর তাই তাকে সেখান থেকে চলে যেতে হয়েছিল। তিনি সুইজারল্যান্ডে পূর্ণসময়ের কাজ করে চলছেন। এত বছর পরেও, আমি তার চমৎকার, গঠনমূলক সাহচর্যের অভাব বোধ করি।
পৃথিবীর আরেক প্রান্তে যাওয়া
১৯৬৩ সালে তুরস্কে থাকার জন্য আমার অনুমতিপত্র নবায়ন করা হয়নি। সেই সমস্ত সহখ্রিস্টানকে ছেড়ে যাওয়া খুবই কঠিন ছিল, যাদেরকে আমি বিভিন্ন কষ্টকর পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করতে দেখেছিলাম। আমাকে উৎসাহিত করার জন্য, আমার আত্মীয়স্বজনরা উদারতা দেখিয়ে আমাকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাওয়ার ভাড়া দিয়েছিল, যাতে সেখানে আমি একটা সম্মেলনে যোগ দিতে পারি। তখনও পর্যন্ত আমি আমার পরবর্তী কার্যভার পাইনি।
সম্মেলনের পর, আমাকে পেরুর লিমাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। যে-যুবতী বোন পরবর্তী সময়ে আমার সঙ্গী হয়েছিলেন,
তাকে নিয়ে আমি নিউ ইয়র্ক থেকে সরাসরি আমার নতুন কার্যক্ষেত্রে গিয়েছিলাম। আমি স্প্যানিশ ভাষা শিখেছিলাম এবং মিশনারি হোমে থাকতাম, যেটা যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসের ওপরেই ছিল। সেখানে প্রচার করা এবং স্থানীয় ভাইবোনদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া খুবই আনন্দদায়ক ছিল।আরেকটা কার্যভার, আরেকটা ভাষা
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, গ্রিসে আমার আত্মীয়স্বজনরা বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা ভোগ করতে শুরু করে এবং তাদের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। তাদেরকে সাহায্য করার জন্য তারা কখনো আমাকে পূর্ণসময়ের কাজ ছেড়ে তথাকথিত স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে উৎসাহিত করেনি। কিন্তু, অনেক চিন্তাভাবনা ও প্রার্থনা করার পর, আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে আমার পরিবারের কাছাকাছি থেকে সেবা করাই আমার জন্য আরও ভাল হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইয়েরা প্রেমের সঙ্গে রাজি হয়েছিলেন এবং আমাকে ইতালিতে কার্যভার দিয়েছিলেন আর আমার আত্মীয়স্বজনরা আমার যাতায়াতের খরচ দিতে চেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, ইতালিতে সুসমাচার প্রচারকদের খুবই প্রয়োজন ছিল।
আমাকে আবারও একটা নতুন ভাষা—ইতালীয় ভাষা—শিখতে হয়েছিল। আমার প্রথম কার্যভার ছিল ফজা শহরে। এরপর আমাকে নেপলসে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে আরও বেশি প্রয়োজন ছিল। আমার এলাকা ছিল পোজিলিপো, যেটা ছিল নেপলসের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। এটা খুব বড় একটা এলাকা ছিল এবং সেখানে মাত্র একজন রাজ্যের প্রকাশক ছিলেন। আমি আমার কাজ খুবই উপভোগ করতাম এবং যিহোবা আমাকে অনেকগুলো বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করতে সাহায্য করেছিলেন। পরে, সেই এলাকায় একটা বড় মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল।
স্থানীয় লোকেদের মধ্যে প্রথমে আমি একজন মহিলা ও তার চার ছেলেমেয়েকে বাইবেল অধ্যয়ন করিয়েছিলাম। তিনি এবং তার দুই মেয়ে এখনও পর্যন্ত যিহোবার সাক্ষি। এ ছাড়া, আমি এক বিবাহিত দম্পতিকেও অধ্যয়ন করিয়েছিলাম, যাদের একটা ছোট মেয়ে ছিল। পুরো পরিবার সত্যে উন্নতি করেছিল এবং উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। এখন সেই মেয়েটি যিহোবার একজন বিশ্বস্ত সাক্ষিকে বিয়ে করেছে এবং তারা দুজনেই উদ্যোগের সঙ্গে ঈশ্বরের সেবা করছে। এক বড় পরিবারের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করার সময়, আমি ঈশ্বরের বাক্যের ক্ষমতা দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা যখন এমন কয়েকটা শাস্ত্রপদ পড়েছিলাম, যেগুলো দেখায় যে প্রতিমার মাধ্যমে করা উপাসনাকে ঈশ্বর অনুমোদন করেন না, তখন সেই পরিবারের মা অধ্যয়ন শেষ হওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করেননি। তক্ষুনি, তিনি তার ঘর থেকে সব প্রতিমা ফেলে দিয়েছিলেন!
সমুদ্রসংকটে
ইতালি এবং গ্রিসে যাওয়া-আসা করার সময়, আমি সবসময় জাহাজে ভ্রমণ করতাম। সাধারণত সমুদ্রযাত্রা খুব উপভোগ্য ছিল। কিন্তু, ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মকালের একটা ভ্রমণ আলাদা ছিল। আমি এলিয়ানা নামের ফেরিতে করে ইতালিতে ফিরে যাচ্ছিলাম। ২৮শে আগস্ট ভোরবেলা, জাহাজের রান্নাঘরে আগুন লেগে গিয়েছিল। আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল আর এর ফলে যাত্রীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। মহিলারা অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল, বাচ্চারা কান্নাকাটি করছিল আর পুরুষেরা প্রতিবাদ করছিল ও চিৎকার করে হুমকি দিচ্ছিল। লোকেরা ডেকের দুই পাশে রাখা লাইফবোটগুলোর দিকে ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু, লাইফজ্যাকেটের সংখ্যা খুব কম ছিল আর যে-যন্ত্র লাইফ বোটগুলোকে নীচে নামানোর জন্য ব্যবহার করা হতো, সেটা সঠিকভাবে কাজ করছিল না। আমার কাছে কোনো লাইফজ্যাকেট ছিল না, অন্যদিকে আগুনের শিখা ক্রমেই বাড়ছিল, তাই সেই সময় একমাত্র বিচক্ষণতার কাজ ছিল সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া।
জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই, আমি একজন মহিলাকে দেখতে পাই যিনি লাইফজ্যাকেট পরে আমার কাছাকাছিই ভাসছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি সাঁতার কাটতে পারেন না, তাই আমি তাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ডুবন্ত জাহাজ
থেকে টেনে নিয়ে আসি। সমুদ্র আরও অশান্ত হয়ে উঠছিল আর ভেসে থাকার জন্য যুদ্ধ করা আমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছিল। পরিস্থিতি হতাশাজনক বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু আমি সাহসের জন্য যিহোবার কাছে মিনতি করছিলাম আর এটাই আমাকে শক্তি জুগিয়েছিল। প্রেরিত পৌলের জাহাজডুবির অভিজ্ঞতাটাই ঘুরেফিরে আমার মনে পড়ছিল।—প্রেরিত, ২৭ অধ্যায়।আমার সঙ্গীকে ধরে রেখে, আমি চার ঘন্টা ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলাম, যখনই শক্তি পাচ্ছিলাম সাঁতার কাটছিলাম এবং সাহায্যের জন্য যিহোবাকে ডাকছিলাম। অবশেষে, আমি একটা ডিঙি নৌকা এগিয়ে আসতে দেখেছিলাম। আমাকে উদ্ধার করা হয়েছিল কিন্তু আমার সঙ্গী ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছিলেন। আমরা যখন ইতালির বারি শহরে পৌঁছেছিলাম, তখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যেখানে আমার প্রাথমিক চিকিৎসা করা হয়। আমাকে কিছুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল এবং অনেক সাক্ষি আমাকে দেখতে এসেছিল এবং আমার যা প্রয়োজন ছিল, সেগুলো সদয়ভাবে জুগিয়েছিল। তারা যে-খ্রিস্টীয় প্রেম দেখিয়েছিল, তা হাসপাতালের ওয়ার্ডের অন্যান্যদের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। *
সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হওয়ার পর, আমাকে রোমে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। আমাকে শহরের কেন্দ্রস্থলে বাণিজ্যিক এলাকায় কাজ করতে বলা হয়েছিল, যেখানে যিহোবার সাহায্যে আমি পাঁচ বছর তা করেছিলাম। সর্বমোট ২০ বছর ধরে আমি ইতালিতে পরিচর্যা কাজ উপভোগ করেছিলাম এবং ইতালীয় লোকেদের ভালবেসে ফেলেছিলাম।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাওয়া
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আ্যরিয়াদনি এবং তার স্বামীর স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হতে থাকে। আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে আমি যদি তাদের কাছাকাছি থাকি, তা হলে তারা ভালবেসে আমার জন্য যা কিছু করেছিল, তা কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে পারব। তবে, আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, ইতালি ছেড়ে যাওয়া খুবই হৃদয়বিদারক ছিল। কিন্তু, দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইয়েরা অনুমতি দিয়েছিলেন এবং ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে আমি এথেন্সে অগ্রগামীর কাজ করছি, যেখানে ১৯৪৭ সালে আমি পূর্ণসময়ের পরিচর্যা কাজ শুরু করেছিলাম।
আমি আমার মণ্ডলীর নির্ধারিত এলাকায় কাজ করেছিলাম এবং শাখা অফিসের ভাইদের কাছে অনুরোধ করেছিলাম যাতে শহরের কেন্দ্রস্থলে বাণিজ্যিক এলাকাতেও কাজ করতে পারি। একজন অগ্রগামী সঙ্গীর সঙ্গে আমি তিন বছর সেই কাজ করেছিলাম। যাদেরকে বাড়িতে খুব একটা পাওয়া যায় না, তাদের কাছেও আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ সাক্ষ্য দিতে পেরেছিলাম।
যদিও, সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার কাজ করার আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বাড়ছে কিন্তু শারীরিক শক্তি বাড়ছে না। এখন আমার দাদাবাবু মৃত্যুতে ঘুমিয়ে আছেন। আ্যরিয়াদনি, যে আমার মায়ের মতোই, সে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আর পূর্ণসময়ের কাজ করার বছরগুলোতে আমার স্বাস্থ্য ভালই ছিল। কিন্তু সম্প্রতি, মার্বেল পাথরের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে আমার ডান হাত ভেঙে যায়। এরপর আবার পড়ে গিয়ে আমার শ্রোণীচক্র (পেলভিস) ভেঙে যায়। আমাকে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল এবং অনেক দিন বিছানায় থাকতে হয়েছিল। এখন আমি আর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারি না। আমি হাঁটার সময় লাঠি ব্যবহার করি এবং যদি কেউ সঙ্গে থাকে কেবল তখনই বাইরে যেতে পারি। তবুও, আমার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হবে এই আশা নিয়ে আমি আমার যথাসাধ্য করি। বাইবেল শিক্ষা কার্যক্রমে এমনকি সীমিতভাবে অংশগ্রহণ করাও আমার সুখ ও সন্তুষ্টির প্রধান উৎস হয়ে এসেছে।
পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় যে-আনন্দময় বছরগুলো কাটিয়েছিলাম, সেগুলো যখন আমি মনে করি, তখন আমার হৃদয় যিহোবার প্রতি কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি এবং তাঁর পার্থিব সংগঠন নিয়মিতভাবে নির্ভরযোগ্য নির্দেশনা ও মূল্যবান সাহায্য জুগিয়েছে, যা আমার জীবন তাঁর সেবায় ব্যয় করার সময় আমাকে যথাসাধ্য করতে সমর্থ করেছে। আমার আন্তরিক ইচ্ছা হল যেন যিহোবা তাঁর সেবা চালিয়ে যেতে আমাকে শক্তিশালী করেন। তাঁর পরিচালনায় বিশ্বব্যাপী বাইবেল শিক্ষা কার্যক্রমে আমার সামান্য অংশের জন্য আমি আনন্দিত।—মালাখি ৩:১০.
[পাদটীকাগুলো]
^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত যিহোবার সাক্ষিদের বর্ষপুস্তক ১৯৯৫ (ইংরেজি) বইয়ের ৭৩-৮৯ পৃষ্ঠা দেখুন।
^ আরও তথ্যের জন্য, ১৯৭২ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকার ১২-১৬ পৃষ্ঠা দেখুন।
[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
গিলিয়েডে যাওয়ার সময়, আমার দিদি আ্যরিয়াদনি এবং তার স্বামী মাইকেলিসের সঙ্গে
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
রূত হেমিগ এবং আমাকে তুরস্কের ইস্তানবুলে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল
[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৭০ এর দশকের শুরুতে, ইতালিতে
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
বর্তমানে আমার দিদি আ্যরিয়াদনির সঙ্গে