সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

প্রেম, বিশ্বাস এবং বাধ্যতার এক প্রামাণিক সাক্ষ্য

প্রেম, বিশ্বাস এবং বাধ্যতার এক প্রামাণিক সাক্ষ্য

প্রেম, বিশ্বাস এবং বাধ্যতার এক প্রামাণিক সাক্ষ্য

 নিউ ইয়র্কের ওয়ালকিল ওয়াচটাওয়ার ফার্মে, ২০০৫ সালের ১৬ই মে-র সকালটা ছিল মনোরম এবং দিনটা ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। সুন্দরভাবে ছাঁটা লন এবং ফুলের বাগান, ভোরের আগে হওয়া বৃষ্টির কারণে চিকচিক করছিল। আটটা বাচ্চাসহ একটা হাঁস পুকুরের কিনারায় শান্ত জলের মধ্যে নীরবে সাঁতার কাটছিল। দর্শনার্থীরা সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল। তারা মৃদুস্বরে কথা বলছিল, যেন সকালের শান্ত অবস্থাকে নষ্ট করে দিতে চাইছিল না।

সেই দর্শনার্থীরা ছিল বিশ্বের ৪৮টা দেশ থেকে আসা যিহোবার সাক্ষিরা। কিন্তু, তারা সেই দৃশ্য দেখতে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালকিলের বেথেল কমপ্লেক্সে অতি সম্প্রতি যুক্ত হওয়া লাল ইট দিয়ে তৈরি বিশাল বিল্ডিংয়ের ভিতরে কী ঘটছে, সেটার প্রতি তারা আগ্রহী ছিল। সেই বিল্ডিংয়ের ভিতরে গিয়ে তারা আবারও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল, যদিও সেই দৃশ্য নীরব বা শান্ত কোনোটাই ছিল না।

একতলা ও দোতলার মধ্যবর্তী একটা স্থান থেকে, দর্শনার্থীদের চোখ যন্ত্রপাতির জটিল এক বিন্যাসের মধ্যে আটকে যায়। ছয়টা বড় ফুটবল মাঠের চেয়েও বৃহৎ আকৃতির ঝকঝকে পাকা মেঝে জুড়ে পাঁচটা বিশাল ছাপার যন্ত্র রয়েছে। এখানেই বাইবেল, বইপুস্তক এবং পত্রপত্রিকা ছাপানো হয়। বিশাল বিশাল কাগজের রোল, যেগুলোর প্রত্যেকটার ওজন ১,৭০০ কেজি, একটা দ্রুতগামী ট্রাকের চাকার মতো ঘোরে। প্রতিটা ২৩ কিলোমিটার কাগজের রোল পাক খুলতে থাকে এবং মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে ছাপার যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে। সেই সময়ের মধ্যে যন্ত্রটা কালি প্রয়োগ করে ও তা শুকিয়ে ফেলে এবং কাগজগুলোকে ঠাণ্ডা করে, যাতে সেগুলোকে এতটা দ্রুত পত্রিকার আকারে ভাঁজ করা যেতে পারে যে প্রত্যেকটা বাহক যন্ত্রও সেগুলোকে বাক্সে ভরে মণ্ডলীগুলোতে পাঠানোর জন্য তৈরি করতে পারে। অন্যান্য ছাপার যন্ত্রগুলো বইয়ের বিভিন্ন ফর্মা (বুক সিগ্নেচার) ছাপাতে ব্যস্ত, যেগুলোকে বাঁধাই করার জন্য দপ্তরিখানায় পাঠানো না পর্যন্ত খুব দ্রুত মেঝে থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত এক গুদাম ক্ষেত্রে রাখা হয়। এই কাজ কম্পিউটার নির্দেশিত এক নির্ভুল গতির ঐকতানের মাধ্যমে করা হয়।

ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে দর্শনার্থীরা দপ্তরিখানা ঘুরে দেখেছিল। এখানে বিভিন্ন মেশিন প্রতিদিন গড়ে ৫০,০০০ কপি পর্যন্ত শক্ত মলাটে বাঁধানো বই এবং ডিলাক্স বাইবেল তৈরি করে। বইয়ের ফর্মাগুলো পরপর ক্রমানুসারে সাজানো হয়, বাঁধাই করা হয় এবং কিনারাগুলো সুবিন্যস্তভাবে কাটা হয়। এরপর কভারগুলো লাগানো হয়। প্রস্তুতকৃত বইয়ের স্তূপ কার্টনগুলোর মধ্যে ভরা হয়। কার্টনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্ত করে বন্ধ করা হয়, সেগুলোতে লেবেল লাগানো হয় এবং প্যালেটের মধ্যে স্তূপীকৃত করা হয়। অধিকন্তু, সাধারণ কাগজের মলাটযুক্ত বই তৈরির প্রণালী দৈনিক প্রায় ১,০০,০০০ বই একত্র করে এবং বাক্সে ভরে। এই প্রণালীর অন্তর্ভুক্ত যন্ত্রপাতির এক বিরাট জগৎ—অসংখ্য মটর, বাহক, গিয়ার, চাকা এবং বেল্ট—সমস্তকিছুই বাইবেল সাহিত্যাদি প্রস্তুত করার জন্য বিস্ময়কর গতিতে চলছে।

সুসংগঠিত পর্যবেক্ষণের নির্ভুলতা সহকারে পরিচালিত ছাপাখানার উচ্চগতি, যন্ত্রপাতির প্রযুক্তিক উন্নয়ন আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার এক বিস্ময়। আমরা যেমন দেখব যে, এটা ঈশ্বরের লোকেদের প্রেম, বিশ্বাস এবং বাধ্যতারও এক প্রামাণিক সাক্ষ্য। কিন্তু, কেন ছাপাখানার কাজ ব্রুকলিন থেকে নিউ ইয়র্কের ওয়ালকিলে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল?

একটা প্রধান কারণ ছিল, একটা স্থানের মধ্যে পরিচালনার কাজকে নিয়ে আসার মাধ্যমে ছাপানো এবং পাঠানোর কাজ সহজ করা। কয়েক দশক ধরে, ব্রুকলিনে বইপুস্তক ছাপানো এবং সেখান থেকে পাঠানো হতো আর ওয়ালকিলে পত্রপত্রিকা ছাপানো এবং সেখান থেকে পাঠানো হতো। একসঙ্গে কাজগুলো করলে তা কর্মীদের সংখ্যা হ্রাস করবে এবং উৎসর্গীকৃত তহবিল আরও ভালভাবে ব্যবহার করা যাবে। তা ছাড়া, ব্রুকলিনের ছাপাখানা যেহেতু অনেক পুরনো হয়ে গিয়েছিল, তাই দুটো নতুন এমএএন রোল্যান্ড লিথোম্যান ছাপার যন্ত্র জার্মানি থেকে নিয়ে আসার জন্য অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। এই যন্ত্রগুলো এত বড় ছিল যে, তা ব্রুকলিনের ছাপাখানায় স্থাপন করা যেত না।

যিহোবা এই কাজে সমর্থন করেন

সবসময়ই ছাপানোর উদ্দেশ্য ছিল, ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচারকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এই বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছে যে, একেবারে শুরু থেকে এই কাজে যিহোবার আশীর্বাদ রয়েছে। ১৮৭৯ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বইপুস্তক বাণিজ্যিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাপানো হতো। ১৯২২ সালে, ব্রুকলিনের ১৮ কনকর্ড স্ট্রিটে একটা ছয়তলা বিল্ডিং ভাড়া নেওয়া হয় এবং বইপুস্তক ছাপানোর জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়। সেই সময়, কেউ কেউ এই বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল যে, ভাইয়েরা এই কাজ পরিচালনা করতে পারবে কি না।

সন্দেহভাজনদের মধ্যে একজন ছিলেন সেই কোম্পানির সভাপতি, যে-কোম্পানি আমাদের বেশির ভাগ বইপুস্তক ছাপানোর কাজ করত। কনকর্ড স্ট্রিটে পরিদর্শন করতে এসে তিনি বলেছিলেন: “আপনাদের এখানে সর্বোচ্চ মানের ছাপাখানা রয়েছে ঠিকই কিন্তু আপনাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যিনি কীভাবে এটা পরিচালনা করতে হয়, তা জানেন। ছয় মাসের মধ্যে এই সমস্তকিছু এক বাতিল যন্ত্রপাতিতে পরিণত হবে; আর আপনারা দেখতে পাবেন যে, আপনাদের ছাপানোর জন্য উপযুক্ত লোকেরা হল তারা, যারা সবসময় তা করে এসেছে আর এই বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠেছে।”

সেই সময়কার ছাপাখানার অধ্যক্ষ রবার্ট জে. মার্টিন মন্তব্য করেছিলেন: “কথাগুলোকে যথেষ্ট যুক্তিসংগত বলে মনে হয়েছিল কিন্তু এই কথাগুলোর মাধ্যমে প্রভুকে উপেক্ষা করা হয়েছিল; আর তিনি সবসময় আমাদের সঙ্গে আছেন। . . . খুব শীঘ্রই আমরা বইপুস্তক ছাপাতে শুরু করেছিলাম।” পরবর্তী ৮০ বছর ধরে, যিহোবার সাক্ষিরা তাদের নিজেদের ছাপাখানায় কোটি কোটি সাহিত্য ছাপিয়েছে।

এরপর ২০০২ সালের ৫ই অক্টোবর, ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যন্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি অভ্‌ পেনসিলভানিয়ার বার্ষিক সভাতে ঘোষণা করা হয় যে, পরিচালক গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের শাখা অফিসের ছাপাখানার কাজ ওয়ালকিলে স্থানান্তর করার বিষয়টা অনুমোদন করেছে। দুটো নতুন ছাপার যন্ত্রের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল এবং ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেগুলো সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল। ভাইদের ছাপাখানার নকশা করার ও তা সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা করতে এবং সেই নতুন যন্ত্রগুলো গ্রহণ করার জন্য ১৫ মাসের মধ্যে প্রস্তুত থাকতে হয়েছিল। এরপর, নতুন দপ্তরিখানা এবং পাঠানোর প্রণালীগুলো স্থাপন করার কাজ পরবর্তী ৯ মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হয়েছিল। কেউ কেউ হয়তো সন্দেহ করেছিল, যখন তারা সময়সূচি সম্বন্ধে শুনেছিল—কাজটা অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ভাইয়েরা জানত যে, যিহোবার আশীর্বাদে তা করা যেতে পারে।

‘সহযোগিতার আনন্দিত মনোভাব’

যিহোবার লোকেরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিলিয়ে দেবে, তা জেনে ভাইয়েরা প্রকল্প শুরু করেছিল। (গীতসংহিতা ১১০:৩) এই বিরাট কাজের জন্য বেথেল নির্মাণ বিভাগের মধ্যে যতজন ছিল, তার চেয়েও বেশি কর্মীর প্রয়োজন হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা থেকে নির্মাণ কাজে দক্ষ এমন ১,০০০রেরও বেশি ভাই ও বোন ক্ষণস্থায়ী স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে তিন মাস পর্যন্ত সেবা করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হয়েছিল। আন্তর্জাতিক দাস এবং স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম থেকে অন্যদেরকে এই প্রকল্পে অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। রিজিওনাল বিল্ডিং কমিটিও এতে বিরাট অবদান রেখেছিল।

অনেকের জন্য ওয়ালকিল প্রকল্পে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করার অর্থ ছিল ভ্রমণের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টাকাপয়সা খরচ করা এবং নিজস্ব চাকরি থেকে যথেষ্ট সময় করে নেওয়া। তা সত্ত্বেও, তারা আনন্দের সঙ্গে এই সমস্ত ত্যাগস্বীকার করেছিল। অতিরিক্ত এই স্বেচ্ছাসেবকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা বেথেল পরিবারকে এই প্রকল্পে সাহায্য করার জন্য নিজেদের বিলিয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ব্রুকলিন, প্যাটারসন এবং ওয়ালকিলের বেথেল পরিবার থেকে ৫৩৫ জনেরও বেশি সদস্য সপ্তাহের অন্যান্য দিনে তাদের স্বাভাবিক কাজ করা ছাড়াও শনিবারগুলোতে এই প্রকল্পে স্বেচ্ছায় কাজ করেছিল। ঈশ্বরের লোকেরা এই ঐতিহাসিক প্রচেষ্টায় যে-ব্যাপক সমর্থন জুগিয়েছিল, তা একমাত্র সম্ভব হয়েছিল কারণ যিহোবা এই প্রকল্পে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছিলেন।

অন্যেরা আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, ভাইয়েরা নয় বছর বয়সি আ্যবির কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছিল। সে লিখেছিল: “আপনারা যেসমস্ত কাজ করছেন—চমৎকার সব বই তৈরি করছেন—তার জন্য আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আমি হয়তো শীঘ্রই আপনাদের দেখতে আসব। আমার বাবা বলেছেন আগামী বছর! আমি একটা ব্যাজ পরব, যাতে আপনারা আমাকে চিনতে পারেন। নতুন ছাপাখানার জন্য এখানে ২০ ডলার রয়েছে! এটা আমার হাতখরচের টাকা কিন্তু এটা আমি আপনাদের দিতে চাই।”

একজন বোন লিখেছিলেন: “দয়া করে কুরুশকাঁটা দিয়ে বোনা টুপিগুলো উপহার হিসেবে গ্রহণ করুন, যেগুলো আমি নিজে আমার ক্ষুদ্র হাতে তৈরি করেছি। এই টুপিগুলো আমি সেইসমস্ত কর্মীদের দিতে চাই, যারা ওয়ালকিল প্রকল্পে কাজ করছে। একটা পঞ্জিকা জানিয়েছে যে, শীঘ্রই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পরতে যাচ্ছে। সেটা সঠিক কি না আমি জানি না। কিন্তু, আমি জানি যে, ওয়ালকিলের বেশির ভাগ কাজ বাইরে করা হবে এবং আমি এই বিষয়টা নিশ্চিত করতে চাই যে, আমার ভাই ও বোনদের মাথা যেন উষ্ণ থাকে। আমার এমন কোনো দক্ষতা নেই, যা ভাইয়েরা চেয়েছিল কিন্তু আমি কুরুশকাঁটা দিয়ে বোনার কাজ করতে পারি, তাই আমি এই দক্ষতাকে যতটুকু পারি দান করার জন্য ব্যবহার করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” এই চিঠির সঙ্গে কুরুশকাঁটা দিয়ে বোনা ১০৬টা টুপি ছিল!

ছাপাখানার কাজ সময়মতো শেষ হয়েছিল। ছাপাখানার অধ্যক্ষ জন লারসন বলেছিলেন: “সেখানে এই ধরনের সহযোগিতার আনন্দিত মনোভাব ছিল। যিহোবা যে এই কাজে আশীর্বাদ করেছিলেন, সেই বিষয়ে কেই বা সন্দেহ করতে পারে? সমস্তকিছু অত্যন্ত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল। আমার মনে পড়ছে, ২০০৩ সালের মে মাসে এই মাটিতে দাঁড়িয়ে ভাইদের বিল্ডিংয়ের ভিত্তি স্থাপন করতে দেখেছিলাম। এক বছরেরও কম সময় পরে, আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছাপাখানার কাজ হতে দেখছি।”

উৎসর্গীকরণ কার্যক্রম

নতুন ছাপাখানা ও সেইসঙ্গে তিনটে বাসভবন উৎসর্গীকরণ কার্যক্রম, ২০০৫ সালের ১৬ই মে সোমবার ওয়ালকিলে অনুষ্ঠিত হয়। প্যাটারসন এবং ব্রুকলিনের বেথেল ও সেইসঙ্গে কানাডার বেথেল ভিডিও লাইনের দ্বারা সংযুক্ত ছিল। সব মিলিয়ে, ৬,০৪৯ জন কার্যক্রম উপভোগ করেছিল। যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালক গোষ্ঠীর একজন সদস্য থিওডোর জারাস সভাপতি হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং ছাপানোর কাজের ইতিহাস সম্বন্ধে এক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার এবং ভিডিও উপস্থাপনের মাধ্যমে শাখা কমিটির সদস্য জন লারসন ও জন কিকট, যুক্তরাষ্ট্রে নির্মাণ প্রকল্প এবং ছাপানোর কাজের ইতিহাস সম্বন্ধে পুনরালোচনা করেছিল। পরিচালক গোষ্ঠীর সদস্য জন বার শেষ বক্তৃতা দিয়েছিলেন, নতুন ছাপাখানা ও তিনটে বাসভবন যিহোবার উদ্দেশে উৎসর্গ করেছিলেন।

এর পরের সপ্তাহে প্যাটারসন এবং ব্রুকলিনের বেথেলকর্মীদের নতুন ব্যবস্থাগুলো দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় সব মিলিয়ে ৫,৯২০ জন পরিদর্শন করেছিল।

ছাপাখানাকে আমরা কীভাবে দেখি?

উৎসর্গীকরণের বক্তৃতার সময় ভাই বার তার শ্রোতাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, যদিও ছাপাখানা অনেক অসাধারণ কিন্তু তা যন্ত্রপাতির জন্য নয়। বরং, তা লোকেদের জন্য। আমরা যে-সাহিত্যাদি ছাপিয়ে থাকি, তা লোকেদের ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলে।

ছাপার প্রতিটা নতুন যন্ত্র শুধু এক ঘন্টার মধ্যে লক্ষ লক্ষ ট্র্যাক্ট ছাপাতে পারে। অথচ, মাত্র একটি ট্র্যাক্ট একজন ব্যক্তির জীবনের ওপর এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯২১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় রেলপথ দেখাশোনা করেন এমন লোকেদের একটা দল রেল লাইনে কাজ করছিল। সেই দলের মধ্যে থেকে ক্রিস্টিয়ান নামে একজন ব্যক্তি রেল লাইনের নীচে এক টুকরো কাগজ পড়ে থাকতে দেখেন। এটি ছিল আমাদের একটি ট্র্যাক্ট। ক্রিস্টিয়ান সেটি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়েন। তিনি দৌড়ে তার জামাতার কাছে যান এবং অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলেন: “আজকে আমি সত্য খুঁজে পেয়েছি!” এর কিছুদিন পর, তারা আরও তথ্যের জন্য লিখে পাঠান। দক্ষিণ আফ্রিকার শাখা অফিস অন্যান্য বাইবেল সাহিত্য পাঠায়। এই দুজন ব্যক্তি অধ্যয়ন করে, বাপ্তিস্ম নেয় এবং অন্যদেরকে বাইবেলের সত্য জানায়। এর ফলে অনেকে সত্য গ্রহণ করে। বস্তুতপক্ষে, ১৯৯০ সালের প্রথম দিকের মধ্যে তাদের বংশ থেকে একশো জনেরও বেশি যিহোবার সাক্ষি হয়েছিল—এর সমস্তকিছুই একজন ব্যক্তি রেল লাইন থেকে মাত্র একটি ট্র্যাক্ট খুঁজে পেয়েছিলেন বলে হয়েছিল!

আমরা যে-সাহিত্যাদি ছাপাই, ভাই বার বলেন, সেগুলো লোকেদের সত্যের দিকে নিয়ে আসে, তাদেরকে সত্যের মধ্যে রাখে, তাদের আরও উদ্যোগী হতে অনুপ্রাণিত করে এবং ভ্রাতৃসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে। আর সর্বোপরি যে-সাহিত্যাদি বিতরণে আমাদের সকলের অংশ রয়েছে, সেগুলো আমাদের ঈশ্বর যিহোবাকে গৌরবান্বিত করে!

ছাপাখানাকে যিহোবা কোন দৃষ্টিতে দেখেন?

এ ছাড়া, ভাই বার ছাপাখানাকে যিহোবা কোন দৃষ্টিতে দেখেন, সেই বিষয়টা শ্রোতাদের বিবেচনা করতে বলেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই তিনি এর ওপর নির্ভর করেন না। তিনি পাথরকে দিয়েও সুসমাচার প্রচার করাতে পারেন! (লূক ১৯:৪০) অধিকন্তু, তিনি যন্ত্রপাতির জটিলতা, আকার, গতি অথবা ক্ষমতা দেখে প্রভাবিত হন না। কারণ তিনিই নিখিলবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন! (গীতসংহিতা ১৪৭:১০, ১১) যিহোবা সাহিত্যাদি উৎপন্ন করার আরও অগ্রগতিমূলক বিভিন্ন উপায় সম্বন্ধে জানেন, যে-উপায়গুলো মানুষের পক্ষে পরিকল্পনা করা অথবা কল্পনা করাও কঠিন। তাই, যিহোবা কী দেখেন, যা তাঁর কাছে সত্যিই মূল্যবান? নিশ্চিতভাবেই, তিনি এই ছাপাখানার মধ্যে তাঁর লোকেদের মূল্যবান গুণগুলো—তাদের প্রেম, বিশ্বাস এবং বাধ্যতা—দেখেন।

প্রেমের বৈশিষ্ট্যকে উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল। একটা মেয়ে তার বাবামার জন্য একটা কেক তৈরি করে। সম্ভবতই, বাবামা হয়তো অনেক খুশি হবে। হ্যাঁ, কেক যেমনই হোক না কেন, যে-বিষয়টা বাবামাকে প্রভাবিত করে সেটা হল সন্তানের প্রেম, যা তার উদার কাজের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে। একইভাবে, যিহোবা যখন এই নতুন ছাপাখানা দেখেন, তখন তিনি বিল্ডিং এবং যন্ত্রপাতির চেয়ে আরও বেশি কিছু দেখেন। মূলত, তিনি এটাকে তাঁর নামের প্রতি প্রেমের এক প্রকাশ হিসেবে দেখেন।—ইব্রীয় ৬:১০.

তা ছাড়া, যিহোবা যেমন জাহাজকে নোহের বিশ্বাসের প্রকাশ হিসেবে দেখেছিলেন, তেমনই তিনি এই ছাপাখানাকে আমাদের বিশ্বাসের বাস্তব প্রমাণ হিসেবে দেখেন। কীসের প্রতি বিশ্বাস? নোহের এই বিশ্বাস ছিল যে, যিহোবা যা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা সত্য হবেই। আমাদের বিশ্বাস রয়েছে যে, আমরা শেষকালে বাস করছি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সুসমাচার সারা পৃথিবীতে ঘোষিত হচ্ছে আর লোকেদের জন্য তা শোনা অত্যন্ত জরুরি। আমরা জানি যে, বাইবেলের বার্তা পরিত্রাণ করতে বা জীবন রক্ষা করতে পারে।—রোমীয় ১০:১৩, ১৪.

নিঃসন্দেহে, এই ছাপাখানার মধ্যে যিহোবা আমাদের বাধ্যতার প্রকাশও দেখে থাকেন। আমরা যেমন জানি যে, ঈশ্বরেরই ইচ্ছা হল শেষ আসার আগে যাতে পৃথিবীব্যাপী সুসমাচার প্রচার করা হয়। (মথি ২৪:১৪) এটা ও সেইসঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যে-ছাপাখানা রয়েছে, সেগুলো এই দায়িত্ব পরিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে।

হ্যাঁ, আর্থিক দান, নির্মাণ কাজ এবং এই ব্যবস্থা পরিচালনা করার মধ্যে যে-প্রেম, বিশ্বাস এবং বাধ্যতা দেখানো হয়েছে, সেটা সমস্ত জায়গার যিহোবার লোকেদের উদ্যোগী কাজের মধ্যেও দেখা যায়, যখন তারা সেইসমস্ত লোকের কাছে প্রচার করে চলে, যারা তা শুনতে ইচ্ছুক।

[১১ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]

যুক্তরাষ্ট্রে ছাপার কাজের প্রসার

১৯২০: ৩৫ মার্টল আ্যভিনিউ, ব্রুকলিনে প্রথম রোটারি প্রেসে পত্রপত্রিকা ছাপানো হয়।

১৯২২: ১৮ কনকর্ড স্ট্রিটের ছয়তলা বিল্ডিংয়ে ছাপাখানা পুনর্স্থাপন করা হয়। তখন থেকে বইপুস্তক ছাপানো শুরু হয়।

১৯২৭: ছাপাখানা নতুন এক বিল্ডিংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যা ১১৭ আ্যডামস্‌ স্ট্রিটে নির্মাণ করা হয়।

১৯৪৯: আরও নয়তলা বাড়ানোর ফলে ছাপাখানার আকার দ্বিগুণ হয়।

১৯৫৬: আ্যডামস্‌ স্ট্রিট ছাপাখানা আবারও দ্বিগুণ করা হয়, যখন ৭৭ স্ট্যান্ডস্‌ স্ট্রিটে নতুন বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়।

১৯৬৭: দশতলা ভবন নির্মাণ করা হয়, যার ফলে মূল ভবনের চেয়ে দশগুণ বড় আন্তঃসংযোগ ছাপাখানা তৈরি করা সম্ভবপর হয়।

১৯৭৩: ওয়ালকিলে সম্পূরক ছাপাখানা নির্মাণ করা হয়, মূলত পত্রপত্রিকা তৈরির জন্য।

২০০৪: যুক্তরাষ্ট্রে সমস্ত ছাপানো, বাঁধানো এবং পাঠানোর কাজ ওয়ালকিলে একত্রিত করা হয়।