সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আট ছেলেমেয়েকে যিহোবার পথে মানুষ করে তোলা ছিল এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আনন্দ

আট ছেলেমেয়েকে যিহোবার পথে মানুষ করে তোলা ছিল এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আনন্দ

জীবন কাহিনী

আট ছেলেমেয়েকে যিহোবার পথে মানুষ করে তোলা ছিল এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আনন্দ

বলেছেন জ্যাসলিন ভ্যালেনটাইন

১৯৮৯ সালে আমার স্বামী কাজের জন্য বিদেশে চলে যায়। সে সেখান থেকে বাড়িতে টাকাপয়সা পাঠাবে বলে প্রতিজ্ঞা করে, যাতে আমি আমার আট ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ করতে পারি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে যায় কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো খবরই পাই না। এমনকি মাসের পর মাস কেটে যায় কিন্তু আমার স্বামীর কোনো খোঁজ নেই। আমি বার বার নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে থাকি যে, ‘তার অবস্থা ভাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে বাড়ি ফিরে আসবে।’

 টাকাপয়সা ছাড়া পরিবারের দেখাশোনা করতে হবে ভেবেই আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। যা ঘটছিল তা বিশ্বাস করতে না পেরে আমি রাতের পর রাত জেগে মনে মনে ভাবতাম, ‘সে কীভাবে তার নিজের পরিবারের সঙ্গে এমনটা করতে পারল?’ শেষ পর্যন্ত আমি এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছিলাম যে, আমার স্বামী আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ১৬ বছর পেরিয়ে গিয়েছে কিন্তু আজও সে ফিরে আসেনি। ফলে, আমি সাথির সাহায্য ছাড়াই আমার ছেলেমেয়েকে মানুষ করে তুলেছি। এটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা যিহোবার পথকে গ্রহণ করে নিয়েছে দেখা আমাকে প্রচুর আনন্দ দিয়েছে। তবে, একটা পরিবার হিসেবে কীভাবে আমরা সবকিছু সামলে নিয়েছি তা বলার আগে আমি আপনাদের বলতে চাই যে, আমি কীভাবে বড় হয়ে উঠেছি।

বাইবেলের নির্দেশনা খোঁজা

আমি ১৯৩৮ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরের জামাইকা দ্বীপে জন্মগ্রহণ করি। যদিও বাবা কখনোই কোনো গির্জার সদস্য ছিলেন না, তবুও তিনি নিজেকে ঈশ্বরভয়শীল ব্যক্তি বলে মনে করতেন। প্রায় রাতে, তিনি আমাকে বাইবেলের গীতসংহিতা বই থেকে পড়ে শোনাতে বলতেন। অল্প সময়ের মধ্যেই, আমি গীতসংহিতার অনেক কটা বই মুখস্থ বলতে পারতাম। আমার মা স্থানীয় এক গির্জার সদস্যা ছিলেন আর তিনি মাঝেমধ্যেই আমাকে ধর্মীয় সভাগুলোতে নিয়ে যেতেন।

সেই সভাগুলোতে আমাদের বলা হয়েছিল যে, ঈশ্বর ভাল লোকেদের স্বর্গে নিয়ে যান এবং খারাপ লোকেদের চিরকালের জন্য নরকাগ্নিতে জ্বলতে দেন। এ ছাড়া, আমাদের এও বলা হয়েছিল, যিশু হলেন ঈশ্বর এবং তিনি ছেলেমেয়েদের ভালবাসেন। আমি বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং ঈশ্বরকে ভয় পেয়েছিলাম। আমি মনে মনে ভেবেছিলাম, ‘যে-ঈশ্বর আমাদের ভালবাসেন, তিনি কীভাবে লোকেদের আগুনে যন্ত্রণা দিতে পারেন?’

নরকাগ্নির বিষয়টা ভেবে আমি অনেক দুঃস্বপ্ন দেখতাম। কিছু সময় পর, আমি সেভেন্থ-ডে আ্যডভেনটিস্ট গির্জার দ্বারা আয়োজিত এক বাইবেল করেসপন্ডেন্স কোর্স করেছিলাম। তারা শিখিয়েছিল যে, দুষ্ট লোকেরা চিরকালের জন্য যন্ত্রণা ভোগ করবে না বরং তারা আগুনে জ্বলে ছাই হয়ে যাবে। এই ধারণাটি বেশি যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল আর তাই আমি তাদের ধর্মীয় সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু, পরে তাদের শিক্ষাগুলো আমার কাছে বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়েছিল আর আমি যা শিখেছিলাম, তা নৈতিকতা সম্বন্ধীয় আমার ভুল ধারণাগুলোকে শুধরে দেয়নি।

সেই সময়ে লোকেরা সাধারণত ব্যভিচারকে অন্যায় বলে মনে করত। তবে, আমি এবং আরও অনেকে বিশ্বাস করতাম যে, যারা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে তারাই কেবলমাত্র ব্যভিচারী। অতএব, দুজন অবিবাহিত ব্যক্তি যদি শুধুমাত্র তাদের দুজনের মধ্যেই যৌনসম্পর্ককে সীমিত রাখে, তা হলে তারা পাপ করছে না। (১ করিন্থীয় ৬:৯, ১০; ইব্রীয় ১৩:৪) এই ধরনের বিশ্বাস থাকায় আমি অবিবাহিত অবস্থায় ছয় ছেলেমেয়ের মা হয়েছিলাম।

আধ্যাত্মিক উন্নতি করা

১৯৬৫ সালে, ভ্যাসলিন গুডিসন ও এথেল চেম্বার্স নামে দুজন মহিলা বাথের কাছাকাছি এলাকায় বসবাস করার জন্য এসেছিল। তারা ছিল অগ্রগামী বা যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণসময়ের পরিচারক এবং একদিন তারা আমার বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল। তিনি তাদের দেওয়া গৃহ বাইবেল অধ্যয়ন করার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। তারা যখন আমাদের বাড়িতে আসত, তখন আমি যদি বাড়িতে থাকতাম, তা হলে তারা আমার সঙ্গেও কথা বলত। যদিও আমি যিহোবার সাক্ষিদের খুবই সন্দেহের চোখে দেখতাম, তবুও আমি তাদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাতে তাদেরকে ভুল বলে প্রমাণ করতে পারি।

অধ্যয়নের সময় আমি তাদেরকে একটার পর একটা প্রশ্ন করতাম আর সাক্ষিরা সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বাইবেল থেকে দিত। তাদের সাহায্যে আমি জেনেছিলাম যে, মৃতেরা অচেতন ও তারা নরকে যন্ত্রণা ভোগ করে না। (উপদেশক ৯:৫, ১০) এ ছাড়া, আমি পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্তজীবন পাওয়ার আশা সম্বন্ধে শিখেছিলাম। (গীতসংহিতা ৩৭:১১, ২৯; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) যদিও আমার বাবা বাইবেল অধ্যয়ন করা ছেড়ে দিয়েছিলেন, আমি যিহোবার সাক্ষিদের স্থানীয় মণ্ডলীর সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করেছিলাম। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠিত সেই সভাগুলো আমাকে যিহোবার সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু শেখার সুযোগ করে দিয়েছিল। এ ছাড়া, আমি সাক্ষিদের দ্বারা আয়োজিত আরও বড় বড় সমাবেশ যেমন, সীমা সম্মেলন ও জেলা সম্মেলনগুলোতেও যোগ দিতাম। বাইবেলের সংস্পর্শে আসার এই সুযোগ, আমার মধ্যে যিহোবাকে গ্রহণযোগ্যভাবে উপাসনা করার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিল। কিন্তু, আমার একটা বাধাও ছিল।

সেই সময়ে, আমি আমার ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে তিন ছেলেমেয়ের বাবার সঙ্গে বিয়ে না করেই একসঙ্গে বাস করছিলাম। বাইবেল থেকে আমি শিখেছিলাম যে, ঈশ্বর বিয়ের বাইরে যৌনসম্পর্ককে নিন্দা করেন আর আমার বিবেক আমাকে দংশন করতে থাকে। (হিতোপদেশ ৫:১৫-২০; গালাতীয় ৫:১৯) সত্যের প্রতি আমার প্রেম যতই গভীর হতে থাকে, ততই আমি ঈশ্বরের আইনের সঙ্গে মিল রেখে আমার জীবনকে চালানোর আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত, আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছিলাম। যে-পুরুষের সঙ্গে আমি সহবাস করছিলাম তাকে আমি বলেছিলাম যে, হয় আমরা বিয়ে করব নতুবা আমাদের সম্পর্ককে এখানেই শেষ করব। আমার সাথি যদিও আমার বিশ্বাসকে গ্রহণ করেনি কিন্তু আমরা ১৯৭০ সালের ১৫ই আগস্ট সরকারিভাবে বিয়ে করেছিলাম, সাক্ষিরা প্রথম আমার সঙ্গে কথা বলার পাঁচ বছর পর এটা ঘটেছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমি আমার উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

পরিচর্যার কথা বলতে গেলে, আমি কখনও সেইদিনটা ভুলবো না যেদিন প্রথম প্রচার কাজে অংশ নিয়েছিলাম। আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আর জানতাম না যে, কীভাবে একটা বাইবেল আলোচনা শুরু করতে হয়। আসলে, আমি স্বস্তিবোধ করেছিলাম যখন প্রথম গৃহকর্তা তাড়াতাড়ি আলোচনা শেষ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য, শীঘ্রই আমি ঘাবড়ে যাওয়া ভাব কাটিয়ে উঠেছিলাম। দিনের শেষে আমি খুব আনন্দিত ছিলাম কারণ অনেক লোকের কাছে আমি বাইবেল থেকে কিছু সময় কথা বলতে পেরেছিলাম ও তাদের কাছে আমাদের কিছু বাইবেলভিত্তিক প্রকাশনা ছেড়ে এসেছিলাম।

পরিবারকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী রাখা

১৯৭৭ সালের মধ্যে আমাদের পরিবারে আট ছেলেমেয়ে হয়েছিল। যিহোবাকে সেবা করার জন্য পরিবারকে সাহায্য করতে আমার যথাসাধ্য করার ব্যাপারে আমি দৃঢ়সংকল্প ছিলাম। (যিহোশূয়ের পুস্তক ২৪:১৫) তাই, আমি এক নিয়মিত পারিবারিক বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম। মাঝে মাঝে ক্লান্ত থাকতাম বলে ছেলেমেয়েদের একজন জোরে জোরে অনুচ্ছেদটি পড়া সত্ত্বেও আমি ঘুমিয়ে পড়তাম আর তারা আমাকে জাগিয়ে তুলত। কিন্তু ক্লান্তির জন্য পরিবারগতভাবে আমাদের বাইবেল অধ্যয়ন কখনোই বন্ধ হয়নি।

এ ছাড়া, আমি প্রায়ই আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রার্থনা করতাম। তারা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তাদেরকে নিজের ভাষায়প্রার্থনা করতে শিখিয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত হয়ে নিতাম যে, তারা প্রত্যেকে শুতে যাওয়ার আগে ব্যক্তিগতভাবে প্রার্থনা করে শুয়েছে। যে-ছেলেমেয়েরা এত ছোট ছিল যে, প্রার্থনা করতে পারত না, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে আমি প্রার্থনা করেছিলাম।

আমি যে ছেলেমেয়েদেরকে মণ্ডলীর সভাগুলোতে নিয়ে যেতাম, তাতে প্রথম প্রথম আমার স্বামী বিরোধিতা করেছিল। তবে, আমি সভাগুলোতে থাকার সময় তাকে ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতে হতে পারে, এই সম্ভাবনার কারণে তার বিরোধিতা কমে গিয়েছিল। রাতে সে বাইরে যেতে ও তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালবাসত কিন্তু আট ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তা করার বিষয়টা তার কাছে আগ্রহজনক ছিল না! পরে, সে এমনকি কিংডম হলে যাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েদের তৈরি করতে আমাকে সাহায্য করতে শুরু করেছিল।

ছেলেমেয়েরা শীঘ্রই মণ্ডলীর সব সভাতে যোগ দেওয়ার ও জনসাধারণের পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল। গ্রীষ্মের ছুটির সময়, তারা প্রায়ই মণ্ডলীর অগ্রগামী বা পূর্ণসময়ের পরিচারকদের সঙ্গে প্রচার কাজে বেরিয়ে পড়ত। এই সমস্তকিছু আমার অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে মণ্ডলীর এবং প্রচার কাজের প্রতি এক গভীর ভালবাসা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল।—মথি ২৪:১৪.

পরীক্ষার সময়গুলো

পরিবারের আর্থিক অবস্থার ক্ষেত্রে উন্নতি আনার জন্য আমার স্বামী কাজের উদ্দেশে বিদেশে যেতে শুরু করেছিল। সে দীর্ঘ সময়ের জন্য পরিবার থেকে দূরে থাকত, তবে নিয়মিতভাবে নির্দিষ্ট সময়ে ফিরেও আসত। কিন্তু, ১৯৮৯ সালে সে যে একবার চলে গেল আর ফিরে আসেনি। আগে যেমন উল্লেখ করেছি, আমার স্বামীকে হারিয়ে আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। রাতের পর রাত জেগে আমি কাঁদতাম এবং সান্ত্বনা ও ধৈর্যের জন্য যিহোবার কাছে অন্তর থেকে প্রার্থনা করতাম আর আমি অনুভব করতাম যে, তিনি আমার প্রার্থনার উত্তর দিয়েছিলেন। জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যিশাইয় ৫৪:৪ ও ১ করিন্থীয় ৭:১৫ পদের মতো শাস্ত্রপদগুলো আমাকে মনের শান্তি ও শক্তি জুগিয়েছে। খ্রিস্টীয় মণ্ডলীতে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরাও আমাকে মানসিক ও আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য করেছে। সাহায্যের জন্য যিহোবা এবং তাঁর লোকেদের কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।

আমাদের আরও অন্য ধরনের পরীক্ষাও এসেছিল। একবার আমার এক মেয়েকে অশাস্ত্রীয় আচরণের জন্য মণ্ডলী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। যদিও আমি আমার সব ছেলেমেয়েকে খুবই ভালবাসি কিন্তু তা সত্ত্বেও, যিহোবার প্রতি আমার আনুগত্য প্রথমে আসে। তাই, সেই সময়ে আমার অন্যান্য ছেলেমেয়ে ও আমি সমাজচ্যুত ব্যক্তিদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেই বিষয়ে দেওয়া বাইবেলের নির্দেশনাকে যথাযথভাবে মেনে চলেছিলাম। (১ করিন্থীয় ৫:১১, ১৩) যে-লোকেরা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে বুঝত না তারা অনেক সমালোচনা করেছিল। কিন্তু, আমার মেয়ে মণ্ডলীতে পুনরায় ফিরে আসার পর তার স্বামী আমাকে বলেছিল যে, বাইবেলের নীতিগুলোর জন্য আমাদের দৃঢ় পদক্ষেপ তার ওপর ছাপ ফেলেছিল। সে এখন তার পরিবারের সঙ্গে যিহোবার সেবা করছে।

আর্থিক সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হওয়া

আমার স্বামী যখন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তখন আমার কোনো বাঁধাধরা আয় ছিল না এবং পরিবার তার কাছ থেকে আর কোনো আর্থিক সাহায্য পাচ্ছিল না। এই পরিস্থিতি আমাদের এক সাধাসিধে জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে এবং বস্তুগত জিনিসগুলোর চেয়ে আধ্যাত্মিক ধনকে মূল্য দিতে শিখিয়েছিল। ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে ভালবাসতে ও সাহায্য করতে শেখায় তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। বড় ছেলেমেয়েরা চাকরি করতে শুরু করার পর স্বেচ্ছায় তাদের ছোট ভাইবোনদের সাহায্য করেছিল। আমার বড় মেয়ে মারসিরি তার ছোট বোন নিকলকে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করতে সাহায্য করেছিল। এ ছাড়া, আমি একটা ছোট্ট মুদিখানার দোকান সামলাতে সক্ষম ছিলাম। সীমিত আয় আমাদের কিছু বস্তুগত প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করেছিল।

যিহোবা আমাদের কখনোই পরিত্যাগ করেননি। একবার আমি একজন খ্রিস্টান বোনকে বলেছিলাম যে, আমাদের আর্থিক অবস্থার জন্য আমরা জেলা সম্মেলনে যোগ দিতে পারব না। তিনি উত্তরে বলেছিলেন: “বোন ভ্যাল, আপনি যখনই সম্মেলনের কথা শুনবেন, তখনই যাত্রা করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করুন! যিহোবা জোগাবেন।” আমি তার পরামর্শ শুনেছিলাম। যিহোবা জুগিয়েছিলেন আর তিনি এখনও জুগিয়ে চলেছেন। আমাদের পরিবার কখনো পয়সার অভাবে সম্মেলনগুলোতে উপস্থিত হতে পারেনি, এমন হয়নি।

১৯৮৮ সালে, গিলবার্ট ঘূর্ণিঝড় জামাইকাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল আর আমরা এক সুরক্ষিত জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। ঝড় কিছু সময়ের জন্য শান্ত হওয়ায় আমার ছেলে ও আমি আশ্রয়স্থল ছেড়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির এলাকা দেখতে সেখানে গিয়েছিলাম। ধ্বংসাবশেষের মধ্যে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আমি এমনকিছু পেয়েছিলাম, যেটাকে আমি যত্ন করে রাখতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ করে আবারও প্রচণ্ড বেগে হাওয়া বইতে শুরু করেছিল কিন্তু যেটা আমি উদ্ধার করেছিলাম সেটাকে তখনও ধরে রেখেছিলাম। “মা, টেলিভিশনটা রেখে দাও। তুমি কি লোটের স্ত্রী?” (লূক ১৭:৩১, ৩২) আমার ছেলের এই কথাগুলো আমার বোধশক্তি ফিরিয়ে এনেছিল। আমি ভিজে যাওয়া টিভিটা ফেলে দিয়েছিলাম এবং দুজনেই আশ্রয়স্থলের দিকে দৌঁড়ে গিয়েছিলাম।

একটা টিভির জন্য আমি নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছিলাম, এই বিষয়টা ভাবতেই আমার শরীর কেঁপে ওঠে। কিন্তু সেই সময়ে আমার ছেলের আধ্যাত্মিক সতর্কবাণীটি চিন্তা করে আমার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠে। খ্রিস্টীয় মণ্ডলী থেকে পাওয়া বাইবেলভিত্তিক প্রশিক্ষণের কারণে সে আমাকে গুরুতর শারীরিক ও সম্ভবত আধ্যাত্মিক ক্ষতি এড়াতে সাহায্য করতে পেরেছিল।

সেই ঘূর্ণিঝড় আমাদের বাড়ি ও সম্পদকে তছনছ করে দিয়েছিল আর আমরা অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এরপর আমাদের খ্রিস্টান ভাইয়েরা উপস্থিত হয়েছিল। আমাদের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেগুলোকে মেনে নিতে তারা আমাদেরকে যিহোবার ওপর নির্ভর করতে ও ক্রমাগতভাবে পরিচর্যায় সক্রিয় থাকতে উৎসাহিত করেছিল এবং তারা আমাদের পুনরায় বাড়ি নির্মাণ করার জন্য সাহায্য করেছিল। জামাইকার এবং বিদেশ থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবক সাক্ষিদের প্রেমময় ও আত্মত্যাগমূলক কাজ আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল।

যিহোবাকে প্রথম স্থান দেওয়া

আমার দ্বিতীয় মেয়ে মেলেন তার পড়াশোনা শেষ করার পর একজন অগ্রগামী পরিচারক হিসেবে সেবা করেছিল। তারপর সে অন্য আরেকটা মণ্ডলীতে একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, যার জন্য তাকে তার চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। যদিও সেই চাকরির মাধ্যমে সে আমাদের পরিবারকে বেশ ভাল আর্থিক সাহায্য জোগাতে পারত, তবুও আমরা আস্থাশীল ছিলাম যে, আমরা প্রত্যেকে যদি রাজ্যের কাজকে প্রথম স্থান দিই, তা হলে যিহোবা আমাদের যত্ন নেবেন। (মথি ৬:৩৩) পরবর্তী সময়ে আমার ছেলে ইউয়েনও একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার আমন্ত্রণ পেয়েছিল। সেও পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছিল কিন্তু আমরা তাকে আমন্ত্রণটা গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করেছিলাম এবং তার ওপর যিহোবার আশীর্বাদের কামনা করেছিলাম। আমি ছেলেমেয়েদেরকে তাদের রাজ্যের কাজকে বৃদ্ধি করার জন্য কখনো নিরুৎসাহিত করিনি আর আমরা যারা বাড়িতে ছিলাম আমাদের কখনো অভাব হয়নি। বরং আমাদের আনন্দ আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং কখনো কখনো আমরা অভাবী লোকেদের সাহায্যও করতে পেরেছি।

আজকে, আমার ছেলেমেয়েদের ‘সত্যে চলিতে’ দেখে খুব আনন্দ হয়। (৩ যোহন ৪) আমার এক মেয়ে মেলেন, সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবারত তার স্বামীর সঙ্গে ভ্রমণ কাজে সঙ্গ দিচ্ছে। আমার মেয়ে আনড্রিয়া ও তার স্বামী বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছে এবং তার স্বামী যখন বিকল্প সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে বিভিন্ন মণ্ডলী পরিদর্শন করে, তখন সে তার সঙ্গে যায়। আমার ছেলে ইউয়েন ও তার স্ত্রী বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছে এবং আমার ছেলে মণ্ডলীর একজন প্রাচীন। আরেক মেয়ে এভা গে তার স্বামীর সঙ্গে জামাইকাতে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে কাজ করছে। জেনিফার, জেনিভ ও নিকল তাদের স্বামী ও বাচ্চাদের সঙ্গে নিজ নিজ মণ্ডলীতে সক্রিয় সদস্য হিসেবে সেবা করছে। মারসিরি আমার সঙ্গে থাকে এবং আমরা দুজনে এখন পোর্ট ম্যারান্ট মণ্ডলীতে যোগ দিই। আমি প্রচুর আশীর্বাদ পেয়েছি কারণ আমার আট ছেলেমেয়েই যিহোবার উপাসনা করে যাচ্ছে।

সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমি এখন রিউম্যাটয়েড আর্থরাইটিসে (বাতের ব্যথা) ভুগছি কিন্তু এখনও আমি একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে পেরে আনন্দিত। তবে, কিছু সময় আগে আমি যেখানে থাকতাম সেখানকার উঁচু এলাকাগুলোতে হাঁটা আমার জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। পরিচর্যার জন্য বাইরে বের হওয়া আমার জন্য একটু কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমি সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম এবং দেখেছিলাম যে, হাঁটার চাইতে এটা সহজ। তাই, আমি একটা পুরনো সাইকেল কিনেছি ও সেটা ব্যবহার করতে শুরু করেছি। প্রথম প্রথম, আমার ছেলেমেয়েদের জন্য এটা দেখা কঠিন ছিল যে, তাদের আর্থরাইটিসে আক্রান্ত মা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, আমার মনের ইচ্ছা অনুযায়ী আমাকে ক্রমাগত প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে দেখে তারা খুব খুশি হয়েছিল।

যে-লোকেদের সঙ্গে আমি অধ্যয়ন করেছি তাদের বাইবেলের সত্যকে নিজের করে নিতে দেখা আমাকে প্রচুর আনন্দ দেয়। সবসময় এটাই আমার প্রার্থনা যে, যিহোবা আমার পরিবারের সবাইকে এই শেষ সময়ে ও চিরকালের জন্য তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করবেন। আমার আট ছেলেমেয়েকে যিহোবার পথে মানুষ করে তোলার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে মোকাবিলা করতে আমাকে সাহায্য করায় আমি মহান “প্রার্থনা-শ্রবণকারী” যিহোবার প্রশংসা করি ও তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।—গীতসংহিতা ৬৫:২.

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার ছেলেমেয়ে, তাদের সাথি ও আমার নাতিনাতনির সঙ্গে

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার পরিচর্যা চালিয়ে যেতে, এখন আমি একটা সাইকেল ব্যবহার করি