সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

‘বধিরগণ শুনিবে’

‘বধিরগণ শুনিবে’

‘বধিরগণ শুনিবে’

 কোনো বধির ব্যক্তি যদি এই কথাগুলো পড়তে পারতেন যে, ‘বধিরগণ শুনিবে,’ তা হলে তিনি কেমন বোধ করতেন? নিশ্চিতভাবে তার হৃদয়ে তা নাড়া দিত! যারা কানে শুনতে পায়, তাদের জন্য পাখির গান, বাচ্চার হাসি অথবা পাথরের উপকূলে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ কখনো শুনতে না পাওয়ার বিষয়টা কল্পনা করা খুবই কঠিন। অথচ, সারা পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ লোকের জন্য এটাই হল বাস্তবতা। প্রকৃতপক্ষে এমন কোনো আশা কি রয়েছে যে, বধিররা শুনতে পাবে? আসুন আমরা দেখি যে, বধিরতা এবং এই অক্ষমতা দূর হয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা সম্বন্ধে বাইবেল কী বলে।

বধিরতা হল আংশিক অথবা পুরোপুরিভাবে শুনতে না পাওয়ার অক্ষমতা আর তা প্রায়ই রোগব্যাধি, দুর্ঘটনা অথবা উচ্চ শব্দ, হতে পারে প্রচণ্ড এবং আকস্মিক বা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা শব্দের কারণে হয়ে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকেরা জন্ম থেকেই বধির হয়ে থাকে। বধিরতার আরেকটা যে-কারণের কথা বাইবেলে উল্লেখ করা হয়েছে তা হল, মন্দ আত্মার প্রভাব। মার্ক ৯:২৫-২৯ পদে যিশু সেই মন্দ আত্মাকে “বধির গোঁগা আত্মা” বলে উল্লেখ করেছিলেন, যা একজন অল্পবয়স্ক ছেলের ওপর ভর করেছিল।

ইব্রীয় শব্দ চেরেশ, যা যিশাইয় ৩৫:৫ পদে ‘বধির’ হিসেবে অনুবাদিত হয়েছে, সেটার উৎস হয় জড়বস্তুর বধিরতা নতুবা ব্যক্তির নীরবতাকে নির্দেশ করতে পারে। এটিকে কখনো কখনো, যেমন গীতসংহিতা ২৮:১ পদে “বধির হইও [অথবা হওয়া]” হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, যেখানে আমরা পড়ি: “সদাপ্রভু, আমি তোমাকে ডাকিতেছি; আমার শৈল, আমার প্রতি বধির হইও না।” আবার অন্যান্য সময়, যেমন গীতসংহিতা ৩৫:২২ পদে এটিকে ‘নীরব থাকা’ হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে, যেখানে বলা আছে, “সদাপ্রভু, তুমি দেখিয়াছ, নীরব থাকিও না।”

যিহোবাই কর্ণ সৃষ্টি করেছেন। “শ্রবণকারী কর্ণ ও দর্শনকারী চক্ষু, এই উভয়ই সদাপ্রভুর নির্ম্মিত।” (হিতোপদেশ ২০:১২) তিনি চান যেন তাঁর লোকেরা বধিরদের প্রতি বিবেচনা দেখায়। ইস্রায়েলীয়রা বধির ব্যক্তিদের উপহাস করতে অথবা তাদেরকে অভিশাপ দিতে পারত না কারণ বধিররা যা শোনে না, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। ঈশ্বরের আইন নির্দেশ দিয়েছিল, “তুমি বধিরকে শাপ দিও না, ও অন্ধের সম্মুখে বাধাজনক বস্তু রাখিও না, কিন্তু তোমার ঈশ্বরকে ভয় করিও; আমি সদাপ্রভু।”—লেবীয় পুস্তক ১৯:১৪. গীতসংহিতা ৩৮:১৩, ১৪ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।

কীভাবে যিহোবা ‘বধিরকে নির্ম্মাণ করেন?’

যাত্রাপুস্তক ৪:১১, ১২ পদে আমরা পড়ি, “সদাপ্রভু তাঁহাকে কহিলেন, মনুষ্যের মুখ কে নির্ম্মাণ করিয়াছে? আর বোবা, বধির, মুক্তচক্ষু বা অন্ধকে কে নির্ম্মাণ করে? আমি সদাপ্রভুই কি করি না?” যিহোবা যখন নিজেকে ‘বধির নির্ম্মাণ’ করেছেন বলে উল্লেখ করেন, তখন এর অর্থ এই নয় যে, সমস্ত ধরনের বধিরতার জন্য তিনিই দায়ী। তবে, কোনো নির্দিষ্ট কারণে অথবা উদ্দেশ্যে যিহোবা একজন ব্যক্তিকে আক্ষরিকভাবে বধির, কথা বলতে অক্ষম অথবা অন্ধ করতে পারেন। যোহন বাপ্তাইজকের বাবা অবিশ্বাস করেছিলেন বলে সাময়িকভাবে তাকে বাক্‌হীন করে ফেলা হয়েছিল।—লূক ১:১৮-২২, ৬২-৬৪.

এ ছাড়া, ঈশ্বর লোকেদের আধ্যাত্মিকভাবেও বধির করে “নির্ম্মাণ” করতে পারেন, যখন তারা সেই অবস্থায় থাকা বেছে নেয় এবং তিনি তাদেরকে সেভাবে থাকতে দেন। ভাববাদী যিশাইয়কে অবিশ্বস্ত ইস্রায়েলের কাছে গিয়ে এই কথা বলতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল, “তোমরা শুনিতে থাকিও, কিন্তু বুঝিও না; এবং দেখিতে থাকিও, কিন্তু জানিও না।” যিহোবা যিশাইয়কে আরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন, “তুমি এই জাতির অন্তঃকরণ স্থূল কর, ইহাদের কর্ণ ভারী কর, ও ইহাদের চক্ষু বন্ধ করিয়া দেও, পাছে তাহারা চক্ষে দেখে, কর্ণে শুনে, অন্তঃকরণে বুঝে, এবং ফিরিয়া আইসে, ও সুস্থ হয়।”—যিশাইয় ৬:৯, ১০.

নির্দেশনা শুনতে চায় না এমন দুষ্ট ব্যক্তিদের গীতরচক একটা কালসর্পের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, যেটা সাপুড়েদের স্বর শোনার ক্ষেত্রে নিজেকে বধির করে রাখে। (গীতসংহিতা ৫৮:৩-৫) একইভাবে, যিশাইয়ের দিনের ইস্রায়েলীয়দের যদিও কর্ণ ছিল তবুও তারা যিহোবার বাক্য শুনতে এবং তাতে সাড়া দিতে অসম্মত হওয়ায় একপ্রকার বধিরের মতোই ছিল। ভাববাদী যিশাইয়ের মাধ্যমে যিহোবা বলেছিলেন, “বাহির কর সেই অন্ধ জাতিকে, যাহার চক্ষু আছে; সেই বধিরগণকে, যাহাদের কর্ণ আছে।” (যিশাইয় ৪৩:৮; ৪২:১৮-২০) কিন্তু, ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বন্দিত্ব থেকে ফিরে আসার পর, ঈশ্বরের লোকেরা আধ্যাত্মিকভাবে বধির থাকবে না। তারা যিহোবার বাক্য শুনবে অর্থাৎ এর প্রতি মনোযোগ দেবে। এটাই ছিল সেই আধ্যাত্মিক পুনর্স্থাপন, যা যিহোবা ভাববাদী যিশাইয়ের মাধ্যমে এই কথা বলার দ্বারা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, “সেই দিন বধিরগণ পুস্তকের বাক্য শুনিবে, এবং তিমির ও অন্ধকারের মধ্য হইতে অন্ধদের চক্ষু দেখিতে পাইবে।” (যিশাইয় ২৯:১৮; ৩৫:৫) কিন্তু, বধিরতা থেকে আধ্যাত্মিকভাবে আরোগ্য লাভ করাই কি প্রত্যাশা করা মতো একমাত্র সুস্থতা ছিল?

বধিরদের জন্য এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পূর্বাভাস

পৃথিবীতে থাকাকালীন যিশু খ্রিস্ট অনেক বধির লোকের কর্ণ খুলে দিয়েছিলেন, আরোগ্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যা শুনেছে, সেই অনুযায়ী কাজ করার জন্য তাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। যারা তাঁর শিক্ষাগুলো শুনেছিল এবং তা গ্রহণ করেছিল, তাদেরকে তিনি বলেছিলেন, “ধন্য [“সুখী,” বাংলা জুবিলী বাইবেল] তোমাদের চক্ষু, কেননা তাহা দেখে, এবং তোমাদের কর্ণ, কেননা তাহা শুনে।” (মথি ১৩:১৬, ২৩) কিন্তু, আধ্যাত্মিকভাবে বধির ব্যক্তিদের আরোগ্য করা ছাড়াও যিশু আরও কিছু করেছিলেন।

যিশু তাঁর পার্থিব পরিচর্যার সময়, বেশ কয়েক বার আক্ষরিকভাবে বধির ব্যক্তিদের শোনার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অলৌকিকভাবে আরোগ্য করার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিলেন। যোহন বাপ্তাইজকের শিষ্যরা, কারাগারে তার কাছে এই সংবাদ নিয়ে গিয়েছিল, “অন্ধেরা দেখিতে পাইতেছে ও খঞ্জেরা চলিতেছে, কুষ্ঠীরা শুচীকৃত হইতেছে ও বধিরেরা শুনিতেছে, এবং মৃতেরা উত্থাপিত হইতেছে ও দরিদ্রদের নিকটে সুসমাচার প্রচারিত হইতেছে।” (মথি ১১:৫; লূক ৭:২২) যে-লোকেরা একজন বধির ব্যক্তিকে যিশুর কাছে নিয়ে এসেছিল এবং তাকে সুস্থ করার জন্য বিনতি করেছিল, তারা নিশ্চয়ই কত আনন্দিতই না হয়েছিল। সুসমাচারের বিবরণ আমাদের জানায় যে যিশু যখন বলেছিলেন, “খুলিয়া যাউক,” তখন সেই ব্যক্তির “কর্ণ খুলিয়া গেল।” শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। “তাহারা যার পর নাই চমৎকৃত হইল, বলিল, ইনি সকলই উত্তমরূপে করিয়াছেন, ইনি বধিরদিগকে শুনিবার শক্তি, এবং বোবাদিগকে কথা কহিবার শক্তি দান করেন।”—মার্ক ৭:৩২-৩৭.

যিশু, ঈশ্বরের সেই প্রতিজ্ঞাত রাজ্য সম্বন্ধে সুসমাচার প্রচার করেছিলেন, যা বেদনা এবং দুঃখকষ্টের সমস্ত কারণ দূর করে দেবে। এটা নিশ্চিত করে যে, পৃথিবীর ওপরে তাঁর শাসনাধীনে বধিরতাসহ সমস্ত দুর্দশা নির্মূল হয়ে যাবে।