সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যা সঠিক তা জানা এবং পালন করা

যা সঠিক তা জানা এবং পালন করা

জীবন কাহিনী

যা সঠিক তা জানা এবং পালন করা

বলেছেন হেডন স্যানডারসন

যিশু তাঁর প্রেরিতদের একবার বলেছিলেন: “এ সকল যখন তোমরা জান, ধন্য তোমরা, যদি এ সকল পালন কর।” (যোহন ১৩:১৭) হ্যাঁ, আমরা হয়তো জানি যে কোনটা সঠিক কিন্তু কখনো কখনো তা পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে! তা সত্ত্বেও, ৪০ বছরের মিশনারি সেবাসহ ৮০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি দৃঢ়নিশ্চিত যে, যিশুর কথাগুলো সত্য। ঈশ্বর যা বলেন তা পালন করা, সত্যিই সুখের দিকে পরিচালিত করে। আসুন আপনাদের সেই বিষয়েই বলি।

 উনিশশো পঁচিশ সালে, আমার বয়স যখন তিন বছর, তখন আমার বাবামা আমাদের নিজের শহর অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসলে বাইবেলভিত্তিক একটা বক্তৃতায় যোগদান করেছিল। “লক্ষ লক্ষ ব্যক্তি যারা এখন জীবিত আছে তারা কখনো মরবে না” শিরোনামের বক্তৃতাটি আমার মাকে দৃঢ়নিশ্চিত করেছিল যে, তিনি সত্য খুঁজে পেয়েছেন আর তাই তিনি নিয়মিতভাবে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগদান করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু, আমার বাবার আগ্রহ সঙ্গে সঙ্গে ঝিমিয়ে পড়েছিল। তিনি মায়ের পাওয়া নতুন বিশ্বাসকে মেনে নিতে অসম্মত হয়েছিলেন এবং এই বলে ভয় দেখিয়েছিলেন যে, মা যদি তার বিশ্বাস পরিত্যাগ না করেন, তা হলে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। বাবাকে মা ভালবাসতেন আর চেয়েছিলেন পরিবারের সবাই যেন একসঙ্গে থাকে। কিন্তু তিনি এও জানতেন যে, ঈশ্বরের প্রতি বাধ্যতা ছিল সর্বপ্রধান বিষয় আর তাই ঈশ্বরের দৃষ্টিতে যা সঠিক তা পালন করার জন্য তিনি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। (মথি ১০:৩৪-৩৯) আমার বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যান আর এরপর তাকে আমি কেবল মাঝেমধ্যে দেখেছিলাম।

অতীতের দিনগুলোর কথা চিন্তা করে, ঈশ্বরের প্রতি আমার মায়ের আনুগত্যকে আমি শ্রদ্ধা করি। তার সিদ্ধান্ত আমার দিদি বিউলা ও আমাকে আধ্যাত্মিক আশীর্বাদপূর্ণ এক জীবনের দিকে পরিচালিত করেছে। এ ছাড়া, এটা আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখিয়েছে—আমরা যখন জানি যে কোনটা সঠিক, তখন আমাদের সেটা পালন করার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে।

বিশ্বাসের পরীক্ষা

বাইবেল ছাত্ররা, যিহোবার সাক্ষিদের তখন এই নামে ডাকা হতো, আমাদের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। আমার দিদিমা আমাদের কাছে চলে এসেছিলেন এবং তিনিও সত্যকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ও আমার মা প্রচার কাজে এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন আর তাদের মর্যাদাপূর্ণ আচরণ এবং বন্ধুত্বপরায়ণ মনোভাবের জন্য তারা লোকেদের সম্মান অর্জন করেছিল।

ইতিমধ্যে, বয়স্ক খ্রিস্টান ভাইয়েরা আমার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং আমাকে মূল্যবান প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। শীঘ্রই, আমি লোকেদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের কাছে সহজ-সরল উপস্থাপনাগুলো তুলে ধরার জন্য পরিচয় পত্র ব্যবহার করতে শিখেছিলাম। এ ছাড়া, আমি বহনযোগ্য গ্রামোফোনে রেকর্ড করা বাইবেলের বক্তৃতাগুলো বাজাতাম এবং শহরের প্রধান রাস্তায় প্ল্যাকার্ড বহন করার কাজেও আমি অংশ নিয়েছিলাম। এটা কঠিন ছিল কারণ আমাকে লোকভয়ের সঙ্গে লড়াই করতে হতো। কিন্তু, আমি জানতাম কোনটা সঠিক আর সেটা পালন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম।

স্কুলের পড়ালেখা শেষ করার পর, আমি একটা ব্যাঙ্কে কাজ করতে শুরু করেছিলাম, যে-কাজের জন্য আমাকে নিউ সাউথ ওয়েলস্‌ রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত ব্যাঙ্কের বেশ কয়েকটা শাখায় যেতে হতো। যদিও দেশের সেই অঞ্চলে অল্প কয়েক জন সাক্ষি ছিল কিন্তু আমার বিশ্বাসকে জীবন্ত রাখতে, আমার প্রশিক্ষণ আমাকে সাহায্য করেছিল। মা উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখতেন, যেগুলো আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তি জোগাত।

সেই চিঠিগুলো সঠিক সময়ে আমাকে সাহায্য করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল আর আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার গির্জার খুবই উদ্যোগী একজন সদস্য এবং সেইসঙ্গে স্থানীয় কমান্ডার ছিলেন। আমি যখন একজন খ্রিস্টান হিসেবে আমার নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা ব্যাখ্যা করেছিলাম, তখন তিনি আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন—হয় আমাকে আমার ধর্ম পরিত্যাগ করতে হবে নতুবা ব্যাঙ্কের চাকরি ছাড়তে হবে! স্থানীয় সৈনিক সংগ্রহ কেন্দ্রে রিপোর্ট করার পর পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছিল। সেই ম্যানেজার সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং আমি যখন রেজিস্ট্রেশন টেবিলের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন তিনি গভীর আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করছিলেন। আমি যখন সেনাবাহিনীতে যোগদান করার কাগজগুলোতে সই করতে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তখন কর্মকর্তারা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল। এটা এক উত্তেজনাকর মুহূর্ত ছিল কিন্তু আমি যা সঠিক, তা পালন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। যিহোবার সাহায্যে আমি শান্ত এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। পরে আমি যখন জানতে পেরেছিলাম যে কিছু উৎপীড়ক আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন আমি দেরি না করে আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্রেন ধরে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম!

নিউ ক্যাসলে ফিরে আসার পর আমাকে, সামরিক কাজে যোগ দিতে প্রত্যাখ্যান করেছিল এমন আরও সাত জন ভাইয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে হাজির হতে হয়েছিল। বিচারক আমাদের তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। যদিও কারাগারে থাকা ছিল এক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা কিন্তু যা সঠিক তা পালন করা অনেক আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিল। আমরা ছাড়া পাওয়ার পর, হিলটেন উইলকিনসন নামে একজন সহসাক্ষি যিনি আমার কারাকক্ষের একজন সঙ্গীও ছিলেন, তিনি আমাকে তার ফটো স্টুডিওতে তার সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানেই আমার ভাবী স্ত্রী মেলডির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, যে সেই স্টুডিওতে একজন রিসেপশনিস্ট হিসেবে কাজ করত। কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়া মাত্রই, আমি যিহোবার প্রতি আমার উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

পূর্ণসময়ের পরিচর্যার জন্য লক্ষ্য স্থাপন করা

আমাদের বিয়ের পর, মেলডি ও আমি নিউ ক্যাসলে আমাদের নিজস্ব ফটো স্টুডিও খুলেছিলাম। শীঘ্রই আমাদের এত বেশি কাজ করতে হতো যে, আমাদের স্বাস্থ্য ও আধ্যাত্মিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। সেই সময়ে টেড জেরাস, যিনি তখন যিহোবার সাক্ষিদের অস্ট্রেলিয়ার শাখা অফিসে সেবা করছিলেন এবং এখন যিনি পরিচালক গোষ্ঠীর একজন সদস্য, তিনি আমাদের আধ্যাত্মিক লক্ষ্য সম্বন্ধে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সেই আলোচনার পর, আমরা আমাদের ব্যাবসাপত্র বিক্রি করে দেওয়ার এবং আমাদের জীবনকে সাধাসিধে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ১৯৫৪ সালে আমরা একটা ছোট ট্রেলার কিনে ভিক্টোরিয়া রাজ্যের বাল্লারাত শহরে চলে গিয়েছিলাম এবং অগ্রগামী বা পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে সেবা করতে শুরু করেছিলাম।

বাল্লারাতের ছোট মণ্ডলীর সঙ্গে কাজ করার সময়, যিহোবা আমাদের প্রচেষ্টায় আশীর্বাদ করেছিলেন। সভাগুলোতে যোগদানকারী লোকেদের সংখ্যা ১৮ মাসের মধ্যেই দ্রুত বেড়ে গিয়ে ১৭ থেকে ৭০ হয়েছিল। এরপর আমরা দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া রাজ্যে ভ্রমণ পরিচর্যা বা সীমার কাজ করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। পরবর্তী তিন বছর ধরে, আমরা আ্যডিলেড শহরের মণ্ডলীগুলো এবং মারে নদীর আশেপাশের এলাকাগুলো যেখানে আঙুরখেত ও লেবুর বাগান ছিল, সেগুলো পরিদর্শন করা উপভোগ করেছিলাম। আমাদের জীবন কী অবিশ্বাস্যরকম পালটে গিয়েছিল! প্রেমময় ভাইবোনদের সঙ্গে একত্রে সেবা করে আমরা আনন্দিত ছিলাম। যেটাকে আমরা সঠিক বলে জানতাম তা পালন করার ফল কী এক পুরস্কারই না হয়েছিল!

মিশনারি কার্যভার

১৯৫৮ সালে, আমরা অস্ট্রেলিয়া শাখা অফিসকে “ঈশ্বরের ইচ্ছা” আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করার বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলাম, যেটি সেই বছরই নিউ ইয়র্ক সিটিতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছিল। তারা আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে গিলিয়েড মিশনারি স্কুলের জন্য আবেদন ফর্ম পাঠিয়ে উত্তর দিয়েছিল। যেহেতু আমাদের বয়স তখন ৩০ এর কোঠার মাঝামাঝিতে ছিল, তাই আমরা ভেবেছিলাম যে, গিলিয়েডে যোগদান করার জন্য আমাদের বয়স পার হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও, আমরা আমাদের আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলাম এবং আমাদেরকে ৩২তম ক্লাসে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কোর্সের মাঝামাঝি সময়ে, আমরা ভারতে আমাদের মিশনারি কার্যভার পেয়েছিলাম! যদিও প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু আমরা যা সঠিক তা-ই পালন করতে চেয়েছিলাম আর তাই আনন্দের সঙ্গে আমাদের কার্যভার গ্রহণ করেছিলাম।

১৯৫৯ সালের এক ভোরবেলায় আমরা জাহাজে করে বোম্বে (এখন মুম্বই) পৌঁছেছিলাম। শত শত কর্মী বাইরে ডকের ওপর ঘুমিয়ে ছিল। বাতাসে অপরিচিত গন্ধ ভাসছিল। সূর্য ওঠার পর আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, সামনে আমাদের কী ভোগ করতে হবে। এর আগে কখনো আমরা এতটা গরম সহ্য করিনি! লিন্টন এবং জেনি ডুয়ার নামে এক মিশনারি দম্পতি আমাদেরকে স্বাগত জানিয়েছিল, যারা বাল্লারাতে আমাদের সঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করেছিল। তারা আমাদেরকে নগরকেন্দ্রের কাছাকাছি অবস্থিত ভারতের বেথেল হোমে নিয়ে গিয়েছিল, যেটা ছিল ওপরের তলায় অবস্থিত একটা ছোট, ঘিঞ্জি আ্যপার্টমেন্ট। সেই হোমে ছয় জন বেথেল স্বেচ্ছাসেবক ছিল। ভাই এডউইন স্কিনার যিনি ১৯২৬ সাল থেকে ভারতে একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করেছেন, তিনি আমাদেরকে আমাদের কার্যভারে যাওয়ার আগে ভ্রমণের জন্য ত্রিপলের তৈরি দুটো ব্যাগ কেনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ভারতের ট্রেনগুলোতে সেগুলো এক পরিচিত দৃশ্য ছিল এবং আমাদের পরবর্তী ভ্রমণগুলোর সময়ে সেই ব্যাগগুলো আমাদের খুবই কাজে এসেছিল।

ট্রেনে করে দুদিন যাত্রা করার পর, আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মাদ্রাজ (এখন তামিলনাড়ু) রাজ্যের একটা শহর তিরুচ্চিরাপল্লীতে আমাদের কার্যভারে পৌঁছেছিলাম। সেখানে আমরা তিন জন ভারতীয় বিশেষ অগ্রগামীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম, যারা ২,৫০,০০০ জনসংখ্যা রয়েছে এমন এক এলাকায় সাক্ষ্য দিচ্ছিল। জীবনযাত্রার মান ছিল খুবই সাধারণ। একবার, আমাদের কাছে ৪ ডলারেরও (মার্কিন ডলার) কম পরিমাণ টাকা ছিল। কিন্তু সেই টাকা যখন খরচ হয়ে গিয়েছিল, তখন যিহোবা আমাদের পরিত্যাগ করেননি। একজন ব্যক্তি যিনি বাইবেল অধ্যয়ন করছিলেন, তিনি আমাদেরকে কিছু টাকা ধার দিয়েছিলেন, যাতে আমরা সভা করার জন্য একটা উপযুক্ত বাড়ি ভাড়া নিতে পারি। আরেকবার যখন আমাদের কাছে কম খাবার ছিল, তখন একজন প্রতিবেশী দয়া দেখিয়ে আমাদের জন্য ঘরে রান্না করা একটু তরকারি নিয়ে এসেছিলেন। এটা আমার ভাল লেগেছিল কিন্তু তা এতই ঝাল ছিল যে, আমার হেঁচকি শুরু হয়েছিল!

ক্ষেত্রের পরিচর্যায়

যদিও তিরুচ্চিরাপল্লীতে কিছু লোক ইংরেজিতে কথা বলত কিন্তু বেশির ভাগই তামিল ভাষায় কথা বলত। তাই, ক্ষেত্রের পরিচর্যার জন্য সেই ভাষায় একটা সহজ উপস্থাপনা শেখার উদ্দেশ্যে আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছিলাম। এর ফলে আমরা স্থানীয় অনেক লোকের সম্মান অর্জন করতে পেরেছিলাম।

আমরা ঘরে ঘরে পরিচর্যা খুবই উপভোগ করেছি। ভারতীয়রা সাধারণত অতিথিপরায়ণ আর তাই অনেকেই জলখাবারের জন্য আমাদের ঘরের ভিতরে আমন্ত্রণ জানাত। যেহেতু তাপমাত্রা প্রায়ই ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকত, তাই আমরা তাদের আতিথেয়তাকে খুবই উপলব্ধি করতাম। আমাদের বার্তা জানানোর আগে, ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করাটা ভদ্রতা ছিল। গৃহকর্তারা প্রায়ই আমার স্ত্রী ও আমাকে জিজ্ঞেস করত: “আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? আপনাদের কি ছেলেমেয়ে আছে? কেন নেই?” এরপর, তারা সাধারণত আমাদেরকে একজন ভাল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিত। তা সত্ত্বেও, সেই আলোচনাগুলো আমাদেরকে নিজেদের পরিচয় দিতে এবং আমাদের বাইবেলভিত্তিক কাজের গুরুত্ব সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে সুযোগ করে দিয়েছিল।

যাদের কাছে আমরা সাক্ষ্য দিতাম তাদের বেশির ভাগই ছিল হিন্দু—যে-ধর্মটি খ্রিস্টধর্ম থেকে একেবারেই আলাদা। হিন্দু দর্শনশাস্ত্রের জটিল বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক না করে আমরা সহজভাবে ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করতাম—আর তা ভাল ফলাফল নিয়ে এসেছিল। ছয় মাসের মধ্যে, প্রায় ২০ জন আমাদের মিশনারি হোমে সভাগুলোতে যোগদান করতে শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে নাল্লাতামবি নামে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি ও তার পুত্র বিজয়ালান, পরে প্রায় ৫০ জন ব্যক্তিকে যিহোবার সেবক হতে সাহায্য করেছিলেন। এ ছাড়া, বিজয়ালান কিছু সময়ের জন্য ভারতের শাখা অফিসেও সেবা করেছিলেন।

অবিরত ভ্রমণ করা

ছয় মাসও হয়নি আমরা ভারতে এসেছি আর তখনই আমাকে দেশের প্রথম স্থায়ী জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল সারা ভারতে ভ্রমণ করা, সম্মেলনগুলোকে সংগঠিত করা এবং নটা ভাষার দলের সঙ্গে কাজ করা। এটা বেশ পরিশ্রমের কাজ ছিল। আমরা তিনটে টিনের ট্রাঙ্ক ও ত্রিপলের তৈরি আমাদের সেই দরকারি ব্যাগ দুটোতে ছয় মাসের জন্য কাপড়চোপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ট্রেনে করে মাদ্রাজ শহর (এখন চেন্নাই) থেকে যাত্রা করেছিলাম। যেহেতু জেলাটা প্রায় ৬,৫০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল, তাই আমরা অবিরতভাবে ভ্রমণ করে যাচ্ছিলাম। একবার, আমরা দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাঙ্গালোর শহরে রবিবারে একটা সম্মেলন শেষ করেছিলাম। তারপর পরের সপ্তাহে আরেকটা সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশে দার্জিলিংয়ের দিকে যাত্রা করেছিলাম। দার্জিলিংয়ে যাওয়ার মানে ছিল প্রায় ২,৭০০ কিলোমিটার পথ যাত্রা করা এবং পাঁচ বার ট্রেন পালটানো।

আমাদের আগের যাত্রাগুলোর সময়ে, আমরা নতুন জগৎ সমাজ কার্যকর চলচ্চিত্রটা দেখানো উপভোগ করেছি। এই চলচ্চিত্রটা যিহোবার পার্থিব সংগঠনের পরিধি ও কাজের সঙ্গে লোকেদের পরিচয় করিয়েছিল। প্রায়ই, শত শত লোক এই প্রদর্শনীগুলোতে উপস্থিত থাকত। একবার, আমরা একটা রাস্তার ধারে জড়ো হওয়া একদল লোকের কাছে চলচ্চিত্রটা উপস্থাপন করেছিলাম। চলচ্চিত্রটা চলাকালীন, আকাশ কালো হয়ে যায় এবং ঝড়ো মেঘগুলো আমাদের দিকে আসতে থাকে। যেহেতু মাঝপথে চলচ্চিত্রটা থেমে যাওয়ায় লোকেরা হইচই শুরু করে দিয়েছিল, তাই আমি প্রদর্শনী চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কিন্তু এর গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আনন্দের বিষয় যে, যখন বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়তে শুরু করে, তখন চলচ্চিত্রটা কোনোরকম বাধা ছাড়াই শেষ হয়েছিল।

পরবর্তী বছরগুলোতে, মেলডি ও আমি ভারতের অধিকাংশ জায়গাতেই ভ্রমণ করেছি। যেহেতু প্রত্যেকটা অঞ্চলেরই স্বতন্ত্র খাবারদাবার, পোশাক-আশাক, ভাষা এবং দেখার মতো দৃশ্য ছিল, তাই এটা যেন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করার মতোই ছিল। যিহোবার সৃষ্টিতে কী অপূর্ব বৈচিত্র্যই না দেখা যায়! ভারতের বন্যপ্রাণীদের ক্ষেত্রেও এটা সত্য। একবার, নেপালের জঙ্গলের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে থাকার সময়, আমরা একটা বড় বাঘকে খুব ভালভাবে দেখতে পেয়েছিলাম। এটা ছিল একটা চমৎকার পশু। সেই পশুটা দেখা আমাদের পরমদেশে থাকার ইচ্ছাকে দৃঢ় করেছিল, যেখানে অবশেষে মানুষ ও পশুদের মধ্যে শান্তি থাকবে।

সাংগঠনিক উন্নতিগুলো

প্রথম দিকের সেই দিনগুলোতে, ভারতে ভাইদের যিহোবার সাংগঠনিক ব্যবস্থাগুলোকে আরও নিখুঁতভাবে মেনে চলার প্রয়োজন হয়েছিল। কিছু মণ্ডলীতে, পুরুষরা সভা কক্ষের একদিকে বসত আর মহিলারা অন্যদিকে বসত। সভাগুলো কদাচিৎ ঠিক সময়ে শুরু হতো। এক জায়গায়, একটা উচ্চআওয়াজযুক্ত ঘন্টা রাজ্যের প্রকাশকদেরকে সভাগুলোর জন্য জড়ো হতে আমন্ত্রণ জানাত। অন্যান্য জায়গায়, প্রকাশকরা ঘড়ির পরিবর্তে সূর্যের অবস্থান দেখে এক এক করে সভায় উপস্থিত হতো। সম্মেলন ও ভ্রমণ অধ্যক্ষদের পরিদর্শনগুলো অনিয়মিত ছিল। ভাইয়েরা যা সঠিক তা পালন করার জন্য ইচ্ছুক ছিল কিন্তু তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল।

১৯৫৯ সালে, যিহোবার সংগঠন কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুল প্রবর্তন করেছিল। পৃথিবীব্যাপী এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সীমা অধ্যক্ষ, বিশেষ অগ্রগামী, মিশনারি এবং মণ্ডলীর প্রাচীনদের তাদের শাস্ত্রীয় দায়িত্বগুলোকে আরও কার্যকারীভাবে পালন করতে সাহায্য করেছিল। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতে যখন এই স্কুল শুরু হয়েছিল, তখন আমি ক্লাসের নির্দেশক হিসেবে সেবা করেছিলাম। ধীরে ধীরে, সেই প্রশিক্ষণের ফলাফল দেশের সর্বত্র মণ্ডলীগুলোকে উপকৃত করেছিল আর তারা দ্রুত উন্নতি করেছিল। ভাইয়েরা যা সঠিক সেটা জানার পর, যিহোবার আত্মা তাদেরকে তা পালন করতে প্রেরণা দিয়েছিল।

এ ছাড়া, বড় সম্মেলনগুলোও ভাইদেরকে উৎসাহিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এই সম্মেলনগুলোর মধ্যে ১৯৬৩ সালে নিউ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন উল্লেখযোগ্য, যেটার বিষয় ছিল “অনন্তকালীন সুসমাচার।” সেই সম্মেলনে যোগদান করার জন্য ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাক্ষিরা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিল আর তা করার জন্য অনেকে তাদের পুরো সঞ্চয় খরচ করেছিল। এ ছাড়া, যেহেতু ২৭টা দেশ থেকে ৫৮৩ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল, তাই স্থানীয় সাক্ষিরা প্রথম বারের মতো বিরাট সংখ্যক অতিথি ভাইদের সঙ্গে মিলিত হতে ও মেলামেশা করতে পেরেছিল।

১৯৬১ সালে, মেলডি ও আমাকে বোম্বের বেথেল পরিবারের অংশ হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যেখানে পরে আমি শাখা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে সেবা করেছিলাম। পরে অন্যান্য কার্যভারও পেয়েছিলাম। অনেক বছর ধরে, আমি এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র একজন আঞ্চলিক অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করেছিলাম। যেহেতু এই দেশগুলোর অনেক জায়গায় প্রচার কাজ নিষিদ্ধ ছিল, তাই স্থানীয় প্রকাশকদের “সর্পের ন্যায় সতর্ক ও কপোতের ন্যায় অমায়িক” হওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল।—মথি ১০:১৬.

প্রসার ও পরিবর্তনগুলো

১৯৫৯ সালে আমরা যখন প্রথম ভারতে পৌঁছেছিলাম, তখন সেই দেশে ১,৫১৪ জন সক্রিয় প্রকাশক ছিল। আজকে, সেই সংখ্যা বেড়ে ২৪,০০০রের ওপরে পৌঁছেছে। এই বৃদ্ধির কারণে আমরা দুবার বোম্বের মধ্যে ও এর কাছাকাছি জায়গায় নতুন বেথেল কমপ্লেক্সগুলোতে চলে গিয়েছিলাম। এরপর ২০০২ সালের মার্চ মাসে, বেথেল পরিবার আবারও স্থান পরিববর্তন করে—এবার দক্ষিণ ভারতে ব্যাঙ্গালোরের কাছে নির্মিত একটা নতুন কমপ্লেক্সে। এই আধুনিক বিল্ডিংয়ে বর্তমানে ২৪০ জন বেথেলকর্মীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, যাদের মধ্যে কিছু সদস্য ২০টারও বেশি ভাষায় বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদি অনুবাদ করে থাকে।

যদিও মেলডি ও আমি ব্যাঙ্গালোরে যাওয়ার জন্য উৎসুকভাবে অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে আমাদেরকে ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যেতে হয়েছিল। এখন আমরা সিডনীর বেথেল পরিবারের সদস্য হিসেবে সেবা করছি। যদিও আমরা ভারত ছেড়ে চলে এসেছি কিন্তু সেই দেশের প্রিয় বন্ধুবান্ধব ও আধ্যাত্মিক ছেলেমেয়েদের জন্য এখনও আমাদের ভালবাসা অটুট রয়েছে। তাদের কাছ থেকে চিঠিপত্র পাওয়া কতই না আনন্দের!

৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্ণসময়ের পরিচর্যার কথা চিন্তা করে, মেলডি ও আমি প্রচুররূপে আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়েছি বলে মনে করি। আমরা আগে ফটোগ্র্যাফিক পেপারে লোকেদের ছবি ধরে রাখার কাজ করতাম কিন্তু ঈশ্বরের স্মৃতিতে লোকেদের জীবন্ত রাখার জন্য কাজ করা আরও উত্তম এক মনোনয়ন ছিল। ঈশ্বরের ইচ্ছাকে আমাদের জীবনে প্রথমে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে আমরা কত অমূল্য অভিজ্ঞতাই না লাভ করেছি! হ্যাঁ, ঈশ্বর যেটাকে সঠিক বলেন তা পালন করা সত্যিই সুখের দিকে পরিচালিত করে!

[১৫ পৃষ্ঠার মানচিত্রগুলো]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

ভারত

নিউ দিল্লি

দার্জিলিং

বোম্বে (মুম্বই)

ব্যাঙ্গালোর

মাদ্রাজ (চেন্নাই)

তিরুচ্চিরাপল্লী

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯৪২ সালে হেডন ও মেলডি

[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৭৫ সালে ভারতের বেথেল পরিবার