এক “রূপক নাটক” আমাদের কাছে যার মূল্য রয়েছে
এক “রূপক নাটক” আমাদের কাছে যার মূল্য রয়েছে
শাস্ত্রের নির্দিষ্ট কিছু অংশের তাৎপর্য পুরোপুরি বোঝা কতই না কঠিন হতো, যদি না বাইবেলের অন্যান্য অংশ সেগুলোর ওপর আলোকপাত করত! ঈশ্বরের বাক্যের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে শুধু ঐতিহাসিক বিবরণের মতোই পড়া যেতে পারে। কিন্তু, এই বিবরণগুলোর কয়েকটায় গভীর সত্য লুকিয়ে রয়েছে, যেগুলো খুব একটা স্পষ্ট নয়। একটা উদাহরণ হল কুলপতি অব্রাহামের পরিবারে দুই স্ত্রীর বিবরণটি। প্রেরিত পৌল এটিকে এক “রূপক অর্থ [“নাটক,” NW]” বলেছিলেন।—গালাতীয় ৪:২৪.
নাটকটার প্রতি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে কারণ এর দ্বারা যে-বাস্তবতাগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো তাদের সকলের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যারা যিহোবা ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করতে চায়। কেন তা, সেই বিষয়টা পরীক্ষা করার আগে, আসুন আমরা সেই পরিস্থিতিগুলো বিবেচনা করি, যেগুলো পৌলকে এই নাটকের তাৎপর্য উন্মোচন করতে পরিচালিত করেছিল।
প্রথম শতাব্দীর গালাতিয়াতে খ্রিস্টানদের মাঝে একটা সমস্যা ছিল। তাদের মধ্যে কিছুজন ‘বিশেষ বিশেষ দিন, মাস, ঋতু ও বৎসর পালন করিতেছিল’—যেগুলো পালন করার জন্য মোশির ব্যবস্থায় আদেশ দেওয়া হয়েছিল। এই ব্যক্তি বিশেষরা দাবি করেছিল যে, ঈশ্বরের অনুগ্রহ পেতে হলে বিশ্বাসীদের ব্যবস্থার বাধ্য থাকা আবশ্যক ছিল। (গালাতীয় ৪:১০; ৫:২, ৩) কিন্তু পৌল জানতেন যে, খ্রিস্টানদের এগুলো পালন করার দরকার ছিল না। এটা প্রমাণ করার জন্য, তিনি এমন একটা বিবরণের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যা যিহুদি পটভূমির যেকারো কাছে পরিচিত ছিল।
পৌল গালাতীয়দের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, যিহুদি জাতির পিতা অব্রাহাম, ইশ্মায়েল ও ইস্হাককে জন্ম দিয়েছিলেন। প্রথম সন্তানটি দাসী হাগারের এবং দ্বিতীয়টি স্বাধীনা সারার গর্ভজাত। গালাতিয়াতে যারা মোশির ব্যবস্থার বাধ্য হওয়ার বিষয়টা তুলে ধরেছিল, তারা নিঃসন্দেহে এই বিবরণের সঙ্গে পরিচিত ছিল যে, প্রথম দিকে সারা বন্ধ্যা ছিলেন এবং অব্রাহামকে তার দাসী হাগারকে দিয়েছিলেন, আদিপুস্তক ১৬:১-৪; ১৭:১৫-১৭; ২১:১-১৪; গালাতীয় ৪:২২, ২৩.
যেন হাগার তার হয়ে একটা সন্তান ধারণ করতে পারেন। তারা নিশ্চয় জানত যে, ইশ্মায়েলকে গর্ভধারণ করার পর হাগার তার কর্ত্রী সারাকে তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা অনুসারে, অবশেষে বৃদ্ধা বয়সে সারা ইস্হাককে জন্ম দিয়েছিলেন। পরে হাগার ও ইশ্মায়েলকে অব্রাহাম দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কারণ ইশ্মায়েল ইস্হাকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন।—দুই স্ত্রী, দুই চুক্তি
পৌল এই ‘রূপক নাটকের’ চরিত্রগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন। “ঐ দুই স্ত্রী দুই নিয়ম” বা চুক্তি, তিনি লিখেছিলেন, “একটী সীনয় পর্ব্বত হইতে উৎপন্ন ও দাসত্বের জন্য প্রসবকারিণী; সে হাগার। . . . সে এখনকার যিরূশালেমের সমতুল্য, কেননা সে নিজ সন্তানগণের সহিত দাসত্বে রহিয়াছে।” (গালাতীয় ৪:২৪, ২৫) হাগার আক্ষরিক ইস্রায়েলকে চিত্রিত করেছিল যার রাজধানী ছিল যিরূশালেম। যিহুদি জাতি সীনয় পর্বতে প্রবর্তিত ব্যবস্থা চুক্তির দ্বারা যিহোবার কাছে আবদ্ধ ছিল। ব্যবস্থা চুক্তির অধীনে, ইস্রায়েলীয়দের ক্রমাগতভাবে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, তারা পাপের দাস এবং তাদের মুক্তি প্রয়োজন ছিল।—যিরমিয় ৩১:৩১, ৩২; রোমীয় ৭:১৪-২৪.
তা হলে, ‘স্বাধীনা’ সারা এবং তার পুত্র ইস্হাক কাকে চিত্রিত করেছিল? পৌল ইঙ্গিত করেছিলেন যে, “বন্ধ্যে” সারা ঈশ্বরের স্ত্রী, তাঁর সংগঠনের স্বর্গীয় অংশকে চিত্রিত করেছিল। এই স্বর্গীয় স্ত্রী এই অর্থে বন্ধ্যা ছিল যে, যিশু পৃথিবীতে আসার আগে, এখানে তার আত্মায় অভিষিক্ত কোনো “সন্তান” ছিল না। (গালাতীয় ৪:২৭; যিশাইয় ৫৪:১-৬) কিন্তু, সা.কা. ৩৩ সালের পঞ্চাশত্তমীর দিনে, এক দল নারী-পুরুষের ওপর পবিত্র আত্মা বর্ষিত হয়েছিল, যারা এর ফলে এই স্বর্গীয় স্ত্রীর সন্তান হিসেবে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেছিল। এই সংগঠনের দ্বারা জন্মানো সন্তানদের ঈশ্বরের দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং এক নতুন চুক্তির সম্পর্কের অধীনে তারা যিশু খ্রিস্টের সহদায়াদ হয়েছিল। (রোমীয় ৮:১৫-১৭) এই সন্তানদের একজন, প্রেরিত পৌল লিখতে পেরেছিলেন: “ঊর্দ্ধ্বস্থ যিরূশালেম স্বাধীনা, আর সে আমাদের জননী।”—গালাতীয় ৪:২৬.
সেই স্ত্রীর সন্তানরা
বাইবেলের বিবরণ অনুসারে, ইশ্মায়েল ইস্হাককে তাড়না করেছিলেন। একইভাবে, সা.কা. প্রথম শতাব্দীতে দাসত্বে থাকা যিরূশালেমের সন্তানরা ঊর্দ্ধ্বস্থ যিরূশালেমের সন্তানদের উপহাস ও তাড়না করেছিল। “মাংস অনুসারে জাত ব্যক্তি [ইশ্মায়েল] যেমন তৎকালে আত্মানুসারে জাতকে [ইস্হাককে] তাড়না করিত, তেমনি এখনও হইতেছে,” পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন। (গালাতীয় ৪:২৯) যিশু খ্রিস্ট যখন পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং রাজ্য সম্বন্ধে ঘোষণা করতে শুরু করেছিলেন, তখন যিহুদি ধর্মীয় নেতারা ঠিক সেইরকম ব্যবহারই করেছিল, যেমনটা হাগারের পুত্র ইশ্মায়েল, অব্রাহামের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, ইস্হাকের প্রতি করেছিলেন। তারা যিশু খ্রিস্টকে উপহাস ও তাড়না করেছিল, স্পষ্টতই নিজেদেরকে অব্রাহামের বৈধ উত্তরাধিকারী হিসেবে এবং যিশুকে অনধিকার প্রবেশকারী হিসেবে দেখেছিল।
জন্মগত ইস্রায়েলের শাসকরা যিশুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অল্প কিছুদিন আগে যিশু বলেছিলেন: “হা যিরূশালেম, যিরূশালেম, তুমি ভাববাদিগণকে বধ করিয়া থাক, ও তোমার নিকটে যাহারা প্রেরিত হয়, তাহাদিগকে পাথর মারিয়া থাক! কুক্কুটী যেমন আপন শাবকদিগকে পক্ষের নীচে একত্র করে, তদ্রূপ আমিও কত বার তোমার সন্তানদিগকে একত্র করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, কিন্তু তোমরা সম্মত হইলে না। দেখ, তোমাদের গৃহ তোমাদের নিমিত্ত উৎসন্ন পড়িয়া রহিল।”—মথি ২৩:৩৭, ৩৮.
প্রথম শতাব্দীর ঘটনাবলির অনুপ্রাণিত নথি দেখায় যে, হাগারের দ্বারা চিত্রিত সেই মাংসিক জাতি জন্মগতভাবে ইস্রায়েলীয় বলে সেই পুত্রদের জন্ম দেয়নি, যারা যিশুর সহদায়াদ হবে। যিহুদিরা যারা গর্বের সঙ্গে বিশ্বাস করত যে, জন্মগতভাবেই তাদের এই উত্তরাধিকার লাভ করার অধিকার রয়েছে, তারা বহিষ্কৃত, যিহোবার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। অবশ্য এটা ঠিক যে, জন্মগত ইস্রায়েলীয়দের কিছুজন খ্রিস্টের সহদায়াদ হয়েছিল। কিন্তু, সেই বিশেষ সুযোগ তারা পেয়েছিল যিশুর ওপর তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে, মাংসিক ইস্রায়েল হিসেবে জন্মগ্রহণ করার ফলে নয়।
খ্রিস্টের এই সহদায়াদদের সংখ্যার শনাক্তিকরণ সা.কা. ৩৩ সালের পঞ্চাশত্তমীর দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সময় পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যিহোবা অন্যদেরকে ঊর্ধ্বস্থ যিরূশালেমের পুত্র হিসেবে অভিষিক্ত করেছিলেন।
এই “রূপক নাটক” ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পৌলের উদ্দেশ্য ছিল, মোশির মধ্যস্থতায় ব্যবস্থা চুক্তির ঊর্ধ্বে নতুন চুক্তির উৎকৃষ্টতা তুলে ধরা। মোশির ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত কাজগুলো করে কেউ-ই ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করতে পারে না, কারণ সব মানুষই অসিদ্ধ এবং স্পষ্টভাবেই ব্যবস্থা তাদের পাপের দাসত্বকে তুলে ধরেছিল। কিন্তু, পৌল যেমন ব্যাখ্যা করেছিলেন, যিশু এসেছিলেন যাতে “তিনি মূল্য দিয়া ব্যবস্থার অধীন লোকদিগকে মুক্ত করেন।” (গালাতীয় ৪:৪, ৫) তাই, খ্রিস্টের বলিদানের মূল্যে বিশ্বাস, ব্যবস্থার শাস্তি থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার দিকে পরিচালিত করেছে।—গালাতীয় ৫:১-৬.
আমাদের কাছে নাটকটার মূল্য
এই নাটকটা সম্বন্ধে পৌলের অনুপ্রাণিত ব্যাখ্যার প্রতি আমাদের কেন আগ্রহী হওয়া উচিত? একটা কারণ হল, এটা আমাদের শাস্ত্রের সেই অর্থগুলো সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যেগুলো অন্যথায় অস্পষ্ট থেকে যেত। এই ব্যাখ্যা বাইবেলের সংগতি ও সামঞ্জস্যতার প্রতি আমাদের আস্থাকে দৃঢ় করে।—১ থিষলনীকীয় ২:১৩.
অধিকন্তু, এই নাটকের দ্বারা চিত্রিত বাস্তবতাগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ সুখের জন্য আবশ্যক। ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা অনুসারে ‘পুত্ত্রদের’ জন্ম যদি না হতো, তা হলে আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা হতো পাপের দাসত্ব ও মৃত্যু। কিন্তু, খ্রিস্টের এবং অব্রাহামের কাছে কৃত ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞানুযায়ী তাঁর সহদায়াদদের প্রেমময় তত্ত্বাবধানে, “পৃথিবীর সকল জাতি আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হইবে।” (আদিপুস্তক ২২:১৮) এটা তখন ঘটবে যখন তারা পাপ, অসিদ্ধতা, দুঃখের প্রভাব এবং মৃত্যু থেকে চিরকালের জন্য স্বাধীন হবে। (যিশাইয় ২৫:৮, ৯) সেটা কতই না আনন্দের এক সময় হবে!
[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]
সীনয় পর্বতে ব্যবস্থা চুক্তি প্রবর্তিত হয়েছিল
[সৌজন্যে]
Pictorial Archive (Near Eastern History) Est.
[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রেরিত পৌলের দ্বারা উল্লেখিত ‘রূপক নাটকের’ তাৎপর্য কী?