সার্দিসের মেলিটো তিনি কি বাইবেলের সত্যের সমর্থক ছিলেন?
সার্দিসের মেলিটো তিনি কি বাইবেলের সত্যের সমর্থক ছিলেন?
প্রতি বছর সত্য খ্রিস্টানরা ইব্রীয় ক্যালেন্ডারের ১৪ই নিশান যে-তারিখে পড়ে, সেদিন প্রভুর সান্ধ্যভোজ উদ্যাপন করে থাকে। এটা করার দ্বারা তারা যিশুর এই আদেশের বাধ্য হচ্ছে: “ইহা আমার স্মরণার্থে করিও।” আসলে সা.কা. ৩৩ সালের ১৪ই নিশান নিস্তারপর্ব উদ্যাপনের পর তাঁর বলিদানমূলক মৃত্যুর স্মরণার্থে যিশু তা প্রবর্তন করেছিলেন। সেই দিন শেষ হওয়ার আগেই, তিনি মারা গিয়েছিলেন।—লূক ২২:১৯, ২০; ১ করিন্থীয় ১১:২৩-২৮.
সাধারণ কাল দ্বিতীয় শতাব্দীতে, কেউ কেউ স্মরণার্থের দিন ও যেভাবে এটা উদ্যাপিত হতো, তার ধরন পালটাতে শুরু করেছিল। এশিয়া মাইনরে যিশুর মৃত্যু তারিখের কোনোরকম পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু, একটি তথ্যগ্রন্থ যেমন উল্লেখ করে, “রোম ও আলেকজান্দ্রিয়ায়, যিশুর মৃত্যু তারিখের পরের রবিবারে যিশুর পুনরুত্থান পালন করার প্রথা ছিল,” যেটাকে পুনরুত্থান নিস্তারপর্ব বলা হতো। কোয়ারটোডেসিমান্ (চতুর্দশ-তারিখ পালনকারী) নামে একটা দল ১৪ই নিশান যিশু খ্রিস্টের মৃত্যুদিবস উদ্যাপন করাকে সমর্থন করেছিল। সার্দিসের মেলিটোও সেই শিক্ষার সঙ্গে একমত ছিলেন। মেলিটো কে ছিলেন? তিনি কীভাবে বাইবেলের এই সত্যটিকে এবং অন্যান্য সত্যকে সমর্থন করেছিলেন?
এক ‘মহান নক্ষত্র’
দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে, কৈসরিয়ার ইউসেবিয়াসের লেখা ইকলেসিয়াসটিক্যাল হিস্টোরি বইয়ে লিখেছিলেন, ইফিষের পলিক্রেট্স এই বিষয়ে সমর্থন জানিয়ে রোমে চিঠি পাঠিয়েছিলেন যে, ‘নিস্তারপর্বের চতুর্দশ দিবসের’ উদ্যাপন ‘খ্রিস্টধর্মের বিশ্বাসসূত্রে, সুসমাচার অনুসারেই, সেটার বিপরীতে নয়।’ এই চিঠি অনুযায়ী, লিডিয়ার সার্দিসের বিশপ মেলিটো ছিলেন সেই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, যিনি ১৪ই নিশান তারিখ উদ্যাপন করাকে সমর্থন করেছিলেন। সেই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, তার সমসাময়িক ব্যক্তিরা মেলিটোকে ‘প্রয়াত মহান নক্ষত্রদের’ মধ্যে একজন হিসেবে বিবেচনা করত। পলিক্রেট্স বলেছিলেন যে, মেলিটো বিয়ে করেননি এবং “পবিত্র আত্মার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয়সকলই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান এবং তিনি সার্দিসে কবরপ্রাপ্ত হয়েছেন ও স্বর্গীয় আহ্বানের অপেক্ষায় আছেন, যখন তিনি মৃত্যু থেকে উত্থিত হবেন।” এর অর্থ, মেলিটো সেই ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন, যারা বিশ্বাস করত যে, খ্রিস্টের পুনরাগমন না হওয়া পর্যন্ত পুনরুত্থান হবে না।—প্রকাশিত বাক্য ২০:১-৬.
তাই এর থেকে স্পষ্ট যে, মেলিটো নিশ্চয়ই এক সাহসী ও দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন। বস্তুতপক্ষে, তিনি খ্রিস্টানদের জন্য আত্মপক্ষসমর্থন (ইংরেজি) নামে একটি বই লিখেছিলেন, যেটি ছিল এযাবৎ নথিভুক্ত তার লেখা প্রথম বই আর তিনি এটি সা.কা. ১৬১ সাল থেকে ১৮০ সালের মধ্যে শাসনরত রোমীয় সম্রাট মারকুস অরিলিয়ুসের উদ্দেশে লিখেছিলেন। মেলিটো খ্রিস্টধর্মকে সমর্থন করতে এবং দুষ্ট ও লোভী ব্যক্তিদের নিন্দা করতে ভয় পেতেন না। এই দুষ্ট ও লোভী ব্যক্তিরা খ্রিস্টানদের তাড়না ও অন্যায়ভাবে নিন্দা করার জন্য অজুহাত হিসেবে সম্রাটের আদেশগুলো পাওয়ার চেষ্টা করেছিল, যাতে তারা খ্রিস্টানদের সম্পদগুলোকে চুরি করতে পারে।
সম্রাটের উদ্দেশে মেলিটো সাহসের সঙ্গে লিখেছিলেন: “আমরা আপনার কাছে শুধু এই অনুরোধটুকুই করছি, আপনি নিজে এই কলহ সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের [খ্রিস্টানদের] পরীক্ষা করে দেখুন এবং ন্যায্যভাবে বিচার করুন যে, তারা মৃত্যু ও শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, নাকি নিরাপত্তা ও রেহাই পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু, এই আদেশ ও নতুন হুকুম, যা এমনকি বর্বরোচিত শত্রুদের ওপরও জারি করা উপযুক্ত নয়, তা যদি আপনার কাছ থেকে না হয়, তা হলে আমরা আপনাকে আরও আন্তরিকভাবে অনুরোধ করছি, আপনি আমাদের এই উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে ছেড়ে দেবেন না, যারা আমাদের যথেচ্ছাচারীভাবে লুটপাট করছে।”
খ্রিস্টধর্মকে সমর্থন করার জন্য শাস্ত্রকে ব্যবহার করা
পবিত্র শাস্ত্র অধ্যয়ন করার প্রতি মেলিটো প্রচুর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। আমাদের কাছে তার সমস্ত বইয়ের তালিকা নেই কিন্তু কিছু বইয়ের শিরোনাম প্রকাশ করে যে, তিনি বাইবেলের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে কিছু হল, খ্রিস্টীয় জীবন ও ভাববাদীদের সম্বন্ধে, মানুষের বিশ্বাস সম্বন্ধে, সৃষ্টি সম্বন্ধে, বাপ্তিস্ম ও সত্য এবং বিশ্বাস ও খ্রিস্টের জন্ম সম্বন্ধে, আতিথেয়তা সম্বন্ধে এবং শাস্ত্র বোঝার চাবিকাঠি সম্বন্ধে আর দিয়াবল ও যোহনের রহস্যোদ্ঘাটন সম্বন্ধে।
ইব্রীয় শাস্ত্রে ঠিক কতগুলো বই রয়েছে, সেই সম্বন্ধে গবেষণা করার জন্য মেলিটো ব্যক্তিগতভাবে বাইবেলে বর্ণিত দেশগুলোতে গিয়েছিলেন। এই সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন: “আমি প্রাচ্যে গিয়ে এবং যেখানে এই বিষয়গুলো প্রচার ও পালন করা হয়, সেখানে উপস্থিত হয়ে এবং পুরাতন নিয়মের
বইগুলো সম্বন্ধে সঠিকভাবে জেনে ও সঠিক তথ্যগুলো নথিভুক্ত করার পরই আপনার কাছে সেগুলো পাঠিয়েছি।” এই তালিকায় নহিমিয় ও ইষ্টের পুস্তকের উল্লেখ নেই, তবে এটি হচ্ছে নামধারী খ্রিস্টানদের দ্বারা রচিত ইব্রীয় শাস্ত্রের অনুপ্রাণিত বইগুলোর সবচেয়ে পুরোনো গ্রন্থতালিকা।এই গবেষণার সময়, মেলিটো ইব্রীয় শাস্ত্র থেকে ধারাবাহিকক্রমে কিছু শাস্ত্রপদ সংগ্রহ করেছিলেন, যেগুলোতে যিশু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল। মেলিটোর লেখা সংকলন (ইংরেজি) শিরোনামের বইটি দেখায় যে, যিশুই ছিলেন সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত মশীহ এবং মোশির ব্যবস্থা ও ভাববাদীরা খ্রিস্টের বিষয়ে আগেই উল্লেখ করেছিল।
মুক্তির মূল্যের গুরুত্বকে সমর্থন করা
এশিয়া মাইনরের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে এক বিরাট যিহুদিসমাজ ছিল। মেলিটো যেখানে বাস করতেন সেই সার্দিসের যিহুদিরা, ১৪ই নিশান ইব্রীয় নিস্তারপর্ব উদ্যাপন করত। মেলিটো নিস্তারপর্ব (ইংরেজি) শিরোনামের একটা বক্তৃতা লিখেছিলেন, যেটা দেখিয়েছিল যে, মোশির ব্যবস্থায় নিস্তারপর্ব বৈধ ছিল আর তা ১৪ই নিশান প্রভুর সান্ধ্যভোজ সম্বন্ধীয় খ্রিস্টীয় উদ্যাপনকে সমর্থন করেছিল।
যাত্রাপুস্তক ১২ অধ্যায়ের ওপর মন্তব্য করার পর এবং নিস্তারপর্ব খ্রিস্টের বলিদানের পূর্বাভাস দিয়েছিল, তা বুঝিয়ে দেওয়ার পর, মেলিটো ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, কী কারণে খ্রিস্টানদের জন্য নিস্তারপর্ব পালন করা আর যুক্তিযুক্ত নয়। এর কারণটা হচ্ছে ঈশ্বর মোশির ব্যবস্থাকে লোপ করেছেন। এরপর তিনি দেখিয়েছিলেন যে, কেন খ্রিস্টের বলিদান অপরিহার্য ছিল: ঈশ্বর আদমকে এক পরমদেশে রেখেছিলেন, যাতে সে এক সুখী জীবন উপভোগ করতে পারে। কিন্তু, প্রথম মানুষ আদম সদসদ্-জ্ঞানদায়ক বৃক্ষের ফল না খাওয়ার বিষয়ে দেওয়া আদেশের অবাধ্য হয়েছিল। আর তখনই এক মুক্তির মূল্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল।
মেলিটো আরও ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, যিশুকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল এবং তিনি একটা গাছ বা দণ্ডের ওপর মৃত্যুবরণ করেছিলেন, যাতে বিশ্বাসী মানবজাতিকে পাপ ও মৃত্যু থেকে মুক্ত করতে পারেন। আগ্রহের বিষয়টা হচ্ছে, যিশু যে-দণ্ডের ওপর মারা গিয়েছিলেন, সেই বিষয়ে লিখতে গিয়ে মেলিটো গ্রিক শব্দ জাইলন ব্যবহার করেছিলেন, যেটির অর্থ হচ্ছে “কাঠ।”—প্রেরিত ৫:৩০; ১০:৩৯; ১৩:২৯.
মেলিটো এশিয়া মাইনর ছাড়াও অন্যান্য জায়গাতে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। টারটুলিয়ান, আলেকজান্দ্রিয়ার ক্লেমেন্ট এবং ওরিজেন তার লেখা বইগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিল। তা সত্ত্বেও, ইতিহাসবেত্তা রানিয়েরো কানটালামেসা বলেন: “মেলিটোর পতন, যা ধীরে ধীরে তার লেখাগুলোকে বিলুপ্ত করার দিকে পরিচালিত করেছিল, তা শুরু হয়েছিল—পুনরুত্থান নিস্তারপর্বের প্রথা জয় লাভ করার পর—যখন কোয়ারটোডেসিমান্দের ধর্মবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয়।” শেষ পর্যন্ত, মেলিটোর লেখাগুলো বলতে গেলে পুরোপুরিই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
ধর্মভ্রষ্টতার এক শিকার ছিলেন?
প্রেরিতদের মৃত্যুর পর, ভবিষ্যদ্বাণীকৃত ধর্মভ্রষ্টতা সত্য খ্রিস্টধর্মে ঢুকে পড়েছিল। (প্রেরিত ২০:২৯, ৩০) স্পষ্টতই, এটা মেলিটোকে প্রভাবিত করেছিল। তার লেখাগুলোর জটিল রচনায়, গ্রিক দর্শনবিদ্যা ও রোমীয় জগতের লেখাগুলো প্রতিফলিত হয়েছিল। সম্ভবত সেই কারণেই মেলিটো খ্রিস্টধর্মকে “আমাদের দর্শনবিদ্যা” বলে অভিহিত করেছিলেন। এ ছাড়া, তিনি তথাকথিত খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে রোমীয় সাম্রাজ্যের সংহতিকে “সাফল্যের . . . সর্ববৃহৎ নিদর্শন” বলে গণ্য করেছিলেন।
নিশ্চিতভাবেই, মেলিটো প্রেরিত পৌলের এই পরামর্শকে মেনে চলেননি: “দেখিও, দর্শনবিদ্যা ও অনর্থক প্রতারণা দ্বারা কেহ যেন তোমাদিগকে বন্দি করিয়া লইয়া না যায়; তাহা মনুষ্যদের পরম্পরাগত শিক্ষার অনুরূপ, জগতের অক্ষরমালার অনুরূপ, খ্রীষ্টের অনুরূপ নয়।” অতএব, মেলিটো বাইবেলের কিছু কিছু সত্যকে যদিও কিছুটা সমর্থন করেছিলেন কিন্তু অনেক দিক দিয়ে তিনি সেগুলোকে পরিত্যাগ করেছিলেন।—কলসীয় ২:৮.
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
যিশু ১৪ই নিশান প্রভুর সান্ধ্যভোজ প্রবর্তন করেছিলেন