সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ঈশ্বর যেকারণে দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন, তা জানা আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল

ঈশ্বর যেকারণে দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন, তা জানা আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল

জীবন কাহিনী

ঈশ্বর যেকারণে দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন, তা জানা আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল

বলেছেন হ্যারি পেলইয়ান

ঈশ্বর কেন দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন? খুব ছোটবেলা থেকেই এই প্রশ্নটা আমার মাথায় ঘুরছিল। আমার বাবামা কঠোর পরিশ্রমী, সৎ ও সাংসারিক মানুষ ছিল। বাবা ধর্মভীরু ছিলেন না কিন্তু মা কিছুটা ছিলেন। তাই, তারা আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি।

 এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও পরে যখন আমি তিন বছরেরও বেশি সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে ছিলাম, তখনও এই প্রশ্নটা আমাকে আরও বেশি করে ভাবিয়ে তুলেছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আমাকে এমন একটা জাহাজে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল, যেটাকে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর জন্য চিনে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আমি প্রায় এক বছর ছিলাম এবং অনেক অনেক লোককে কষ্টভোগ করতে দেখেছিলাম।

সাধারণত, চিনের লোকেরা হচ্ছে পরিশ্রমী ও বুদ্ধিমান লোক। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দরুন দরিদ্রতা ও সেইসঙ্গে হিংসার ফলে অনেকে নিদারুণ কষ্টভোগ করছিল। আমি বিশেষ করে সেই ফুটফুটে বাচ্চাদের দেখে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম, যাদের মধ্যে অনেকে অপুষ্টিতে ভুগছিল ও ছেঁড়া জামাকাপড় পরে থাকত এবং যখনই আমরা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যেতাম, আমাদের কাছে ভিক্ষা চাইত।

কেন?

আমি ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালিফোর্ণিয়ায় বড় হয়ে উঠি। আগে কখনো আমি এই ধরনের পরিস্থিতি দেখিনি। তাই, বার বার আমার মনে এই প্রশ্ন আসত, ‘সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা বলে যদি একজন থাকেন-ই, তা হলে কেন তিনি এত লোকের, বিশেষ করে নিরীহ বাচ্চাদের ওপর এই ধরনের পরিস্থিতি ঘটতে দিয়েছেন?’

এ ছাড়া আমি এও ভাবতাম যে, ঈশ্বর যদি সত্যিই থাকেন, তা হলে কীকারণে তিনি এই ধরনের ধ্বংস, গণহত্যা, মৃত্যু ও দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন, যেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানবজাতিকে জর্জরিত করে চলেছে—বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে, যখন ৫ কোটিরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছিল। এ ছাড়া, যুদ্ধ চলাকালীন কেন একই ধর্মের লোকেরা তাদের পাদরিদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে শুধুমাত্র ভিন্ন জাতির বলে একে অন্যকে হত্যা করছে?

দূরবিন

১৯৩৯ সালে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং সারা বিশ্বে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চলছিল, তখন আমি ভেবেছিলাম যে, ঈশ্বর বলে কেউ নেই। এরপর, হাইস্কুলের এক বিজ্ঞান ক্লাসে আমাদের প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে এমন একটা জিনিস বানাতে বলা হয়েছিল, যেটা বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আমি যেহেতু গ্রহনক্ষত্রবিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী ছিলাম, তাই আমি বিরাট আকারের একটা প্রতিফলক দূরবিন বানিয়েছিলাম, যেটার দর্পণের ব্যাস ছিল ২০ সেন্টিমিটার।

এই দূরবিনটা বানানোর জন্য আমি ২.৫ সেন্টিমিটারেরও বেশি পুরু ও ২০ সেন্টিমিটার চওড়া একটা কাচ কিনেছিলাম এবং একজন কাচ কাটার কারিগরকে দিয়ে গোল আকারে সেটা কাটিয়েছিলাম। এরপর আমি এটাকে এক অবতল দর্পণের আকার দেওয়ার জন্য সেটার ধারগুলোকে হাত দিয়ে ঘষতে শুরু করেছিলাম। এর জন্য আমাকে অবসর সময়গুলো ব্যয় করতে হয়েছিল, যার ফলে আমার পাঠ্যক্রমের অর্ধেক বছর এভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। দর্পণটা তৈরি হওয়ার পর আমি সেটাকে এক লম্বা ধাতব টিউবে বসিয়েছিলাম এবং দুই চোখ দিয়ে দেখার জন্য দূরবিনটাতে একটা ফ্রেম বসিয়েছিলাম, যেটাতে বিভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন লেন্স যুক্ত ছিল।

পরিষ্কার অন্ধকার রাতে আমি প্রথমবার আমার তৈরি দূরবিনটা বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং তারা ও আমাদের সৌরজগতে থাকা গ্রহগুলোর দিকে তাক করেছিলাম। অগণিত তারকারাজি ও যেভাবে সমস্তকিছু সুশৃঙ্খলভাবে সজ্জিত, তা দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর আমি এটা জানতে পেরে আরও বেশি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমার জানা “তারাগুলো” হচ্ছে আসলে আমাদের ছায়াপথের মতো বহু নক্ষত্র জগৎ, যেগুলোর প্রত্যেকটাতে কোটি কোটি তারা রয়েছে।

আমি চিন্তা করেছিলাম, ‘নিশ্চয়ই এই সমস্তকিছু আপনাআপনি হতে পারে না। সুসংগঠিত কোনোকিছুই আকস্মিকভাবে হয়ে যেতে পারে না। নিখিলবিশ্ব এত সুন্দরভাবে সুসংগঠিত যে, দেখে মনে হয় যেন অতীব প্রতিভাবান কোনো ব্যক্তি এটা তৈরি করেছেন। তা হলে, সত্যিই কি একজন ঈশ্বর আছেন?’ দূরবিন বানানোর অভিজ্ঞতা আমাকে আমার পূর্বের গোঁড়া নাস্তিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে পরিচালিত করেছিল।

এরপর আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম: ‘শক্তিশালী ও বিজ্ঞ ঈশ্বর বলে যদি সত্যিই কেউ থাকেন, যিনি এই বিস্ময়কর নিখিলবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তা হলে, তিনি কি পৃথিবীর এই শোচনীয় অবস্থাকে ঠিক করতে পারেন না? কেনই বা তিনি এই সমস্ত দুর্দশা থাকতে দিচ্ছেন?’ এই ধরনের প্রশ্নগুলো যখন আমি ধর্মীয় লোকেদের কাছে জিজ্ঞেস করি, তারা কোনো সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি।

হাইস্কুল ও কয়েক বছর কলেজে পড়ার পর, আমি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি বলতে কী, সৈন্যবাহিনীর পাদরিরাও আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেনি। যারা ধর্মভীরু ছিল, তারা প্রায়ই এমনটা বলত, “প্রভুর পথ বোঝা দায়।”

আমি সন্ধান চালিয়ে গিয়েছিলাম

আমি চিন ছেড়ে চলে আসার পরও, ঈশ্বর যেকারণে দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন সেই প্রশ্নগুলো আমার মনে ঘুরতে থাকে। আমি কোনোভাবেই প্রশ্নগুলো ভুলে যেতে পারছিলাম না, বিশেষ করে এই কারণে যে, আমরা প্রশান্ত মহাসাগরের ওপার থেকে নিজের দেশে ফেরার সময় যখন বিভিন্ন দ্বীপে থেমেছিলাম, তখন সেখানে সৈনিকদের সমাধিগুলো দেখেছিলাম। প্রায় অধিকাংশই সেই যুবক ব্যক্তিদের সমাধি ছিল, যারা অকালে মারা গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে নৌবাহিনী থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমাকে ম্যাসাচুসিটসের, ক্যামব্রিজে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুলের আরেকটা বছর শেষ করতে হয়েছিল। সেই বছর গ্র্যাজুয়েশন করে আমি ডিগ্রি নিয়েছিলাম কিন্তু আমি কালিফোর্ণিয়ায় বাড়িতে ফিরে যায়নি। আমি আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় কিছু সময়ের জন্য পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল যেখানে অনেক ধর্ম রয়েছে, সেই নিউ ইয়র্ক সিটিতে যাওয়া এবং সেখানে কী শেখানো হয়, তা দেখার জন্য কিছু ধর্মীয় সভায় যোগ দেওয়া।

আমার বড় মাসি ইজাবেল কাপিজেন নিউ ইয়র্কে আমাকে তার বাড়িতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি ও তার দুই মেয়ে রোজ ও রূৎ হলেন যিহোবার সাক্ষি। যেহেতু আমি ভাবিনি যে, তাদের বিশ্বাসের প্রতি আমি আগ্রহী হব, তাই আমি অন্য ধর্মগুলোর সভাতে যোগ দিতে শুরু করেছিলাম, সেই ধর্মের লোকেদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম এবং তাদের সাহিত্যাদি পড়েছিলাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করতাম যে, কীকারণে ঈশ্বর দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন কিন্তু তারাও এমনকি এর উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাই, আমি এই উপসংহারে পৌঁছেছিলাম যে, সম্ভবত ঈশ্বর বলে কেউ নেই।

উত্তরগুলো খুঁজে পাওয়া

এরপর আমি আমার মাসি ও তার মেয়েদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, যিহোবার সাক্ষিদের দৃষ্টিভঙ্গি জানার জন্য আমি তাদের কিছু সাহিত্যাদি পড়তে পারি কি না। প্রকাশনাগুলো পড়ার পর আমি সহজেই বুঝেছিলাম যে, সাক্ষিরা অন্যান্য ধর্মের চেয়ে একেবারেই আলাদা। বাইবেল থেকে পাওয়া উত্তরগুলো খুবই সন্তোষজনক ছিল। আমি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, ঈশ্বর যেকারণে দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়েছিলাম।

শুধু তা-ই নয় কিন্তু আমি এটাও দেখেছিলাম যে, যিহোবার সাক্ষিরা তাদের বাইবেলভিত্তিক উত্তরগুলোর সঙ্গে মিল রেখে কাজও করে। উদাহরণস্বরূপ, আমি আমার মাসিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে যুবক যিহোবার সাক্ষিরা কী করেছিল। তারা কি সেখানে “হাইল হিটলার!” বলে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল এবং স্বস্তিকা-চিহ্নের পতাকাকে অভিবাদন করেছিল? তার উত্তর ছিল না, তারা তা করেনি। আর তাদের নিরপেক্ষতার কারণে তাদেরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, সব জায়গাতেই যুদ্ধের সময়ে যিহোবার সাক্ষিরা একই অবস্থান বজায় রেখেছিল: সেটা হল নিরপেক্ষতা। এমনকি গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও যুবক যিহোবার সাক্ষিদের তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানের জন্য জেলে পাঠানো হয়েছিল।

এরপর আমার মাসি আমাকে যোহন ১৩:৩৫ পদ পড়তে বলেছিলেন, যেখানে বলা আছে: “তোমরা যদি আপনাদের মধ্যে পরস্পর প্রেম রাখ, তবে তাহাতেই সকলে জানিবে যে, তোমরা আমার শিষ্য।” সত্য খ্রিস্টানদের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে প্রেমের এই শনাক্তিকরণ চিহ্নটি অবশ্যই থাকবে। তারা ভিন্ন জাতির বলে কখনোই তাদেরকে, যুদ্ধে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ও একে অপরকে হত্যা করতে দেখা যাবে না! তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন: “তুমি কি এইরকম কল্পনা করতে পারো যে, রোমের যুদ্ধগুলোতে যিশু ও তাঁর শিষ্যরা দুদলে থেকে একে অন্যকে হত্যা করছে?”

এ ছাড়া, আমাকে ১ যোহন ৩:১০-১২ পদও পড়তে বলা হয়েছিল। সেখানে বলা আছে: “ইহাতে ঈশ্বরের সন্তানগণ এবং দিয়াবলের সন্তানগণ প্রকাশ হইয়া পড়ে; যে কেহ ধর্ম্মাচরণ না করে, এবং যে ব্যক্তি আপন ভ্রাতাকে প্রেম না করে, সে ঈশ্বরের লোক নয়। . . . আমাদের পরস্পর প্রেম করা কর্ত্তব্য; কয়িন যেমন সেই পাপাত্মার লোক, এবং আপন ভ্রাতাকে বধ করিয়াছিল, তেমন যেন না হই।”

এই বিষয়ে বাইবেল স্পষ্টভাবে বলে। সত্য খ্রিস্টানরা একে অপরকে ভালবাসে, তা তারা যে-দেশেই বাস করুক না কেন। তাই, এই কারণে তাদের কখনোই তাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিক ভাইবোনদের অথবা অন্য কাউকে হত্যা করতে দেখা যায় না। এইজন্য, যিশু তাঁর অনুসারীদের সম্বন্ধে বলতে পেরেছিলেন: “তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই।”—যোহন ১৭:১৬.

যেকারণে থাকতে দিয়েছেন

শীঘ্রই, আমি জেনেছিলাম বাইবেল আমাদের বলে যে, কীকারণে ঈশ্বর দুঃখকষ্ট থাকতে দিয়েছেন। এটি ব্যাখ্যা করে যে, ঈশ্বর যখন আমাদের আদি পিতামাতাকে সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তিনি তাদের সিদ্ধ হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন ও এক পরমদেশ উদ্যানে রেখেছিলেন। (আদিপুস্তক ১:২৬; ২:১৫) এ ছাড়া, তিনি তাদেরকে খুব সুন্দর এক উপহার দিয়েছিলেন—স্বাধীন ইচ্ছা। কিন্তু, সেই স্বাধীন ইচ্ছাকে তাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হতো। তারা যদি ঈশ্বরের ও তাঁর নিয়মগুলোর বাধ্য থাকত, তা হলে তারা এক পরমদেশে সিদ্ধভাবে চিরকাল বেঁচে থাকতে পারত। তারা সেই পরমদেশের সীমানাকে সেই পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারত, যে পর্যন্ত না সমগ্র পৃথিবী পরমদেশে পরিণত হতো। তাদের বংশধররাও সিদ্ধ হতো, যার ফলে এই পৃথিবী সিদ্ধ, সুখী লোকেদের নিয়ে এক চমৎকার পরমদেশ হয়ে উঠত।—আদিপুস্তক ১:২৮.

কিন্তু, আদম ও হবা যদি তাদের ইচ্ছামতো, ঈশ্বর থেকে দূরে চলে যাওয়া বেছে নেয়, তা হলে তিনি তাদের কখনোই সিদ্ধ হিসেবে থাকার অনুমতি দেবেন না। (আদিপুস্তক ২:১৬, ১৭) মানবজাতির জন্য এটা দুঃখের বিষয় যে, আমাদের আদি পিতামাতা তাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে অপব্যবহার করেছিল এবং ঈশ্বর থেকে স্বাধীন হওয়াই বেছে নিয়েছিল। তারা এক বিদ্রোহী আত্মিক প্রাণীর দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল, যে শয়তান দিয়াবল নামে পরিচিত হয়ে উঠে। সে ঈশ্বর থেকে স্বাধীন হওয়ার এবং যে-উপাসনা পাওয়ার অধিকার একমাত্র ঈশ্বরেরই, সেটা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিল।—আদিপুস্তক ৩:১-১৯; প্রকাশিত বাক্য ৪:১১.

এভাবে শয়তান “এই যুগের দেব” হয়ে উঠেছে। (২ করিন্থীয় ৪:৪) বাইবেল বলে: “সমস্ত জগৎ সেই পাপাত্মার মধ্যে শুইয়া রহিয়াছে।” (১ যোহন ৫:১৯) যিশু শয়তানকে “জগতের অধিপতি” বলে আখ্যা দিয়েছেন। (যোহন ১৪:৩০) শয়তান ও আমাদের আদি পিতামাতার অবাধ্যতা সমস্ত মানবজাতির জন্য অসিদ্ধতা, দৌরাত্ম্য, মৃত্যু, শোক ও দুঃখকষ্ট নিয়ে এসেছে।—রোমীয় ৫:১২.

‘মনুষ্য পারে না’

সৃষ্টিকর্তার নিয়মগুলোকে অবজ্ঞা করা মানব পরিবারের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা দেখানোর জন্য ঈশ্বর হাজার হাজার বছর ধরে এর পরিণতিগুলো ঘটতে দিয়েছেন। এই সময়কাল, সমগ্র মানবজাতিকে বাইবেল এই বিষয়ে যা বলেছে সেটা কতখানি সত্য, তা দেখার প্রচুর সুযোগ করে দিয়েছে: “মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়, মনুষ্য চলিতে চলিতে আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না। হে সদাপ্রভু, আমাকে শাসন কর।”—যিরমিয় ১০:২৩, ২৪.

বহু শতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পর, বর্তমানে আমরা দেখতে পাই যে, ঈশ্বর থেকে স্বাধীন হয়ে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থা ব্যর্থই হয়েছে। তাই, মানবজাতি ঈশ্বরের ও তাঁর নিয়মগুলো থেকে স্বাধীন হওয়ায় যে-ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা লাভ করছে সেটার সমাপ্তি আনা হচ্ছে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য।

এক চমৎকার ভবিষ্যৎ

বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী দেখায় যে, খুব শীঘ্রই ঈশ্বর এই দুষ্ট বিধি ব্যবস্থার শেষ নিয়ে আসবেন: “ক্ষণকাল, পরে দুষ্ট লোক আর নাই, . . . কিন্তু মৃদুশীলেরা দেশের অধিকারী হইবে, এবং শান্তির বাহুল্যে আমোদ করিবে।”—গীতসংহিতা ৩৭:১০, ১১.

দানিয়েল ২:৪৪ পদে দেওয়া ভবিষ্যদ্বাণী ঘোষণা করে: “সেই রাজগণের [বর্তমানে বিদ্যমান সমস্ত ধরনের শাসনব্যবস্থার] সময়ে স্বর্গের ঈশ্বর এক রাজ্য স্থাপন করিবেন, তাহা কখনও বিনষ্ট হইবে না, এবং সেই রাজত্ব অন্য জাতির হস্তে সমর্পিত হইবে না; তাহা ঐ সকল রাজ্য চূর্ণ ও বিনষ্ট করিয়া আপনি চিরস্থায়ী হইবে।” আর কখনোই মানুষকে শাসন করতে অনুমতি দেওয়া হবে না। সমগ্র পৃথিবী ঈশ্বরের রাজ্য দ্বারা শাসিত হবে। এর শাসনাধীনে, পুরো পৃথিবীকে এক পরমদেশে পরিণত করা হবে এবং মানবজাতি চিরকাল সুখে বাস করার জন্য সিদ্ধতায় পৌঁছাবে। বাইবেল প্রতিজ্ঞা করে: “[ঈশ্বর] তাহাদের সমস্ত নেত্রজল মুছাইয়া দিবেন; এবং মৃত্যু আর হইবে না; শোক বা আর্ত্তনাদ বা ব্যথাও আর হইবে না।” (প্রকাশিত বাক্য ২১:৪) ঈশ্বর আমাদের জন্য কী এক চমৎকার ভবিষ্যৎ-ই না রেখেছেন!

এক ভিন্ন জীবন

আমার প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাওয়া আমার জীবনকে বদলে দিয়েছিল। সেই সময় থেকে আমি ঈশ্বরকে সেবা করতে এবং অন্যেরা যাতে এই উত্তরগুলো খুঁজে পেতে পারে, সেইজন্য সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। ১ যোহন ২:১৭ পদ যা বলতে চায় সেটার গুরুত্বকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম: “জগৎ [শয়তানের দ্বারা শাসিত এই বর্তমান বিধি ব্যবস্থা] ও তাহার অভিলাষ বহিয়া যাইতেছে; কিন্তু যে ব্যক্তি ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করে, সে অনন্তকালস্থায়ী।” আমি ঈশ্বরের নতুন জগতে অনন্তজীবন পাওয়ার বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলাম। আমি নিউ ইয়র্কে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং সেখানে যিহোবার সাক্ষিদের একটা মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করেছিলাম আর আমি যা শিখেছিলাম, তা অন্যদের শিখতে সাহায্য করার অনেক মনোরম অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে।

১৯৪৯ সালে, আমার সঙ্গে রোজ মেরি লুইসের দেখা হয়। সে, তার মা স্যাডি এবং তার ছয় বোন, সবাই হলেন যিহোবার সাক্ষি। রোজ পূর্ণসময় প্রচার কাজ করে ঈশ্বরকে সেবা করছিল। তার অনেক ভাল গুণ ছিল এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। আমরা ১৯৫০ সালের জুন মাসে বিয়ে করেছিলাম এবং নিউ ইয়র্কেই থেকে গিয়েছিলাম। আমরা যা করছিলাম তাতে খুশি ছিলাম এবং ঈশ্বরের নতুন জগতে চিরকাল বেঁচে থাকার আশায় আনন্দিত ছিলাম।

১৯৫৭ সালে, রোজ মেরি ও আমাকে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে পূর্ণসময়ের সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ২০০৪ সালের জুন মাসে আমাদের সুখী বিবাহিত জীবনের ৫৪ বছর কেটে গিয়েছিল, যার মধ্যে ৪৭ বছর কেটেছিল ব্রুকলিনের প্রধান কার্যালয়ে। সেই বছরগুলো ছিল যিহোবাকে সেবা করার এবং হাজার হাজার সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে থেকে কাজ করার আনন্দময় সময়।

আমার সবচেয়ে কষ্টকর সময়

দুঃখের বিষয় যে, ২০০৪ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে পরীক্ষা করে জানা যায় যে, রোজ মেরির একটা ফুসফুসে টিউমার রয়েছে, যা ক্যানসারের দিকে মোড় নিয়েছে। ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তে আসে যে, সেটা খুব দ্রুত বড় হচ্ছে এবং শীঘ্রই সেটাকে কেটে ফেলতে হবে। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে অপারেশন করানো হয়েছিল এবং এক সপ্তাহ পর সার্জন হাসপাতালে রোজের রুমে এসেছিলেন, যখন আমি সেখানে ছিলাম আর তিনি বলেছিলেন: “রোজ মেরি, আপনি বাড়ি যেতে পারেন! আপনি একেবারে সুস্থ হয়ে গিয়েছেন!”

কিন্তু, রোজ মেরি বাড়িতে আসার মাত্র অল্প কয়েক দিন পর সে তার পেটে এবং তার আশেপাশে প্রচণ্ড যন্ত্রণা বোধ করেছিল। যন্ত্রণা কমেনি, তাই আরও কিছু পরীক্ষা করানোর জন্য সে আবারও হাসপাতালে গিয়েছিল। তাতে জানা গিয়েছিল যে, কিছু কারণের জন্য তার বেশ কয়েকটা জরুরি অঙ্গে রক্ত জমাট বাঁধছে এবং এর ফলে সেই অঙ্গগুলো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাচ্ছে না। ডাক্তাররা এটা সারাতে তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি। মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরে, ২০০৫ সালের ৩০শে জানুয়ারি, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার খবর পেয়েছিলাম। আমার প্রিয়তমা রোজ মেরি মারা গিয়েছিল।

সেই সময়ে, আমার বয়স ছিল প্রায় ৮০ বছর এবং সারাজীবন আমি লোকেদের কষ্টভোগ করতে দেখেছিলাম কিন্তু এই কষ্ট ছিল একেবারেই আলাদা। রোজ মেরি ও আমি ছিলাম “একাঙ্গ,” যেমন বাইবেল বলে। (আদিপুস্তক ২:২৪) আমি অন্যদের কষ্টভোগ দেখেছিলাম এবং নিজে কষ্ট পেয়েছিলাম, যখন আমার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন মারা গিয়েছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী মারা যাওয়ায় যে-কষ্ট আমি পেয়েছিলাম, তা খুব বেশি তীব্র ও চিরস্থায়ী ছিল। এখন আমি পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারি যে, প্রিয়জনদের মৃত্যু এতদিন ধরে মানব পরিবারে কী প্রচণ্ড শোকই না নিয়ে এসেছে।

তবে, দুঃখকষ্টের উৎস সম্বন্ধে এবং এটা কীভাবে শেষ হবে, তা জানা আমাকে বল দিয়েছে। গীতসংহিতা ৩৪:১৮ পদ বলে: “সদাপ্রভু ভগ্নচিত্তদের নিকটবর্ত্তী, তিনি চূর্ণমনাদের পরিত্রাণ করেন।” এই দুঃখকষ্টকে ধৈর্য ধরে সহ্য করার চাবিকাঠি হল এটা জানা যে, বাইবেল পুনরুত্থানের বিষয়ে শিক্ষা দেয় এই বলে যে, যারা কবরে রয়েছে তারা বেরিয়ে আসবে এবং ঈশ্বরের নতুন জগতে চিরকাল বেঁচে থাকার সুযোগ পাবে। প্রেরিত ২৪:১৫ পদ বলে: “ধার্ম্মিক অধার্ম্মিক উভয় প্রকার লোকের পুনরুত্থান হইবে।” রোজ মেরি ঈশ্বরকে খুবই ভালবাসত। আমি নিশ্চিত যে, ঈশ্বরও রোজ মেরিকে একইভাবে ভালবাসেন এবং তিনি তাকে স্মরণে রাখবেন ও তাঁর নির্ধারিত সময়ে তাকে আবার ফিরিয়ে আনবেন, আশা করি খুব শীঘ্রই।—লূক ২০:৩৮; যোহন ১১:২৫.

কোনো প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ যদিও অনেক কিন্তু সেই প্রিয়জনকে পুনরুত্থানে ফিরে পাওয়ার আনন্দ তার চেয়েও আরও বেশি হবে। (মার্ক ৫:৪২) ঈশ্বরের বাক্য প্রতিজ্ঞা করে: “তোমার মৃতেরা জীবিত হইবে, . . . ভূমি প্রেতদিগকে ভূমিষ্ঠ করিবে [“পৃথিবী মৃত মানুষদের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাবে,” বাংলা ইজি-টু-রিড ভারসন]।” (যিশাইয় ২৬:১৯) প্রেরিত ২৪:১৫ পদে উল্লেখিত ‘ধার্ম্মিক লোকের’ মধ্যে সম্ভবত অনেকে প্রথম দিকে পুনরুত্থিত হবে। সেই সময়টা কী চমৎকারই না হবে! আর যাদের ফিরিয়ে আনা হবে তাদের মধ্যে থাকবে রোজ মেরি। তার প্রিয়জনদের কাছ থেকে কত উষ্ণ অভ্যর্থনাই না সে পাবে! সেই সময় এমন এক জগতে বাস করা কতই না সন্তোষজনক হবে, যেখানে কোনো দুঃখকষ্টই নেই!

[৯ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

চিনে থাকার সময় আমি লোকেদের কষ্টভোগ করতে দেখেছিলাম

[১০ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯৫৭ সাল থেকে আমি ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয়ে সেবা করছি

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫০ সালে আমি রোজ মেরিকে বিয়ে করেছিলাম

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

২০০০ সালে আমাদের ৫০তম বিবাহবার্ষিকীতে