সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অধ্যবসায় আনন্দ নিয়ে আসে

অধ্যবসায় আনন্দ নিয়ে আসে

জীবন কাহিনী

অধ্যবসায় আনন্দ নিয়ে আসে

বলেছেন মারিয়ো রোশা ডি সৌজা

“এই অপারেশন হলে মি. রোশা বেঁচে থাকবেন কি না, সেই বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।” একজন ডাক্তার এমন হতাশাজনক অনুমান করা সত্ত্বেও, আজকে প্রায় ২০ বছর পর এখনও পর্যন্ত আমি যিহোবার সাক্ষিদের একজন পূর্ণসময়ের প্রচারক হিসেবে সেবা করে যাচ্ছি। কী আমাকে এত বছর ধরে অধ্যবসায়ী হতে সাহায্য করেছে?

 আমার ছেলেবেলা কেটেছে উত্তরপূর্ব ব্রাজিলের বাহিয়া অঙ্গরাজ্যের সানটু এসটেভ্যাওঁ গ্রামের কাছে এক খামারে। আমার বয়স যখন সাত বছর, তখন থেকেই আমি বাবাকে খামারের কাজে সাহায্য করি। প্রতিদিন স্কুলের পর, তিনি আমাকে কোনো না কোনো কাজে লাগিয়ে দিতেন। পরবর্তী সময়ে, বাবা ব্যাবসার কাজে অঙ্গরাজ্যের রাজধানী শহর সালভাদরে গেলে আমার ওপর খামারের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন।

আমাদের এখানে বিদ্যুৎ ছিল না, জল সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল না বা বর্তমানে প্রাপ্তিসাধ্য সুযোগ-সুবিধাও ছিল না কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম। আমি ঘুড়ি উড়াতাম বা আমার বন্ধুদের সঙ্গে মিলে যে-কাঠের খেলনা গাড়িগুলো বানিয়েছিলাম, সেগুলো দিয়ে খেলতাম। এ ছাড়া, আমি ধর্মীয় শোভাযাত্রায় বাঁশি বাজাতাম। আমি স্থানীয় গির্জায় গানের দলের সদস্য ছিলাম এবং সেখানেই আমি ইসটরিয়া সাগরাদা (পবিত্র ইতিহাস) নামে একটি বই দেখেছিলাম, যেটি বাইবেলের প্রতি আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল।

১৯৩২ সালে আমার বয়স যখন ২০ বছর, তখন ব্রাজিলের উত্তরপূর্বাঞ্চলে এক প্রচণ্ড, দীর্ঘস্থায়ী খরা হয়। এর ফলে আমাদের গবাদি পশু মারা যায়, শস্যের ক্ষতি হয় আর তাই আমি সালভাদরে চলে যাই ও সেখানে গিয়ে আমি ট্রাম চালকের চাকরি পাই। পরে আমি একটা ঘর ভাড়া নিই ও আমার পরিবারকে আমার সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে আসি। ১৯৪৪ সালে বাবা মারা যান আর আমার ওপর মা এবং আট বোন ও তিন ভাইয়ের দেখাশোনা করার দায়িত্ব এসে পড়ে।

ট্রাম চালক থেকে সুসমাচার প্রচারক

সালভাদরে পৌঁছে আমি সবচেয়ে প্রথমে যে-কাজগুলো করেছিলাম তার মধ্যে একটা হল, আমি একটি বাইবেল কিনেছিলাম। কয়েক বছর ব্যাপ্টিস্ট গির্জায় যোগ দেওয়ার পর, আরেকজন ট্রাম চালক ডুরভালের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। ডুরভাল ও আমি প্রায়ই বাইবেল সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনা করতাম। একদিন সে আমাকে মৃতেরা কোথায়? (ইংরেজি) * শিরোনামের একটি পুস্তিকা দিয়েছিল। যদিও আমি বিশ্বাস করতাম যে, মানুষের অমর আত্মা রয়েছে কিন্তু তবুও আমি সেই পুস্তিকায় উদ্ধৃত বাইবেলের পদগুলো পরীক্ষা করে দেখার ব্যাপারে বেশ কৌতূহলী হয়েছিলাম। আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন দেখেছি যে, বাইবেল বলে, মানুষের কোনো অমর আত্মা নেই।—উপদেশক ৯:৫, ১০.

ডুরভাল আমার আগ্রহ লক্ষ করে আন্তনিয়ু আন্দ্রাদি নামে যিহোবার সাক্ষিদের একজন পূর্ণসময়ের পরিচারককে আমার ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আন্তনিয়ু তৃতীয় বার আমার এখানে আসার পর, আমাকে অন্যদের কাছে বাইবেলের শিক্ষাগুলো জানানোর জন্য তার সঙ্গে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রথম দুটো ঘরে তিনি কথা বলার পর, আমাকে বলেছিলেন, “এখন আপনার পালা।” আমি খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম কিন্তু আনন্দের বিষয় হচ্ছে, একটা পরিবার খুব মন দিয়ে আমার কথা শোনে এবং আমি যে-দুটো বই তাদের দিয়েছিলাম, সেগুলো নেয়। বাইবেলের সত্যের প্রতি আগ্রহ দেখায় এমন কারো সঙ্গে দেখা হলে, আজও আমি একইরকম আনন্দ পাই।

১৯৪৩ সালের ১৯শে এপ্রিল, সেই বছর খ্রিস্টের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি সালভাদরের কাছে আটলান্টিক মহাসাগরে বাপ্তিস্ম নিই। সেই সময় অভিজ্ঞ খ্রিস্টান পুরুষদের অভাব থাকায় এক সাক্ষি দলকে সাহায্য করার জন্য আমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল, যে-দলটা ভাই আন্দ্রাদির বাড়িতে মিলিত হতো। ভাই আন্দ্রাদির বাড়ি ছিল এমন একটা সরু রাস্তার ওপর, যে-রাস্তাটা সালভাদর শহরের উঁচু ও নিচু এলাকাকে যুক্ত করেছে।

প্রথম দিকের বিরোধিতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫ সাল) চলাকালীন আমাদের খ্রিস্টীয় কাজকর্মকে তেমন একটা ভাল চোখে দেখা হতো না। কিছু কর্মকর্তা আমাদের উত্তর আমেরিকার গুপ্তচর বলে সন্দেহ করেছিল কারণ আমাদের অধিকাংশ প্রকাশনাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসত। ফলে, প্রায়ই গ্রেপ্তার ও জেরা করা হতো। কোনো সাক্ষি ক্ষেত্রের পরিচর্যা থেকে ফিরে না আসলে আমরা ধরে নিতাম যে, তাকে নিশ্চয়ই আটকে রাখা হয়েছে আর আমরা তাকে ছাড়িয়ে আনতে পুলিশ স্টেশনে যেতাম।

১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে, আ্যডল্ফ মেসমার নামে জার্মানির একজন সাক্ষি সালভাদরে আমাদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠানে সাহায্য করার জন্য আসেন। সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার পর, “নতুন জগতে স্বাধীনতা” শিরোনামের জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার বিজ্ঞাপন স্থানীয় খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশ করা হয়েছিল এবং এই বিষয়ে দোকানের জানালায় জানালায় এবং ট্রামের গায়ে পোস্টার লাগানো হয়েছিল। কিন্তু, সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে একজন পুলিশ আমাদের জানান যে, সম্মেলন করার বিষয়ে আমাদের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছে। সালভাদরের আর্চবিশপ আমাদের সম্মেলন বন্ধ করার জন্য পুলিশ প্রধানকে চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরের বছর এপ্রিল মাসে, বিজ্ঞাপনে দেওয়া সেই জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

অনুধাবন করার মতো এক লক্ষ্য

১৯৪৬ সালে, সাও পাওলো শহরে অনুষ্ঠিত আনন্দিত জাতির ঈশতান্ত্রিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আমি আমন্ত্রণ পাই। সালভাদরে মালবাহী এক জাহাজের ক্যাপ্টেন আমাদের দলকে তার জাহাজে করে যেতে অনুমতি দিয়েছিলেন, তবে যদি আমরা জাহাজের ডেকে ঘুমাতে পারি। একটা ঝড়ের কবলে পড়ে আমরা সকলে সমুদ্রপীড়ায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও, চারদিন সমুদ্রে থাকার পর আমরা নিরাপদে রিও ডি জেনেরিওতে গিয়ে জাহাজ ভিড়িয়েছিলাম। আমরা সেখান থেকে ট্রেনে করে যাত্রা শুরু করার আগে, আমাদেরকে কয়েক দিন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রিও শহরের সাক্ষিরা সানন্দে তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল। আমাদের ট্রেন সাও পাওলোতে এসে পৌঁছালে একটা ছোট দল “যিহোবার সাক্ষিদের স্বাগতম” লেখা ব্যানার নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।

সালভাদরে ফিরে আসার অল্প কিছুদিন পর, আমি হ্যারি ব্ল্যাক নামে যুক্তরাষ্ট্রের একজন মিশনারির কাছে একজন অগ্রগামী হওয়ার বিষয়ে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলাম, যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণসময়ের পরিচারকদের অগ্রগামী বলা হয়। হ্যারি আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমার ওপর পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব রয়েছে, তাই তিনি আমাকে তখন ধৈর্য ধরতে বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত, ১৯৫২ সালের জুন মাসের মধ্যে আমার ভাইবোনেরা আর্থিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিল আর আমাকে সালভাদরের উপকূল থেকে ২১০ কিলোমিটার দক্ষিণে ইলিয়েয়ুস শহরের একটা ছোট মণ্ডলীতে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল।

এক উদার ব্যবস্থা

পরের বছর আমাকে বাহিয়া অঙ্গরাজ্যের মধ্যভাগে ঝেকিয়ে নামে এক বড় শহরে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল, যেখানে কোনো সাক্ষি ছিল না। সবচেয়ে প্রথমে স্থানীয় যাজকের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, এই এলাকা তার অধিকারভুক্ত আর তাই আমাকে সেখানে প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি তার যাজকপল্লির অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের একজন “মিথ্যা ভাববাদীর” আগমন সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিলেন এবং আমার কাজের ওপর নজর রাখার জন্য সারা শহরে লোক লাগিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও, আমি সেদিন ৯০টিরও বেশি বাইবেলভিত্তিক সাহিত্য অর্পণ করেছিলাম ও চারটে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম। দুবছর পর, ঝেকিয়েতে ৩৬ জন সাক্ষিসহ নিজস্ব কিংডম হল হয়েছিল! আজকে সেখানে আটটা মণ্ডলী রয়েছে আর ঝেকিয়ে শহরে প্রায় ৭০০ জন সাক্ষি রয়েছে।

ঝেকিয়েতে প্রথম কয়েক মাস আমি শহরের প্রান্তে অবস্থিত ভাড়া করা একটা ছোট্ট ঘরে থাকতাম। এরপর মিগেল ভাজ ডি ওলিভেরা নামে একজন ব্যক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যিনি ঝেকিয়ে শহরের সেরা হোটেলগুলোর মধ্যে একটার মালিক ছিলেন, যেটার নাম ছিল হোটেল সাদোয়েসটে। মিগেল বাইবেল অধ্যয়ন করতে রাজি হন এবং অনেকবার আমাকে তার হোটেলের একটা রুমে থাকতে অনুরোধ করেন। পরে মিগেল ও তার স্ত্রী সাক্ষি হয়।

ঝেকিয়ে শহরে থাকাকালীন একজন হাইস্কুল শিক্ষক লুইজ কোট্রিঁকে ঘিরে আমার আরেকটা আনন্দের স্মৃতি রয়েছে, তাকে আমি বাইবেল অধ্যয়ন করিয়েছিলাম। লুইজ আমাকে পর্তুগিজ ভাষা ও গণিত বিষয়ে আরও উন্নতি করতে সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যেহেতু আমি কোনোরকমে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলাম, তাই আমি সানন্দে তার সেই আমন্ত্রণে রাজি হয়েছিলাম। প্রতি সপ্তাহে লুইজের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করার পর, তার শেখানো পড়াগুলো আমাকে বাড়তি কিছু বিশেষ সুযোগ পাওয়ার জন্য প্রস্তুত করেছিল, যা আমি শীঘ্রই যিহোবার সংগঠনের কাছ থেকে পেয়েছিলাম।

এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হওয়া

১৯৫৬ সালে আমি একটা চিঠি পেয়েছিলাম, যেটাতে আমাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে প্রশিক্ষণ লাভ করার জন্য আমাদের শাখা অফিসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যেটা তখন রিও ডি জেনেরিওতে ছিল আর উল্লেখ্য যে, যিহোবার সাক্ষিদের ভ্রমণ পরিচারকদের সীমা অধ্যক্ষ বলা হয়। আরও আটজন সেই প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগ দিয়েছিল, যেটা একমাসের একটু বেশি সময় পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। সেই কোর্সের শেষের দিকে আমাকে সাও পাওলো অঙ্গরাজ্যে নিয়োগ করা হয়েছিল, যা আমাকে অনেক ভাবিয়ে তুলেছিল। আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম: ‘আমার মতো একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি, সেখানে সেই ইতালীয় লোকেদের মাঝে গিয়ে কী করবে? তারা কি আমাকে গ্রহণ করে নেবে?’ *

সানটু আমারু জেলায় প্রথম মণ্ডলীতে পরিদর্শন করে আমি কিংডম হল ভরতি সহসাক্ষি ও আগ্রহী লোকেদের দেখে খুবই উৎসাহ পেয়েছিলাম। আমার দুশ্চিন্তা যে ভিত্তিহীন ছিল সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যখন আমি দেখেছিলাম যে, মণ্ডলীর ৯৭ জন প্রকাশক সবাই সেই সপ্তাহের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পরিচর্যায় অংশ নিয়েছিল। ‘সত্যি সত্যিই তারা আমার ভাইবোন,’ আমি মনে মনে ভেবেছিলাম। সেই প্রিয় ভাইবোনদের উষ্ণ ভালবাসাই আমাকে ভ্রমণ পরিচর্যায় অধ্যবসায়ী হওয়ার সাহস জুগিয়েছিল।

গাধা, ঘোড়া ও পিপীলিকাভুক

সেই প্রাথমিক দিনগুলোতে ভ্রমণ অধ্যক্ষরা যে-বড় বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতো তার মধ্যে একটা হচ্ছে, মণ্ডলীগুলোতে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট ছোট সাক্ষি দলের কাছে পৌঁছানোর জন্য দীর্ঘ যাত্রা করা। সেই জায়গাগুলোতে সাধারণ পরিবহন তেমন নিরাপদ ছিল না আর বলতে গেলে তেমন যানবাহনও ছিল না এবং অধিকাংশ রাস্তাই ছিল সরু ও কাঁচা।

কিছু কিছু সীমার ভাইবোনেরা, একজন সীমা অধ্যক্ষের ব্যবহারের জন্য একটা গাধা বা ঘোড়া কিনে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করেছিল। অনেক সোমবার আমি ঘোড়া বা গাধার ওপর চড়ে, আমার মালপত্র চাপিয়ে নিয়ে প্রায় ১২ ঘন্টা যাত্রা করে পরবর্তী মণ্ডলীতে যেতাম। সানটা ফে দু সুল শহরের সাক্ষিদের ডরাডু (গোলডি) নামে একটা গাধা ছিল, ডরাডু প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধ্যয়ন দলগুলোর কাছে যাওয়ার রাস্তা চিনত। ডরাডু খামারের দরজার সামনে এসে থামত এবং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করত, যেন আমি দরজাগুলো খুলে দিই। পরিদর্শনের পর, ডরাডু ও আমি পরবর্তী দলের কাছে যাওয়ার জন্য যাত্রা করতাম।

এ ছাড়া, যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য মাধ্যম না থাকা সীমার কাজকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করে তুলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, সাক্ষিদের একটা ছোট দল, যারা মাটো গ্রোসো অঙ্গরাজ্যের একটা খামারে মিলিত হতো, তাদের পরিদর্শন করার জন্য আমাকে নৌকায় করে আরাগুয়াইয়া নদী পার হতে হতো এবং জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ২৫ কিলোমিটার পথ ঘোড়া বা গাধার ওপর চড়ে ভ্রমণ করতে হতো। একবার আমি এই দলকে আমার পরিদর্শনের বিষয় জানিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম কিন্তু সেই চিঠিটা তাদের কাছে পৌঁছায়নি কারণ আমি যখন নদী পার হয়েছিলাম, তখন কেউই আমার জন্য অপেক্ষা করছিল না। প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল, তাই আমি একটা ছোট পানশালার মালিকের কাছে আমার মালপত্র রেখে শুধু আমার ব্রিফকেইসটা নিয়ে পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছিলাম।

একটু পরই অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। আমি যখন অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে চলছিলাম, তখন একটা পিপীলিকাভুক প্রাণীর ফোঁস ফোঁস আওয়াজ শুনতে পাই। আমি শুনেছিলাম যে, পিপীলিকাভুক প্রাণী উঠে দাঁড়িয়ে এর শক্তিশালী থাবা দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলতে পারে। তাই, ছোট ছোট লতাপাতার মধ্যে কোনো একটা শব্দ হলেই আমি খুব সাবধানে আমার ব্রিফকেইসটাকে সামনের দিকে ঢালের মতো করে ধরে এগোতে থাকি। ঘন্টার পর ঘন্টা হাঁটার পর, আমি একটা নালার কাছে এসে পৌঁছি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে আমি দেখতে পাইনি যে, অন্য পারে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। আমি কোনোক্রমে এক লাফে সেই নালা পার হয়ে সেই বেড়ার ওপর গিয়েই পড়ি আর স্বাভাবিকভাবেই আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়!

যা হোক, শেষ পর্যন্ত আমি খামারে এসে পৌঁছি এবং কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠে আমাকে স্বাগত জানায়। সেই সময়ে ভেড়াচোররা সাধারণত রাতের বেলা আক্রমণ করত, তাই দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি আমার পরিচয় দিই। ছেঁড়া, রক্তমাখা পোশাকে আমাকে নিশ্চয়ই অনেক অসহায় দেখাচ্ছিল কিন্তু ভাইয়েরা আমাকে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিল।

নানা কষ্ট থাকা সত্ত্বেও, সেই দিনগুলো অনেক আনন্দের ছিল। আমি ঘোড়ার পিঠে চড়ে ও পায়ে হেঁটে দীর্ঘ যাত্রাগুলো উপভোগ করতাম, মাঝে মাঝে গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিতাম, পাখির গান শুনতাম এবং সেইসব নির্জন রাস্তায় আমার পাশ দিয়ে শিয়ালদের হেঁটে যেতে দেখতাম। আনন্দের আরেকটা কারণ ছিল এই বিষয়টা জানা যে, আমার পরিদর্শনগুলো লোকেদের সত্যিই সাহায্য করেছিল। অনেকে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আমাকে চিঠি লিখেছিল। অন্যদের সঙ্গে যখন আমার সম্মেলনে দেখা হতো, সেই সময়ে তারা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। লোকেরা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠছে এবং আধ্যাত্মিক অগ্রগতি করছে, তা দেখে আমি কতই না আনন্দ পেতাম!

অবশেষে একজন সহকারিণী

ভ্রমণের কাজের সেই বছরগুলোতে আমি প্রায়ই একা একা কাজ করতাম আর তা “মম শৈল, মম দুর্গ” হিসেবে যিহোবার ওপর আমাকে নির্ভর করতে শিখিয়েছিল। (গীতসংহিতা ১৮:২) এ ছাড়া, আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, অবিবাহিত থাকায় তা আমাকে রাজ্যের বিষয়গুলোতে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।

কিন্তু, ১৯৭৮ সালে ঝুলিয়া তাকাহাশি নামে একজন অগ্রগামী বোনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে রাজ্যের প্রকাশকদের যেখানে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেখানে গিয়ে সেবা করার জন্য সাও পাওলো শহরের এক বড় হাসপাতালে একজন নার্স হিসেবে বেশ ভাল একটা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। যে-খ্রিস্টান প্রাচীনরা তাকে চিনত, তারা অগ্রগামী হিসেবে তার আধ্যাত্মিক গুণাবলি ও যোগ্যতার বিষয়ে অনেক প্রশংসা করেছিল। আপনারা নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছেন যে, এত বছর পর আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত শুনে কেউ কেউ অবাক হয়েছিল। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তো তা বিশ্বাসই করতে পারেনি আর সে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আমি যদি সত্যিই বিয়ে করি, তা হলে সে ২৭০ কিলো ওজনের একটা ষাঁড় দেবে। আমরা ১৯৭৮ সালের ১লা জুলাই আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে সেই ষাঁড় বারবিকিউ করে খেয়েছিলাম।

দুর্বল স্বাস্থ্য সত্ত্বেও অধ্যবসায়ী থাকা

ঝুলিয়া আমার সঙ্গে ভ্রমণের কাজে যোগ দিয়েছিল আর আমরা একসঙ্গে পরবর্তী আট বছর দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব ব্রাজিলের মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করেছিলাম। সেইসময়ই আমার হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। প্রচার কাজে গৃহকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি দুবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আমার শারীরিক সীমাবদ্ধতাগুলো সত্ত্বেও, আমরা সাও পাওলো অঙ্গরাজ্যের বিরিগুয়ি শহরে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেছিলাম।

এই সময়ে, বিরিগুয়ির সাক্ষিরা আমাকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোইয়ানিয়া শহরে একজন ডাক্তার দেখানোর জন্য গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিল। আমার অবস্থা কিছুটা ভাল হলে অপারেশন করে আমার হার্টে পেসমেকার লাগানো হয়। সেটা ছিল প্রায় ২০ বছর আগে। এ ছাড়া আরও দুবার হার্টের অপারেশন হওয়া সত্ত্বেও, আমি এখনও শিষ্য তৈরির কাজে সক্রিয় রয়েছি। অন্যান্য অনেক অনুগত খ্রিস্টান স্ত্রীর মতো, ঝুলিয়া সবসময় আমাকে শক্তি ও উৎসাহ দিয়ে চলেছে।

যদিও স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলোর কারণে আমি তেমন কাজ করতে পারি না এবং মাঝে মাঝে তা আমার নিরুৎসাহের কারণ হয় কিন্তু আমি এখনও একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে পারছি। আমি সবসময় এই কথা মনে রাখি, যিহোবা আমাদের কাছে কখনোই প্রতিজ্ঞা করেননি যে, এই পুরোনো ব্যবস্থায় আমাদের আরামআয়েশের জীবন থাকবে। প্রেরিত পৌল এবং প্রাচীনকালের অন্যান্য বিশ্বস্ত খ্রিস্টানকে যদি অধ্যবসায়ী হতে হয়, তা হলে আমরা কেন আশা করব যে আমাদের জন্য বিষয়টা ভিন্ন হবে?—প্রেরিত ১৪:২২.

সম্প্রতি, আমি ১৯৩০ এর দশকে কেনা আমার সেই প্রথম বাইবেলটি খুঁজে পেয়েছি। প্রচ্ছদ পৃষ্ঠার ভিতরের দিকে আমি লিখেছিলাম ৩৫০—১৯৪৩ সালে ব্রাজিলে, আমি যখন খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করেছিলাম, সেইসময়কার রাজ্য ঘোষণাকারীদের সংখ্যা। আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে যে, এখন ব্রাজিলে ৬,০০,০০০রও বেশি সাক্ষি রয়েছে। এই বৃদ্ধিতে সামান্য অংশ নেওয়ার কী এক বিশেষ সুযোগই না আমি পেয়েছি! অধ্যবসায়ী হওয়ার কারণে যিহোবা নিশ্চিতভাবেই আমাকে প্রচুররূপে আশীর্বাদ করেছেন। গীতরচকের মতো, আমি বলতে পারি: “সদাপ্রভু আমাদের নিমিত্ত মহৎ মহৎ কর্ম্ম করিয়াছেন, সে জন্য আমরা আনন্দিত হইয়াছি।”—গীতসংহিতা ১২৬:৩.

[পাদটীকাগুলো]

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।

^ ১৮৭০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে সাও পাওলোতে প্রায় ১০,০০,০০০ ইতালীয় অভিবাসী স্থায়ীভাবে বসবাস করত।

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৩ সালে সালভাদর শহরে প্রথম সম্মেলনের জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার বিষয়ে সাক্ষিরা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৬ সালে, আনন্দিত জাতিদের সম্মেলনের জন্য সাক্ষিরা সাও পাওলোতে এসে পৌঁছাচ্ছে

[১০, ১১ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯৫০ এর দশকের শেষের দিকে ভ্রমণ কাজে

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার স্ত্রী ঝুলিয়ার সঙ্গে