সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অবশেষে আমাদের পরিবার একতাবদ্ধ হয়!

অবশেষে আমাদের পরিবার একতাবদ্ধ হয়!

জীবন কাহিনী

অবশেষে আমাদের পরিবার একতাবদ্ধ হয়!

বলেছেন সুমিকো হিরানো

আমি জীবনের সর্বোত্তম পথ খুঁজে পেয়েছিলাম আর চেয়েছিলাম যেন আমার স্বামীও এতে আমার সঙ্গে যোগ দেয়। এর জন্য বিয়াল্লিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

 উনিশশো একান্ন সালে যখন আমার বয়স ২১ বছর, তখন আমাদের বিয়ে হয়। চার বছরের মধ্যে আমাদের দুটো ছেলে হয় আর আমার জীবন সবদিক থেকেই পরিপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল।

১৯৫৭ সালের কোনো একদিন আমার দিদি আমাকে বলে যে, যিহোবার সাক্ষিদের একজন মিশনারি তার কাছে এসে থাকে। একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও, সেই মিশনারির সঙ্গে আমার দিদি বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করে আর আমাকেও বাইবেল অধ্যয়ন করার জন্য উৎসাহিত করে। আমি এতে রাজি হই। আমি একটা প্রটেস্টান্ট গির্জায় যোগ দিতাম আর মনে করেছিলাম যে, আমি যিহোবার সাক্ষিদের ভুলগুলো ধরতে পারব।

বাইবেল সম্বন্ধে আমি যে কত কম জানতাম, তা আমি শীঘ্রই বুঝতে পারি। সেই মিশনারিকে আমার জিজ্ঞেস করতে হয়েছিল যে, “যিহোবা কে?” আমার গির্জায় আমি কখনো সেই নাম ব্যবহার করতে শুনিনি। ডেফনি কুক (পরে পেটিট হয়েছিলেন) নামে সেই মিশনারি আমাকে যিশাইয় ৪২:৮ (NW) পদ দেখান, যেটি স্পষ্টভাবে বলে যে যিহোবা হল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নাম। ডেফনি বাইবেল ব্যবহার করে আমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন।

আমার যাজককেও আমি সেই প্রশ্নগুলোই জিজ্ঞেস করি। তিনি আমাকে বলেন: “প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা পাপ। তোমাকে যা বলা হচ্ছে, সেটাই বিশ্বাস করো।” যদিও আমার এমনটা মনে হয়নি যে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা ভুল, তবুও ছয় মাস ধরে প্রতি রবিবার সকালে আমি গির্জায় যেতাম এবং দুপুরবেলা যিহোবার সাক্ষিদের সভাগুলোতেও যোগ দিতাম।

আমার বিয়ের ওপর প্রভাব

বাইবেল থেকে আমি যা শিখছিলাম, তা আমাকে রোমাঞ্চিত করে আর সেগুলো আমি আমার স্বামী কাজুহিকোকেও জানাই। প্রত্যেক অধ্যয়ন ও সভার পর, আমি যা শিখতাম তা তাকে বলতাম। এর ফলে, আমাদের মাঝে অদৃশ্য এক দেওয়াল গড়ে ওঠে। সে চায়নি যে আমি একজন যিহোবার সাক্ষি হই। কিন্তু বাইবেল অধ্যয়ন করা এতটাই পরিতৃপ্তিদায়ক ছিল যে, আমি অধ্যয়ন ও সাক্ষিদের সঙ্গে মেলামেশা করা চালিয়ে যাই।

সভার দিনগুলোতে বাইরে যাওয়ার আগে, আমি কাজুহিকোর জন্য তার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করতাম কিন্তু সে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে শুরু করে। সভার পর আমি বাড়ি ফিরে আসলে তার মেজাজ খারাপ থাকত আর সে কোনো কথা বলতে চাইত না। দুতিন দিন পর, তার মেজাজ যদিও একটু ভাল হতো কিন্তু তখন আবারও আরেকটা সভার দিন চলে আসত।

এই সময়ের দিকে আমার যক্ষ্মা হয়, যে-রোগের কারণে ইতিমধ্যেই আমার স্বামীর পরিবারের কয়েক জন সদস্য মারা গিয়েছিল। কাজুহিকো অনেক চিন্তিত হয়ে পড়ে আর আমাকে বলে যে, একটু সুস্থ হলে আমার যা ভাল লাগে, আমি তা-ই করতে পারব। আমার একমাত্র অনুরোধ ছিল, সে যেন দয়া করে সাপ্তাহিক সভাগুলোতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে আমাকে বাধা না দেয়। সে তাতে রাজি হয়।

সুস্থ হতে আমার ছয় মাস সময় লেগেছিল আর সেই সময় আমি গভীরভাবে বাইবেল অধ্যয়ন করি। আমি এই চিন্তা করে সাক্ষিদের শিক্ষাগুলোর মধ্যে অসংগতি খুঁজতে থাকি যে, যদি কেবলমাত্র একটা বিষয়ও খুঁজে পাই, তা হলে আমি অধ্যয়ন করা বন্ধ করে দেব। কিন্তু, আমি একটাও খুঁজে পাইনি। এর পরিবর্তে, প্রটেস্টান্ট গির্জার ভুলগুলোই আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। আমি যিহোবার প্রেম ও ন্যায়বিচার সম্বন্ধে জেনেছিলাম এবং তাঁর নিয়মগুলোর সঙ্গে মিল রেখে জীবনযাপন করার উপকার লক্ষ করেছিলাম।

আমি সুস্থ হওয়ার পর, আমার স্বামী তার প্রতিজ্ঞা রাখে এবং সভাগুলোতে যাওয়ার ব্যাপারে আমাকে আর বাধা দেয়নি। আমি আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করতে থাকি এবং ১৯৫৮ সালের মে মাসে বাপ্তিস্ম নিয়ে একজন যিহোবার সাক্ষি হই। আমি আকুলভাবে চেয়েছিলাম যেন আমার পরিবারও সত্য ঈশ্বরের উপাসনায় আমার সঙ্গে যোগ দেয়।

আমার সন্তানদের আধ্যাত্মিকভাবে সাহায্য করা

আমার ছেলেরা সবসময়ই আমার সঙ্গে সভাগুলোতে ও প্রচারে যেত কিন্তু কয়েকটা ঘটনায় আমি বুঝতে পারি যে, তারা বাইবেলের জ্ঞানে উন্নতি করছিল। একদিন আমার ছয় বছর বয়সি ছেলে মাসাহিকো বাড়ির বাইরে খেলা করছিল। আমি প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ আর সেইসঙ্গে কারো চিৎকার শুনতে পাই। একজন প্রতিবেশী দৌড়ে আমার ঘরে ঢোকেন এবং চিৎকার করে বলেন যে, একটা গাড়ি আমার ছেলেকে ধাক্কা দিয়েছে। সে কি বেঁচে আছে? আমি নিজেকে শান্ত রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বাইরে গিয়েছিলাম। তার দুমড়ানোমুচড়ানো সাইকেল দেখে আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যাই কিন্তু তার পর পরই তাকে আমার দিকে হেঁটে আসতে দেখি, সে একটু ব্যথা পেয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে সে বলে: “যিহোবাই আমাকে সাহায্য করেছেন, তাই না মা?” সে বেঁচে আছে দেখে আর ঐ চমৎকার কথাগুলো শুনে আমি কেঁদে দিয়েছিলাম।

আরেকদিন পরিচর্যায় একজন বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল, যিনি চিৎকার করে বলেছিলেন: “তোমাদের কি মনে হয় যে এভাবে একটা ছোট বাচ্চাকে জোর করে সঙ্গে নিয়ে ঘোরা ঠিক? তার জন্য আমার সত্যিই মায়া হচ্ছে।” আমি উত্তর দেওয়ার আগেই আট বছর বয়সি তোমোইয়োশি বলে: “দাদু, আমার মা প্রচার করার জন্য আমাকে জোর করেন না। আমি প্রচার করি কারণ আমি যিহোবাকে সেবা করতে চাই।” সেই বয়স্ক ব্যক্তি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই ছিলেন, কোনো কথাই বলতে পারেননি।

আমার ছেলেরা আধ্যাত্মিকভাবে পিতৃহীন ছিল। তাদেরকে বাইবেলের সত্যগুলো সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব আমার ওপরে ছিল, যদিও আমার নিজেরই অনেক কিছু শেখার ছিল। আমি আমার ভালবাসা, বিশ্বাস ও উদ্যোগ গড়ে তুলেছিলাম এবং উদাহরণ স্থাপন করতে চেষ্টা করেছিলাম। আমি প্রতিদিন সন্তানদের সামনেই যিহোবাকে ধন্যবাদ জানাতাম। প্রচার কাজে আমার যে-অভিজ্ঞতাগুলো হতো, সেগুলো তাদের বলতাম। এটা তাদের উৎসাহিত করেছিল। পরে, যখন তাদের জিজ্ঞেস করা হয় যে কেন তারা অগ্রগামী বা যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণসময়ের পরিচারক হয়েছে, তখন তারা উত্তর দিয়েছিল, “আমরা দেখেছি যে আমাদের মা একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করে সুখী ছিলেন আর আমরাও সুখী হতে চেয়েছিলাম।”

আমি তাদের বাবা অথবা মণ্ডলীর কারো সম্বন্ধে অসম্মানজনক কথাবার্তা না বলার ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধান থাকতাম। আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, নেতিবাচক কথাবার্তা আমার সন্তানদের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তারা হয়তো শুধুমাত্র যার বিরুদ্ধে কথা বলা হচ্ছে তার প্রতিই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে যিনি বলছেন, তার প্রতিও সম্মান হারিয়ে ফেলতে পারে।

অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে ওঠা

১৯৬৩ সালে, আমার স্বামীর চাকরির কারণে আমাদের পরিবারকে তাইওয়ানে যেতে হয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল যে, যদি আমি সেখানকার জাপানি লোকেদের কাছে প্রচার করি, তা হলে সমস্যা হবে। আমাদের জাপানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে আর সেটা তার কোম্পানির জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করবে। সে সাক্ষিদের কাছ থেকে আমাদের দূরে রাখতে চেয়েছিল।

তাইওয়ানের সাক্ষিরা আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল আর সেখানে সমস্ত সভাই চাইনিজ ভাষায় হতো। জাপানিদের পরিবর্তে, স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি চাইনিজ ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এভাবে আমি আমার স্বামী যে-সমস্যাগুলোর কথা বলেছিল, সেগুলো এড়িয়ে চলতে পেরেছি।

তাইওয়ানের সাক্ষিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা আমাদের শক্তিশালী করেছিল। হারভে ও ক্যাথি লোগান নামে এক মিশনারি দম্পতি আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেছিল। ভাই লোগান আমার ছেলেদের আধ্যাত্মিক পিতা হয়ে ওঠেন। তিনি তাদের দেখিয়েছিলেন যে, যিহোবাকে সেবা করা এক আনন্দহীন, কঠোর জীবন নয়। আমি নিশ্চিত যে আমার ছেলেরা তাইওয়ানে থাকতেই যিহোবাকে সেবা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

তোমোইয়োশি ও মাসাহিকো একটা আমেরিকান স্কুলে পড়াশোনা করত, যেখানে তারা ইংরেজি ও সেইসঙ্গে চাইনিজ ভাষা শিখেছিল। সেই শিক্ষা তাদেরকে ভবিষ্যতে সত্য ঈশ্বর যিহোবার পরিচারক হিসেবে সেবা করার জন্য সুসজ্জিত করেছিল। যে-সময়টা আমাদের জন্য অনেক কঠিন হতে পারত, সেটাকে স্থায়ী আশীর্বাদগুলো লাভের এক সময়ে পরিণত করার জন্য আমি যিহোবার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তাইওয়ানে সাড়ে তিন বছর স্মরণীয় সময় কাটানোর পর, আমাদের পরিবার জাপানে ফিরে যায়।

সেই সময়ে ছেলেরা কৈশোরে পা দেয় আর তারা কিছুটা স্বাধীনতা পেতে চায়। আমি শাস্ত্রীয় নীতিগুলো নিয়ে যুক্তি করার জন্য তাদের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় করেছি আর সেই কঠিন সময়ে যিহোবা তাদের সাহায্য করেছেন। কলেজ পাশ করার পর, তোমোইয়োশি অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করে। অগ্রগামীর কাজ করার প্রথম কয়েক বছরে সে চার জন ব্যক্তিকে উৎসর্গীকরণ করতে ও বাপ্তিস্ম নিতে সাহায্য করেছিল। মাসাহিকো তার দাদার উদাহরণ অনুসরণ করে এবং মাধ্যমিক স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পর পরই অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করে। অগ্রগামীর কাজ করার প্রথম চার বছরে সে চার জন অল্পবয়সি ব্যক্তিকে সাক্ষি হতে সাহায্য করেছিল।

যিহোবা এরপর আমার সন্তানদের আরও অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন। আমি একজন মহিলাকে বাইবেলের সত্য শিখতে সাহায্য করেছিলাম আর তোমোইয়োশি তার স্বামীর সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করেছিল। তাদের দুই মেয়েও যিহোবার সাক্ষি হয়েছিল। পরে, তোমোইয়োশি তাদের বড় মেয়ে নোবুকোকে এবং মাসাহিকো ছোট মেয়ে মাসাকোকে বিয়ে করে। এখন তোমোইয়োশি ও নোবুকো নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে সেবা করছে। আর মাসাহিকো ও মাসাকো প্যারাগুয়েতে মিশনারি হিসেবে সেবা করছে।

আমার স্বামীর মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়

সেই বছরগুলোতে আমার স্বামীকে আমাদের বিশ্বাসের ব্যাপারে অনাগ্রহী বলেই মনে হয়েছিল কিন্তু আমরা তার মধ্যে কিছু পরিবর্তনের লক্ষণ দেখি। অন্যেরা যখন আমার বিরোধিতা করত, তখন সে আমার বিশ্বাসের পক্ষে কথা বলত এবং নিজের অজান্তেই বাইবেলের সত্যগুলোকে সমর্থন করত। সে অভাবী সাক্ষিদের বস্তুগতভাবে সাহায্য করত। আমাদের এক ছেলের বিয়েতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেওয়ার সময় সে বলেছিল: “লোকেদের সঠিক পথে জীবনযাপন করার জন্য শিক্ষা দেওয়া হল সবচেয়ে চমৎকার এবং সবচেয়ে কঠিন এক কাজ। আমার ছেলেরা ও তাদের স্ত্রীরা সবচেয়ে কঠিন এই পথকে তাদের কেরিয়ার হিসেবে নিয়েছে। দয়া করে তাদের সাহায্য করুন।” এই সমস্ত ঘটনা আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করেছে যে, সে-ও নিশ্চয়ই যিহোবার সেবায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে।

আমি আমাদের ঘরে তার সঙ্গে সহসাক্ষিদের মেলামেশার ব্যবস্থা করতাম। আমি কাজুহিকোকে খ্রিস্টীয় সভা, সম্মেলন ও সেইসঙ্গে খ্রিস্টের মৃত্যুর স্মরণার্থ সভায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাতাম। খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও, যখন কাজ না থাকত, তখন সে এগুলোতে যোগ দিত। অনেকবার আমি মনে করেছিলাম যে সে হয়তো বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করবে, তাই আমি খ্রিস্টান প্রাচীনদের আমার ঘরে আমন্ত্রণ জানাতাম। কিন্তু, সে অধ্যয়ন করতে চাইত না। সমস্যাটা কোথায় সেই বিষয়ে আমি অনেক ভেবেছিলাম।

তখন প্রেরিত পিতরের এই কথাগুলো আমার মনে আসে: “হে ভার্য্যা সকল, তোমরা আপন আপন স্বামীর বশীভূতা হও; যেন কেহ কেহ যদিও বাক্যের অবাধ্য হয়, তথাপি যখন তাহারা তোমাদের সভয় বিশুদ্ধ আচার ব্যবহার স্বচক্ষে দেখিতে পায়, তখন বাক্য বিহীনে আপন আপন ভার্য্যার আচার ব্যবহার দ্বারা তাহাদিগকে লাভ করা হয়।” (১ পিতর ৩:১, ২) আমি বুঝতে পারি যে, আমি সবসময় এই পরামর্শ মেনে চলতে পারিনি। এই পরামর্শ সম্পূর্ণরূপে মেনে চলার জন্য আমার নিজের আধ্যাত্মিকতার উন্নতি করার দরকার ছিল।

আরও আধ্যাত্মিকমনা ব্যক্তি হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আমি ১৯৭০ সালে অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করি। এভাবে দশ বছর কেটে যায়, বিশ বছর কেটে যায়। তখনও পর্যন্ত আমি আমার স্বামীর মধ্যে কোনো আধ্যাত্মিক পরিবর্তন লক্ষ করিনি। একবার একজন বাইবেল ছাত্রী মন্তব্য করেছিলেন: “আপনি যেখানে এমনকি আপনার নিজের স্বামীকে সাহায্য করতে পারেননি, সেখানে অন্য লোকেদের সাহায্য করা নিশ্চয়ই অনেক কঠিন।” সেটা নিরুৎসাহজনক ছিল কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিইনি।

১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে আমাদের বাবামারা তাদের জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছায়। তাদের যত্ন নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার অন্যান্য দায়িত্ব পালন করা অত্যন্ত ক্লান্তিকর ছিল আর তা চাপ নিয়ে এসেছিল। বছরের পর বছর ধরে, তারা সকলে যিহোবার প্রতি আমার বিশ্বাসের বিরোধিতা করেছিল কিন্তু আমি যতটা সম্ভব তাদের প্রতি ভালবাসা দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম। আমার ৯৬ বছর বয়সি মা তার মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে আমাকে বলেছিলেন, “সুমিকো, আমি যদি পুনরুত্থিত হই, তা হলে আমি তোমার ধর্ম পালন করব।” আমার প্রচেষ্টা যে নিষ্ফল হয়নি, আমি তা বুঝতে পারি।

আমাদের বাবামাদের জন্য আমি যা যা করেছিলাম, আমার স্বামী সেগুলোর সমস্তই লক্ষ করেছিল। তাই, উপলব্ধি প্রকাশ করার জন্য সে নিয়মিতভাবে সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করে। অনেক বছর ধরেই সে এভাবে যোগ দিতে থাকে কিন্তু আসলে কোনো আধ্যাত্মিক উন্নতি করেনি। আমি তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাই। আমি তার বন্ধুদের ও এমনকি তার বিদেশি সহকর্মীদের আমাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করার জন্য আমাদের ঘরে নিমন্ত্রণ করতাম। আমি তার সঙ্গে আমোদপ্রমোদে যোগ দিতাম। যখন অগ্রগামীদের প্রয়োজনীয় ঘন্টা কমিয়ে মাসে ৭০ ঘন্টা করা হয়, তখন আমি তার সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতাম।

অবসর গ্রহণ এক পরিবর্তন নিয়ে আসে

১৯৯৩ সালে আমার স্বামী অবসর গ্রহণ করে। তখন আমি চিন্তা করি যে, শেষপর্যন্ত বাইবেল অধ্যয়ন করার মতো সময় তার হবে। কিন্তু সে বলে, শুধুমাত্র তার সময় রয়েছে বলে ঈশ্বরের উপাসনা করলে, তা ধর্মের প্রতি সঠিক শ্রদ্ধা দেখানো হবে না। এর পরিবর্তে সে বলে যে, যখন তার হৃদয় তাকে তা করার জন্য পরিচালিত করবে, তখনই সে ঈশ্বরের উপাসনা করবে আর আমি যেন সেই ব্যাপারে তাকে জোর না করি।

একদিন কাজুহিকো আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, এখন আমি আমার জীবনের বাকিটা সময় তার জন্য কাটাতে পারি কি না। এই কথায় আমি অনেক দুঃখ পাই কারণ বিয়ের পর থেকে আমার পক্ষে তার জন্য যা যা করা সম্ভব ছিল, সেগুলোর সমস্তই আমি করে এসেছি। তাকে সুখী করার জন্য আমি আমার যথাসাধ্য করেছি কিন্তু সে মনে করে যে, তার চেয়ে যিহোবাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আমি তাকে বলি যে, আমার পক্ষে তার জন্য এর চেয়ে আর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি যে-কাজ করছি সে যদি আমার সঙ্গে তাতে যোগ দেয়, তা হলে আমরা একসঙ্গে এক চমৎকার নতুন জীবন শুরু করতে পারব, যা অল্প কয়েক বছরের জন্য নয় বরং চিরকালের জন্য স্থায়ী হবে। কয়েক দিন পর্যন্ত আমার স্বামী কোনো উত্তর দেয়নি। অবশেষে সে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি আমাকে বাইবেল অধ্যয়ন করাবে?” যতবারই আমি সেই কথাগুলো চিন্তা করি, আনন্দে আমার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে।

প্রথমে, আমি একজন খ্রিস্টান প্রাচীনের সঙ্গে আমার স্বামীর অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেছিলাম কিন্তু সে আমাকে বলে যে, “অন্য কারো সঙ্গে নয়, আমি তোমার সঙ্গেই অধ্যয়ন করব।” তাই আমরা প্রতিদিন বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করি। যেহেতু আমি একটা চাইনিজ মণ্ডলীতে ছিলাম আর আমার স্বামীও সেই ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারত, তাই আমরা চাইনিজ ভাষায় অধ্যয়ন করতাম। এ ছাড়া, আমরা এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পুরো বাইবেল পড়ে শেষ করি।

সেই সময়ে, চাইনিজ মণ্ডলীর একজন প্রাচীন ও তার স্ত্রী আমাদের দুজনের প্রতি আগ্রহ দেখায়। বয়সের দিক থেকে আমাদের সন্তানদের চেয়ে ছোট হলেও, তারা আমাদের প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠে। অন্যান্য অনেক সাক্ষিও আমার স্বামীর প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখায়। তারা আমাদের আতিথেয়তা দেখায় এবং কাজুহিকোর সঙ্গে এমনভাবে কথাবার্তা বলে যেন সে তাদের বাবা। এটা তাকে অত্যন্ত আনন্দিত করে।

একদিন, আমার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে লেখা মণ্ডলীর একটা বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র আমাদের বাড়িতে আসে। পরিবারের মস্তক হিসেবে সেই স্বীকৃতি তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে আর সে সেই বিয়েতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শীঘ্রই সে সাক্ষিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং একজন খ্রিস্টান প্রাচীনের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করে। বাইবেল অধ্যয়ন করা, সভাগুলোতে যোগ দেওয়া এবং মণ্ডলীর প্রতি তার ভালবাসা তাকে উত্তম আধ্যাত্মিক উন্নতি করতে সাহায্য করেছে।

অবশেষে একতাবদ্ধ এক পরিবার

২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার স্বামী যিহোবার কাছে উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে বাপ্তিস্ম গ্রহণ করে। আমার ছেলেরা ও তাদের স্ত্রীরা অনেক দূর থেকে আধুনিক দিনের এই “অলৌকিক কাজ” দেখতে এসেছিল। যদিও ৪২ বছর সময় লেগেছে কিন্তু অবশেষে আমরা একতাবদ্ধ এক পরিবার হয়েছি।

এখন প্রতিদিন সকালে আমরা দুজন দৈনিক শাস্ত্রপদ আলোচনা করি এবং একসঙ্গে বাইবেল পড়ি। প্রতিদিন আমরা আধ্যাত্মিক কথাবার্তা উপভোগ করি এবং বিভিন্ন আধ্যাত্মিক কাজে অংশ নিই। আমার স্বামী এখন মণ্ডলীর একজন পরিচারক দাস এবং সম্প্রতি সে চাইনিজ ভাষায় জনসাধারণের উদ্দেশে একটা বাইবেলভিত্তিক বক্তৃতা দিয়েছে। আমাদেরকে এক করার জন্য আমি যিহোবাকে ধন্যবাদ জানাই। যারা আমার কাছের মানুষ এবং প্রিয়জন, তাদের সকলের সঙ্গে আমি চিরকালের জন্য তাঁর নাম ও সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করার জন্য অপেক্ষা করে আছি।

[১৩ পৃষ্ঠার মানচিত্র]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

চিন

কোরিয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র

কোরিয়া গ্রজাতন্ত্র

জাপান সাগর

জাপান

টোকিও

পূর্ব চিন সাগর

তাইওয়ান

তাইপে

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৮ সালে আমার পরিবারের সঙ্গে, যে-বছর আমি বাপ্তিস্ম নিই

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

আমরা যখন টোকিও থেকে তাইপেতে চলে যাই, তখন হারভে ও ক্যাথি লোগানের মতো বন্ধুদের সাহায্যে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী হয়েছিলাম

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আজকে আমার পরিবার সত্য উপাসনায় একতাবদ্ধ