ধর্ম এতে কী উপকার রয়েছে?
ধর্ম এতে কী উপকার রয়েছে?
“ধর্মপ্রাণ না হয়েও আমি একজন ভাল ব্যক্তি হতে পারি!” অনেকেই এইরকম মনে করে থাকে। অনেক সৎ, সমবেদনাপূর্ণ, দায়িত্ববান লোকেরা ধর্মের প্রতি আগ্রহী নয়। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম ইউরোপের খুব অল্প সংখ্যক লোক নিয়মিত গির্জায় যায়, যদিও অধিকাংশই বলে যে তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। * এমনকি ল্যাটিন আমেরিকায়, মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্যাথলিক নিয়মিত গির্জায় যায়।
আরও অনেকের মতো আপনিও হয়তো মনে করতে পারেন যে, উন্নত জীবনযাপনের জন্য ধর্মের তেমন কোনো গুরুত্ব নেই। কিন্তু, সম্ভবত আপনি জানেন যে, কয়েক দশক আগে আপনার ঠাকুরমা-ঠাকুরদাদের আমলে, অধিকাংশ লোকই আজকের লোকেদের চেয়ে আরও অনেক বেশি ধর্মপ্রাণ ছিল। ধর্ম কীভাবে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব হারাল? ধর্মপ্রাণ না হয়েও কি একজন ব্যক্তি ভাল হতে পারেন? এমন কোনো ধর্ম কি আছে, যেটা আপনাকে উপকৃত করতে পারে?
যেকারণে অনেকে ধর্ম থেকে সরে গিয়েছে
শত শত বছর ধরে খ্রিস্টীয়জগতের অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে এসেছে যে, ঈশ্বর বাধ্যতা চান। তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করার জন্য গির্জায় যেত, হয় একজন যাজকের দ্বারা পরিচালিত আচার-অনুষ্ঠানের অথবা একজন প্রচারকের শিক্ষার মাধ্যমে। অবশ্য, অনেকেই ধর্মের মধ্যে থাকা কপটতা সম্বন্ধে অবগত ছিল। যুদ্ধে ধর্মের ভূমিকা, কিছু পাদরির অনৈতিক আচরণের মতোই সুপরিচিত ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ লোকই মনে করত যে, স্বয়ং ধর্মের মধ্যে কোনো দোষ ছিল না। অন্যেরা এর রহস্যময়তা ও ভক্তির পরিবেশ, ঐতিহ্য এবং গানবাজনা পছন্দ করত; এমনকি কেউ কেউ অনন্তকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করার ভয়ের দ্বারা প্রণোদিত হয়েছিল, যে-শিক্ষাটা শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। পরবর্তী সময়ে, বেশ কয়েকটা ঘটনা গির্জার প্রতি অনেক লোকের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিয়েছে।
বিবর্তনবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিছু ব্যক্তি বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ছাড়া আকস্মিক জীবনের উদ্ভব হয়েছে। ঈশ্বরই যে জীবনের উৎস তার দৃঢ়প্রত্যয়জনক প্রমাণ জোগাতে বেশির ভাগ ধর্মই ব্যর্থ হয়েছে। (গীতসংহিতা ৩৬:৯) এ ছাড়া, প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, চিকিৎসা, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য মানুষকে এই ধারণা প্রদান করেছিল যে, বিজ্ঞানের দ্বারা যেকোনো সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে। অধিকন্তু মনে করা হয়েছিল যে, সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা গির্জার চেয়েও আরও ভাল নির্দেশনা প্রদান করেছে। ঈশ্বরের ব্যবস্থা অনুযায়ী জীবনযাপন করাই যে জীবনের সর্বোত্তম পথ, গির্জাগুলো তা স্পষ্টভাবে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।—যাকোব ১:২৫.
এর ফলে, অনেক গির্জা তাদের বার্তাকে পরিবর্তন করেছে। যাজক ও প্রচারকরা এই বিষয় শিক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে যে, ঈশ্বর বাধ্যতা চান। এর পরিবর্তে অনেকে শিক্ষা দিয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কোনটা ঠিক ও কোনটা ভুল। জনপ্রিয়তা লাভের চেষ্টা করে কিছু ধর্মীয় নেতা দাবি করেছিল যে, আপনি যেভাবেই জীবনযাপন করুন না কেন ঈশ্বর তা অনুমোদন করেন। এই ধরনের শিক্ষা, বাইবেলে যা ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল তা মনে করিয়ে দেয়: “এমন সময় আসিবে, যে সময় লোকেরা নিরাময় শিক্ষা সহ্য করিবে না, কিন্তু কাণচুল্কানি-বিশিষ্ট হইয়া আপন আপন অভিলাষ অনুসারে আপনাদের জন্য রাশি রাশি গুরু ধরিবে।”—২ তীমথিয় ৪:৩.
এই ধরনের শিক্ষা, আকর্ষণ করার পরিবর্তে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। স্বভাবতই তারা ভেবে থাকে: ‘সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের শক্তি ও নিয়মগুলো তৈরির বিষয়ে ঈশ্বরের প্রজ্ঞা নিয়ে যদি গির্জাগুলোই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকে, তা হলে গির্জায় গিয়ে আমার কী লাভ? আমি কেন শুধু শুধু কষ্ট করে আমার বাচ্চাদের ধর্ম শিক্ষা দেব?’ যে-ব্যক্তিরা শুধুমাত্র এক সুন্দর জীবনযাপন করার চেষ্টা করছিল তারা ধর্মকে গুরুত্বহীন বলে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল। তারা গির্জাগুলোতে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল আর তাই ধর্ম তাদের কাছে আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। এমন কী ঘটেছিল যে, যেটা উপকারজনক কিছু হওয়ার কথা ছিল সেটা গুরুত্বহীন হয়ে গেল? বাইবেল এই বিষয়ে এক দৃঢ়প্রত্যয়জনক ব্যাখ্যা প্রদান করে।
ধর্ম খারাপ উদ্দেশ্যগুলোর জন্য ব্যবহৃত হয়
প্রেরিত পৌল প্রাথমিক খ্রিস্টানদের সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, কিছু ব্যক্তি খ্রিস্টধর্মকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে। তিনি বলেছিলেন: “দুরন্ত কেন্দুয়ারা তোমাদের মধ্যে প্রবেশ করিবে, পালের প্রতি মমতা করিবে না; এবং তোমাদের মধ্য হইতেও কোন কোন লোক উঠিয়া শিষ্যদিগকে আপনাদের পশ্চাৎ টানিয়া লইবার জন্য বিপরীত কথা কহিবে।” (প্রেরিত ২০:২৯, ৩০) রোমান ক্যাথলিক ঈশ্বরতত্ত্ববিদ অগাস্টিন ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি বিকৃত বা “বিপরীত কথা” বলেছিলেন। যিশু তাঁর অনুসারীদেরকে শাস্ত্র থেকে যুক্তি করার দ্বারা অন্যদের প্রত্যয় জন্মাতে শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু, অগাস্টিন লূক ১৪:২৩ পদে লিপিবদ্ধ “আসিবার জন্য লোকদিগকে পীড়াপীড়ি কর,” যিশুর বলা এই কথাগুলোর অর্থকে বিকৃত করেছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, লোকেদেরকে ধর্মান্তরিত করার জন্য জোর করার মধ্যে ভুল কিছু নেই। (মথি ২৮:১৯, ২০; প্রেরিত ২৮:২৩, ২৪) অগাস্টিন লোকেদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন।
ধর্মের এই অপব্যবহার এবং দুর্নীতির পিছনে রয়েছে এক বিদ্রোহী দূত, শয়তান। সে খ্রিস্টীয় মণ্ডলীগুলোকে কলুষিত করার চেষ্টা করে প্রথম শতাব্দীর ধর্মপ্রাণ লোকেদের উসকে দিয়েছিল। বাইবেল সেই লোকেদের সম্পর্কে বলে: “এরূপ লোকেরা ভাক্ত প্রেরিত, প্রতারক কর্ম্মকারী, তাহারা খ্রীষ্টের প্রেরিতদের বেশ ধারণ করে। আর ইহা আশ্চর্য্য নয়, কেননা শয়তান আপনি দীপ্তিময় দূতের বেশ ধারণ করে। সুতরাং তাহার পরিচারকেরাও যে ধার্ম্মিকতার পরিচারকদের বেশ ধারণ করে, ইহা মহৎ বিষয় নয়।”—২ করিন্থীয় ১১:১৩-১৫.
শয়তান এখনও ধর্মকে ব্যবহার করে, যেটা লোকেদেরকে ঈশ্বরের মানগুলোর পরিবর্তে তার মানগুলো অনুযায়ী জীবনযাপন করানোর জন্য খ্রিস্টীয়, নৈতিক এবং জ্ঞানালোকিত হওয়ার ভান করে। (লূক ৪:৫-৭) সম্ভবত আপনি লক্ষ করেছেন যে, বর্তমানে অনেক পাদরি নিজেদেরকে বড় বড় পদবিতে ভূষিত করার এবং পালের সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ লাভের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়া, নাগরিকদেরকে যুদ্ধে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে সরকারগুলোও ধর্মকে ব্যবহার করেছে।
অধিকাংশ লোক যতখানি কল্পনা করতে পারে, দিয়াবল তার চেয়েও আরও ব্যাপকভাবে ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন যে, অল্প কিছু ধর্মপ্রাণ চরমপন্থীই শয়তানের ইচ্ছানুসারে কাজ করছে। কিন্তু বাইবেল অনুসারে, “যাহাকে দিয়াবল [অপবাদক] এবং শয়তান [বিপক্ষ] বলা যায় . . . সে সমস্ত নরলোকের ভ্রান্তি জন্মায়।” এ ছাড়া বাইবেল এও বলে: “সমস্ত জগৎ সেই পাপাত্মার মধ্যে শুইয়া রহিয়াছে।” (প্রকাশিত বাক্য ১২:৯; ১ যোহন ৫:১৯) সেই ধর্ম সম্বন্ধে ঈশ্বর কেমন অনুভব করেন, যেটাকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতারা লোকেদেরকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য ব্যবহার করে থাকে?
“তাতে আমার কি দরকার?”
আপনি যদি খ্রিস্টীয়জগতের কিছু গির্জার আচরণে আঘাত পেয়ে থাকেন, তা হলে জেনে রাখুন যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাদের ওপর খুবই অসন্তুষ্ট। খ্রিস্টীয়জগৎ ঈশ্বরের সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ বলে দাবি করে থাকে; প্রাচীন ইস্রায়েলও এইরকম এক দাবি করেছিল। উভয়ই অবিশ্বস্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাই, ইস্রায়েল জাতির ওপর যিহোবার বিচার ঘোষণা, বর্তমান দিনে খ্রিস্টীয়জগতের প্রতিও সমভাবে প্রযোজ্য। যিহোবা বলেছিলেন: “তারা আমার কথা শোনে নি আর আমার আইন-কানুনকে অগ্রাহ্য করেছে। . . . শিবা দেশ থেকে যে ধূপ আসে . . . তাতে আমার কি দরকার? . . . তোমাদের পশু-উৎসর্গের অনুষ্ঠান আমাকে সন্তুষ্ট করে না।” (যিরমিয় ৬:১৯, ২০, বাংলা কমন ল্যাংগুয়েজ ভারসন) কপটদের উপাসনাকে ঈশ্বর অনুমোদন করেননি। তিনি তাদের আচার-অনুষ্ঠান ও প্রার্থনায় আগ্রহী ছিলেন না। তিনি ইস্রায়েলকে বলেছিলেন: “আমার প্রাণ তোমাদের . . . নিরূপিত উৎসব সকল ঘৃণা করে; সে সকল আমার পক্ষে ক্লেশকর, আমি সে সকল বহনে পরিশ্রান্ত হইয়াছি। তোমরা অঞ্জলি প্রসারণ করিলে আমি তোমাদের হইতে আমার চক্ষু আচ্ছাদন করিব; যদ্যপি অনেক প্রার্থনা কর, তথাপি শুনিব না।”—যিশাইয় ১:১৪, ১৫.
গির্জাগুলো খ্রিস্টান হিসেবে যে-উৎসবগুলো পালন করে কিন্তু যেগুলো মূলত মিথ্যা দেবতাদের সম্মান করে সেগুলোর প্রতি কি যিহোবা আকৃষ্ট হন? তিনি কি সেই সমস্ত পাদরির প্রার্থনা শোনেন, যারা খ্রিস্টের শিক্ষাগুলোকে বিকৃত করে? ঈশ্বর কি এমন কোনো ধর্মকে অনুমোদন করেন, যেটা তাঁর ব্যবস্থাকে লঙ্ঘন করে? আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, বর্তমানেও তিনি গির্জার আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তেমনই প্রতিক্রিয়া দেখান যেমন প্রাচীন ইস্রায়েলের পশু-উৎসর্গের প্রতি দেখিয়েছিলেন, যে সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন: “তাতে আমার কি দরকার?”
তা সত্ত্বেও, যিহোবা আন্তরিক ব্যক্তিদের সত্যে উপাসনা করাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। ঈশ্বর খুশি হন, যখন ব্যক্তি বিশেষরা ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া সমস্তকিছুর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেয়। (মালাখি ৩:১৬, ১৭) তা হলে আপনি কি ঈশ্বরকে উপাসনা না করেও ভাল ব্যক্তি হতে পারেন? যে-ব্যক্তি তার প্রেমময় বাবামার জন্য কিছুই করেন না তাকে কদাচিৎই একজন ভাল ব্যক্তি বলে বিবেচনা করা হয়, তাই নয় কি? একজন ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরের জন্য কিছুই করেন না তিনি কি ভাল ব্যক্তি হতে পারেন? তাই যুক্তিসংগতভাবেই, আমাদের সেই ঈশ্বরের প্রতি সক্রিয় আগ্রহ দেখানো উচিত, যাঁর কাছ থেকে জীবন এসেছে। পরবর্তী প্রবন্ধে আমরা দেখব যে, কীভাবে সত্য উপাসনা শুধুমাত্র ঈশ্বরকে সম্মানই করে না কিন্তু সেইসঙ্গে আমাদের উপকৃতও করে।
[পাদটীকা]
^ “১৯৬০ এর দশককে . . . অনেক দেশে সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় সংস্কৃতির আকস্মিক পতনের শুরু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।”—পশ্চিম ইউরোপে খ্রিস্টীয়জগতের পতন (ইংরেজি), ১৭৫০-২০০০.
[৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
ঈশ্বরই যে সমস্তকিছু সৃষ্টি করেছেন, গির্জাগুলো কি সেই প্রমাণকে তুলে ধরেছে?
[৪, ৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
ঈশ্বরের একজন প্রচারক কি এইরকম কাজের অংশী হতে পারেন?
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
এই ধরনের উৎসবকে ঈশ্বর কোন দৃষ্টিতে দেখেন?
[সৌজন্যে]
AP Photo/Georgy Abdaladze