সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আধ্যাত্মিকভাবে দৃঢ় থাকার জন্য আমাদের যুদ্ধ

আধ্যাত্মিকভাবে দৃঢ় থাকার জন্য আমাদের যুদ্ধ

জীবন কাহিনী

আধ্যাত্মিকভাবে দৃঢ় থাকার জন্য আমাদের যুদ্ধ

বলেছেন রল্ফ ব্রুগগেমাইয়ার

কারারুদ্ধ হওয়ার পর আমি প্রথম যে-চিঠিটা পেয়েছিলাম, সেটা এক বন্ধুর কাছ থেকে ছিল। সে আমাকে জানিয়েছিল যে, আমার মা ও ছোট ভাইদেরও—পিটার, ইয়খেন ও মানফ্রেটকেও—গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফলে, আমাদের ছোট দুই বোনকে বাবামা ও ভাইদের ছাড়া একা একা থাকতে হয়েছিল। পূর্ব জার্মানির কর্তৃপক্ষ কেন আমাদের পরিবারকে তাড়না করেছিল? আধ্যাত্মিকভাবে দৃঢ় থাকার জন্য কোন বিষয়টা আমাদের সাহায্য করেছিল?

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের ছেলেবেলার শান্তিকে নষ্ট করে দিয়েছিল; আমরা নিজের চোখে যুদ্ধের নৃশংসতা দেখেছি। বাবা জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং একজন যুদ্ধবন্দি হিসেবে মারা গিয়েছিলেন। আর তাই মাকে এক থেকে ১৬ বছর বয়সি ছয়জন সন্তানের ভরণপোষণ করতে হয়েছিল। আমার মায়ের নাম বেরটা।

মা যে-গির্জায় যেতেন, সেটা ধর্মের ব্যাপারে মাকে সম্পূর্ণরূপে হতাশ করেছিল আর তাই তিনি ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনোকিছুই শুনতে চাইতেন না। কিন্তু ১৯৪৯ সালের কোনো একদিন, ইলজে ফুক্স নামে একজন সাধাসিধে, বিচক্ষণ মহিলা আমাদের ঘরে ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে কথা বলতে এসেছিলেন। তিনি যে-প্রশ্নগুলো করেন ও যুক্তি দেখান, তা মাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। বাইবেল অধ্যয়ন করা মাকে আশা প্রদান করেছিল।

কিন্তু, প্রথম প্রথম আমরা ছেলেরা সন্দেহ করেছিলাম। নাৎসিরা ও পরে সাম্যবাদীরা আমাদের কাছে মহৎ মহৎ প্রতিজ্ঞা করেছিল কিন্তু তা আমাদের কেবল হতাশই করেছিল। যদিও আমরা নতুন যেকোনো প্রতিজ্ঞা শুনলেই সন্দেহ করতাম কিন্তু আমরা যখন জানতে পারি যে, যুদ্ধকে সমর্থন করতে প্রত্যাখ্যান করার কারণে কিছু সাক্ষি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে আছে, তখন তা আমাদের মনে ছাপ ফেলেছিল। পরের বছর মা, পিটার ও আমি বাপ্তিস্ম নিই।

আমাদের ছোট ভাই মানফ্রেটও বাপ্তিস্ম নিয়েছিল কিন্তু আসলে বাইবেলের সত্য তার হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে গেঁথে যায়নি। তাই, ১৯৫০ সালে সাম্যবাদীরা যখন আমাদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল আর গুপ্ত পুলিশ—কুখ্যাত শ্টাজি—তাকে চাপ দিয়েছিল, তখন সে আমাদের সভাগুলো কোথায় হয়ে থাকে, তা ফাঁস করে দেয়। আর এই কারণেই শেষ পর্যন্ত আমার মা ও অন্য ভাইয়েরা গ্রেপ্তার হয়েছিল।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সেবা করা

নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের বাইবেল সাহিত্যাদি গোপনে পূর্ব জার্মানিতে পাঠিয়ে দিতে হয়েছিল। একজন বার্তাবাহক হিসেবে আমি বার্লিনের পশ্চিমাঞ্চলে সরবরাহকৃত সাহিত্যাদি সংগ্রহ করতাম, যেখানে আমাদের সাহিত্যাদি নিষিদ্ধ ছিল না আর সেগুলো সীমান্তের ওপারে নিয়ে যেতাম। আমি বেশ কয়েক বার পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলাম কিন্তু ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

শ্টাজি আমাকে ভূগর্ভস্থ জানালাবিহীন একটা কক্ষে রেখেছিল। দিনের বেলা আমাকে ঘুমাতে দেওয়া হতো না আর রাতের বেলা আমাকে জেরা করা হতো, মাঝে মাঝে মারধরও করা হতো। ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে আদালতে আমার বিচারের সময় মা, পিটার ও ইয়খেন এসেছিল কিন্তু এর আগে পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগই হয়নি। আমাকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

আমার বিচারের ছয় দিন পর পিটার, ইয়খেন ও মাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে, একজন সহবিশ্বাসী বোন আমার ১১ বছর বয়সি বোন হেননেলরের দেখাশোনা করেছিলেন আর আমার এক মাসি ৭ বছরের সাবিনকে তার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। শ্টাজি রক্ষীরা আমার মা ও ভাইদের সঙ্গে ভয়ংকর অপরাধীদের মতো আচরণ করত, এমনকি তাদেরকে দিয়ে জুতোর ফিতে পর্যন্ত খোলাত। জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে তাদেরকে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। তাদের প্রত্যেককেও ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

১৯৫৩ সালে আমাকে ও অন্য কয়েক জন বন্দি সাক্ষিকে একটা সামরিক বিমানাঙ্গন বানানোর জন্য নিযুক্ত করা হয় কিন্তু আমরা তা করতে প্রত্যাখ্যান করি। এর শাস্তি হিসেবে কর্তৃপক্ষ আমাদের ২১ দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন করে রাখে যার অর্থ ছিল, কোনো কাজ নেই, কোনো চিঠিপত্র নেই, কেবল অল্প একটু খাবার খেতে দেওয়া হতো। কয়েক জন খ্রিস্টান বোন তাদের নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত সামান্য অংশ থেকে রুটি বাঁচিয়ে তা গোপনে আমাদের কাছে পাঠাত। এর ফলে সেই বোনদের মধ্যে আ্যনি নামের এক বোনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, ছাড়া পাওয়ার পর যাকে আমি বিয়ে করি। আ্যনি ও আমি যথাক্রমে ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে ছাড়া পেয়েছিলাম। বিয়ের এক বছর পর আমাদের মেয়ে রূতের জন্ম হয়। প্রায় একই সময়ে পিটার, ইয়খেন ও হেননেলরও বিয়ে করে।

ছাড়া পাওয়ার প্রায় তিন বছরের মধ্যেই, আমাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। একজন শ্টাজি অফিসার আমাকে তাদের গুপ্তচর হওয়ার জন্য প্ররোচিত করেন। তিনি বলেছিলেন: “মি. ব্রুগগেমাইয়ার, একটু যুক্তিবাদী হোন। জেলে থাকার অভিজ্ঞতা আপনার আছে আর আমরাও চাই না যে আপনি আবারও সেখানে যান। আপনি আপনার খুশিমতো একজন সাক্ষি থাকতে পারেন, আপনার অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে ও বাইবেল সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে পারেন। আমরা শুধু নতুন তথ্যগুলো সম্বন্ধে অবগত থাকতে চাই। তা ছাড়া, আপনার স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়েটার কথাও একটু ভেবে দেখুন।” তার শেষ কথাটা আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল। কিন্তু, আমি জানতাম যে আমি জেলে থাকার সময়ে যিহোবা আমার পরিবারের যত্ন আমার চেয়েও ভালভাবে নিতে পারবেন আর তিনি তা নিয়েছিলেনও!

কর্তৃপক্ষ আ্যনিকে পূর্ণসময়ের চাকরি করার জন্য ও সপ্তাহের দিনগুলোতে রূতের দেখাশোনার ভার অন্যদের ওপর দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। আ্যনি তাতে রাজি হয়নি এবং সে যাতে দিনের বেলা রূতের দেখাশোনা করতে পারে সেইজন্য রাতের বেলা কাজ করত। আমাদের আধ্যাত্মিক ভাইবোনেরা অনেকভাবে যত্ন নিয়েছিল আর তারা আমার স্ত্রীকে এতকিছু দিয়েছিল যে, সে সেগুলো থেকে কিছু আবার অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল। ইতিমধ্যে, আমি ছয় বছরেরও বেশি সময় জেলে কাটিয়েছি।

জেলে থাকার সময়ে আমরা যেভাবে বিশ্বাস বজায় রেখেছিলাম

আমি পুনরায় জেলে যাওয়ার পর, আমার কারাকক্ষের সঙ্গী সাক্ষিরা সম্প্রতি কোন নতুন বিষয়গুলো প্রকাশিত হয়েছে, তা জানার জন্য উৎসুক ছিল। মনোযোগ সহকারে প্রহরীদুর্গ পত্রিকা পড়েছি বলে ও নিয়মিতভাবে সভাগুলোতে যোগ দিয়েছি বলে আমি কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম আর সেই কারণেই আমি তাদের আধ্যাত্মিক উৎসাহের উৎস হতে পেরেছিলাম!

আমরা যখন রক্ষীদের কাছে একটি বাইবেল চেয়েছিলাম, তখন তারা উত্তর দিয়েছিল: “যিহোবার সাক্ষিদের হাতে বাইবেল দেওয়া, কারারুদ্ধ একটা চোরকে তালা ভাঙার যন্ত্র দেওয়ার মতোই বিপদজনক।” যে-ভাইয়েরা নেতৃত্ব দিত, তারা প্রতিদিন আলোচনা করার জন্য একটি শাস্ত্রপদ বাছাই করত। প্রতিদিন উঠানে আধ ঘন্টা হাঁটার সময়ে, আমরা ব্যায়াম ও মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার ব্যাপারে যতটা না আগ্রহী থাকতাম, তার চেয়েও বেশি আগ্রহী থাকতাম দৈনিক বাইবেলের পদ থেকে উপকার লাভ করার জন্য। যদিও আমাদের প্রত্যেককে একজন আরেকজনের কাছ থেকে ৫ মিটার দূরে দূরে রাখা হতো এবং কথা বলার অনুমতি দেওয়া হতো না কিন্তু তারপরও আমরা একে অন্যকে সেই শাস্ত্রপদ সম্বন্ধে বলার উপায় খুঁজে নিতাম। কক্ষে ফিরে আমরা সকলে যা যা শুনতে পেরেছি, তা বলতাম আর তারপর আমরা আমাদের প্রতিদিনের বাইবেল আলোচনা করতাম।

শেষ পর্যন্ত একজন গুপ্তচর আমাদের কাজ সম্বন্ধে ফাঁস করে দেন আর এর ফলে আমাকে নিঃসঙ্গ কারাকক্ষে রাখা হয়। আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম কারণ সেই সময়েই আমি শত শত শাস্ত্রপদ মনে করে মুখস্থ করতে পেরেছি! কাজবিহীন সেই দিনগুলোতে আমি বাইবেলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ধ্যান করতে পেরেছি। এরপর আমাকে অন্য আরেকটা জেলে বদলি করা হয়, যেখানে একজন রক্ষী আমাকে অন্য দুজন সাক্ষির সঙ্গে একই কক্ষে থাকতে দেন আর—এর চেয়েও আনন্দের বিষয়টা হল—আমাদের একটি বাইবেল দেন। ছয় মাস নিঃসঙ্গ কারাকক্ষে বন্দি থাকার পর সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে আবারও বাইবেলের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে সমর্থ হওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম।

আমার ভাই পিটার অন্য আরেকটা জেলে বন্দি থাকার সময়ে কোন বিষয়টা তাকে ধৈর্য ধরতে সাহায্য করেছে, তা এভাবে বলে: “আমি নতুন জগতের জীবন সম্বন্ধে কল্পনা করতাম আর বাইবেলের বিভিন্ন বিষয় চিন্তা করে আমার মনকে পূর্ণ রাখতাম। আমরা সাক্ষিরা বাইবেল থেকে প্রশ্ন করে বা শাস্ত্র সম্বন্ধে যাচাই করে একে অন্যের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করতাম। কিন্তু, সেখানকার জীবন সহজ ছিল না। মাঝে মাঝে আমাদের ১১ জনকে প্রায় ১২ বর্গ মিটার আয়তনের একটা কক্ষে বন্দি করে রাখা হতো। সেখানেই আমাদেরকে সমস্তকিছু—খাওয়াদাওয়া, ঘুমানো, স্নান এমনকি মলমূত্র ত্যাগ—করতে হতো। এটা মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিল।”

আমার আরেক ভাই ইয়খেন তার জেলের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে এভাবে বলে: “আমাদের গান বইয়ের যে-গানগুলো আমার মনে ছিল, আমি সেগুলো গাইতাম। প্রতিদিন আমি কোনো একটি শাস্ত্রপদ মনে করে, তা নিয়ে ধ্যান করতাম। ছাড়া পাওয়ার পরও আমি আধ্যাত্মিক নির্দেশনা লাভ করার এক উত্তম তালিকা মেনে চলছি। প্রতিদিন আমি আমার পরিবারের সঙ্গে সেই দিনের শাস্ত্রপদ পড়ি। এ ছাড়া, আমরা সমস্ত সভার জন্য প্রস্তুতিও নিই।”

মা জেল থেকে ছাড়া পান

মা দুবছরের চেয়ে একটু বেশি সময় কারাদণ্ড ভোগ করার পর ছাড়া পান। মুক্তি পেয়ে তিনি হেননেলর ও সাবিনের মধ্যে বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করার জন্য তাদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলেন। এ ছাড়া, ঈশ্বরের প্রতি তাদের বিশ্বাসের কারণে স্কুলে যে-বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়েছিল, সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে, সেই বিষয়েও তিনি তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। হেননেলর বলে: “আমরা পরিণতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম না কারণ ঘরে আমরা একে অন্যকে উৎসাহিত করতাম। আমরা যে-সমস্যাই ভোগ করেছি, আমাদের দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন সেই কষ্টকে পুষিয়ে দিয়েছে।”

হেননেলর আরও বলে: “এ ছাড়া, আমরা জেলে আমাদের ভাইদের কাছে আধ্যাত্মিক খাবার পৌঁছে দিতাম। আমরা প্রহরীদুর্গ পত্রিকার একটা সংখ্যার সমস্ত বিষয়বস্তু, মোমের প্রলেপ লাগানো কাগজে ছোট ছোট করে লিখতাম। তারপর, আমরা সেগুলো জল নিরোধক কাগজে মুড়ে প্রতি মাসে আমরা যে-পার্সেল পাঠাতাম সেটার ভিতরে কিছু প্রুনের (আলুবোখরার) মধ্যে লুকিয়ে পাঠিয়ে দিতাম। তারা যখন খবর পাঠিয়েছিল যে প্রুনগুলো ‘খুবই সুস্বাদু’ ছিল, তখন আমরা অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম। আমরা আমাদের কাজে এতটাই নিবিষ্ট ছিলাম যে আমাকে বলতেই হবে, সেটা অত্যন্ত চমৎকার এক সময় ছিল।”

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বাস করা

পূর্ব জার্মানিতে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও দশকের পর দশক ধরে বাস করতে কেমন লাগত, সেই বিষয়ে পিটার বর্ণনা করে: “আমরা কারো বাড়িতে ছোট ছোট দলে মিলিত হতাম, বিভিন্ন সময়ে সেখানে উপস্থিত হতাম ও সেখান থেকে বের হতাম। প্রত্যেকটা সভায় আমরা পরবর্তী সভার জন্য ব্যবস্থা করতাম। আড়ি পেতে আমাদের কথা শোনা হবে, শ্টাজি-র এই হুমকির কারণে আমরা সংকেত ও লিখিত নোটের মাধ্যমে তা করতাম।”

হেননেলর ব্যাখ্যা করে: “মাঝে মাঝে আমরা সম্মেলন কার্যক্রমের টেপ পেতাম। সেটা সবসময়ই এক আনন্দময় সভা হতো। আমাদের ছোট দলটা একসঙ্গে কয়েক ঘন্টা ধরে বাইবেল থেকে নির্দেশনা শোনার জন্য মিলিত হতো। যদিও আমরা বক্তাকে দেখতে পেতাম না কিন্তু আমরা মনোযোগের সঙ্গে কার্যক্রম শুনতাম এবং নোট নিতাম।”

পিটার বলে: “অন্যান্য দেশে আমাদের খ্রিস্টান ভাইয়েরা আমাদের জন্য বাইবেল সাহিত্যাদি জোগাতে তাদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করেছিল। ১৯৮৯ সালে বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে ফেলার এক দশক বা তারও কিছু সময় আগে, তারা আমাদের জন্য ছোট আকারের বিশেষ প্রকাশনাগুলো ছাপাত। পূর্ব জার্মানিতে আধ্যাত্মিক খাবার পাঠানোর জন্য কেউ কেউ তাদের গাড়ি, টাকাপয়সা এমনকি স্বাধীনতাকে পর্যন্ত ঝুঁকির মুখে ফেলেছিল। একদিন রাতে আমরা এক দম্পতির জন্য অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু তারা আসেনি। পুলিশ তাদের গাড়িতে সাহিত্যাদি খুঁজে পেয়েছিল এবং সেই গাড়ি বাজেয়াপ্ত করেছিল। বিভিন্ন বিপদ সত্ত্বেও আমরা কখনোই আরও নির্বিঘ্ন এক জীবনযাপনের জন্য আমাদের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কথা চিন্তাও করিনি।”

আমার ছোট ভাই মানফ্রেট, যে ১৯৫০ সালে আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, সে যে-বিষয়টা তার বিশ্বাসকে পুনরুদ্ধার করতে ও বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল, তা এভাবে বর্ণনা করে: “কয়েক মাস বন্দি থাকার পর আমি পশ্চিম জার্মানিতে চলে যাই এবং বাইবেলের সত্য ত্যাগ করি। ১৯৫৪ সালে আমি পূর্ব জার্মানিতে ফিরে আসি ও এর পরের বছর বিয়ে করি। শীঘ্রই আমার স্ত্রী বাইবেলের সত্য গ্রহণ করে এবং ১৯৫৭ সালে সে বাপ্তিস্ম নেয়। যতই সময় পার হয়, আমার বিবেক আমাকে দংশন করতে শুরু করে আর আমার স্ত্রীর সাহায্যে আমি আবারও মণ্ডলীতে ফিরে আসি।”

“আমি সত্য ত্যাগ করার আগে যে-খ্রিস্টান ভাইবোনেরা আমাকে চিনত, তারা প্রেমের সঙ্গে আমাকে এমনভাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল যেন কিছুই ঘটেনি। আন্তরিক হাসি ও আলিঙ্গনসহ অভ্যর্থনা লাভ করা সত্যিই চমৎকার। যিহোবা ও আমার ভাইদের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।”

আধ্যাত্মিক যুদ্ধ অব্যাহত থাকে

আমাদের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকেই তাদের বিশ্বাসের জন্য কঠোর যুদ্ধ করতে হয়েছে। আমার ভাই পিটার বলে, ‘আজকে আমাদের চারপাশে অনেক বিক্ষেপ ও বস্তুগত বিষয়ের প্রলোভন রয়েছে, যেগুলো আগে এতটা ছিল না। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে, আমাদের যা ছিল আমরা তাতেই সন্তুষ্ট ছিলাম। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের মধ্যে কেউই শুধুমাত্র ব্যক্তিগত কারণে অন্য অধ্যয়ন দলে যোগ দিতে চাইনি বা কেউই এই বিষয়ে অভিযোগ করেনি যে, সভাগুলো অনেক দূরে বা অনেক দেরিতে করা হচ্ছে। যদিও আমাদের মধ্যে কাউকে কাউকে সভাস্থল ত্যাগ করার জন্য রাত ১১:০০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো তবুও আমরা সবাই একসঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দিত হতাম।’

মা ১৯৫৯ সালে সাবিনকে নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যখন সাবিনের বয়স ১৬ বছর। তারা যেখানে রাজ্য প্রকাশকদের বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে সেবা করতে চেয়েছিল, তাই শাখা অফিস তাদের বাডেন-ওয়ারটেমবার্গের এলভাঙেনে পাঠিয়েছিল। দুর্বল স্বাস্থ্য সত্ত্বেও মায়ের এই উদ্যোগ সাবিনকে ১৮ বছর বয়সে অগ্রগামীর কাজ শুরু করতে প্রেরণা দিয়েছিল। সাবিনের বিয়ে হয়ে গেলে মা—৫৮ বছর বয়সে—ড্রাইভিং শেখেন, যাতে তিনি প্রচার কাজে আরও বেশি যোগ দিতে পারেন। ১৯৭৪ সালে তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সেই কাজকে অত্যন্ত মূল্যবান বলে গণ্য করেছেন।

আর আমি, দ্বিতীয় দফায় প্রায় ছয় বছর জেল খাটার পর, ১৯৬৫ সালে আমার পরিবারকে না জানিয়েই আমাকে পশ্চিম জার্মানিতে নির্বাসন দেওয়া হয়। কিন্তু, শীঘ্রই আমার স্ত্রী আ্যনি ও আমাদের মেয়ে রূত সেখানে আমার কাছে আসে। যেখানে প্রকাশকদের বেশি প্রয়োজন, সেখানে গিয়ে আমরা সেবা করতে পারি কি না, সেই বিষয়ে আমি শাখা অফিসে জিজ্ঞেস করেছিলাম আর এর ফলে তারা আমাদের বাভ্যারিয়ার নর্টলিঙেনে যেতে বলেছিল। সেখানেই রূত আর আমাদের ছোট ছেলে ইয়োহানেস বড় হয়। আ্যনি অগ্রগামীর কাজ শুরু করে। তার উত্তম উদাহরণ রূতকে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার পর পরই অগ্রগামীর কাজ শুরু করতে প্রেরণা দিয়েছিল। আমাদের দুই সন্তানই অগ্রগামীকে বিয়ে করেছে। এখন তাদের নিজ নিজ পরিবার রয়েছে আর আমাদের ছয় জন আদরের নাতি-নাতনি রয়েছে।

১৯৮৭ সালে আমি সময়ের আগেই অবসর নেওয়ার সুযোগ গ্রহণ করি এবং আ্যনির সঙ্গে অগ্রগামী পরিচর্যায় যোগ দিই। তিন বছর পর আমাকে সেল্টারসের শাখা অফিস সম্প্রসারণের কাজে সাহায্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর, আমরা পূর্ব জার্মানির গ্লুকুতে যিহোবার সাক্ষিদের প্রথম সম্মেলন হল নির্মাণে সাহায্য করেছিলাম, যেখানে পরে আমরা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সেবা করি। স্বাস্থ্যগত কারণে আমরা আমাদের মেয়ের কাছে নর্টলিঙেন মণ্ডলীতে চলে আসি, যেখানে আমরা এখন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছি।

আমি খুবই আনন্দিত যে, আমার সব ভাইবোন ও আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই একজন চমৎকার ঈশ্বর যিহোবাকে সেবা করে চলেছে। বছরের পর বছর ধরে আমরা শিখেছি যে, আমরা যদি আধ্যাত্মিকভাবে দৃঢ় থাকি, তা হলে আমরা গীতসংহিতা ১২৬:৩ পদের এই কথাগুলো সত্য হতে দেখব: “সদাপ্রভু আমাদের নিমিত্ত মহৎ মহৎ কর্ম্ম করিয়াছেন, সে জন্য আমরা আনন্দিত হইয়াছি।”

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৭ সালে আমাদের বিয়ের দিন

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৮ সালে আমার পরিবারের সঙ্গে: (সামনে বাম দিক থেকে ডান দিকে) মানফ্রেট, মা, সাবিন, হেননেলর, পিটার; (পিছনে বাম দিক থেকে ডান দিকে) আমি ও ইয়খেন

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

নিষেধাজ্ঞার সময়ে ব্যবহৃত ছোট আকারের একটি বই এবং “শ্টাজি”-র আড়ি পাতার যন্ত্র

[সৌজন্যে]

Forschungs- und Gedenkstätte NORMANNENSTRASSE

[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার ভাইবোনদের সঙ্গে: (সামনে বাম দিক থেকে ডান দিকে) হেননেলর ও সাবিন; (পিছনে বাম দিক থেকে ডান দিকে) আমি, ইয়খেন, পিটার ও মানফ্রেট