সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

সঠিক বাছাইগুলো চিরস্থায়ী আশীর্বাদগুলোর দিকে চালিত করে

সঠিক বাছাইগুলো চিরস্থায়ী আশীর্বাদগুলোর দিকে চালিত করে

জীবনকাহিনি

সঠিক বাছাইগুলো চিরস্থায়ী আশীর্বাদগুলোর দিকে চালিত করে

বলেছেন পল কুশ্‌নির

 আমার দাদু ও দিদিমা ১৮৯৭ সালে ইউক্রেন থেকে কানাডায় অভিবাসী হয়েছিল এবং সাসকাচেয়ানের ইয়র্কটনে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছিল। তারা চার সন্তানকে—তিনটে ছেলে এবং একটা মেয়েকে—সঙ্গে নিয়ে সেখানে এসেছিল। ১৯২৩ সালে তাদের সেই মেয়ে মেরিন্‌কাই আমার মা হন; আমি ছিলাম তার সপ্তম সন্তান। সেই সময়ে জীবন খুবই সাদামাটা অথচ নিরাপদ ছিল। আমাদের পুষ্টিকর খাবার ও গরম কাপড়চোপড় ছিল এবং সরকার মৌলিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করত। বন্ধুত্বপরায়ণ প্রতিবেশীরা বড় বড় কাজে সানন্দে একে অন্যকে সাহায্য করত। ১৯২৫ সালের শীতের সময় একজন বাইবেল ছাত্র আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যিহোবার সাক্ষিরা সেই সময়ে এই নামেই পরিচিত ছিল। সেই সাক্ষাৎ আমাদেরকে বিভিন্ন বাছাই করার দিকে পরিচালিত করে, যার জন্য আমি এখনও কৃতজ্ঞ।

বাইবেলের সত্য আমাদের ঘরে প্রবেশ করে

মা বাইবেল ছাত্রদের কাছ থেকে কয়েকটি পুস্তিকা গ্রহণ করেন আর শীঘ্রই সত্যের সমষ্টি উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি দ্রুত আধ্যাত্মিক উন্নতি করেন এবং ১৯২৬ সালে বাপ্তিস্ম নেন। মা যখন একজন বাইবেল ছাত্রী হন, তখন তা আমাদের পরিবারকে জীবন সম্বন্ধে এক পুরোপুরি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছিল। আমাদের ঘর আতিথেয়তার এক আশ্রয়স্থান হয়ে ওঠে। ভ্রমণকারী বলে ডাকা হতো এমন ভ্রমণ অধ্যক্ষরা এবং অন্যান্য বাইবেল ছাত্ররা প্রায়ই আমাদের সঙ্গে থাকত। ১৯২৮ সালে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ আমাদেরকে “ইউরেকা ড্রামা” দেখান, যা “ফটো-ড্রামা অফ ক্রিয়েশন” এর এক সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। তিনি আমাদের ছোটদের কাছ থেকে একটা খেলনা ব্যাঙ ধার নেন, যেটা ঘ্যাঙর ঘ্যাং শব্দ করত। যখন সেই ব্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাং শব্দ করত, তখন স্লাইড পরিবর্তন করার সময় হতো। এই ক্ষেত্রে আমরা ছোটরা কিছু করতে পেরে খুবই খুশি হয়েছিলাম!

ইমিল জার্‌ইস্কি নামে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ প্রায়ই তার ভ্রাম্যমাণ বাড়ি নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। কখনো কখনো তার সঙ্গে তার প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আসত, যে আমাদের ছোটদেরকে পূর্ণসময়ের পরিচারক অথবা অগ্রগামী হওয়ার বিষয়ে চিন্তা করার জন্য উৎসাহিত করত। এ ছাড়া, অনেক অগ্রগামী আমাদের ঘরে থাকত। একবার মা সাময়িকভাবে ব্যবহারের জন্য একজন অগ্রগামী ভাইকে একটা শার্ট দেন ও তার শার্টটা সেলাই করে দেন। কিন্তু, সেই ভাই চলে যাওয়ার সময় ভুলে সেটা নিয়ে যান। বেশ অনেক দিন পরে তিনি সেটা ফেরত পাঠান এবং বিলম্ব হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি লিখেছিলেন, “এটা ডাকযোগে পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় দশ সেন্ট আমি জোগাড় করতে পারিনি।” আমরা ভেবেছিলাম, তিনি যদি সেই শার্টটা রেখে দিতেন, তা হলেই আরও ভাল হতো! একদিন আমিও এই ধরনের আত্মত্যাগী অগ্রগামীদের অনুকরণ করতে পারব বলে আশা করেছিলাম। আমি আমার মার আতিথেয়তার মনোভাবের জন্য কৃতজ্ঞ, যা আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভ্রাতৃসমাজের জন্য আমাদের প্রেমকে বৃদ্ধি করেছে।—১ পিতর ৪:৮, ৯.

বাবা বাইবেল ছাত্র হননি; তবে তিনি আমাদের বিরোধিতাও করেননি। এমনকি ১৯৩০ সালে তিনি ভাইদেরকে একদিনের সম্মেলন করার জন্য তার বড় গুদামঘর ব্যবহার করতে অনুমতি দিয়েছিলেন। যদিও আমার বয়স তখন সাত বছর কিন্তু সেই অনুষ্ঠানের আনন্দ এবং মর্যাদা আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। বাবা ১৯৩৩ সালে মারা যান। কিন্তু, মা আটটি ছেলেমেয়েসহ একজন বিধবা হওয়া সত্ত্বেও, আমাদেরকে সত্য উপাসনার পথে রাখার বিষয়ে তার দৃঢ়সংকল্প থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। তিনি আমাকে তার সঙ্গে সভাগুলোতে নিয়ে যেতেন। সেই সময়ে সভাগুলোকে খুবই দীর্ঘ মনে হতো আর আমি তখন অন্য সেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইতাম, যাদেরকে বাইরে খেলাধুলা করতে দেওয়া হতো। কিন্তু, মার প্রতি সম্মান দেখাতে আমি সভাতেই থাকতাম। রান্না করার সময় মা প্রায়ই কোনো একটা শাস্ত্রপদ উল্লেখ করতেন আর এরপর খেলার ছলে আমাকে প্রশ্ন করতেন যে, বাইবেলে এটা কোথায় রয়েছে। ১৯৩৩ সালে প্রচুর শস্য হয়েছিল আর এর ফলে মা বাড়তি উপার্জিত আয় দিয়ে একটা গাড়ি কিনেছিলেন। কয়েক জন প্রতিবেশী এটাকে টাকার অপচয় বলে তার সমালোচনা করেছিল কিন্তু তিনি চিন্তা করেছিলেন যে, এই গাড়ি ঈশতান্ত্রিক কাজগুলোতে আমাদেরকে সাহায্য করবে। তিনিই ঠিক ছিলেন।

অন্যেরা আমাকে সঠিক বাছাইগুলো করতে সাহায্য করেছিল

একটা সময় আসে, যখন একজন অল্পবয়সিকে সেই বাছাইগুলো করতে হয়, যেগুলো তার ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে। আমার দিদি কে এবং হেলেনের বেলায় যখন সেই সময় আসে, তখন তারা অগ্রগামীর কাজ শুরু করে। জন জ্যাজুস্কি নামে একজন চমৎকার যুবক অগ্রগামী আমাদের ঘরে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। মা জনকে খামারের কাজে সাহায্য করার জন্য আরও কিছু সময় থাকতে বলেছিলেন। পরে, জন কে-কে বিয়ে করে এবং তারা অগ্রগামী হিসেবে সেবা করে, যা আমাদের ঘর থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন আমার স্কুলের ছুটির সময় তারা আমাকে তাদের সঙ্গে ক্ষেত্রের পরিচর্যায় যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এটা আমাকে অগ্রগামীর জীবনকে উপলব্ধি করার এক সুযোগ প্রদান করে।

পরবর্তী সময়ে আমার দাদা জন এবং আমি কম-বেশি খামার দেখাশোনা করতাম। এর ফলে মা গরমের সময়, এখন যেটাকে সহায়ক অগ্রগামীর কাজ বলা হয়, সেই কাজ করতে পারতেন। তিনি একটা বুড়ো ঘোড়ার টানা দুই চাকার গাড়ি ব্যবহার করতেন। বাবা এই বুড়ো একগুঁয়ে ঘোড়াটার নাম দিয়েছিলেন সোল কিন্তু মার কাছে ঘোড়াটা ছিল একটা বাধ্য প্রাণী, যেটাকে তিনি বশ করতে পারতেন। জন এবং আমি খামারের কাজ পছন্দ করতাম কিন্তু প্রত্যেকবারই মা যখন ক্ষেত্রের পরিচর্যা থেকে ঘরে আসতেন এবং তার অভিজ্ঞতাগুলো বলতেন, তখন খামারের প্রতি আমাদের ভালবাসা পরিবর্তিত হয়ে অগ্রগামীর পরিচর্যার প্রতি বৃদ্ধি পেত। ১৯৩৮ সালে আমি আমার ক্ষেত্রের পরিচর্যাকে বৃদ্ধি করি এবং ১৯৪০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বাপ্তিস্ম নিই।

অল্প সময় পর, মণ্ডলীতে আমাকে একজন দাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আমি মণ্ডলীর রেকর্ডগুলো দেখাশোনা করতাম এবং বৃদ্ধির প্রত্যেকটা লক্ষণ দেখে আনন্দিত হতাম। ঘর থেকে দশ মাইল দূরে একটা শহরে আমার একটা ব্যক্তিগত প্রচারের এলাকা ছিল। শীতের সময় আমি প্রত্যেক সপ্তাহে সেখানে হেঁটে চলে যেতাম এবং এক বা দুই রাত সেই পরিবারের ঘরের চিলে কোঠায় ঘুমাতাম, যারা বাইবেলের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল। একজন লুথারিয়ান প্রচারকের সঙ্গে আলোচনার পর—এক্ষেত্রে আমার কৌশলতায় কিছুটা ঘাটতি ছিল—তিনি আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, যদি কিনা আমি তার পালের এলাকা ত্যাগ না করি। আর এটা আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে আরও বেশি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ করেছিল।

১৯৪২ সালে আমার দিদি কে এবং তার স্বামী জন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে একটা সম্মেলনে উপস্থিত থাকার পরিকল্পনা করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত হই। সেই সম্মেলন ছিল আমার জীবনের সর্বোত্তম বিষয়গুলোর মধ্যে একটা। এটা ভবিষ্যতের জন্য আমার পরিকল্পনাগুলোকে আরও জোরালো করেছিল। ভাই নেথেন নর, যিনি সেই সময়ে সাক্ষিদের পৃথিবীব্যাপী কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি যখন ১০,০০০ জন অগ্রগামীর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে প্রেরণাদায়ক আহ্বান জানিয়েছিলেন, তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে একজন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম!

১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে হেনরি নামে একজন ভ্রমণ পরিচারক আমাদের মণ্ডলী পরিদর্শন করেন। তিনি এক উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দেন, যা আমাদের উদ্যমে পূর্ণ করে। তার বক্তৃতার পরদিন, তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নীচে ৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রচণ্ড বায়ুর কারণে ঠাণ্ডা আরও তীব্র হয়েছিল। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা সাধারণত ঘরের ভিতরেই থাকি কিন্তু হেনরি পরিচর্যার জন্য বাইরে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনিসহ বাকিরা একটা কাঠের চুল্লী নিয়ে ঘোড়ায় টানা স্লেজ গাড়িতে চেপে ১১ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামে গিয়েছিলেন। আমি পাঁচ ছেলে রয়েছে এমন এক পরিবারের সঙ্গে পুনর্সাক্ষাৎ করার জন্য একা একা গিয়েছিলাম। তাদেরকে বাইবেল অধ্যয়ন করানোর বিষয়ে আমার প্রস্তাবে তারা রাজি হয়েছিল আর পরবর্তী সময়ে সত্যকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।

নিষেধাজ্ঞার মধ্যে প্রচার করা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কানাডাতে রাজ্যের প্রচার কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। বাইবেল সাহিত্যাদি আমাদের লুকিয়ে রাখতে হতো এবং এই ক্ষেত্রে আমাদের খামারে লুকানোর জন্য অনেক স্থান ছিল। পুলিশ আমাদের এখানে প্রায়ই সাহিত্যের খোঁজে আসত কিন্তু একবারও কিছুই খুঁজে পায়নি। প্রচারে আমরা কেবলমাত্র বাইবেল ব্যবহার করতাম। আমরা ছোট ছোট দলে মিলিত হতাম আর আমার ভাই জন এবং আমি গোপনে বিলি করার কাজ করতাম।

যুদ্ধ চলাকালীন আমাদের মণ্ডলী সারা দেশে নাৎসিবাদের শেষ (ইংরেজি) পুস্তিকাটি বিতরণে অংশ নিয়েছিল। আমরা মধ্যরাতে বেরিয়ে পড়তাম। আমরা যখন চুপি চুপি প্রত্যেকটা ঘরের কাছে যেতাম এবং ঘরের দরজার সামনে একটা পুস্তিকা রেখে চলে আসতাম, তখন আমি খুবই ঘাবড়ে যেতাম। এটা ছিল আমার করা সবচেয়ে আতঙ্কজনক বিষয়। সেই পুস্তিকার শেষ কপিটা বিতরণ হয়ে যাওয়ার পর তা কত স্বস্তিদায়কই না ছিল! এরপর আমরা তাড়াতাড়ি গাড়ি রাখার জায়গায় ফিরে এসেছিলাম, সবাই ফিরে এসেছে কি না তা গণনা করেছিলাম এবং শীঘ্রই অন্ধকারের মধ্যে সেই স্থান ত্যাগ করেছিলাম।

অগ্রগামীর কাজ, কারারুদ্ধ এবং সম্মেলনগুলো

১৯৪৩ সালের ১লা মে, আমি মার কাছ থেকে বিদায় নিই। মানিব্যাগে ২০ ডলার (কানাডিয়ান) এবং সঙ্গে একটা ছোট সুটকেস নিয়ে আমি আমার প্রথম অগ্রগামীর কার্যভারে যাত্রা করি। সাসকাচেয়ানের কুইল লেক শহরে ভাই টম ট্রুপ এবং তার প্রেমময় পরিবার আমাকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। এর পরের বছর আমি সাসকাচেয়ানের ওয়েবার্ন শহরের একটা বিচ্ছিন্ন এলাকায় যাই। ১৯৪৪ সালের ২৪শে ডিসেম্বর সেখানে রাস্তায় প্রচার কাজ করার সময় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানকার স্থানীয় জেলে কিছু সময় থাকার পর, আমাকে আলবার্টার জেসপার শহরে একটা শিবিরে নেওয়া হয়। সেখানে, কানাডার পার্বত্য অঞ্চলে যিহোবার সৃষ্টির চমৎকারিত্বের মাঝে আমি এবং আরও অন্য সাক্ষিরা ছিলাম। ১৯৪৫ সালের প্রথম দিকে শিবিরের কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে আলবার্টার এডমনটনে একটা সভাতে উপস্থিত হতে অনুমতি দেয়। ভাই নর পৃথিবীব্যাপী কাজের অগ্রগতির বিষয়ে এক রোমাঞ্চকর রিপোর্ট দেন। আমরা সাগ্রহে সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যেদিন আমরা আমাদের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাব আর পুনরায় পরিচর্যায় পুরোপুরি অংশ নিতে পারব।

ছাড়া পাওয়ার পর, আমি পুনরায় অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। এর অল্প কিছু সময় পর, “সর্বজাতির প্রসার” নামক সম্মেলনের বিষয়ে ঘোষণা করা হয়, যা ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলসে অনুষ্ঠিত হবে। আমার অগ্রগামীর কাজের নতুন কার্যভারের একজন ভাই তার ট্রাকে ২০ জন যাত্রীর বসার জন্য ব্যবস্থা করেন। ১৯৪৭ সালের ১লা আগস্ট আমরা ইয়েলোস্টোন ও ইয়োসেমিটি জাতীয় উদ্যানসহ তৃণভূমি, মরুভূমি এবং অপূর্ব দৃশ্যাবলিপূর্ণ অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে ৭,২০০ কিলোমিটার পথের এক স্মরণীয় যাত্রা শুরু করি। পুরো যাত্রা করতে ২৭ দিন লাগে—চমৎকার এক অভিজ্ঞতা!

সেই সম্মেলন ছিল একটা আশীর্বাদ, যা কখনোই ভুলে যাবার নয়। সম্মেলন থেকে পুরোপুরি উপকার পাওয়ার জন্য আমি দিনের বেলা একজন পরিচারক হিসেবে এবং রাতের বেলা একজন প্রহরী হিসেবে সেবা করি। মিশনারি সেবায় আগ্রহী এমন ব্যক্তিদের জন্য আয়োজিত সভাতে উপস্থিত থাকার পর, আমি একটা আবেদনপত্র পূরণ করি, তবে এই ব্যাপারে কোনোরকম উচ্চাশা করিনি। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালে আমি কানাডার কুইবেক প্রদেশে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার আহ্বানে সাড়া দিই।—যিশাইয় ৬:৮.

গিলিয়েড এবং এর পরের জীবন

১৯৪৯ সালে আমি ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অভ্‌ গিলিয়েড এর ১৪তম ক্লাসে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ পেয়ে অত্যন্ত খুশি হই। এই প্রশিক্ষণ আমার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিল এবং আমাকে যিহোবার আরও নিকটবর্তী করেছিল। জন এবং কে ইতিমধ্যেই ১১তম ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিল এবং উত্তর রোডেশিয়ায় (এখন জাম্বিয়া) মিশনারি হিসেবে সেবা করছিল। আমার দাদা জন ১৯৫৬ সালে গিলিয়েড থেকে গ্র্যাজুয়েট হন। তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার স্ত্রী ফ্রিডার সঙ্গে তিনি ৩২ বছর ধরে ব্রাজিলে সেবা করেন।

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আমি দুটো টেলিগ্রাম পেয়ে যথেষ্ট উৎসাহিত হই, যার একটা ছিল আমার মার কাছ থেকে এবং অন্যটা কুইল লেকের ট্রুপ পরিবারের কাছ থেকে। দ্বিতীয় টেলিগ্রামে “একজন গ্র্যাজুয়েটের প্রতি উপদেশ,” এমন শিরোনামসহ এই কথাগুলো লেখা ছিল: “এটা তোমার জন্য বিশেষ এক দিন। এমন এক দিন যেটাকে তুমি সবসময় মূল্যবান বলে গণ্য করবে; আমরা তোমার সাফল্য ও আনন্দ কামনা করি।”

আমি কুইবেক শহরে সেবা করার কার্যভার লাভ করি কিন্তু কিছু সময়ের জন্য আমি নিউ ইয়র্ক রাজ্যে কিংডম ফার্মে ছিলাম, যেখানে সেই সময়ে গিলিয়েড স্কুল অবস্থিত ছিল। একদিন ভাই নর আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি বেলজিয়ামে যেতে ইচ্ছুক কি না। কিন্তু কয়েক দিন পর তিনি জিজ্ঞেস করেন, আমি নেদারল্যান্ডসে কার্যভারে যাব কি না। যখন আমি কার্যভারের চিঠি পাই, তাতে উল্লেখ করা ছিল যে, আমাকে “শাখার দাস হিসেবে কাজ করতে হবে।” আমি কিছুটা চাপ বোধ করেছিলাম।

১৯৫০ সালের ২৪শে আগস্ট আমি নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশে ১১ দিনের যাত্রা শুরু করি—এটা নতুন প্রকাশিত খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্রের নতুন জগৎ অনুবাদ (ইংরেজি) পুরোপুরি পড়ার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল। আমি ১৯৫০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর রটাড্যামে পৌঁছাই, সেখানে বেথেল পরিবার আমাকে এক উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্ত অবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ভাইবোনেরা ভালভাবেই পুনরায় খ্রিস্টীয় কার্যক্রম শুরু করেছিল। প্রচণ্ড তাড়নার মধ্যে তাদের নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখার বিবরণ শোনার সময় আমি চিন্তা করছিলাম যে, আমার মতো একজন অনভিজ্ঞ অল্পবয়সি শাখা দাসের নির্দেশনার অধীনে এইসব ভাইবোনের পক্ষে কাজ করা কঠিন হতে পারে। কিন্তু, খুব শীঘ্রই স্পষ্ট হয় যে, আমার এমনটা আশঙ্কা করার কোনো কারণই নেই।

অবশ্য, কিছু বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। আমি একটা সম্মেলনের ঠিক আগে এসে পৌঁছাই আর সম্মেলনস্থলে হাজার হাজার অভ্যাগতের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। পরবর্তী সম্মেলনের জন্য আমি প্রস্তাব দিই যে, আমরা ব্যক্তিগত ঘরগুলোতে থাকার জায়গার ব্যবস্থা খুঁজতে পারি। ভাইয়েরা এটাকে একটা চমৎকার পরিকল্পনা মনে করে—কিন্তু তাদের দেশের জন্য নয়। শেষে এই বিষয়ে আলোচনা করার পর, আমরা একটা সমঝোতায় আসি—অর্ধেক অভ্যাগতের জন্য সম্মেলনস্থলে থাকার ব্যবস্থা করা হবে এবং বাকিরা সম্মেলন শহরের ন-সাক্ষিদের ঘরগুলোতে থাকবে। ভাই নর যখন সম্মেলনে উপস্থিত হন, তখন আমি কিছুটা আত্মতৃপ্তির সঙ্গে সেই বিষয়ে উল্লেখ করি। কিন্তু, কিছু সম্পাদনের অনুভূতি খুব শীঘ্রই দূর হয়ে যায় যখন আমি পরে প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় আমাদের সম্মেলনের বিষয়ে একটা রিপোর্ট পড়ি, যেখানে বলা ছিল: “আমরা নিশ্চিতভাবে আশা করি যে, পরবর্তী সময়ে ভাইদের বিশ্বাস থাকবে এবং সম্মেলনের অভ্যাগতদের জন্য সাক্ষ্যদানের সবচেয়ে কার্যকারী জায়গা হিসেবে লোকেদের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য তারা প্রচেষ্টা করবে।” আমরা “পরবর্তী সময়ে” ঠিক তা-ই করেছিলাম!

১৯৬১ সালের জুলাই মাসে, আমাদের শাখা অফিস থেকে দুজন প্রতিনিধিকে লন্ডনে অন্যান্য শাখার প্রতিধিনিদের সঙ্গে একটা সভাতে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভাই নর ঘোষণা করেন যে, পবিত্র শাস্ত্রের নতুন জগৎ অনুবাদ আরও বেশি ভাষায় প্রাপ্তিসাধ্য হবে, যার মধ্যে ডাচ্‌ ভাষাও রয়েছে। এই সংবাদ কতই না রোমাঞ্চকর ছিল! যাই হোক, এই প্রকল্পের বিশালতা সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না। দুই বছর পর, ১৯৬৩ সালে নিউ ইয়র্কে একটা সম্মেলনে আমার একটা কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল, যেখানে খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্রের নতুন জগৎ অনুবাদ ডাচ্‌ ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল।

বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং নতুন কার্যভারগুলো

১৯৬১ সালের আগস্ট মাসে আমি লাইডা ভেমেলিংককে বিয়ে করি। তার পুরো পরিবার ১৯৪২ সালে নাৎসিদের তাড়নার সময়ে সত্যকে গ্রহণ করেছিল। লাইডা ১৯৫০ সালে অগ্রগামীর কাজ শুরু করে এবং ১৯৫৩ সালে বেথেলে আসে। সে যেভাবে বেথেলে এবং মণ্ডলীতে কাজ করত, সেটা আমাকে বুঝতে সাহায্য করে যে, পরিচর্যায় সে আমার একজন অনুগত সঙ্গীই হবে।

আমাদের বিয়ের এক বছরের কিছু বেশি সময় পর, দশ মাসের এক অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে ব্রুকলিনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই সময় স্ত্রীদের তাদের স্বামীদের সঙ্গে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। যদিও লাইডার স্বাস্থ্য তেমন ভাল ছিল না, তবুও সে প্রেমের সঙ্গে আমাকে এই আমন্ত্রণ গ্রহণে সম্মতি দেয়। পরে লাইডার স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে যায়। আমরা বেথেলে আমাদের কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিই যে, ক্ষেত্রে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়াই আমাদের জন্য আরও বেশি ব্যবহারিক হবে। তাই, আমি ভ্রমণ পরিচর্যায় সেবা করতে শুরু করেছিলাম। এর অল্প কিছুদিন পরেই, আমার স্ত্রীর একটা গুরুতর অপারেশন করাতে হয়। খ্রিস্টান ভাইবোনদের প্রেমময় সমর্থনে আমরা সেই অবস্থা মোকাবিলা করতে পারি আর এমনকি আমরা এক বছর পর জেলার কাজে সেবা করার একটা কার্যভার গ্রহণ করতে সক্ষম হই।

আমরা ভ্রমণের কাজে প্রাণবন্ত সেবার সাতটি বছর উপভোগ করি। এরপর, যখন আমাকে কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুলে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেথেলে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন আবার এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা সম্মতি দিই, যদিও এই পরিবর্তন করা বেশ কঠিন ছিল কারণ আমরা ভ্রমণের পরিচর্যা ভালবাসতাম। সেই স্কুলের ৪৭টি ক্লাশ, প্রত্যেকটার স্থায়িত্ব দুই সপ্তাহ করে ছিল, যা আমাকে মণ্ডলীর প্রাচীনদের সঙ্গে আধ্যাত্মিক আশীর্বাদগুলো ভাগ করে নেওয়ার এক চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছিল।

সেই সময়ে, আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম যে ১৯৭৮ সালে মাকে দেখতে যাব। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯৭৭ সালের ২৯শে এপ্রিল আমরা একটা টেলিগ্রাম পাই, যেখানে মায়ের মৃত্যু সংবাদ উল্লেখ ছিল। আমি এটা চিন্তা করে অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, আমি আর কখনো তার স্নেহমাখা স্বর শুনতে পাব না অথবা তিনি আমার জন্য যা কিছু করেছেন সেগুলোর জন্য যে আমি কত কৃতজ্ঞ, তা বলতে পারব না।

কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুলের কোর্স শেষে আমাদেরকে বেথেল পরিবারের সদস্য হওয়ার বিষয়ে বলা হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে আমি দশ বছর ধরে শাখা কমিটির কোঅর্ডিনেটর হিসেবে সেবা করি। পরবর্তী সময়ে, পরিচালক গোষ্ঠী একজন নতুন কোঅর্ডিনেটর নিযুক্ত করে, যিনি বেশ ভালভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এর জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ।

বৃদ্ধ বয়সেও যতটা সম্ভব সেবা করা

লাইডা এবং আমার উভয়ের বয়স এখন ৮৩ বছর। আমি ৬০ বছরের বেশি সময় পূর্ণসময়ের পরিচর্যা উপভোগ করেছি, শেষের ৪৫ বছর আমার অনুগত স্ত্রীর সঙ্গে। সে আমাদের সমস্ত কার্যভারে আমাকে সমর্থন করাকে যিহোবার প্রতি তার উৎসর্গীকৃত সেবার অংশ হিসেবে দেখেছে। বর্তমানে বেথেলে এবং মণ্ডলীতে আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব, আমরা তা-ই করে থাকি।—যিশাইয় ৪৬:৪.

মাঝে মাঝে আমরা আমাদের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো স্মরণ করি। আমরা যিহোবার সেবায় যা কিছু করেছি, সেই বিষয়ে আমাদের কোনো দুঃখ নেই আর আমরা দৃঢ়প্রত্যয়ী যে, জীবনের শুরুতেই আমরা যে-বাছাইগুলো করেছিলাম, সেগুলো ছিল সর্বোত্তম। আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে যিহোবাকে অবিরত সেবা ও সম্মান করার জন্য সংকল্পবদ্ধ।

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার দাদা বিল এবং আমাদের ঘোড়া সোলের সঙ্গে

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬১ সালের আগস্ট মাসে আমাদের বিয়ের দিন

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আজকে লাইডার সঙ্গে