সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

শিশুদের কাছ থেকে আপনি কী শিখতে পারেন?

শিশুদের কাছ থেকে আপনি কী শিখতে পারেন?

শিশুদের কাছ থেকে আপনি কী শিখতে পারেন?

 “আপনি একটা শিশুর মতো আচরণ করছেন!” এই কথাগুলো যদি আমাদের উদ্দেশে বলা হতো, তা হলে আমরা সম্ভবত বিরক্ত হতাম। যদিও ছোট ছেলেমেয়েদেরকে খুবই ভাল লাগে কিন্তু স্পষ্টতই তাদের পরিপক্বতা, অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞার অভাব রয়েছে, যা সাধারণত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।—ইয়োব ১২:১২.

তা সত্ত্বেও, যিশু একবার তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন: “আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, তোমরা যদি না ফির ও শিশুদের ন্যায় না হইয়া উঠ, তবে কোন মতে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পাইবে না।” (মথি ১৮:৩) যিশু এখানে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? শিশুদের এমন কোন গুণাবলি রয়েছে, যা বড়দের অনুকরণ করা উচিত?

শিশুদের মতো নম্রতা গড়ে তোলা

যে-পরিস্থিতি যিশুকে মন্তব্য করতে প্রণোদিত করেছিল, তা বিবেচনা করুন। এক দীর্ঘযাত্রা শেষে কফরনাহূমে পৌঁছানোর পর, যিশু তাঁর শিষ্যদের জিজ্ঞেস করেন: “পথে তোমরা কোন্‌ বিষয়ে তর্কবিতর্ক করিতেছিলে?” শিষ্যরা অস্বস্তি বোধ করে নীরব থাকে কারণ তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, সেই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে তারা বাদানুবাদ করেছিল। অবশেষে, তারা যিশুকে এই কথা জিজ্ঞেস করার জন্য সাহস অর্জন করে: “স্বর্গ-রাজ্যের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে?”—মার্ক ৯:৩৩, ৩৪; মথি ১৮:১.

এটা হয়তো অবাক হওয়ার মতো মনে হতে পারে যে, যিশুর সঙ্গে প্রায় তিন বছর থাকার পরও, এই শিষ্যরা পদমর্যাদার বিষয়ে বাদানুবাদ করতে পারল। কিন্তু, তারা সেই যিহুদি ধর্মে বড় হয়ে উঠেছিল, যেখানে এই বিষয়গুলোকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্পষ্টতই, এই ধর্মীয় পটভূমি ও সেইসঙ্গে মানব অসিদ্ধতা শিষ্যদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল।

যিশু তখন বসে শিষ্যদের তাঁর কাছে ডাকেন আর এরপর বলেন: “কেহ যদি প্রথম হইতে ইচ্ছা করে, তবে সে সকলের শেষে থাকিবে ও সকলের পরিচারক হইবে।” (মার্ক ৯:৩৫) এই কথাগুলো সম্ভবত তাদের অবাক করেছিল। যিশু যেভাবে যুক্তি করছিলেন, তা শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে যিহুদিদের ধারণার সরাসরি বিরোধিতা করেছিল! এরপর যিশু একটা ছোট্ট শিশুকে তাঁর পাশে ডাকেন। শিশুটিকে সস্নেহে জড়িয়ে ধরে, তিনি তাঁর মূল বিষয়টার ওপর এভাবে জোর দেন: “আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, তোমরা যদি না ফির ও শিশুদের ন্যায় না হইয়া উঠ, তবে কোন মতে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পাইবে না। অতএব যে কেহ আপনাকে এই শিশুর মত নত করে, সেই স্বর্গ-রাজ্যে শ্রেষ্ঠ।”—মথি ১৮:৩, ৪.

বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে নত হওয়া বা নম্রতা সম্বন্ধে কী এক প্রগাঢ় শিক্ষা! দৃশ্যটা কল্পনা করুন। একটা ছোট্ট শিশুকে ঘিরে আছে গুরুগম্ভীর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের একটা দল, যাদের দৃষ্টি স্থির রয়েছে শিশুটির ওপর। শিশুটি কতই না লজ্জা পায় ও নির্ভরতা দেখায়! প্রতিযোগিতা ও বিদ্বেষ থেকে কতই না মুক্ত! কতই না বশীভূত ও অমায়িক! হ্যাঁ, এই ছোট্ট শিশুটি ঈশ্বরীয় গুণ নম্রতাকে চমৎকারভাবে প্রতিনিধিত্ব করেছে।

যিশুর বিষয়টা স্পষ্ট। আমরা যদি ঈশ্বরের রাজ্যের অধিকারী হতে চাই, তা হলে আমাদের সকলকে অবশ্যই শিশুদের মতো নম্রতা গড়ে তুলতে হবে। যিহোবার পরিবারতুল্য ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিবাদ বা গর্বের কোনো স্থান নেই। (গালাতীয় ৫:২৬) বস্তুতপক্ষে, এগুলো হল সেই বৈশিষ্ট্য, যেগুলো শয়তান দিয়াবলকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্ররোচিত করেছিল। নিঃসন্দেহে যিহোবা এগুলো ঘৃণা করেন!—হিতোপদেশ ৮:১৩.

সত্য খ্রিস্টানরা সেবা করতে চায়, ক্ষমতা খাটানোর চেষ্টা করে না। কোনো একটা কাজ যতই অপ্রিয় হোক বা যার জন্য কাজ করছি তিনি যতই সাধারণ হোন না কেন, সত্যিকারের নম্রতা আমাদেরকে অন্যদের সেবা করতে পরিচালিত করে। এই ধরনের নম্র সেবা প্রচুর আশীর্বাদ নিয়ে আসে। যিশু বলেন: “যে কেহ আমার নামে ইহার মত কোন শিশুকে গ্রহণ করে, সে আমাকেই গ্রহণ করে; আর যে কেহ আমাকে গ্রহণ করে, সে আমাকে নয় কিন্তু যিনি আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, তাঁহাকেই গ্রহণ করে।” (মার্ক ৯:৩৭) এক উদার, নম্র, শিশুদের মতো মনোভাব গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করা আমাদেরকে নিখিলবিশ্বের সর্বোচ্চ ব্যক্তির সঙ্গে এবং তাঁর পুত্রের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করে। (যোহন ১৭:২০, ২১; ১ পিতর ৫:৫) আমরা সেই সুখ লাভ করব, যা দেওয়ার মাধ্যমে আসে। (প্রেরিত ২০:৩৫, NW) অধিকন্তু, ঈশ্বরের লোকেদের মধ্যে যে-শান্তি ও একতা দেখা যায়, তাতে অবদান রাখার পরিতৃপ্তি আমাদের রয়েছে।—ইফিষীয় ৪:১-৩.

শিখতে ইচ্ছুক এবং নির্ভরযোগ্য

যিশু এরপর আরেকটা শিক্ষা তুলে ধরেন, যা বড়রা শিশুদের থেকে শিখতে পারে: “যে ব্যক্তি শিশুবৎ হইয়া ঈশ্বরের রাজ্য গ্রহণ না করে, সে কোন মতে তাহাতে প্রবেশ করিতে পাইবে না।” (মার্ক ১০:১৫) শিশুরা শুধুমাত্র নম্রই নয় বরং তারা শিখতেও ইচ্ছুক। “তারা স্পঞ্জের মতো তথ্য শুষে নেয়,” একজন মা বলেন।

তাই, ঈশ্বরের রাজ্যের অধিকারী হতে হলে আমাদের অবশ্যই রাজ্যের বার্তাকে গ্রহণ করতে এবং এর বাধ্য থাকতে হবে। (১ থিষলনীকীয় ২:১৩) নবজাত শিশুদের মতো আমরা অবশ্যই ‘সেই পারমার্থিক অমিশ্রিত দুগ্ধের লালসা করিব, যেন তাহার গুণে পরিত্রাণের জন্য বৃদ্ধি পাই।’ (১ পিতর ২:২) বাইবেলের কোনো শিক্ষা বোঝা যদি কঠিন বলে মনে হয়, তা হলে কী? “শিশুরা যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পায়, ততক্ষণ তারা জিজ্ঞেস করেই চলে, ‘কেন?,’” একজন শিশু-তত্ত্বাবধান কর্মী বলেন। তাদের উদাহরণ আমাদের অনুকরণ করা উচিত। তাই, অধ্যয়ন করে চলুন। অভিজ্ঞ খ্রিস্টানদের সঙ্গে কথা বলুন। যিহোবার কাছে জ্ঞান বা প্রজ্ঞা চান। (যাকোব ১:৫) নিঃসন্দেহে, আপনার প্রার্থনাপূর্ণ অধ্যবসায় এক সময় পুরস্কৃত হবে।—মথি ৭:৭-১১.

তবে কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারে, ‘শিখতে ইচ্ছুক লোকেরা কি সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে না?’ না, যদি তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য নির্দেশনা থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শিশুরা নির্দেশনার জন্য সহজাতভাবেই তাদের বাবামার কাছে যায়। “বাবামায়েরা প্রতিদিন তাদের সন্তানদের সুরক্ষা করে ও যত্ন নিয়ে নিজেদের নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করে থাকে,” একজন বাবা বলেন। নিশ্চিতভাবে আমাদেরও আমাদের স্বর্গীয় পিতা যিহোবার ওপর নির্ভর করার একই কারণ রয়েছে। (যাকোব ১:১৭; ১ যোহন ৪:৯, ১০) যিহোবা তাঁর লিখিত বাক্যের মাধ্যমে আমাদেরকে অব্যর্থ নির্দেশনা প্রদান করেন। তাঁর পবিত্র আত্মা এবং সংগঠন আমাদেরকে সান্ত্বনা এবং সমর্থন জোগায়। (মথি ২৪:৪৫-৪৭; যোহন ১৪:২৬) এই ব্যবস্থাগুলোর সদ্ব্যবহার করা আমাদেরকে আধ্যাত্মিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করবে।—গীতসংহিতা ৯১:১-১৬.

এ ছাড়া, ঈশ্বরের ওপর শিশুদের মতো নির্ভরতা গড়ে তোলার চেষ্টা করা আমাদেরকে মনের শান্তিও প্রদান করে। একজন বাইবেল পণ্ডিত বলেন: “আমরা শিশুবস্থায় কোনোরকম ভাড়া না দিয়েই এবং গন্তব্য না জেনেই এক যাত্রা শুরু করি আর তারপরও আমাদের মনে কখনো এমন সন্দেহ আসে না যে, আমাদের বাবামা নিরাপদে আমাদেরকে গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবে কি না।” জীবনের পথে যাত্রা করার সময় আমাদেরও কি যিহোবার ওপর একইরকম নির্ভরতা রয়েছে?—যিশাইয় ৪১:১০.

ঈশ্বরের ওপর পূর্ণরূপে নির্ভরতা আমাদেরকে সেই মনোভাব ও কাজগুলো পরিহার করতে সাহায্য করে, যেগুলো আমাদের আধ্যাত্মিকতাকে বিপন্ন করতে পারে। এর পরিবর্তে, আমাদের যিশুর এই কথাগুলোর ওপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে যে, আমাদের স্বর্গীয় পিতা আমাদের কাজগুলো জানেন এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরের রাজ্য এবং ধার্মিকতার বিষয়ে প্রথমে চেষ্টা করব, ততক্ষণ ঈশ্বর আমাদের জন্য চিন্তা করবেন। এটা আমাদেরকে আধ্যাত্মিক দায়িত্বগুলো অবহেলা করে বস্তুগত বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার প্রলোভনকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে।—মথি ৬:১৯-৩৪.

“মন্দ বিষয়ে শিশুগণের ন্যায়”

শিশুরা অসিদ্ধ হয়ে জন্ম নিলেও তারা হৃদয়ে ও মনে সতেজতাদায়কভাবে বিশুদ্ধ। এই কারণে বাইবেল খ্রিস্টানদের জোরালো পরামর্শ দেয়: “হিংসাতে [মন্দ বিষয়ে, NW] শিশুগণের ন্যায় হও।”—১ করিন্থীয় ১৪:২০.

পাঁচ বছর বয়সি মনিকের বিষয়ে বিবেচনা করুন, যে তার মাকে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে বলেছিল: “আমার নতুন বন্ধু সারার না ঠিক আমার মতোই কোঁকড়ানো চুল আছে!” সারার ভিন্ন গায়ের রং এবং জাতীয়তা সম্বন্ধে কিছুই বলা হয়নি। একজন মা বলেন: “ছোট্ট শিশুরা বিশেষ বর্ণ বা জাতির মধ্যে পার্থক্য দেখতে পায় না। তাদের মধ্যে বর্ণ বা ভেদাভেদের কোনো ধারণাই নেই।” এই ক্ষেত্রে, শিশুরা কত চমৎকারভাবেই না আমাদের পক্ষপাতহীন ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে থাকে, যিনি সমস্ত জাতির লোককে ভালবাসেন।—প্রেরিত ১০:৩৪, NW, ৩৫.

এ ছাড়া, শিশুদের ক্ষমা করার এক উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা রয়েছে। একজন বাবা বলেন: “যখন ছোট্ট জ্যাক এবং লেভি হাতাহাতি করে, তখন আমরা তাদের ক্ষমা চাইতে বলি আর অল্পসময়ের মধ্যেই তারা পুনরায় খুশি মনে খেলা করতে থাকে। তারা অতীতের বিষয়গুলো নিয়ে অত্যধিক চিন্তা করে না, সেগুলো নিয়ে আসে না অথবা ক্ষমা করার আগে বিভিন্ন দাবিও উত্থাপন করে না। তারা ঠিক আগের মতোই সবকিছু করে চলে।” বড়দের জন্য অনুকরণ করার মতো কী এক চমৎকার উদাহরণ!—কলসীয় ৩:১৩.

অধিকন্তু, ছোট্ট শিশুরা অনায়াসে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে। (ইব্রীয় ১১:৬) তাদের সহজাত সারল্য প্রায়ই তাদেরকে অন্যদের কাছে নির্ভীকভাবে সাক্ষ্য দিতে পরিচালিত করে। (২ রাজাবলি ৫:২, ৩) তাদের সরল, আন্তরিক প্রার্থনাগুলো কঠিন হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে। আর প্রলোভনের সময় তারা উল্লেখ করার মতো নৈতিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে পারে। ছোট্ট শিশুরা কতই না মূল্যবান উপহার!—গীতসংহিতা ১২৭:৩, ৪.

সৌন্দর্য পুনরুদ্ধার

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ‘বড়দের পক্ষে কি শৈশবাবস্থার চমৎকার গুণাবলি পুনরাধিকার করা সম্ভব?’ সহজ-সরল এবং আশ্বাসজনক উত্তরটা হল, হ্যাঁ! নিশ্চিতভাবে ‘শিশুদের ন্যায় হইয়া উঠিবার’ বিষয়ে যিশুর আদেশ প্রমাণ করে যে, এটা সম্ভব।—মথি ১৮:৩.

উদাহরণস্বরূপ: শিল্পকর্ম পুনরুদ্ধারকারী একটা দল হয়তো এক মূল্যবান শিল্পকর্ম সংস্কারের কাজ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায়, তারা জমে থাকা ময়লার স্তরকে সরিয়ে ফেলে এবং শিল্পকর্মকে পুনরুদ্ধার করার জন্য পূর্বের অদক্ষ প্রচেষ্টাগুলোকে পুরোপুরিভাবে বদলে দেয়। পুনরুদ্ধারকারীদের যথেষ্ট ধৈর্যপূর্ণ প্রচেষ্টার পর, আদি শিল্পকর্মটির চমৎকার রং এবং স্বাভাবিক সৌন্দর্য সকলের দৃষ্টিগোচর হয়। একইভাবে অধ্যবসায়ী প্রচেষ্টা, যিহোবার পবিত্র আত্মার সাহায্য এবং খ্রিস্টীয় মণ্ডলীর প্রেমময় সমর্থনের মাধ্যমে আমরা আমাদের ছোটবেলার সহজাতভাবে বিকশিত চমৎকার গুণাবলি পুনরুদ্ধার করতে পারি।—ইফিষীয় ৫:১.

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

শিশুরা স্বভাবতই নম্র

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

ছোট্ট শিশুরা ভেদাভেদ পোষণ করে না আর তারা দ্রুত ক্ষমা করে ও ভুলে যায়