সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস জীবন রক্ষা করে

বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস জীবন রক্ষা করে

বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস জীবন রক্ষা করে

 যিশু শেষবারের মতো যিরূশালেম মন্দির ত্যাগ করছেন, যখন তাঁর শিষ্যদের মধ্যে একজন বিস্ময়ে বলে ওঠেন: “হে গুরু, দেখুন, কেমন পাথর ও কেমন গাঁথনি!” মন্দিরটা ছিল যিহুদি জাতির গর্ব ও গৌরবের বিষয়। কিন্তু যিশু উত্তর দেন: “তুমি কি এই সকল বড় বড় গাঁথনি দেখিতেছ? ইহার একখানি পাথর আর একখানি পাথরের উপরে থাকিবে না, সকলই ভূমিসাৎ হইবে।”—মার্ক ১৩:১, ২.

সেটা এক অবিশ্বাস্য ধারণা! মন্দিরের কিছু পাথর ছিল বিশাল আকৃতির। এ ছাড়া, মন্দির সম্বন্ধে যিশু যা বলেন, তা যিরূশালেম ও সম্ভবত সেই যিহুদি জাতির ধ্বংসকে ইঙ্গিত করে, মন্দিরটা যাদের উপাসনার কেন্দ্রস্থল। তাই, যিশুর শিষ্যরা তাঁকে প্রশ্ন করে: “আমাদিগকে বলুন দেখি, এই সকল ঘটনা কখন্‌ হইবে? আর এই সমস্তের সিদ্ধি নিকটবর্ত্তী হইবার চিহ্নই বা কি?”—মার্ক ১৩:৩, ৪.

“তখনও শেষ নয়” যিশু সাবধান করেন। প্রথমে শিষ্যরা যুদ্ধ, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ এবং স্থানে স্থানে মহামারীর কথা শুনতে পাবে। তারপর, ভয়ংকর ঘটনাগুলো যিহুদি জাতিকে আকস্মিক বিপর্যয়ে, হ্যাঁ, ‘মহাক্লেশে’ নিক্ষেপ করবে। কিন্তু, ঈশ্বর “মনোনীতদের” অর্থাৎ বিশ্বস্ত খ্রিস্টানদের রক্ষা করার জন্য হস্তক্ষেপ করবেন। কীভাবে?—মার্ক ১৩:৭; মথি ২৪:৭, ২১, ২২; লূক ২১:১০, ১১.

রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

আটাশ বছর কেটে গিয়েছে আর যিরূশালেমের খ্রিস্টানরা এখনও শেষের জন্য প্রতীক্ষা করছে। রোম সাম্রাজ্য যুদ্ধ, ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর দ্বারা দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। (৯ পৃষ্ঠার বাক্স দেখুন।) যিহূদিয়া হল বেসামরিক ও জাতিগত দ্বন্দ্বের এক ঘাঁটি। কিন্তু, যিরূশালেমের নিরাপদ প্রাচীরের মধ্যে কিছুটা শান্তি রয়েছে। লোকেরা খাওয়াদাওয়া করে, কাজে যায়, বিয়ে করে এবং সন্তানের জন্ম দেয়, যেমনটা সবসময়ই করে এসেছে। বিশাল মন্দিরের আক্ষরিক উপস্থিতিই লোকেদের এইরকম ধারণা প্রদান করে যে, শহরটা দৃঢ় ও স্থায়ী।

সাধারণ কাল প্রায় ৬১ সালে, যিরূশালেমের খ্রিস্টানরা প্রেরিত পৌলের কাছ থেকে একটা চিঠি পায়। তিনি তাদের ধৈর্যের জন্য প্রশংসা করেন কিন্তু উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, মণ্ডলীতে কারো কারো তৎপরতার মনোভাবের অভাব রয়েছে। বেশ কিছু খ্রিস্টান আধ্যাত্মিকভাবে ভেসে যেতে শুরু করেছে বা সরে পড়ছে অথবা তাদের মধ্যে খ্রিস্টীয় পরিপক্বতার অভাব রয়েছে। (ইব্রীয় ২:১; ৫:১১, ১২) পৌল তাদের জোরালো পরামর্শ দেন: “অতএব তোমাদের সেই সাহস ত্যাগ করিও না . . . কারণ ‘আর অতি অল্প কাল বাকী অছে, যিনি আসিতেছেন, তিনি আসিবেন, বিলম্ব করিবেন না। কিন্তু আমার ধার্ম্মিক ব্যক্তি বিশ্বাস হেতুই বাঁচিবে, আর যদি সরিয়া পড়ে, তবে আমার প্রাণ তাহাতে প্রীত হইবে না।’” (ইব্রীয় ১০:৩৫-৩৮) সত্যিই সময়োপযোগী পরামর্শ! কিন্তু, খ্রিস্টানরা কি বিশ্বাস অনুশীলন করে চলবে এবং যিশুর ভবিষ্যদ্বাণীর পরিপূর্ণতার বিষয়ে সতর্ক থাকবে? আর যিরূশালেমের ধ্বংস কি সত্যিই সন্নিকট?

পরবর্তী পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে, যিরূশালেমের অবস্থা ক্রমাগত অধঃপতনের দিকে যায়। অবশেষে, সা.কা. ৬৬ সালে, দুর্নীতিপরায়ণ রোমীয় দেশাধ্যক্ষ ফ্লোরাস “বকেয়া খাজনা” হিসেবে পবিত্র মন্দিরের কোষাগার থেকে ১৭ তালন্ত বাজেয়াপ্ত করেন। যিহুদিরা এতে প্রচণ্ড রেগে যায় এবং বিদ্রোহ করে। বিদ্রোহী যিহুদি বা জেলটরা দলে দলে যিরূশালেমে এসে পৌঁছায় এবং সেখানে রোমীয় সৈন্যবাহিনীকে হত্যা করে। তারপর তারা সাহসের সঙ্গে যিহূদিয়াকে রোম থেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। এবার যিহূদিয়া আর রোমে যুদ্ধ লেগে যায়!

তিন মাসের মধ্যে, সিরিয়ার রোমীয় দেশাধ্যক্ষ সেস্টিয়াস গ্যালাস, যিহুদি বিদ্রোহীদের দমন করতে ৩০,০০০ সৈন্য নিয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হন। তার সৈন্যবাহিনী কুটিরোৎসব চলাকালীন যিরূশালেমে এসে পৌঁছায় এবং শীঘ্রই শহরতলিতে প্রবেশ করে। জেলটরা, যারা সংখ্যায় অল্প ছিল, তারা মন্দিরের দুর্গের ভিতরে আশ্রয় নেয়। রোমীয় সৈন্যরা শীঘ্রই মন্দিরের দেওয়াল ভাঙতে শুরু করে। যিহুদিরা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। কারণ পরজাতীয় সৈন্যরা এখন যিহুদিধর্মের পবিত্রতম স্থানকে কলুষিত করছে! কিন্তু, নগরের খ্রিস্টানরা যিশুর এই কথাগুলো স্মরণ করে: “যখন দেখিবে, ধ্বংসের যে ঘৃণার্হ বস্তু পবিত্র . . . স্থানে দাঁড়াইয়া আছে, . . . তখন যাহারা যিহূদিয়াতে থাকে, তাহারা পাহাড় অঞ্চলে পলায়ন করুক।” (মথি ২৪:১৫, ১৬) তারা কি যিশুর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত কথাগুলোতে বিশ্বাস দেখিয়ে সেইমতো কাজ করার জন্য পরিচালিত হবে? ঘটনাগুলো ঘটার সঙ্গে সঙ্গে, তা করার ওপর তাদের জীবন নির্ভর করছে। কিন্তু কীভাবে?

হঠাৎ করে এবং কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই, সেস্টিয়াস গ্যালাস তার সৈন্যবাহিনীকে সরিয়ে নেন এবং উপকূলের দিকে ফিরে যান যেখানে জেলটরা তাদের পিছু ধাওয়া করেছিল। আশ্চর্যজনকভাবে, নগরের ওপর আসা মহাক্লেশের মেয়াদ কমে যায়! যিশুর ভবিষ্যদ্বাণীকৃত সতর্কবাণীতে তাদের বিশ্বাস প্রদর্শন করে খ্রিস্টানরা যিরূশালেম থেকে যর্দন নদীর ওপারে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এক নিরপেক্ষ শহর পেল্লাতে পালিয়ে যায়। তারা ঠিক সময়মতো পালিয়ে যায়। জেলটরা শীঘ্রই যিরূশালেমে ফিরে আসে আর তাদের বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার জন্য বাকি অধিবাসীদের জোর করে। * ইতিমধ্যে, পেল্লাতে সুরক্ষিত খ্রিস্টানরা পরবর্তী ঘটনাগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

অরাজকতার অধঃপতন হয়

কয়েক মাসের মধ্যেই, এক নতুন রোমীয় সৈন্যদল যিরূশালেমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সা.কা. ৬৭ সালে প্রধান সেনাপতি ভেস্পাসিয়ান এবং তার ছেলে টাইটাস ৬০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীকে একত্রিত করেন। পরবর্তী দুবছর, এই ধ্বংসাত্মক সামরিকবাহিনী পথে আসা সমস্ত বাধাকে চূর্ণ করে যিরূশালেমের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ইতিমধ্যে, যিরূশালেমের ভিতরে বিভক্ত হয়ে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী যিহুদি দলগুলো নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। শহরে মজুত করে রাখা শস্য নষ্ট করা হয়, মন্দিরের পার্শ্ববর্তী এলাকা ভূমিসাৎ করে ফেলা এবং ২০,০০০রেরও বেশি যিহুদিকে হত্যা করা হয়। ভেস্পাসিয়ান যিরূশালেমের দিকে তার যাত্রা স্থগিত রেখে ঘোষণা করেন: ‘ঈশ্বর আমার চেয়েও ভাল একজন রোমীয় প্রধান সেনাপতি হিসেবে কাজ করেন; আমাদের শত্রুরা নিজেরাই একে অপরকে ধ্বংস করছে।’

রোমীয় সম্রাট নিরো মারা গেলে, ভেস্পাসিয়ান সিংহাসন দখল করার জন্য টাইটাসকে যিহুদিয়ার অভিযান সম্পূর্ণ করতে দিয়ে রোমের উদ্দেশে যাত্রা করেন। টাইটাস সা.কা. ৭০ সালে নিস্তারপর্বের কাছাকাছি সময়ে যিরূশালেমে এসে পৌঁছান এবং শহরের মধ্যে থাকা অধিবাসী ও তীর্থযাত্রীদের আটক করেন। তার সৈন্যবাহিনী সেই অবরুদ্ধ শহরের চারপাশে ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ খুঁটির প্রাচীর তৈরি করার জন্য যিহুদিয়ার গ্রামগুলোতে থাকা গাছগুলোকে কেটে ফেলে। ঠিক তাই ঘটেছিল, যেমনটা যিশু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: “তোমার শত্রুগণ তোমার চারিদিকে জাঙ্গাল বাঁধিবে, তোমাকে বেষ্টন করিবে, তোমাকে সর্ব্বদিকে অবরোধ করিবে।”—লূক ১৯:৪৩.

শীঘ্রই দুর্ভিক্ষ শহরকে জর্জরিত করে। সশস্ত্র জনতা মৃত ও মৃতপ্রায় লোকেদের ঘরগুলোকে লুঠ করে। অন্তত একজন দুঃসাহসী মহিলা তার সদ্যজাত শিশুকে হত্যা করে এবং খায় আর এইভাবে এই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ করে: “যখন তোমার শত্রুগণ কর্ত্তৃক তুমি অবরুদ্ধ ও ক্লিষ্ট হইবে, তখন তুমি আপন শরীরের ফল, তোমার . . . নিজ পুত্ত্রকন্যাদিগের মাংস, ভোজন করিবে।”—দ্বিতীয় বিবরণ ২৮:৫৩-৫৭.

শেষ পর্যন্ত, পাঁচ মাস অবরুদ্ধ থাকার পর যিরূশালেমের পতন হয়। শহর এবং এর বিশাল মন্দিরকে লুঠ করা হয় ও পুড়িয়ে দেওয়া হয় আর তারপর প্রত্যেকটা পাথর উৎপাটন করা হয়। (দানিয়েল ৯:২৬) সর্বমোট প্রায় ১১,০০,০০০ লোক মারা যায়; আরও ৯৭,০০০ লোককে দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। * (দ্বিতীয় বিবরণ ২৮:৬৮) যিহুদিয়া প্রায় যিহুদিশূন্য হয়ে যায়। সত্যিই, এটা ছিল এক নজিরবিহীন জাতীয় বিপর্যয়, যিহুদি রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক সন্ধিক্ষণ। *

এরই মধ্যে, পেল্লাতে থাকা খ্রিস্টানরা তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য ঈশ্বরকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানায়। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণীতে তাদের বিশ্বাস সত্যিই তাদের জীবন রক্ষা করেছিল!

অতীতের সেই ঘটনাগুলোর কথা চিন্তা করে, আজকে আমাদের প্রত্যেকের জিজ্ঞেস করা উচিত: ‘আমার কি সেই বিশ্বাস আছে, যা আসন্ন মহাক্লেশ থেকে আমার জীবনকে রক্ষা করবে? আমি কি “প্রাণের রক্ষার জন্য বিশ্বাসের লোক”?’—ইব্রীয় ১০:৩৯; প্রকাশিত বাক্য ৭:১৪.

[পাদটীকাগুলো]

^ যিহুদি ইতিহাসবেত্তা জোসিফাস বলেন যে, জেলটরা যিরূশালেমে ফিরে আসার আগের সাত দিন পর্যন্ত রোমীয়দের পিছু ধাওয়া করেছিল।

^ একটা হিসেব অনুসারে, রোমীয় সাম্রাজ্যে থাকা সমস্ত যিহুদির প্রায় সাত ভাগের এক ভাগকে হত্যা করা হয়েছিল।

^ যিহুদি বাইবেল পণ্ডিত আলফ্রেট এডারশাইম লিখেছিলেন: “ইস্রায়েলের ওপর আসা [এই] মহাক্লেশ অতীত ইতিহাসের শোচনীয় ঘটনাগুলোর সঙ্গে অতুলনীয় এবং এমনকি এর রক্তক্ষয়ী ভবিষ্যৎও অসাধারণ।”

[৯ পৃষ্ঠার তালিকা]

প্রথম শতাব্দীতে পরিপূর্ণ হওয়া চিহ্নের বৈশিষ্ট্যসমূহ

যুদ্ধবিগ্রহ:

গল (সা.কা. ৩৯-৪০ সাল)

উত্তর আফ্রিকা (সা.কা. ৪১ সাল)

ব্রিটেন (সা.কা. ৪৩, ৬০ সাল)

আর্মেনিয়া (সা.কা. ৫৮-৬২ সাল)

যিহুদিয়াতে ঘটা বেসামরিক ও জাতিগত দ্বন্দ্বগুলো (সা.কা. ৫০-৬৬ সাল)

ভূমিকম্প:

রোম (সা.কা. ৫৪ সাল)

পম্পেই (সা.কা. ৬২ সাল)

এশিয়া মাইনর (সা.কা. ৫৩, ৬২ সাল)

ক্রীট (সা.কা. ৬২ সাল)

দুর্ভিক্ষ:

রোম, গ্রিস, মিশর (সা.কা. প্রায় ৪২ সাল)

যিহুদিয়া (সা.কা. প্রায় ৪৬ সাল)

মহামারী:

বাবিল (সা.কা. ৪০ সাল)

রোম (সা.কা. ৬০, ৬৫ সাল)

ভাক্ত ভাববাদীরা:

যিহুদিয়া (সা.কা. প্রায় ৫৬ সাল)

[১০ পৃষ্ঠার মানচিত্র/চিত্র]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

সাধারণ কাল ৬৭-৭০ সালে প্যালেস্টাইনে রোমীয় অভিযান

তলিমায়ি

গালীল সমুদ্র

পেল্লা

পিরিয়া

শমরিয়া

যিরূশালেম

লবণ সমুদ্র

যিহুদিয়া

কৈসরিয়া

[সৌজন্যে]

শুধু মানচিত্র: Based on maps copyrighted by Pictorial Archive (Near Eastern History) Est. and Survey of Israel

[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]

‘আমাদের শত্রুরা নিজেরাই একে অপরকে ধ্বংস করছে।’—ভেস্পাসিয়ান

[১১ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

সাধারণ কাল ৭০ সালে রোমীয় সৈন্যবাহিনী যিরূশালেম ধ্বংস করেছিল

[১১ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

উদ্‌গত শিল্পকর্ম: Soprintendenza Archeologica di Roma; ভেস্পাসিয়ান: Bildarchiv Preussischer Kulturbesitz/Art Resource, NY