সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

বিরয়ার পথে পৌলকে অনুসরণ করুন

বিরয়ার পথে পৌলকে অনুসরণ করুন

বিরয়ার পথে পৌলকে অনুসরণ করুন

দুজন মিশনারির কাজ বেশ সফল হয়েছিল আর বিপুল সংখ্যক লোক বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। এরপর এক উত্তেজিত জনতা মিশনারিদের বিরুদ্ধে উঠেছিল। তাই, একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নবগঠিত মণ্ডলীর মঙ্গল এবং মিশনারিদের নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে এই দুজন খুব দ্রুত, মধ্যরাতে সেই এলাকা ত্যাগ করেছিল। এভাবে পৌল ও সীল সা.কা. প্রায় ৫০ সালে থিষলনীকীর মেসিডোনিয়া (মাকিদনিয়া) সমুদ্রবন্দরে পালিয়ে এসেছিল। সেখান থেকে তারা তাদের পরবর্তী প্রচারের গন্তব্যস্থলে—বিরয়াতে—যাত্রা করেছিল।

 দূর থেকে, প্রাচীনকালের ভ্রমণকারীদের মতো আধুনিক সময়ের পর্যটকরাও দেখতে পাবে যে, বিরয়া (ভিরয়া) সবুজ লতাপাতায় বেষ্টিত ভারমিয়ো পর্বতের পূর্বদিকের পাদদেশে অবস্থিত। বিরয়া থিষলনীকীর প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্ব দিকে এবং ঈজিয়ান সমুদ্রোপকূল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত। এর দক্ষিণ দিকে অলিম্পাস পর্বত অবস্থিত, যেটা প্রাচীন গ্রিসের দেব-দেবীদের মধ্যে প্রধান দেবতাদের পৌরাণিক আবাস।

বাইবেল ছাত্রদের কাছে বিরয়া এমন এক জায়গা হিসেবে আগ্রহজনক, যেখানে পৌল প্রচার করেছিলেন এবং অনেককে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিলেন। (প্রেরিত ১৭:১০-১৫) আসুন আমরা পৌলকে অনুসরণ করি এবং এই নগরের অতীত ইতিহাস অনুসন্ধান করে দেখি।

প্রাথমিক ইতিহাস

বিরয়া নগরটা কখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেটা কেউই নিশ্চিতভাবে জানে না। এর প্রথম অধিবাসীরা, সম্ভবত ফ্রিজিয়ান বংশের লোকেরা, সা.কা.পূ. প্রায় সপ্তম শতাব্দীতে মেসিডোনিয়া থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল। এর তিনশো বছর পর, মহান আলেকজান্ডার মেসিডোনিয়া জয় করার পর এটা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। মনোরম অনেক অট্টালিকা এবং প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল, যেখানে জিউস, আর্টিমিস, আ্যপোলো, এথেনা এবং অন্যান্য গ্রিক দেব-দেবীর উপাসনার স্থান ছিল।

ইতিহাসের একটি বই জানায় যে, শত শত বছর ধরে বিরয়া “এর নিকটবর্তী এলাকা এবং উত্তর গ্রিসের অন্যান্য জায়গার ওপর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।” এই নগরটি মেসিডোনিয়ার শেষ রাজবংশ এনটিগনিডস্‌দের শাসনের সময়ে (সা.কা.পূ. ৩০৬-১৬৮ সাল) বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, যারা শেষ পর্যন্ত রোমের কাছে পরাজিত হয়েছিল।

যখন রোমীয়রা সা.কা.পূ. ১৯৭ সালে রাজা ফিলিপ ৫ম-কে পরাজিত করেছিল, তখন “প্রাক্তন ক্ষমতা কাঠামো উলটে গিয়েছিল এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোম সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল,” এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলে। সা.কা.পূ. ১৬৮ সালে, বিরয়ার কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে পিডনা অঞ্চলে একজন রোমীয় সেনাপতি প্রাচীন মেসিডোনিয়ার শেষ শাসক পারসিয়ুসের ওপর চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন। বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে, গ্রিক বিশ্ব শক্তিকে রোম অপসারণ করেছিল। (দানিয়েল ৭:৬, ৭, ২৩) সেই যুদ্ধের পর, বিরয়া ছিল মেসিডোনিয়ার প্রথম নগর, যা রোমের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

সাধারণ কাল পূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, পম্পেই এবং জুলিয়াস সিজারের মধ্যে দ্বন্দ্বের সময় মেসিডোনিয়া একটা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে, পম্পেই তার সেনা দফতর এবং সেনাবাহিনীকে বিরয়ার আশেপাশে স্থাপন করেছিলেন।

রোমীয়দের অধীনে সমৃদ্ধি লাভ করা

প্যাক্স রোমানা বা রোমীয় শান্তির সময়ে বিরয়ায় আসা পর্যটকরা দুই দিকে সারিবদ্ধ স্তম্ভ দ্বারা সজ্জিত পাকা রাস্তা দেখতে পেত। নগরটিতে জনসাধারণের জন্য স্নানাগার, থিয়েটার, গ্রন্থাগার এবং মল্লযুদ্ধের স্থান ছিল। পানীয়জল পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতো এবং নগরটিতে সুসংহতভাবে ভূগর্ভস্থ নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল। বিরয়া বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল, যেখানে ব্যবসায়ী, শিল্পী, ক্রীড়াবিদ ও দর্শকরা মল্লপ্রতিযোগিতা ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসত। বিদেশিরা এখানে উপাসনা করার জন্য বিভিন্ন স্থান খুঁজে পেত, যেখানে তারা তাদের নিজ ধর্মের আচারঅনুষ্ঠান করতে পারত। সত্যিই, এই নগরে প্রকৃতপক্ষে পুরো রোমীয় সাম্রাজ্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো দেখা যেত।

মৃত্যুর পর রোমীয় সম্রাটদের দেবত্বদান করা হতো আর বিরয়ার লোকেরা তাদেরকে উপাসনা করত। বিরয়ার লোকেদের কাছে এটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় ছিল না, কারণ এভাবে সম্রাট উপাসনার একজন অগ্রদূত ছিলেন মহান আলেকজান্ডার, যাকে একজন দেবতা হিসেবে ভক্তি করা হতো। একটা গ্রিক উৎস বলে: “তারা রাজার জীবিত অবস্থাতেই তাকে ঐশিক সম্মান প্রদানে অভ্যস্ত হয়েছিল, পূর্ব সাম্রাজ্যের হেলিনরা [গ্রিকরা], আনন্দের সঙ্গে রোমীয় সম্রাটদেরও ধর্মীয় সম্মান প্রদানে একমত হয়েছিল . . . তাদের মুদ্রাগুলোতে সম্রাটকে দেবতা হিসেবে তুলে ধরা হতো, যার মাথায় দীপ্তি ছড়ায় এমন মুকুট পরা থাকত। তারা একজন দেবতার প্রতি যেমনটা করত, সেভাবে স্তব ও গানসহ সম্রাটের জয়ধ্বনি করত।” বিভিন্ন বেদি ও মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল এবং সেখানে তার উদ্দেশে বলি উৎসর্গ করা হতো। এমনকি সম্রাটরা রাজকীয় ধর্মীয় উৎসবগুলোতে উপস্থিত থাকার জন্য আসত, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল মল্লযুদ্ধ, শিল্প ও সাহিত্য সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা।

কেন বিরয়া পৌত্তলিক উপাসনার এক কেন্দ্রস্থল ছিল? কারণ এটা মেসিডোনিয়ার কিনোনের স্থান ছিল। এটা মেসিডোনিয়ার নগরগুলো থেকে আসা অভ্যাগতদের সম্মিলনস্থল ছিল। এই অভ্যাগতরা বিরয়াতে নিয়মিতভাবে রোমের তত্ত্বাবধানের অধীনে নগর ও প্রদেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হতো। কিনোনের কার্যক্রমগুলোর মধ্যে একটা প্রধান কাজ ছিল, রাজকীয় ধর্মীয় উদ্‌যাপনগুলো দেখাশোনা করা।

অতএব পৌল এবং সীল থিষলনীকী থেকে পালিয়ে আসার পর যেখানে ভ্রমণ করেছিল, সেই নগরের পরিবেশ এইরকম ছিল। সেই সময়ের মধ্যে, বিরয়া দুশো বছর ধরে রোমের শাসনাধীনে ছিল।

বিরয়াতে সুসমাচার পৌঁছায়

পৌল বিরয়া নগরের সমাজগৃহে তার প্রচার কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি কেমন সাড়া পেয়েছিলেন? অনুপ্রাণিত বিবরণ বলে যে, সেখানকার যিহুদিরা “থিষলনীকীর যিহূদীদের অপেক্ষা . . . ভদ্র ছিল; কেননা ইহারা সম্পূর্ণ আগ্রহপূর্ব্বক বাক্য গ্রহণ করিল, আর এ সকল বাস্তবিকই এইরূপ কি না, তাহা জানিবার জন্য প্রতিদিন শাস্ত্র পরীক্ষা করিতে লাগিল।” (প্রেরিত ১৭:১০, ১১) “ভদ্র” বা উদারমনা হওয়ায়, তারা একগুঁয়েভাবে তাদের রীতিনীতিকে আঁকড়ে ধরে থাকেনি। যদিও তারা নতুন কিছু বিষয়ই শুনেছিল, তবুও তারা সন্দেহ করেনি বা রেগে যায়নি। পৌলের বার্তাকে প্রত্যাখ্যান করার পরিবর্তে, তারা মনোযোগী হয়েছিল, উদারভাবে শুনেছিল আর কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব করেনি।

কীভাবে সেই যিহুদিরা পৌলের শিক্ষায় সত্যের সমষ্টিকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল? তারা যা শুনেছিল, সেগুলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কষ্টিপাথর বা মানদণ্ড ব্যবহার করে পরীক্ষা করেছিল। তারা মনোযোগ ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে শাস্ত্র অনুসন্ধান করত। বাইবেল পণ্ডিত ম্যাথিউ হেনরি উপসংহারে বলেছিলেন: “যেহেতু পৌল শাস্ত্র থেকে যুক্তি করেছিলেন এবং তার বলা বিষয়গুলোকে প্রমাণ করার জন্য তাদেরকে পুরাতন নিয়মের বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন, তাই তারা তাদের বাইবেল থেকে সাহায্য নিয়েছিল, তিনি যে-বিষয়গুলো উল্লেখ করেছিলেন সেই জায়গাগুলো তারা খুলে দেখেছিল, প্রসঙ্গ বিষয় পড়েছিল, সেগুলোর প্রসঙ্গ ও মূল অর্থ বিবেচনা করেছিল, অন্য শাস্ত্রপদগুলোর সঙ্গে সেগুলোকে তুলনা করেছিল, সেখান থেকে উপনীত পৌলের সিদ্ধান্ত যথার্থ ও বিশুদ্ধ কি না এবং তার যুক্তি তাদের কাছে প্রত্যয়োৎপাদক কি না, তা পরীক্ষা করেছিল এবং সেইমতো উপসংহারে পৌঁছেছিল।”

এটা কেবল ওপর ওপর অধ্যয়ন করা ছিল না। বিরয়ার লোকেরা এক অধ্যবসায়ী, ধারাবাহিক অধ্যয়ন করেছিল, তা করার জন্য শুধুমাত্র বিশ্রামবারেই নয় বরং প্রতিদিন তারা সময় করে নিয়েছিল।

এখন এর ফলাফল সম্বন্ধে চিন্তা করুন। বিরয়ার অনেক যিহুদি বার্তা গ্রহণ করেছিল এবং বিশ্বাসী হয়েছিল। অনেক গ্রিক, যাদের মধ্যে সম্ভবত কিছু ধর্মান্তরিত যিহুদি ছিল, তারাও বিশ্বাসী হয়েছিল। কিন্তু, এটা অলক্ষিত থাকেনি। যখন থিষলনীকীর যিহুদিরা এই বিষয়ে শুনেছিল, তারা শীঘ্রই বিরয়াতে গমন করে “লোকসমূহকে অস্থির ও উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিতে লাগিল।”—প্রেরিত ১৭:৪, ১২, ১৩.

পৌল বিরয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কিন্তু তিনি অন্যত্র তার প্রচার কাজ করে চলেছিলেন। এই সময়ে তিনি এথেন্সে (আথীনীতে) গমনরত একটা জাহাজে চড়েছিলেন। (প্রেরিত ১৭:১৪, ১৫) তা সত্ত্বেও, তিনি এই কারণে আনন্দ করতে পারতেন যে, বিরয়াতে তার কাজের ফলে সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তা আজকেও ফল উৎপন্ন করছে।

হ্যাঁ, আজকেও বিরয়াতে (ভিরয়া) এমন লোকেরা রয়েছে, যারা ‘সর্ব্ববিষয় পরীক্ষা করিতে’ এবং সুপ্রতিষ্ঠিত ও সত্য বিষয়গুলোকে ‘ধরিয়া রাখিতে’ মনোযোগের সঙ্গে শাস্ত্র পরীক্ষা করে। (১ থিষলনীকীয় ৫:২১) সেই নগরে যিহোবার সাক্ষিদের দুটো উন্নতিশীল মণ্ডলী পৌলের মতো প্রচার কাজে জড়িত রয়েছে, অন্যদেরকে বাইবেলের বার্তা জানাচ্ছে। তারা আন্তরিক ব্যক্তিদের অন্বেষণ করে এবং শাস্ত্র থেকে তাদের সঙ্গে যুক্তি করে, বাইবেলের চালিকাশক্তিকে সেইসব ব্যক্তিকে সাহায্য করার সুযোগ করে দেয়, যারা সত্য ঈশ্বর যিহোবাকে জানতে চায়।—ইব্রীয় ৪:১২.

[১৩ পৃষ্ঠার মানচিত্র]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

পৌলের দ্বিতীয় মিশনারি যাত্রার অংশ

মুশিয়া

ত্রোয়া

নিয়াপলি

ফিলিপী

মেসিডোনিয়া

আম্ফিপলি

থিষলনীকী

বিরয়া

গ্রিস

এথেন্স

করিন্থ

আখায়া

এশিয়া

ইফিষ

রোদঃ

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

মহান আলেকজান্ডারের প্রতিকৃতিসহ রুপোর মুদ্রা, যেটাতে তাকে একজন গ্রিক দেবতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে

[সৌজন্যে]

মুদ্রা: Pictorial Archive (Near Eastern History) Est.

[১৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

বিরয়াতে (ভিরয়া) যিহুদি এলাকায় একটা প্রবেশপথ

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আধুনিক দিনের বিরয়াতে (ভিরয়া) একটা প্রাচীন সমাজগৃহ