সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমাদের পরিচর্যা সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

আমাদের পরিচর্যা সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

জীবনকাহিনি

আমাদের পরিচর্যা সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ

বলেছেন লিনা ডেভিসন

“আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি আর দেখতে পাচ্ছি না,” অস্পষ্ট স্বরে এই কথাগুলো আমাদের পাইলট বলেছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে পাইলট তার সিটে ধপ করে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় সেই ছোট্ট প্লেন যেটাতে আমরা ছিলাম, সেটা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমার স্বামী যার বিমান চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না সে মরিয়া হয়ে পাইলটের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকে। কীভাবে আমরা মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম তা বলার আগে আমি আপনাদের ব্যাখ্যা করতে চাই যে, কী আমাদেরকে সেই প্লেনে করে পৃথিবীর একেবারে প্রান্তে অবস্থিত পাপুয়া নিউ গিনির ওপর দিয়ে যেতে পরিচালিত করেছিল।

 অস্ট্রেলিয়ায় আমি ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করি এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনিতে বড় হয়ে উঠি। আমার বাবা বিল মাসকেট যদিও একজন সাম্যবাদী ছিলেন, তবুও যথেষ্ট আশ্চর্যের বিষয় হল যে, তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। এমনকি ১৯৩৮ সালে, যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয় থেকে জোসেফ এফ. রাদারফোর্ডকে সিডনি টাউন হলে এসে বক্তৃতা দেওয়ার অনুমোদন প্রদানের জন্য করা একটা জাতীয় আবেদনে স্বাক্ষর করায় তিনি রাজি হয়েছিলেন।

“তিনি নিশ্চয়ই কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন,” বাবা আমাদের সেই সময় বলেছিলেন। আট বছর পর, আমরা সেই বার্তার মূল বিষয়গুলো সম্বন্ধে শিখেছিলাম। বাবা বাইবেল সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য আমাদের ঘরে নরমান বিলটি নামে যিহোবার সাক্ষিদের একজন পূর্ণসময়ের অগ্রগামী পরিচারককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমাদের পরিবার সঙ্গে সঙ্গে বাইবেলের সত্য গ্রহণ করেছিল এবং শীঘ্রই খ্রিস্টীয় পরিচর্যায় অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছিল।

১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝিতে আমি আমার মাকে সাহায্য করার জন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম, যিনি দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আমি জীবিকা নির্বাহের জন্য দর্জির কাজও করতাম। শনিবার রাতগুলোতে, আমার দিদি রোজ এবং আমি অগ্রগামীদের একটা দলের সঙ্গে সিডনি টাউন হলের বাইরে রাস্তায় সাক্ষ্যদানের কাজ করতাম। ১৯৫২ সালে আমার দাদা জন যুক্তরাষ্ট্রের গিলিয়েড মিশনারি স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন এবং তাকে পাকিস্তানে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। আমিও পরিচর্যা ভালবাসতাম এবং তার উদাহরণ অনুসরণ করতে চেয়েছিলাম। তাই, পরের বছর আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী হয়েছিলাম।

বিয়ে এবং মিশনারি কাজ

এর কিছু সময় পরই, জন ডেভিসনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যে যিহোবার সাক্ষিদের অস্ট্রেলিয়া শাখা অফিসে কাজ করত। তার নম্রতা, অকৃত্রিম দৃঢ়সংকল্প এবং দৃঢ় নৈতিক উৎকর্ষতা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, সে তার খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কারণে তিনবার কারারুদ্ধ হয়েছিল। খ্রিস্টীয় পরিচর্যাকে আমাদের জীবনের প্রধান কাজ করে তোলার বিষয়ে আমরা একত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

১৯৫৫ সালের জুন মাসে জন এবং আমি বিয়ে করি। আমরা একটা বাস কিনেছিলাম, যেটাকে একটা ভ্রাম্যমান বাড়িতে পরিণত করব বলে ঠিক করেছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল এটাকে মূলত অস্ট্রেলিয়ার দূরবর্তী এলাকাগুলোতে প্রচার করার জন্য ব্যবহার করা। পরের বছর, সাক্ষিদের উত্তর অস্ট্রেলিয়ার একটা বিশাল দ্বীপের উত্তরপূর্ব অংশ নিউ গিনিতে গিয়ে প্রচার করার আমন্ত্রণ জানানো হয়। * পৃথিবীর এই অংশে তখনও রাজ্যের বার্তা প্রচার করা হয়নি। আমরা শীঘ্রই স্বেচ্ছায় সাড়া দিয়েছিলাম।

সেই সময়, কেবলমাত্র পূর্ণসময়ের চাকরির চুক্তিতেই নিউ গিনিতে প্রবেশ করা যেত আর তাই, জন একটা কাজ খুঁজতে থাকে। সে শীঘ্রই নিউ গিনির অধীনস্থ খুব ছোট্ট একটা দ্বীপ নিউ ব্রিটেনে একটা স-মিলে কাজ করার চুক্তি করে। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর আমরা আমাদের নতুন কার্যভারের উদ্দেশে রওনা দিই আর ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে নিউ ব্রিটেনের রাবায়ুলে এসে পৌঁছাই। সেখানে আমরা ওয়াটারফল বেতে যাত্রা করতে একটা নৌকার জন্য ছয় দিন অপেক্ষা করেছিলাম।

ওয়াটারফল বে এলাকায় আমাদের পরিচর্যা

বেশ কয়েক দিন উত্তাল সমুদ্রে ভ্রমণ করার পর আমরা ওয়াটারফল বে এলাকায় পৌঁছাই, যেটা হচ্ছে রাবায়ুলের প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে একটা বড় খাঁড়ি। এখানে জঙ্গলের পরিষ্কার ফাঁকা জায়গায় একটা বিশাল স-মিল অবস্থিত ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় যখন সমস্ত কর্মী খাবারের টেবিলের চারপাশে বসেছিল, তখন ম্যানেজার বলেছিলেন, “মি. ও মিসেস ডেভিসন, এই কোম্পানির নীতি হচ্ছে সমস্ত কর্মী তাদের নিজ নিজ ধর্মের বিষয়ে উল্লেখ করবে।”

আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম যে, এই ধরনের কোনো নীতি ছিল না কিন্তু যেহেতু আমরা ধূমপান করা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তাই স্পষ্টতই তারা আমাদের সন্দেহ করেছিল। যা-ই হোক, জন উত্তরে বলেছিলেন, “আমরা যিহোবার সাক্ষি।” এরপর এক অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করেছিল। সেই ব্যক্তিরা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাবেক অভিজ্ঞ সৈনিক এবং যুদ্ধের সময় সাক্ষিদের নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে তাদের প্রতি তারা বিদ্বেষপরায়ণ ছিল। সেই সময় থেকে, সেই লোকেরা আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলোকে কঠিন করে তুলতে সুযোগ খুঁজছিল।

প্রথমে ম্যানেজার আমাদেরকে একটা রেফ্রিজারেটার এবং স্টোভ দিতে রাজি হননি, যদিও আমাদের এ দুটোই পাওয়ার অধিকার ছিল। আমাদের পচনশীল খাবার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আর আমরা একটা ভাঙা স্টোভে রান্না করতে বাধ্য হয়েছিলাম, যেটা আমরা জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এরপর স্থানীয় গ্রামবাসীদেরকে আমাদের কাছে টাটকা জিনিস বিক্রি করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল, তাই যে-শাকসবজি পেতাম, তা-ই খেয়ে আমরা বেঁচে ছিলাম। আমাদেরকে গুপ্তচর হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং আমাদের ওপর কড়া নজর রাখা হতো এটা দেখতে যে, আমরা কাউকে বাইবেল থেকে শিক্ষা দিচ্ছি কি না। এরপর আমি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হই।

যা-ই হোক, আমরা আমাদের পরিচর্যা সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। তাই, আমরা স-মিলের দুজন স্থানীয় যুবক কর্মী, যারা ইংরেজি বলতে পারত, তাদেরকে সেখানকার জাতীয় ভাষা মেলানিশিয়ান পিজিন শেখাতে বলেছিলাম। এর প্রতিদানে আমরা তাদেরকে বাইবেল শেখাতাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আমরা দূরদূরান্তে ‘দর্শনীয় স্থানগুলোতে’ ঘুরতে যেতাম। যাত্রাপথে আমরা কোনো গ্রামবাসী পেলেই সতর্কতার সঙ্গে তাকে সাক্ষ্য দিতাম; আমাদের বাইবেল ছাত্ররা অনুবাদক হিসেবে ভূমিকা পালন করত। আমরা যে-নদীগুলো পার হতাম, সেগুলোতে প্রচণ্ড স্রোত ছিল এবং নদীর তীরগুলোতে বড় বড় কুমির রোদ পোহাত। একবার কোনোরকমে রক্ষা পাওয়া ছাড়া এই ভয়ংকর শিকারিদের কবলে আমরা তেমন একটা পড়িনি।

শিক্ষাদানের হাতিয়ারগুলো তৈরি করা

আমাদের পরিচর্যা সম্প্রসারিত হওয়ায় আমরা আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছে বাইবেলের বার্তাকে সহজ-সরলভাবে বন্টন করার জন্য সেগুলো টাইপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই স-মিলে কর্মরত আমাদের বাইবেল ছাত্ররা এগুলোর প্রথমটা অনুবাদ করার জন্য আমাদেরকে সাহায্য করেছিল। আমরা রাতের পর রাত ধরে শত শত ট্র্যাক্ট টাইপ করেছিলাম এবং সেগুলো গ্রামবাসীদের ও নৌকার মাঝিদের কাছে বিতরণ করেছিলাম।

১৯৫৭ সালে, জন কাটফর্থ নামে একজন অভিজ্ঞ ভ্রমণ পরিচারক আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমাদেরকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। * তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, যারা পড়তে পারে না, তাদেরকে বাইবেলের সত্য শেখানোর জন্য ছবিগুলো ব্যবহার করা এক কার্যকর উপায় হতে পারে। তিনি এবং আমার স্বামী বাইবেলের মৌলিক শিক্ষাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য কয়েকটা সাধারণভাবে আঁকা ছবি অথবা রেখাচিত্রগুলো তৈরি করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে, আমরা ছবি দ্বারা বোঝানো উপদেশগুলোকে আমাদের নোটবুকে কপি করার জন্য অনেক ঘন্টা ব্যয় করেছিলাম। প্রত্যেকটা বাইবেল ছাত্র এর একটি করে কপি পেয়েছিলেন, যেটি তিনি অন্যদের কাছে প্রচার করার সময় ব্যবহার করেছিলেন। এই শিক্ষাপদ্ধতি ধীরে ধীরে পুরো দেশে ব্যবহৃত হয়েছিল।

ওয়াটারফল বে এলাকায় প্রায় আড়াই বছর কাটানোর পর, আমরা আমাদের কাজের চুক্তি পূর্ণ করেছিলাম এবং সেই দেশে থাকার জন্য অনুমতি পেয়েছিলাম। তাই, আমরা বিশেষ অগ্রগামীর পরিচর্যা করার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম।

আবার রাবায়ুলে ফিরে যাওয়া

উত্তর দিকে রাবায়ুলে যাত্রা করার সময় আমাদের নৌকা একরাত ওয়াইড বে এলাকার একটা নারিকেল ও কোকো বাগানের কাছে থেমেছিল। সেই বাগানের মালিক এক বয়স্ক দম্পতি, যারা তাদের কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে অস্ট্রেলিয়াতে ফিরে যেতে চেয়েছিল, তারা জনকে সেই বাগান দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। চাকরির প্রস্তাবটা খুবই লোভনীয় ছিল কিন্তু আমরা সেই রাতে যখন এই বিষয় নিয়ে দুজনে আলোচনা করেছিলাম, তখন আমরা একমত হয়েছিলাম যে, আমরা নিউ গিনিতে বস্তুগত ধনসম্পদ অর্জন করার জন্য আসিনি। অগ্রগামী হিসেবে আমরা আমাদের পরিচর্যা সম্পন্ন করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। তাই, পরের দিন আমরা সেই দম্পতিকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম এবং নৌকায় চড়ে আবার রওনা দিয়েছিলাম।

রাবায়ুলে পৌঁছানোর পর, আমরা অন্যদেশ থেকে আসা সাক্ষিদের একটা ছোট দলের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম, যারা এই এলাকায় থাকত। স্থানীয় লোকেরা রাজ্যের বার্তার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিল আর আমরা অনেক বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম। এই সময়ের মধ্যে আমরা একটা স্থানীয় ভাড়া করা হলে খ্রিস্টীয় সভাগুলো করতাম আর সেখানে উপস্থিতির সংখ্যা হতো ১৫০ জনের কাছাকাছি। এদের মধ্যে অনেকেই সত্যকে গ্রহণ করেছিল এবং দেশের অন্যান্য জায়গায় ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিল।—মথি ২৪:১৪.

আমরা রাবায়ুল থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভুনাবেল নামে একটা গ্রামও পরিদর্শন করেছিলাম, যেখানে একদল লোক বাইবেলের সত্যের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিল। শীঘ্রই তারা একজন স্থানীয় প্রভাবশালী ক্যাথলিক ব্যক্তির নজরে পড়েছিল। তিনি তার গির্জার সঙ্গীদের একটা দল নিয়ে আমাদের সাপ্তাহিক বাইবেল অধ্যয়নের মাঝে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন এবং গ্রাম থেকে আমাদের বের করিয়ে দিয়েছিলেন। যখন আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, পরবর্তী সপ্তাহে আরও ঝামেলা হবে, তখন আমরা পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলাম।

সেই দিন বেশ কয়েক কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে উপহাসকারী ক্যাথলিকরা জড়ো হয়েছিল। অনেকেই আমাদেরকে পাথর মারতে প্রস্তুত ছিল। ইতিমধ্যে, একজন পাদরি গ্রামের মধ্যে কয়েকশো উপজাতি লোককে জড়ো করেছিলেন। পুলিশ আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, আমাদের সভা করার অধিকার রয়েছে, তাই তারা সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের জন্য একটা পথ করে দিয়েছিল। কিন্তু, আমাদের সভা শুরু হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই, সেই পাদরি জনতাকে উসকে দিয়েছিলেন। পুলিশ সেই বড় ভিড়কে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল; তাই, পুলিশ প্রধান আমাদেরকে সেই স্থান ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তাড়াতাড়ি করে আমাদের গাড়ির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

উত্তেজিত জনতা আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছিল, আমাদেরকে গালিগালাজ করছিল, থুতু দিচ্ছিল এবং তাদের মুষ্টি পাকাচ্ছিল আর এই সময়ে সেই পাদরি হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাসছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচার পর পুলিশ প্রধান স্বীকার করেছিলেন যে, এইরকম চরম অবস্থা তিনি আগে কখনো দেখেননি। যদিও ভুনাবেলের অধিকাংশ লোকই উচ্ছৃঙ্খল জনতার কারণে ভয় পেয়েছিল কিন্তু একজন বাইবেল ছাত্র সাহসের সঙ্গে রাজ্যের সত্যের পক্ষ নিয়েছিলেন। এরপর থেকে, পুরো নিউ ব্রিটেনে শত শত ব্যক্তি সত্যের পক্ষ নিয়েছে।

নিউ গিনিতে সুযোগের দ্বার খুলে যায়

১৯৬০ সালের নভেম্বর মাসে আমাদের আবারও মাডাংয়ে পাঠানো হয়েছিল, যেটা মূল দ্বীপ নিউ গিনির উত্তর উপকূলবর্তী এলাকার একটা বড় শহর। এখানে জন ও আমি পূর্ণসময়ের চাকরির অনেক প্রস্তাব পেয়েছিলাম। একটা কোম্পানি আমাকে তাদের পোশাকের দোকান দেখাশোনা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল। আরেকটা কোম্পানি চেয়েছিল আমি যেন তাদের পোশাকগুলো অল্টার করার কাজ করি। কিছু বিদেশি মহিলা এমনকি আমাকে আমার নিজস্ব দর্জির দোকান স্থাপন করে দেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য মনে রেখে, আমরা নম্রভাবে এগুলোসহ অন্যান্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।—২ তীমথিয় ২:৪.

মাডাংয়ের এলাকা ফলপ্রসূ ছিল এবং শীঘ্রই সেখানে একটা উন্নতশীল মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল। আমরা হেঁটে এবং মোটরবাইকে করে দূরবর্তী গ্রামগুলোতে প্রচার অভিযানের জন্য ভ্রমণ করেছিলাম, যা বেশ কয়েকদিন ধরে চলেছিল। পথের ধারে পরিত্যক্ত কুটিরগুলোতে আমরা ঝোপজঙ্গল থেকে কেটে আনা ঘাসের স্তূপের ওপর ঘুমাতাম। আমরা সঙ্গে করে কেবলমাত্র টিনজাত খাবার, বিস্কুট এবং একটা মশারি নিতাম।

একবার এক অভিযানে, আমরা মাডাংয়ের প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে টালিডিগ নামে একটা গ্রামে আগ্রহী ব্যক্তিদের একটা দলের কাছে গিয়েছিলাম। যখন সেই দলটি আধ্যাত্মিকভাবে অগ্রগতি করছিল, তখন স্থানীয় স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাদেরকে সরকারি জায়গায় বাইবেল অধ্যয়ন করতে নিষেধ করেছিলেন। পরে তিনি পুলিশকে তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলতে এবং তাদেরকে তাড়িয়ে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিতে উসকে দিয়েছিলেন। কিন্তু, পার্শ্ববর্তী এলাকার একজন প্রধান ব্যক্তি এই দলটিকে তার জায়গায় বাস করতে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই দয়ালু প্রধান ব্যক্তি, বাইবেলের সত্য গ্রহণ করেছিলেন এবং সেই এলাকায় আধুনিক ধরনের একটা কিংডম হল তৈরি করা হয়েছিল।

অনুবাদ এবং ভ্রমণ কাজ

১৯৫৬ সালে নিউ ব্রিটেনে পৌঁছানোর ঠিক দুবছর পর, জন ও আমাকে বাইবেলের বিভিন্ন প্রকাশনা মেলানিশিয়ান পিজিন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই কাজ বেশ কয়েক বছর ধরে অব্যাহত ছিল। এরপর ১৯৭০ সালে, আমাদেরকে পূর্ণসময়ের অনুবাদক হিসেবে সেবা করার জন্য পাপুয়া নিউ গিনির রাজধানী পোর্ট মোর্জবিতে অবস্থিত শাখা অফিসে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমরা সেখানে ভাষা শেখার ক্লাসগুলোতেও শিক্ষা দিতাম।

আমরা ১৯৭৫ সালে ভ্রমণ পরিচর্যায় সেবা করার জন্য আবারও নিউ ব্রিটেনে ফিরে গিয়েছিলাম। পরবর্তী ১৩ বছর আমরা প্লেনে করে, নৌকায় করে, গাড়িতে করে ও পায়ে হেঁটে সেই দেশের প্রায় প্রত্যেকটা জায়গায় গিয়েছিলাম। এই যাত্রা পথে আমাদের বহু ভীতিকর ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে এই প্রবন্ধের শুরুতে বর্ণিত ঘটনাটা অন্তর্ভুক্ত। সেই সময়ে, আমরা যখন নিউ ব্রিটেনের ক্যানড্রিয়ান বিমান অবতরণস্থলের নিকটবর্তী হচ্ছিলাম, তখন আমাদের পাইলট তার পাকস্থলীর প্রদাহের কারণে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। প্লেনটিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে আমরা অসহায়ভাবে জঙ্গলের ওপর ঘুরপাক খাচ্ছিলাম আর সেই সময়ে জন মরিয়া হয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া পাইলটের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছিল। অবশেষে, পাইলটের জ্ঞান ফিরে এসেছিল এবং তার দৃষ্টিশক্তি যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছিল, যার ফলে তিনি কোনোরকমে প্লেনটা নামাতে পেরেছিলেন। এরপর তিনি আবারও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।

কাজের আরেকটা দ্বার খুলে যায়

শাখা অফিসে অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ১৯৮৮ সালে আমাদেরকে পুনরায় পোর্ট মোর্জবিতে পাঠানো হয়েছিল। আমরা প্রায় ৫০ জন একটা পরিবার হিসেবে শাখা অফিসে থাকতাম এবং কাজ করতাম, যেখানে আমরা নতুন অনুবাদকদের প্রশিক্ষণও দিয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যেককে থাকার জন্য একটা করে ছোট রুম দেওয়া হয়েছিল। জন ও আমি আমাদের দরজা হালকা করে খুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাতে পরিবারের সদস্যরা এবং অতিথিরা আমাদের রুমের সামনে থামতে এবং পরিচিত হতে উৎসাহিত হয়। এভাবে আমরা আমাদের পরিবারের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম এবং একে অন্যকে যথেষ্ট ভালবাসা ও সমর্থন প্রদান করতে পেরেছিলাম।

এরপর, ১৯৯৩ সালে এক হার্ট আ্যটাকের কারণে জন মারা যায়। আমার মনে হয়েছিল যে, আমার একটা অঙ্গকে যেন বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা ৩৮ বছরের বিবাহিত জীবনের প্রায় পুরো সময়ই একত্রে পরিচর্যায় ব্যয় করেছিলাম। এরপরও আমি যিহোবার শক্তিতে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। (২ করিন্থীয় ৪:৭) আমার রুমের দরজা তখনও খোলাই থাকত আর অল্পবয়সিরা সবসময় আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত। এই ধরনের গঠনমূলক মেলামেশা আমাকে এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল।

২০০৩ সালে আমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে আমাকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শাখা অফিসে পুনরায় কার্যভার দেওয়া হয়। আজকে, ৭৭ বছর বয়সে আমি এখনও অনুবাদ বিভাগে পূর্ণসময়ের সেবা করছি আর প্রচার কাজেও ব্যস্ত থাকি। আমার বন্ধুবান্ধব এবং আধ্যাত্মিক ছেলেমেয়ে ও নাতিনাতনিরা আমাকে সবসময় আনন্দ দেয়।

বেথেলে আমার রুমের দরজা এখনও খোলা থাকে আর প্রায় প্রতিদিনই পরিদর্শকরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। বরং, আমার দরজা বন্ধ থাকলে লোকেরা প্রায়ই কড়া নেড়ে দেখে যায় যে, আমার কোনো সমস্যা হয়েছে কি না। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, আমার পরিচর্যা সম্পন্ন করার এবং আমার ঈশ্বর যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ থাকব।—২ তীমথিয় ৪:৫.

[পাদটীকাগুলো]

^ সেই সময়ে, দ্বীপের পূর্ব অংশ, দক্ষিণে পাপুয়া এবং উত্তরে নিউ গিনি হিসেবে বিভক্ত করা ছিল। আজকে, এই দ্বীপের পশ্চিম অংশকে বলা হয় পাপুয়া, যেটা ইন্দোনেশিয়ার একটা অংশ এবং পূর্ব অংশকে বলা হয় পাপুয়া নিউ গিনি।

^ জন কাটফর্থের জীবনকাহিনির জন্য ১৯৫৮ সালের ১লা জুন প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ৩৩৩-৬ পৃষ্ঠা দেখুন।

[১৮ পৃষ্ঠার মানচিত্রগুলো]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

নিউ গিনি

অস্ট্রেলিয়া

সিডনি

ইন্দোনেশিয়া

পাপুয়া নিউ গিনি

টালিডিগ

মাডাং

পোর্ট মোর্জবি

নিউ ব্রিটেন

রাবায়ুল

ভুনাবেল

ওয়াইড বে

ওয়াটারফল বে

[সৌজন্যে]

মানচিত্র এবং ভূ-গোলক: Based on NASA/Visible Earth imagery

[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

নিউ গিনির লেতে ১৯৭৩ সালে জনের সঙ্গে একটা সম্মেলনে

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

২০০২ সালে পাপুয়া নিউ গিনির শাখা অফিসে