সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আপনি অবিচারের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন!

আপনি অবিচারের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন!

আপনি অবিচারের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেন!

 এমন কেই বা রয়েছেন, যিনি তার জীবনে কোনো ধরনের অবিচার ভোগ করেননি? যদিও কিছু কিছু অবিচার সম্বন্ধে হয়তো কেবল মনে মনে উপলব্ধি বা কল্পনা করা হয় কিন্তু অন্যগুলো খুবই বাস্তব।

যখনই আমরা অবিচার ভোগ করি, তখনই আমরা কিছুটা আবেগগত কষ্ট বোধ করি আর এর ফলে হয়তো আধ্যাত্মিক ক্ষতিও ভোগ করতে পারি। আমাদের হয়তো পরিস্থিতি সংশোধন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। কেন? একটা কারণ হল যে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা যিহোবা ঈশ্বর “[যাঁহাতে] অন্যায়” বা অবিচার “নাই,” তিনি মানুষের মধ্যে দৃঢ় ন্যায়বিচারবোধ গেঁথে দিয়েছেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪; আদিপুস্তক ১:২৬) কিন্তু, আমরা হয়তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারি, যেখানে কোনো ন্যায়বিচার নেই বলে আমরা মনে করতে পারি। একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি একবার এই মন্তব্য করেছিলেন: “আমি ফিরিয়া, সূর্য্যের নীচে যে সকল উপদ্রব হয়, তাহা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। আর দেখ, উপদ্রুত লোকদের অশ্রুপাত হইতেছে, কিন্তু তাহাদের সান্ত্বনাকারী কেহ নাই; উপদ্রবী লোকদের হস্তে বল আছে, কিন্তু উপদ্রুত লোকদের সান্ত্বনাকারী কেহ নাই।” (উপদেশক ৪:১) তা হলে, কীভাবে আমরা অবিচারের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারি?

অবিচার বলতে আসলে কী বোঝায়?

অবিচার হল ন্যায়বিচারের মানগুলো লঙ্ঘন করার অবস্থা বা অভ্যাস। মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের মান কী হবে? স্পষ্টতই, আমাদের ধার্মিক এবং অপরিবর্তনীয় সৃষ্টিকর্তার কোনটা ন্যায় ও কোনটা অন্যায়, সেই বিষয়ে মান স্থাপন করার অধিকার রয়েছে। তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে “জীবনদায়ক বিধি-পথে” চলার অন্তর্ভুক্ত হল অবিচার বা ‘অন্যায় না করা।’ (যিহিষ্কেল ৩৩:১৫) তাই, যিহোবা যখন প্রথম মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তিনি তার মধ্যে এক সংবেদ বা বিবেক দিয়েছিলেন—ভিতরের এক স্বর দিয়েছিলেন, যা তাকে ভুল থেকে সঠিককে আলাদা করায় সাহায্য করতে পারত। (রোমীয় ২:১৪, ১৫) তা ছাড়া, যিহোবা তাঁর বাক্য বাইবেলে কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, সেই বিষয়ে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু আমরা যদি মনে করি যে, আমাদের প্রতি কোনো অবিচার করা হয়েছে, তা হলে? আসলেই অবিচার করা হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য বিষয়টা আমাদের নিরপেক্ষভাবে পরীক্ষা করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ইব্রীয় ভাববাদী যোনা যে-পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন, তা বিবেচনা করুন। যিহোবা তাকে নীনবীর লোকেদের কাছে আসন্ন বিপর্যয় সম্বন্ধে বলার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথমে যোনা তার কার্যভার পূর্ণ না করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, শেষপর্যন্ত তিনি নীনবীতে গিয়েছিলেন এবং আসন্ন ধ্বংস সম্বন্ধে অধিবাসীদের সতর্ক করেছিলেন। তারা অনুকূলভাবে সাড়া দেওয়ায় যিহোবা সেই নগর ও এর অধিবাসীদের রক্ষা করা বেছে নিয়েছিলেন। যোনা কেমন বোধ করেছিলেন? “ইহাতে যোনা মহা বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হইলেন।” (যোনা ৪:১) তিনি মনে করেছিলেন যে, যিহোবা এক চরম অবিচার করেছেন।

স্পষ্টতই, যিহোবা যিনি হৃদয় পড়তে পারেন এবং “ধার্ম্মিকতা ও ন্যায়বিচার ভালবাসেন,” তিনি ভুল ছিলেন না। (গীতসংহিতা ৩৩:৫) যোনাকে কেবল শিখতে হয়েছিল যে, যিহোবা যে-উপায়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেটা তাঁর নিখুঁত ন্যায়বিচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। আমরা যখন মনে করি যে, আমাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, তখন আমরা হয়তো নিজেদের জিজ্ঞেস করতে পারি, ‘এটা কি হতে পারে যে, যিহোবা বিষয়টা ভিন্নভাবে দেখবেন?’

অবিচারের মুখোমুখি হওয়া

বাইবেল এমন কয়েক জন ব্যক্তির বেশ কিছু ঘটনা সম্বন্ধে জানায়, যারা অবিচার ভোগ করেছিল। তারা কীভাবে তাদের কঠিন সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করেছিল, তা পরীক্ষা করার মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। যোষেফের কথা বিবেচনা করুন, যাকে তার ঈর্ষাপরায়ণ ভাইয়েরা মিশরে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছিল। মিশরে তার প্রভুর স্ত্রী তাকে যৌনসম্পর্ক করার জন্য প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন আর যখন তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, তখন তিনি অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগে যোষেফকে মিথ্যাভাবে অভিযুক্ত করেছিলেন। ফলস্বরূপ, যোষেফ কারাগারে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিশ্বাস, তাকে যে-লোহার বেড়ি দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল, সেটার চেয়ে দৃঢ় ছিল। এই অবিচারকে তিনি তার আধ্যাত্মিকতাকে দুর্বল করে দেওয়ার অথবা যিহোবার প্রতি তার নির্ভরতাকে হ্রাস করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ দেননি।—আদিপুস্তক ৩৭:১৮-২৮; ৩৯:৪-২০; গীতসংহিতা ১০৫:১৭-১৯.

আরেকজন ব্যক্তি যিনি অবিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন নাবোৎ। তিনি ইস্রায়েলের রাজা আহাবের স্ত্রী ঈষেবলের দ্বারা চরম অবিচারের শিকার হয়েছিলেন। রাজা প্রাসাদের পাশে নাবোতের পৈত্রিক জমি পাওয়ার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন। একজন ইস্রায়েলীয়র জন্য তার পৈত্রিক সম্পত্তি স্থায়ীভাবে দিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল, তাই নাবোৎ সেই জমি কেনার বিষয়ে রাজার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। (লেবীয় পুস্তক ২৫:২৩) এতে আহাবের দুষ্ট স্ত্রী মিথ্যা সাক্ষিদের ব্যবস্থা করেছিলেন, যারা নাবোৎকে ঈশ্বর ও রাজাকে নিন্দা করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। ফলস্বরূপ, নাবোৎ ও তার ছেলেদের হত্যা করা হয়েছিল। লোকেরা যখন তাকে হত্যা করার জন্য পাথর তুলছিল, তখন নাবোতের কেমন লেগেছিল, তা একটু কল্পনা করুন!—১ রাজাবলি ২১:১-১৪; ২ রাজাবলি ৯:২৬.

কিন্তু, খ্রিস্ট যিশুর ওপর যে-অবিচারগুলো আনা হয়েছিল, সেগুলোর তুলনায় পূর্ববর্তী ঘটনাগুলো কিছুই না। তাঁর মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে মিথ্যা বিবৃতি ও আইনবিরুদ্ধ বিচার জড়িত ছিল। বিচারাসনে অধিষ্ঠিত রোমীয় দেশাধ্যক্ষের সেই বিষয়কে সমর্থন করার নৈতিক শক্তি ছিল না, যেটাকে তিনি সঠিক বলে দেখেছিলেন। (যোহন ১৮:৩৮-৪০) হ্যাঁ, খ্রিস্ট যিশুর ওপর শয়তান এযাবৎ কালের সবচেয়ে বড় অবিচার নিয়ে এসেছিল!

এই ঘটনাগুলো কি ইঙ্গিত দেয় যে, যিহোবা অবিচারের প্রতি উদাসীন? না! যিহোবা সেই ঘটনাগুলোকে নিছক মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি। (যিশাইয় ৫৫:৮, ৯) যোষেফকে দাসত্বে বিক্রি করা হয়েছিল বলেই তিনি তার পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। একটা বড় দুর্ভিক্ষ তার পরিবারকে আঘাত করার আগেই তিনি মিশরের খাদ্য প্রশাসক হয়েছিলেন। একটু চিন্তা করুন, যিহোবা যদি অবিচার ঘটতে না দিতেন, তা হলে যোষেফ কারাগারে যেতেন না। সেখানেই তিনি দুজন সহবন্দির স্বপ্নের অর্থ ব্যাখ্যা করেছিলেন, যাদের মধ্যে একজন পরে ফরৌণকে যোষেফের বিষয়ে বলেছিলেন আর এর ফলে যোষেফ খাদ্য প্রশাসক হতে পেরেছিলেন।—আদিপুস্তক ৪০:১; ৪১:৯-১৪; ৪৫:৪-৮.

নাবোৎ সম্বন্ধে কী বলা যায়? আবারও, বিষয়টা যিহোবার মতো করে দেখার চেষ্টা করুন। যিহোবা, যিনি মৃতদের পুনরুত্থিত করতে পারেন, তাঁর স্মৃতিতে নাবোৎ জীবিত ছিলেন, এমনকি সেই সময়েও, যখন তার মৃতদেহ ভূমিতে পড়ে ছিল। (১ রাজাবলি ২১:১৯; লূক ২০:৩৭, ৩৮) নাবোৎকে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না যিহোবা তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনেন কিন্তু সেই অপেক্ষার সময়কাল ক্ষণিকের, কারণ মৃতেরা কিছুই জানে না। (উপদেশক ৯:৫) তা ছাড়া, যিহোবা আহাব ও তার পরিবারের ওপর বিচার নিয়ে আসার মাধ্যমে নাবোতের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।—২ রাজাবলি ৯:২১, ২৪, ২৬, ৩৫, ৩৬; ১০:১-১১; যোহন ৫:২৮, ২৯.

যিশুর ক্ষেত্রে, তিনি মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু, ঈশ্বর তাঁকে পুনরুত্থিত করেছিলেন এবং এমন এক অবস্থানে উচ্চীকৃত করেছিলেন, যা “সমস্ত আধিপত্য, কর্ত্তৃত্ব, পরাক্রম, ও প্রভুত্বের উপরে, এবং যত নাম . . . উল্লেখ করা যায় তৎসমুদয়ের উপরে।” (ইফিষীয় ১:২০, ২১) খ্রিস্ট যিশুর ওপর শয়তান যে-অবিচার নিয়ে এসেছিল, তা তাঁর পুত্রকে পুরস্কৃত করা থেকে যিহোবাকে বিরত করতে পারেনি। যিশুর এই আস্থা ছিল যে, যিহোবা বেআইনিভাবে গ্রেপ্তার করার অবিচারকে তৎক্ষণাৎ দূর করতে পারতেন, যদি সেটা তাঁর ইচ্ছা হতো। কিন্তু, খ্রিস্ট এটাও জানতেন যে, শাস্ত্রের পরিপূর্ণতা করার ও সেইসঙ্গে যেকোনো অবিচার দূর করার জন্য যিহোবার একটা সময় রয়েছে।

এটা ঠিক যে, শয়তান ও তার প্রতিনিধিরা ধার্মিক ব্যক্তিদের ওপর অবিচার নিয়ে এসেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত যিহোবা বিষয়টা সংশোধন করেছিলেন এবং স্থায়ীভাবে অবিচার দূর করেছিলেন বা দূর করবেন। তাই, একটা অবিচারের প্রতিকার করার জন্য আমাদের অবশ্যই ঈশ্বরের অপেক্ষা করতে হবে।—দ্বিতীয় বিবরণ ২৫:১৬; রোমীয় ১২:১৭-১৯.

যেকারণে যিহোবা হয়তো অবিচার থাকার অনুমতি দেন

একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিকে সংশোধন না করার পিছনে যিহোবার হয়তো কিছু কারণও থাকতে পারে। আমাদের খ্রিস্টীয় প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে তিনি হয়তো আমাদেরকে অবিচার ভোগের অনুমতি দিতে পারেন। অবশ্য, ‘মন্দ বিষয়ের দ্বারা ঈশ্বর কাহারও পরীক্ষা করেন না।’ (যাকোব ১:১৩) তা সত্ত্বেও, তিনি হয়তো তাঁর হস্তক্ষেপ ছাড়াই একটা পরিস্থিতিকে বৃদ্ধি পেতে দিতে পারেন এবং যারা এই ধরনের প্রশিক্ষণের প্রতি সাড়া দেয়, তাদেরকে শক্তি প্রদান করতে পারেন। “তোমাদের ক্ষণিক দুঃখভোগের পর,” বাইবেল আমাদের আশ্বাস দেয়, ‘সমস্ত অনুগ্রহের ঈশ্বর আপনি তোমাদিগকে পরিপক্ক [“তোমাদের প্রশিক্ষণের শেষ আনবেন,” NW], সুস্থির, সবল, বদ্ধমূল করিবেন।’—১ পিতর ৫:১০.

অধিকন্তু, যিহোবা একটা নির্দিষ্ট অবিচারকে থাকতে অনুমতি দেওয়ায় অপরাধীরা হয়তো অনুতপ্ত হওয়ার সময় পায়। যিশুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর, পিতরের পরামর্শ শুনেছিল এমন কিছু যিহুদির “হৃদয়ে যেন শেল-বিদ্ধ হইল।” তারা সানন্দে ঈশ্বরের বাক্যকে গ্রহণ করেছিল এবং বাপ্তিস্ম নিয়েছিল।—প্রেরিত ২:৩৬-৪২.

এটা ঠিক যে, অবিচার করে থাকে এমন সকলেই অনুতপ্ত হবে না। কেউ কেউ হয়তো এমনকি আরও চরম অবিচারগুলো করার ক্ষেত্রে সাহসী হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু, হিতোপদেশ ২৯:১ পদ বলে: “যে পুনঃ পুনঃ অনুযুক্ত হইয়াও ঘাড় শক্ত করে, সে হঠাৎ ভাঙ্গিয়া পড়িবে, তাহার প্রতীকার হইবে না।” বস্তুতপক্ষে, যিহোবা পরিশেষে পদক্ষেপ নেবেন এবং যারা অনুপযুক্ত আচরণ করেই চলে, তাদের ধ্বংস করবেন।—উপদেশক ৮:১১-১৩.

অবিচার কাটিয়ে উঠতে যতটুকু সময়ই লাগুক না কেন, আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে হবে, সেটা যিহোবা জানেন। আর এই মন্দ বিধিব্যবস্থায় আমরা হয়তো যে-অবিচারই ভোগ করি না কেন, তিনি তা দূর করবেনই। অধিকন্তু, তিনি আমাদের এক চূড়ান্ত পুরস্কার দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছেন আর তা হল সেই নতুন জগতে অনন্তজীবন, যেখানে “ধার্ম্মিকতা বসতি করে।”—২ পিতর ৩:১৩.

[১৬, ১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

নাবোৎ যখন ভয়ানক অবিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন তার কেমন লেগেছিল?