সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমি যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে শিখেছি

আমি যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে শিখেছি

জীবনকাহিনি

আমি যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে শিখেছি

বলেছেন অব্রি বাক্সটার

১৯৪০ সালের এক শনিবার বিকেলে দুজন লোক আমাকে আক্রমণ করে, এত জোরে আঘাত করে যে, আমি মাটিতে পড়ে যাই। দুজন পুলিশ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু সাহায্য করার পরিবর্তে তারা আমাকেই গালিগালাজ করে এবং সেই আক্রমণকারীদের প্রশংসা করে। আমার জীবনের যে-ঘটনাগুলো এই নিষ্ঠুর ব্যবহারের দিকে পরিচালিত করেছিল, সেগুলো প্রায় আরও পাঁচ বছর আগে শুরু হয়েছিল, যখন কিনা আমি একটা কয়লার খনিতে চাকরি করতাম। আসুন আপনাদের সেই বিষয়েই বলি।

 চার ছেলের মধ্যে আমি ছিলাম তৃতীয়। ১৯১৩ সালে, অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটা উপকূলবর্তী শহর সুয়ানসিতে আমার জন্ম হয়েছিল। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন আমাদের পুরো পরিবার ভয়াবহ স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিল, যে-রোগটা পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। আনন্দের বিষয় যে, আমরা সকলেই রক্ষা পেয়েছিলাম। কিন্তু ১৯৩৩ সালে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, যখন ৪৭ বছর বয়সে মা মারা যান। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ মহিলা ছিলেন আর তার কাছে আগে থেকেই যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা বিতরিত বাইবেল অধ্যয়ন সহায়ক, জ্যাতি (ইংরেজি) নামক দুই খণ্ডের বইটি ছিল।

সেই সময়ে, আমি একটা কয়লার খনিতে কাজ করতাম। আমার কাজের ধরনের কারণে কিছু সময়ের জন্য আমি কর্মব্যস্ত থাকতাম কিন্তু পরে তেমন কাজ থাকত না আর তাই আমি সেই বইগুলো কাজের জায়গায় নিয়ে যেতাম এবং আমার হেলমেটের সঙ্গে সংযুক্ত কার্বাইড ল্যাম্পের আলোর সাহায্যে সেগুলো পড়তাম। শীঘ্রই আমি উপলব্ধি করি যে, আমি সত্য খুঁজে পেয়েছি। এ ছাড়া, আমি সাক্ষিদের দ্বারা রেডিওতে সম্প্রচারিত বাইবেলের বক্তৃতাগুলোও শুনতে শুরু করি। আমার আনন্দ আরও বৃদ্ধি পায়, কারণ বাবা এবং সেইসঙ্গে আমার ভাইয়েরা সকলেই বাইবেলের সত্যের প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করে।

১৯৩৫ সালে আবারও এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, যখন আমার ছোট ভাই বিলি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তার বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু, এবার আমাদের পরিবার পুনরুত্থানের আশার দ্বারা সান্ত্বনা লাভ করে। (প্রেরিত ২৪:১৫) পরবর্তী সময়ে, বাবা এবং আমার দাদা ভারনার ও হ্যারল্ড আর সেইসঙ্গে তাদের দুজনের স্ত্রী ঈশ্বরের কাছে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। আমার নিজের পরিবারের মধ্যে কেবলমাত্র আমিই এখনও পর্যন্ত বেঁচে আছি। তবে, ভারনারের স্ত্রী মার্জরি এবং হ্যারল্ডের স্ত্রী এলিজাবেথ এখনও সক্রিয়ভাবে যিহোবার সেবা করে চলেছে।

যিহোবার ওপর নির্ভর করতে শেখা

যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে পরে আমার প্রথম সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল ১৯৩৫ সালে, যখন ইউক্রেনের একজন মহিলা একটা সাইকেলে চড়ে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। পরের রবিবার, আমি প্রথমবারের মতো খ্রিস্টীয় সভাতে উপস্থিত হয়েছিলাম এবং এক সপ্তাহ পর আমি ক্ষেত্রের পরিচর্যার জন্য দলে যোগদান করেছিলাম। যে-সাক্ষি ক্ষেত্রের পরিচর্যার জন্য সভা পরিচালনা করেছিলেন, তিনি আমাকে কয়েকটি পুস্তিকা দিয়েছিলেন এবং অবাক করে দিয়ে আমাকে একাই পরিচর্যায় পাঠিয়েছিলেন! প্রথম দরজায় আমি এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে, আমি চেয়েছিলাম যেন মাটি দুভাগ হয়ে যায় আর আমাকে গ্রাস করে! কিন্তু, গৃহকর্তা হাসিখুশি ছিলেন আর এমনকি তিনি সাহিত্যাদি নিয়েছিলেন।

উপদেশক ১২:১ এবং মথি ২৮:১৯, ২০ পদের মতো শাস্ত্রপদগুলো আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল আর আমি একজন অগ্রগামী বা পূর্ণসময়ের পরিচারক হতে চেয়েছিলাম। বাবা আমার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন। যদিও আমি তখনও বাপ্তিস্ম নিইনি কিন্তু আমি ১৯৩৬ সালের ১৫ই জুলাই থেকে এই কাজ শুরু করব বলে স্থির করেছিলাম। সেই দিন, আমি সিডনিতে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে গিয়েছিলাম, যেখানে আমাকে সিডনির উপকণ্ঠে ডুলিজ হিলে ১২ জন অগ্রগামীর একটা দলের সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তারা আমাকে হাতে চালিত গম ভাঙানোর একটা যন্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখিয়েছিল, যেটা অগ্রগামীরা ময়দা তৈরি করার সময় ব্যবহার করত আর এভাবে খাবারের খরচ কমাতে পারত।

বন্য, অনাবাদী এলাকায় অগ্রগামীর কাজ করা

পরবর্তীতে সেই বছরেই বাপ্তিস্ম নেওয়ার পর, আমাকে অন্য দুজন অগ্রগামীর সঙ্গে—অব্রি উইল্‌স এবং ক্লাইভ শেডের সঙ্গে—মধ্য কুইন্সল্যান্ডে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। আমাদের জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল অব্রির ভ্যান গাড়ি, কয়েকটা সাইকেল, বাইবেলের বক্তৃতাগুলো সম্প্রচারের জন্য বহনযোগ্য একটা ফোনোগ্রাফ, একটা তাঁবু যেটা পরবর্তী তিন বছরের জন্য আমাদের ঘরে পরিণত হয়েছিল, তিনটে বিছানা, একটা টেবিল এবং রান্না করার জন্য লোহার একটা পাত্র। একদিন সন্ধ্যায় আমার রান্না করার পালা ছিল আর আমি ভেবেছিলাম যে, আমি শাকসবজি ও গমের আটা দিয়ে একটা “বিশেষ” খাবার তৈরি করব। কিন্তু, আমাদের মধ্যে কেউই তা খেতে পারেনি। সেই সময়ে সেখানে কাছাকাছি একটা ঘোড়া ছিল আর তাই আমি সেই ঘোড়াকেই খাবারটা খেতে দিয়েছিলাম। ঘোড়াটাও গন্ধ শুঁকে নাক সিটকায়, মাথা ঝাঁকায় এবং সেখান থেকে চলে যায়! এর ফলে আমার রান্নাবান্না সম্পর্কিত পরীক্ষানিরীক্ষা সেখানেই শেষ হয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে, আমরা আমাদের এলাকা শেষ করার জন্য প্রচার কাজের গতি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর তাই এলাকাকে তিনটে অংশে ভাগ করেছিলাম এবং প্রত্যেকে এক একটা অংশে কাজ করেছিলাম। দিনের শেষে, আমি প্রায়ই আমাদের তাঁবু থেকে অনেক দূরে চলে যেতাম এবং কখনো কখনো গ্রামের অতিথিপরায়ণ লোকেদের সঙ্গে রাতে থেকে যেতাম। একবার আমি একটা খামার বাড়ির অতিথিশালার এক আরামদায়ক বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম কিন্তু পরবর্তী রাতে একজন ক্যাঙারু শিকারির কুঁড়েঘরের নোংরা মেঝেতে শুয়েছিলাম, যার আশেপাশে চামড়ার স্তূপের অসহনীয় দুর্গন্ধ ছিল। আমি প্রায়ই জঙ্গলের মধ্যে ঘুমিয়েছি। একবার, অনেকগুলো ডিঙ্গো (বন্য কুকুর) বেশ দূরে থেকে আমাকে ঘিরে ছিল, গভীর অন্ধকারে এদের আতঙ্কজনক চিৎকার শোনা গিয়েছিল। নির্ঘুম একটা রাতের পর, আমি জানতে পেরেছিলাম যে, সেই কুকুরগুলো আমার প্রতি নয় বরং কাছাকাছি আবর্জনা ফেলার জায়গায় উচ্ছিষ্ট অংশের প্রতি আগ্রহী ছিল।

সাউন্ড কার নিয়ে প্রচার করা

ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে ঘোষণা করার জন্য আমরা একটা সাউন্ড কারের সদ্ব্যবহার করেছিলাম। উত্তর কুইন্সল্যান্ডের টাউন্সভিল শহরে, পুলিশ আমাদেরকে শহরের কেন্দ্রে এটা ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করেছিল। কিন্তু, এই রেকর্ডকৃত বক্তৃতা সালভেশন আর্মি নামে ধর্মীয় দলের কিছু সদস্যকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল, যারা আমাদেরকে সেই এলাকা পরিত্যাগ করতে বলেছিল। যখন আমরা তাদের কথা শুনতে অসম্মত হয়েছিলাম, তখন তাদের মধ্যে পাঁচজন আমাদের ভ্যান গাড়িকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়েছিল। সেই সময়ে আমি গাড়ির ভিতরে ছিলাম, সাউন্ডের যন্ত্রপাতি পরিচালনা করছিলাম! এই ক্ষেত্রে আমাদের অধিকারগুলোর ওপর জোর খাটানো অবিবেচনাপূর্ণ হবে বলে মনে হয়েছিল আর তাই লোকেরা যখন কিছুটা ক্ষান্ত হয়েছিল, তখন আমরা সেই এলাকা পরিত্যাগ করেছিলাম।

বুন্ডাবার্গ শহরে একজন আগ্রহী ব্যক্তি আমাদেরকে একটা নৌকা ধার দিয়েছিলেন, যাতে আমরা বারনেট নদী থেকে বক্তৃতাগুলো সম্প্রচার করতে পারি, যেটা শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে। অব্রি এবং ক্লাইভ যখন সাউন্ডের যন্ত্রপাতিসহ নৌকায় যাত্রা করেছিল, তখন আমি আমাদের ভাড়া করা হলে ছিলাম। সেই রাতে, যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় থেকে জোসেফ এফ. রাদারফোর্ডের রেকর্ডকৃত অত্যন্ত গুরুগম্ভীর স্বর বুন্ডাবার্গ জুড়ে শোনা গিয়েছিল, এক জোরালো বাইবেলের বার্তা ঘোষণা করা হয়েছিল। এটা নিশ্চিত যে, তখনকার সময় রোমাঞ্চকর ছিল, যে-সময়ে ঈশ্বরের লোকেদের জন্য সাহস ও বিশ্বাস আবশ্যক ছিল।

যুদ্ধ আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আসে

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই, প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ১লা নভেম্বর সংখ্যায় রাজনীতি ও যুদ্ধের প্রতি খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতার বিষয় আলোচনা করা হয়েছিল। আমি আনন্দিত হয়েছিলাম কারণ সেই সময়োপযোগী বিষয় পরে আমার জন্য বেশ উপকারী হয়েছিল। ইতিমধ্যে, তিন বছর একত্রে থাকার পর অব্রি, ক্লাইভ এবং আমি ভিন্ন ভিন্ন কার্যভার লাভ করেছিলাম। আমাকে উত্তর কুইন্সল্যান্ডে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল, এমন এক কার্যভার, যা প্রায়ই যিহোবার ওপর আমার নির্ভরতাকে পরীক্ষায় ফেলেছিল।

১৯৪০ সালের আগস্ট মাসে, আমি টাউন্সভিলের মণ্ডলীতে সেবা করেছিলাম, যেখানে চারজন অগ্রগামী ছিল—পারসি ও ইলমা ইজলব * আর নরম্যান ও বিট্রিস বিলটি, যারা আপন ভাইবোন ছিল। ছয় বছর পর, বিট্রিসকে আমি বিয়ে করেছিলাম। এক শনিবার বিকেলে, আমাদের একটা দল রাস্তায় সাক্ষ্যদান শেষ করার পর, শুরুতে বর্ণিত সেই আক্রমণের ঘটনাটা ঘটেছিল। কিন্তু, এই অবিচার যিহোবার সেবায় আমাকে কেবল উদ্দীপিতই করেছিল।

ইউনা এবং মার্ল কিলপ্যাট্রিক নামে দুজন অগ্রগামী বোন উত্তরাঞ্চলে উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করছিল। আমি পরিচর্যায় তাদের সঙ্গে এক আনন্দদায়ক দিন অতিবাহিত করেছিলাম আর তখন তারা আমাকে নৌকা বেয়ে একটা নদী পার করে তাদেরকে একটা আগ্রহী পরিবারের ঘরে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিল। এর মানে ছিল, অন্যপারে নোঙ্গর করা একটা দাঁড় টানা নৌকার কাছে সাঁতার কেটে যাওয়া, দাঁড় বেয়ে সেটাকে এপারে নিয়ে আসা আর এরপর বোনদের নিয়ে পার হওয়া। কিন্তু, যখন আমি নৌকার কাছে পৌঁছেছিলাম, তখন দেখেছিলাম যে এর দাঁড়গুলো নেই! পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম, একজন বিরোধী ব্যক্তি সেগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু, তার কৌশল আমাদেরকে থামাতে পারেনি। আমি অনেক বছর ধরে উদ্ধারকারী এক দক্ষ সাঁতারু ছিলাম আর তখন পর্যন্ত চমৎকার সাঁতার কাটতে পারতাম। তাই, আমি নোঙ্গরের দড়িটা আমার কোমরের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে নৌকাটা বোনদের কাছে টেনে এসেছিলাম এবং তাদেরকে আবার টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম। যিহোবা আমাদের প্রচেষ্টাগুলোতে আশীর্বাদ করেছিলেন, কারণ পরে সেই আগ্রহী পরিবার সাক্ষি হয়েছিল।

যিহোবার সুরক্ষার অধীনে

নিরাপত্তাজনিত কারণে সেনাবাহিনী ইনিসফেল শহরে প্রবেশের আগে ব্যারিকেড স্থাপন করেছিল। যেহেতু আমার ঘর এই ব্যারিকেড দেওয়া এলাকার মধ্যে ছিল, তাই আমি ঢোকার অনুমতি পেয়েছিলাম আর তা খুবই উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছিল, যখন যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিস থেকে প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করতে আসত। ব্যারিকেডের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি তাদেরকে আমার গাড়ির পিছনের আসনের নীচে গোপন কক্ষে লুকিয়ে রাখতাম।

সেই সময়ে গাড়ির পেট্রল রেশন কার্ড দিয়ে নিতে হতো আর অনেক গাড়ি তখন গ্যাস উৎপাদক যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত ছিল। ইঞ্জিনে জ্বালানি জোগানোর জন্য সেই যন্ত্র উত্তপ্ত কাঠকয়লা থেকে দাহ্য গ্যাস উৎপন্ন করত। আমি রাতের বেলা কাঠকয়লা বোঝাই ব্যাগগুলো গাড়ির সেই কক্ষে নিয়ে যাত্রা করতাম, যেখানে ভাই লুকিয়ে থাকতেন। যখন ব্যারিকেডে থামতে হতো, তখন আমি গাড়ির ইঞ্জিন জোরে চালু রেখে রক্ষীদের বিক্ষিপ্ত করতাম এবং নিশ্চিত করতাম যে, কাঠকয়লার চোঙা প্রচণ্ড গরম। “যদি আমি মোটর বন্ধ করি,” একবার এক রাতে আমি রক্ষীদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেছিলাম, “তা হলে গ্যাস-বায়ুর মিশ্রণে সমস্যা হবে আর পুনরায় গাড়ি চালু করা কঠিন হয়ে যাবে।” গাড়ির তাপ, শব্দ এবং নির্গত ধোঁয়ার কালির কারণে রক্ষীরা বিরক্ত হয়ে গাড়ির তল্লাশি দ্রুত শেষ করে আমাকে যেতে দিয়েছিল।

সেই সময়ে, আমাকে টাউন্সভিলের স্থানীয় সাক্ষিদের জন্য একটা সম্মেলনের অয়োজন করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। খাবার রেশন কার্ডের মাধ্যমে দেওয়া হতো আর আমাদের যে-পরিমাণ দরকার ছিল, সেটা পাওয়ার জন্য স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হতো। সেই সময়ে, আমাদের খ্রিস্টান ভাইয়েরা তাদের নিরপেক্ষতার জন্য কারারুদ্ধ হচ্ছিল। তাই, আমি যখন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় নির্ধারণ করেছিলাম, তখন আমি চিন্তা করেছিলাম যে, ‘আমি কি বিজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছি, নাকি আমি একটা বাঘকে উত্তেজিত করতে যাচ্ছি?’ যাই হোক, নির্দেশনা অনুযায়ী আমি সেখানে গিয়েছিলাম।

একটা জমকালো ডেস্কের পিছনে বসে ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে বসতে বলেছিলেন। যখন আমি তাকে আমার সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলেছিলাম, তখন তিনি অনমনীয় হয়ে গিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ সময় আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এরপর তিনি নমনীয় হয়ে বলেছিলেন, “আপনার কী পরিমাণ খাবার দরকার?” আমি তার হাতে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ন্যূনতম পরিমাণের একটা তালিকা দিয়েছিলাম। তিনি সেটা ভালমতো দেখে বলেছিলেন: “এটা অপর্যাপ্তই মনে হচ্ছে। আমাদের কাছে দ্বিগুণের চাইতেও বেশি রয়েছে।” আমি তার অফিস থেকে বের হয়ে এসে যিহোবার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম, যিনি আমাকে নির্ভরতার বিষয়ে আরেকটা শিক্ষা দিয়েছেন।

১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে অস্ট্রেলিয়াতে যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অনেক লোক আমাদেরকে সন্দেহ করতে থাকে আর এমনকি আমাদেরকে জাপানের গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করে! একবার, দুই গাড়ি ভর্তি পুলিশ এবং সৈন্য এসে কিংডম ফার্মে ঢুকে পড়ে, যেটা আথারটন মালভূমির অংশ ছিল এবং খাদ্য উৎপাদনের জন্যই এই জমি ক্রয় করা হয়েছিল। তারা একটা সার্চলাইট খুঁজছিল, যেটা শত্রুদেরকে সংকেত দেওয়ার জন্য আমরা ব্যবহার করি বলে, তারা মনে করেছিল। এ ছাড়া, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে, আমরা এমনভাবে ভুট্টা রোপণ করি, যাতে সেটা প্লেন থেকে বোঝার জন্য একটা সংকেত হিসেবে কাজ করে! অবশ্য, এই সমস্ত অভিযোগই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।

নিষেধাজ্ঞার কারণে সাহিত্যাদি বিলি করার সময় আমাদেরকে সতর্ক—এবং উদ্ভাবনকুশল—হতে হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন সন্তান (ইংরেজি) বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল, তখন আমি ব্রিসবেন থেকে এক কার্টন বই নিয়ে ট্রেনে করে উত্তরাঞ্চলে যাত্রা করেছিলাম এবং যেখানেই ট্রেন থেমেছিল, সেখানে কোনো মণ্ডলী থাকলে সেই জায়গায় বইগুলো ছেড়ে গিয়েছিলাম। পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর পরিদর্শকদের বইয়ের কার্টন খোলায় নিরুৎসাহিত করার জন্য আমি একটা যন্ত্রচালিত বৃত্তাকার করাত সঙ্গে নিতাম এবং ট্রেন থেকে নামার আগে বাক্সের সঙ্গে সেটা বেঁধে দিতাম। যদিও সাধারণ বিষয়, তবুও এই কৌশল কখনো ব্যর্থ হয়নি। যিহোবার লোকেদের যথেষ্ট স্বস্তি দিয়ে ১৯৪৩ সালের জুন মাসে নিষেধাজ্ঞা—যেটাকে আদালতের একজন বিচারক “অযৌক্তিক, খেয়ালি এবং পীড়নকর বলে বর্ণনা করেছিলেন, তা—তুলে নেওয়া হয়েছিল।

সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আহ্বান করা হয়

এর আগের বছর, অব্রি উইল্‌স, নরম্যান বিলটি এবং আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছিল। অব্রি এবং নরম্যান, আমার এক সপ্তাহ আগে বিচারকের সামনে হাজির হয়েছিল, তাদেরকে ছয় মাসের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। সেই সময়ে, পোস্ট অফিস পরিচিত সাক্ষিদের ঠিকানায় পাঠানো প্রহরীদুর্গ পত্রিকাগুলো বাজেয়াপ্ত করত কিন্তু গ্রাহকদের কাছে পাঠানো পত্রিকাগুলো করত না। আমাদের কার্যভার ছিল এই ধরনের একজন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা, সেই পত্রিকাগুলো কপি করা এবং সহবিশ্বাসীদের মাঝে সেই কপিগুলো বিতরণ করা। এভাবে আমরা নিয়মিত আধ্যাত্মিক খাবার লাভ করেছিলাম।

যখন আমাকেও সেই ছয় মাসের শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল যেটার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম, তখন সঙ্গে সঙ্গেই আমি আপিল করেছিলাম, যা করার জন্য আমাকে সিডনির শাখা অফিস থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ একজন কাজের দেখাশোনা করার জন্য নিযুক্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ কারাভোগকে বিলম্বিত করা। আমি উত্তর কুইন্সল্যান্ডে কারারুদ্ধ ২১ জন সাক্ষির মধ্যে কয়েক জনের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমার সেই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করেছিলাম। অধিকাংশই একটা কারাগারেই ছিল এবং সেখানকার কারারক্ষক আমাদের অপছন্দ করতেন। যখন আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, অন্য ধর্মের পরিচারকরাও তাদের লোকেদের সঙ্গে দেখা করতে পারে, তখন তিনি রেগে গিয়েছিলেন। “যদি আমার ক্ষমতা থাকত,” তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, “তা হলে, আমি সমস্ত যিহোবার সাক্ষিকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করতাম!” রক্ষীরা আমাকে দ্রুত সেখান থেকে বের করে দিয়েছিল।

যখন আমার আপিলের শুনানির সময় এসেছিল, তখন আমার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু, বাস্তবে আমার নিজের মামলা আমিই পরিচালনা করেছিলাম, যার অর্থ যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা। এর ফলে, তিনি আমাকে নিরাশ করেননি। (লূক ১২:১১, ১২; ফিলিপীয় ৪:৬, ৭) আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সেই আপিল সফল হয়েছিল কারণ ক্লার্ক চার্জশিট পূরণ করায় কিছু ভুল করেছিলেন!

১৯৪৪ সালে, আমাকে পুরো দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনি শহরের এক বিশাল সীমায় কাজ করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। পরের বছর, পৃথিবীব্যাপী জনসাধারণ্যে বক্তৃতা দেওয়ার এক অভিযান শুরু করা হয়েছিল এবং প্রত্যেক বক্তাকে সংগঠনের দেওয়া এক পৃষ্ঠার আউটলাইনের ওপর ভিত্তি করে তার নিজের বক্তৃতার বিষয়বস্তু তৈরি করতে হয়েছিল। এক ঘন্টার বক্তৃতা দেওয়া এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে এসেছিল কিন্তু আমরা যিহোবার ওপর পূর্ণ নির্ভরতা রেখে কাজ করেছিলাম আর তিনি আমাদের প্রচেষ্টাগুলোতে আশীর্বাদ করেছিলেন।

বিয়ে এবং নতুন নতুন দায়িত্ব

১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে বিট্রিস বিলটি এবং আমি বিয়ে করি আর আমরা একত্রে অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি। একটা কাঠের তৈরি ভ্রাম্যমাণ গাড়ি অথবা ট্রেলারই ছিল আমাদের ঘর। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমাদের একমাত্র মেয়ে জেনিস (জেন) জন্মগ্রহণ করে। আমরা নিউ সাউথ ওয়েলসের কেম্প্‌সি শহরসহ অনেক জায়গায় অগ্রগামীর কাজ করি, যেখানে শুধুমাত্র আমরাই সাক্ষি ছিলাম। প্রত্যেক রবিবার আমরা একটা স্থানীয় কমিউনিটি হলে যেতাম এবং আমি জনসাধারণ্যে একটা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তৈরি থাকতাম, যেটার বিষয় আমরা ইস্তাহারের মাধ্যমে ঘোষণা করতাম। কয়েক মাস, কেবলমাত্র বিট্রিস এবং ছোট্ট জেনই আমার শ্রোতা ছিল। কিন্তু শীঘ্রই, ধীরে ধীরে অন্যেরাও আসতে শুরু করে। আজকে কেম্প্‌সিতে বৃদ্ধিরত দুটো মণ্ডলী রয়েছে।

জেনের বয়স যখন দুবছর, তখন আমরা ব্রিসবেনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করি। এরপর সে যখন তার স্কুল শেষ করে, তখন বিট্রিসের অসুস্থ মাকে সাহায্য করার জন্য পুনরায় ব্রিসবেনে ফিরে আসার আগে আমরা পরিবারগতভাবে নিউ সাউথ ওয়েলসের সেসনক শহরে চার বছর অগ্রগামীর কাজ করি। বর্তমানে আমার চার্মসাইড মণ্ডলীতে একজন প্রাচীন হিসেবে সেবা করার বিশেষ সুযোগ রয়েছে।

বিট্রিস এবং আমি যিহোবাকে তাঁর অগণিত আশীর্বাদের জন্য ধন্যবাদ দিই, যার অন্তর্ভুক্ত ৩২ জন লোককে তাঁকে জানতে সাহায্য করার জন্য বিশেষ সুযোগ। ব্যক্তিগতভাবে আমি যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই আমার প্রিয় স্ত্রীর জন্য, যে যদিও শান্ত ও নম্র কিন্তু বাইবেলের সত্যের পক্ষে এক নির্ভীক যোদ্ধা হয়ে এসেছে। ঈশ্বরের জন্য তার ভালবাসা, তাঁর ওপর নির্ভরতা এবং তার ‘সরল চক্ষু’ তাকে সত্যিই একজন যোগ্য স্ত্রী ও মা করে তুলেছে। (মথি ৬:২২, ২৩; হিতোপদেশ ১২:৪) তার সঙ্গে আমিও আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে বলতে পারি: “ধন্য সেই ব্যক্তি, যে সদাপ্রভুতে [“যিহোবাতে,” NW] নির্ভর করে।”—যিরমিয় ১৭:৭.

[পাদটীকা]

^ পারসি ইজলবের জীবনকাহিনি এই পত্রিকার ১৯৮১ সালের ১৫ই মে (ইংরেজি) সংখ্যায় পাওয়া যায়।

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমরা উত্তর কুইন্সল্যান্ডে এই সাউন্ড কারটা ব্যবহার করতাম

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

উত্তর কুইন্সল্যান্ডে বর্ষার সময় কিলপ্যাট্রিক বোনদের তাদের গাড়ি সরাতে সহায়তা করা

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের বিয়ের দিন