সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

‘নম্রতা পরিধান করুন’

‘নম্রতা পরিধান করুন’

‘নম্রতা পরিধান করুন’

 তিনি এক বিখ্যাত শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। একজন রোমীয় নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করার পদমর্যাদা তার ছিল আর সম্ভবত তিনি এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। সেই ব্যক্তি ছিলেন শৌল যিনি সা.কা. প্রথম শতাব্দীতে সেই সময়ের সর্বোত্তম শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি অন্ততপক্ষে দুটো ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং ফরীশী নামক এক সুপরিচিত যিহুদি ধর্মীয় দলের সদস্য ছিলেন।

শৌল নিশ্চয়ই সাধারণ লোকেদের ছোট করে দেখতে এবং তার নিজের ধার্মিকতা নিয়ে গর্ব করতে শিখেছিলেন। (লূক ১৮:১১, ১২; প্রেরিত ২৬:৫) শৌলের সহফরীশীরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে মনে করত এবং বিশিষ্টতা ও তোষামোদকারী উপাধি ভালবাসত। (মথি ২৩:৬, ৭; লূক ১১:৪৩) এই ধরনের লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করা সম্ভবত শৌলকে উদ্ধত করে তুলেছিল। আমরা জানি যে, তিনি খ্রিস্টানদের তাড়না করার ব্যাপারে উদ্যোগী ছিলেন। কিছু বছর পরে, যখন তিনি প্রেরিত পৌল বলে পরিচিত হয়েছিলেন, তখন তিনি নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন যে, তিনি একজন “ধর্ম্মনিন্দক, তাড়নাকারী ও অপমানকারী” ছিলেন।—১ তীমথিয় ১:১৩.

হ্যাঁ, শৌল একজন খ্রিস্টান, প্রেরিত পৌলে পরিণত হয়েছিলেন আর তার ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়েছিল। একজন খ্রিস্টান প্রেরিত হিসেবে, নম্রতার সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি “সমস্ত পবিত্রগণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্রতম” ছিলেন। (ইফিষীয় ৩:৮) তিনি একজন সফল সুসমাচার প্রচারক ছিলেন কিন্তু এর জন্য তিনি নিজে কোনো কৃতিত্ব নেননি। পরিবর্তে, তিনি ঈশ্বরকে সমস্ত গৌরব দিয়েছিলেন। (১ করিন্থীয় ৩:৫-৯; ২ করিন্থীয় ১১:৭) পৌলই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি সহখ্রিস্টানদের উপদেশ দিয়েছিলেন: “করুণার চিত্ত, মধুর ভাব, নম্রতা, মৃদুতা, সহিষ্ণুতা পরিধান কর।”—কলসীয় ৩:১২.

এই উপদেশ কি আমাদের একবিংশ শতাব্দীতে প্রযোজ্য? নম্র হওয়া কি উপকারী? নম্রতা কি সত্যিই মনোবলের এক প্রতীক হতে পারে?

সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা কি নম্র?

নম্রতা সম্বন্ধীয় যেকোনো আলোচনায় ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গিকে বিবেচনা করতেই হবে। কেন? কারণ তিনিই হলেন আমাদের সার্বভৌম এবং আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তাঁর বৈসাদৃশ্যে, আমাদের নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলোকে স্বীকার করতেই হবে। আমরা তাঁর ওপর নির্ভরশীল। ইলীহূ নামে একজন প্রাচীন বিজ্ঞ ব্যক্তি বলেছিলেন “সর্ব্বশক্তিমান! তিনি আমাদের বোধের অগম্য; তিনি পরাক্রমে মহান্‌।” (ইয়োব ৩৭:২৩) সত্যিই, কেবল আমাদের চারপাশের বিশাল নিখিলবিশ্বকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করাই আমাদের নম্র করতে পারে! “ঊর্দ্ধ্বদিকে চক্ষু তুলিয়া দেখ,” যিশাইয় ভাববাদী আমন্ত্রণ জানান। “ঐ সকলের সৃষ্টি কে করিয়াছে? তিনি বাহিনীর ন্যায় সংখ্যানুসারে তাহাদিগকে বাহির করিয়া আনেন, সকলের নাম ধরিয়া তাহাদিগকে আহ্বান করেন; তাঁহার সামর্থ্যের আধিক্য ও শক্তির প্রাবল্য প্রযুক্ত তাহাদের একটাও অনুপস্থিত থাকে না।”—যিশাইয় ৪০:২৬.

সর্বশক্তিমান হওয়ার পাশাপাশি, যিহোবা ঈশ্বর হলেন কোমল বা নম্র। রাজা দায়ূদ তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন: “তুমি আমাকে নিজ পরিত্রাণ-ঢাল দিয়াছ, তব কোমলতা আমাকে মহান করিয়াছে।” (২ শমূয়েল ২২:৩৬) ঈশ্বর এই অর্থে নম্র যে, তুচ্ছ মানুষ যারা তাঁকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, তাদের প্রতি তিনি বিবেচনা দেখান, তাদের ক্ষমা করে থাকেন। ঈশ্বর ভয়শীল লোকেদের সঙ্গে সদয়ভাবে ব্যবহার করার জন্য রূপক অর্থে যিহোবা স্বর্গ থেকে নেমে আসেন।—গীতসংহিতা ১১৩:৫-৭.

এ ছাড়াও, যিহোবা তাঁর দাসদের নম্রতাকে মূল্য দিয়ে থাকেন। প্রেরিত পিতর লিখেছিলেন: “ঈশ্বর অহঙ্কারীদের প্রতিরোধ করেন, কিন্তু নম্রদিগকে অনুগ্রহ প্রদান করেন।” (১ পিতর ৫:৫) গর্ব সম্বন্ধে ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে একজন বাইবেল লেখক মন্তব্য করেছিলেন: “যে কেহ হৃদয়ে গর্ব্বিত, সে সদাপ্রভুর ঘৃণাস্পদ।” (হিতোপদেশ ১৬:৫) কিন্তু, নম্রতা কীভাবে মনোবলের এক প্রতীক হতে পারে?

নম্রতা বলতে যা বোঝায় না

নম্রতা বলতে অবমাননাকে বোঝায় না। কিছু প্রাচীন সংস্কৃতিতে, একজন সাধারণ নম্র ব্যক্তি একজন ক্রীতদাস—নিকৃষ্ট, নগণ্য, নিচু ব্যক্তি—ছিলেন। এর বিপরীতে, বাইবেল এই বিষয়ে জোর দেয় যে, নম্রতা সম্মানের দিকে পরিচালিত করে। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞ ব্যক্তি লিখেছিলেন: “নম্রতার ও সদাপ্রভুর ভয়ের পুরস্কার, ধন, সম্মান ও জীবন।” (হিতোপদেশ ২২:৪) আর গীতসংহিতা ১৩৮:৬ পদে আমরা পড়ি: “সদাপ্রভু উচ্চ, তথাপি অবনতের প্রতি দৃষ্টি রাখেন, কিন্তু গর্ব্বিতকে দূর হইতে জানেন।”

নম্র হওয়ার অর্থ এই নয় যে, একজন ব্যক্তির কোনো ক্ষমতা বা সফলতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, যিশু খ্রিস্ট কখনোই দাবি করেননি যে, তিনি যিহোবার একমাত্র পুত্র ছিলেন না এবং কখনোই এমন ভান করেননি যে, পৃথিবীতে তাঁর পরিচর্যা উল্লেখযোগ্য ছিল না। (মার্ক ১৪:৬১, ৬২; যোহন ৬:৫১) তা সত্ত্বেও, যিশু তাঁর নিজের কাজের জন্য তাঁর পিতাকে কৃতিত্ব দেওয়ার এবং তাঁর শক্তিকে অন্যদের ওপর প্রভুত্ব ও অত্যাচার করার পরিবর্তে, তাদেরকে সেবা এবং সহযোগিতা করার জন্য ব্যবহার করার দ্বারা নম্রতা প্রদর্শন করেছিলেন।

মনোবলের এক প্রতীক

প্রশ্নাতীতভাবে, যিশু খ্রিস্ট তাঁর সমসাময়িকদের কাছে ‘পরাক্রম-কার্য্য দ্বারা’ পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। (প্রেরিত ২:২২) অথচ, কিছু লোকের চোখে, তিনি ছিলেন ‘মনুষ্যদের মধ্যে অতি নীচ ব্যক্তি।’ (দানিয়েল ৪:১৭) তিনি শুধুমাত্র সাধাসিধে জীবনযাপনই করেননি কিন্তু সেইসঙ্গে বার বার নম্রতার মূল্য সম্বন্ধেও শিক্ষা দিয়েছিলেন। (লূক ৯:৪৮; যোহন ১৩:২-১৬) যাই হোক, তাঁর নম্রতা তাঁকে দুর্বল করেনি। তাঁর পিতার নামের পক্ষসমর্থন এবং তাঁর পরিচর্যা সম্পন্ন করার সময়ে তিনি নির্ভীক ছিলেন। (ফিলিপীয় ২:৬-৮) বাইবেলে যিশুকে একটা সাহসী সিংহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। (প্রকাশিত বাক্য ৫:৫) যিশুর উদাহরণ দেখায় যে, নম্রতা নৈতিক মনোবলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আমরা প্রকৃত নম্রতা গড়ে তোলার কঠোর প্রচেষ্টা করার সময় বুঝতে পারি যে, নম্রতাকে জীবনের অংশ করে তোলার জন্য সত্যিকারের প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এর অন্তর্ভুক্ত হল, সহজ পন্থা গ্রহণ করা অথবা পাপপূর্ণ প্রবণতাগুলোর প্রতি বশীভূত হওয়ার পরিবর্তে, সর্বদা ঈশ্বরের ইচ্ছার বশীভূত হওয়া। নম্রতা গড়ে তোলার জন্য নৈতিক মনোবলের প্রয়োজন কারণ নিঃস্বার্থভাবে যিহোবার ও অন্যদের সেবা করার জন্য আমাদের ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয়গুলোকে দ্বিতীয় স্থানে রাখতে হবে।

নম্র হওয়ার উপকারগুলো

নম্রতা গর্ব বা অহংকার থেকে মুক্ত। আমরা এমন নম্রতা গড়ে তুলতে পারি যা আমাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করবে যদি আমরা নিজেদের—আমাদের মনোবল এবং দুর্বলতাগুলোর, আমাদের সফলতা এবং ব্যর্থতাগুলোর—এক বাস্তব মূল্যায়ন করি। পৌল এই বিষয়ে উত্তম পরামর্শ দিয়েছিলেন যখন তিনি লিখেছিলেন: “আমি তোমাদের মধ্যবর্ত্তী প্রত্যেক জনকে বলিতেছি, আপনার বিষয়ে যেমন বোধ করা উপযুক্ত, কেহ তদপেক্ষা বড় বোধ না করুক; কিন্তু . . . সে সুবোধ হইবারই চেষ্টায় আপনার বিষয়ে বোধ করুক।” (রোমীয় ১২:৩) যে-কেউ এই পরামর্শটি অনুসরণ করেন সে-ই নম্রতা প্রদর্শন করছেন।

নম্রতা সেই সময়ও স্পষ্ট দেখা যায় যখন আমরা আমাদের নিজেদের চেয়ে অন্যদের আগ্রহকে প্রথমে রাখি। অনুপ্রাণিত হয়ে পৌল খ্রিস্টানদের উপদেশ দিয়েছিলেন: “প্রতিযোগিতার কিম্বা অনর্থক দর্পের বশে কিছুই করিও না, বরং নম্রভাবে প্রত্যেক জন আপনা হইতে অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর।” (ফিলিপীয় ২:৩) এটা তাঁর অনুসারীদেরকে দেওয়া যিশুর এই আজ্ঞার সঙ্গে মিল রেখেছিল: “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, সে তোমাদের পরিচারক হইবে। আর যে কেহ আপনাকে উচ্চ করে, তাহাকে নত করা যাইবে; আর যে কেহ আপনাকে নত করে, তাহাকে উচ্চ করা যাইবে।”—মথি ২৩:১১, ১২.

হ্যাঁ, নম্রতা একজনকে ঈশ্বরের চোখে উচীকৃত করে। শিষ্য যাকোব এই বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন, যখন তিনি লিখেছিলেন: “প্রভুর [“যিহোবার,” NW] সাক্ষাতে নত হও, তাহাতে তিনি তোমাদিগকে উন্নত করিবেন।” (যাকোব ৪:১০) ঈশ্বরের চোখে উন্নত বা উচীকৃত হতে কে না চাইবে?

নম্রতার অভাবে বিভিন্ন দল ও লোকেদের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, নম্র হওয়ার মাধ্যমে ইতিবাচক ফলাফল লাভ করা যায়। আমরা ঈশ্বরের উষ্ণ অনুমোদন উপভোগ করতে পারি। (মীখা ৬:৮) আমরা মনের শান্তি উপভোগ করতে পারি কারণ একজন গর্বিত ব্যক্তির চেয়ে একজন নম্র ব্যক্তির খুশি ও পরিতৃপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি। (গীতসংহিতা ১০১:৫) পরিবার, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী এবং অন্যান্যদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও বেশি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক হয়ে উঠবে। নম্র ব্যক্তিরা বিরোধী এবং একগুঁয়ে হওয়া এড়িয়ে চলে, এমন আচরণ যা সহজেই রাগ, বিচ্ছেদ, অসন্তোষ এবং তিক্ততার দিকে পরিচালিত করতে পারে।—যাকোব ৩:১৪-১৬.

হ্যাঁ, অন্যদের সঙ্গে উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে নম্রতা গড়ে তোলা হল এক চমৎকার উপায়। এটা আমাদেরকে স্বার্থপর, প্রতিযোগিতাপূর্ণ এক পৃথিবীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর মুখোমুখি হতে সাহায্য করতে পারে। ঈশ্বরের সাহায্যে প্রেরিত পৌল তার পূর্বে থাকা উদ্ধত মনোভাব এবং গর্বকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। একইভাবে, অহংকার অথবা অন্যদের চেয়ে নিজেকে ভাল বলে মনে করার যে-কোনো প্রবণতাকে আমাদের দমন করা উচিত। “বিনাশের পূর্ব্বে অহঙ্কার, পতনের পূর্ব্বে মনের গর্ব্ব,” বাইবেল সতর্ক করে। (হিতোপদেশ ১৬:১৮) পৌলের উদাহরণ এবং উপদেশ অনুসরণ করার দ্বারা ‘নম্রতা পরিধান করা’ যে প্রজ্ঞার কাজ তা আমরা দেখতে পাব।—কলসীয় ৩:১২.

[৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

পৌল উদ্ধত মনোভাব এবং গর্বকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন

[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

নম্রতা থাকা অন্যদের সঙ্গে এক উত্তম সম্পর্ক বজায় রাখতে আমাদের সাহায্য করে

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

Anglo-Australian Observatory/David Malin Images