যখন শেষ আসবে, তখন আপনার কোথায় থাকা উচিত?
যখন শেষ আসবে, তখন আপনার কোথায় থাকা উচিত?
যিহোবা যখন আরমাগিদোনে বর্তমান দুষ্ট বিধিব্যবস্থার শেষ নিয়ে আসবেন, তখন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের কী হবে? হিতোপদেশ ২:২১, ২২ পদ উত্তর দেয়: “সরলগণ [“ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিরা,” NW] দেশে বাস করিবে, সিদ্ধেরা [“নির্দোষ ব্যক্তিরা” NW] তথায় অবশিষ্ট থাকিবে। কিন্তু দুষ্টগণ দেশ হইতে উচ্ছিন্ন হইবে, বিশ্বাসঘাতকেরা তথা হইতে উন্মূলিত হইবে।”
তাহলে, কীভাবে নির্দোষ ব্যক্তিরা দেশে বা পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে? তাদের জন্য কি আশ্রয়ের কোনো স্থান থাকবে? যখন শেষ আসবে, তখন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিদের কোথায় থাকা উচিত? শাস্ত্রের চারটে রক্ষার বিবরণ এই বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করে।
স্থান যখন গুরুত্বপূর্ণ ছিল
কুলপতি নোহ এবং লোটের উদ্ধার সম্বন্ধে ২ পিতর ২:৫-৭ পদে আমরা পড়ি: “[ঈশ্বর] পুরাতন জগতের প্রতি মমতা করেন নাই, কিন্তু যখন ভক্তিহীনদের জগতে জলপ্লাবন আনিলেন, তখন আর সাত জনের সহিত ধার্ম্মিকতার প্রচারক নোহকে রক্ষা করিলেন। আর সদোম ও ঘমোরা নগর ভস্মীভূত করিয়া উৎপাটনরূপ দণ্ড দিলেন, যাহারা ভক্তিবিরুদ্ধ আচরণ করিবে, তাহাদের দৃষ্টান্তস্বরূপ করিলেন; আর সেই ধার্ম্মিক লোটকে উদ্ধার করিলেন, যিনি ধর্ম্মহীনদের স্বৈরাচারে ক্লিষ্ট হইতেন।”
কীভাবে নোহ জলপ্লাবন থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন? ঈশ্বর নোহকে বলেছিলেন: “আমার গোচরে সকল প্রাণীর অন্তিমকাল উপস্থিত, কেননা তাহাদের দ্বারা পৃথিবী দৌরাত্ম্যে পরিপূর্ণ হইয়াছে; আর দেখ, আমি পৃথিবীর সহিত তাহাদিগকে বিনষ্ট করিব। তুমি গোফর কাষ্ঠ দ্বারা এক জাহাজ নির্ম্মাণ কর।” (আদি. ৬:১৩, ১৪) যিহোবা যেভাবে তাকে আদেশ দিয়েছিলেন নোহ ঠিক সেইভাবেই জাহাজটা তৈরি করেছিলেন। জলপ্লাবন শুরু হওয়ার সাত দিন আগে যিহোবা তাকে জাহাজের ভিতরে পশুপাখিদের একত্র করতে এবং সপরিবারে এর ভিতরে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সপ্তম দিনে, তিনি জাহাজে প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আর “পৃথিবীতে চল্লিশ দিবারাত্র মহাবৃষ্টি হইল।” (আদি. ৭:১-৪, ১১, ১২, ১৬) নোহ আর তার পরিবার “জল দ্বারা রক্ষা পাইয়াছিল।” (১ পিতর ৩:২০) তাদের রক্ষা পাওয়া জাহাজের ভিতরে থাকার ওপর নির্ভর করেছিল। পৃথিবীর আর কোনো স্থানই তাদেরকে সুরক্ষা জোগাতে পারত না।—আদি. ৭:১৯, ২০.
লোটের ক্ষেত্রে, নির্দেশনা কিছুটা অন্যরকম ছিল। কোথায় থাকতে হবে না, সেই বিষয়ে দুজন দূত তাকে জানিয়েছিল। “তোমার . . . যত জন এই [সদোম] নগরে আছে,” দুজন দূত লোটকে বলেছিল, “সে সকলকে এই স্থান হইতে লইয়া যাও। কেননা আমরা এই স্থান উচ্ছিন্ন করিব।” তাদের “পর্ব্বতে পলায়ন” করার ছিল।—আদি. ১৯:১২, ১৩, ১৭.
নোহ ও লোটের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, “প্রভু [“যিহোবা,” NW] ভক্তদিগকে পরীক্ষা হইতে উদ্ধার করিতে, এবং অধার্ম্মিকদিগকে . . . বিচারদিনের জন্য রাখিতে জানেন।” (২ পিতর ২:৯) এই উভয় উদ্ধারের ক্ষেত্রে স্থান ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নোহকে জাহাজের ভিতরে যেতে হয়েছিল; লোটকে সদোমের বাইরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু, সবসময় কি এইরকমই হবে? ধার্মিক ব্যক্তিরা যেখানেই থাকুক না কেন, যিহোবা কি তাদেরকে স্থানান্তরিত না করেই রক্ষা করতে পারেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য অন্য দুটো উদ্ধারের বিবরণ লক্ষ করুন।
স্থান কি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ?
মোশির দিনে মিশরকে দশম আঘাত দ্বারা বিধ্বস্ত করার আগে, যিহোবা ইস্রায়েলীয়দেরকে নিস্তারপর্বের পশুর রক্ত তাদের ঘরের দরজার কপালী ও বাজুতে ছিটিয়ে দিতে আদেশ দিয়েছিলেন। কেন? “কেননা সদাপ্রভু মিস্রীয়দিগকে আঘাত করিবার জন্য তোমাদের নিকট দিয়া গমন করিবেন, তাহাতে দ্বারের কপালীতে ও দুই বাজুতে সেই রক্ত দেখিলে সদাপ্রভু সেই দ্বার ছাড়িয়া অগ্রে যাইবেন, তোমাদের গৃহে সংহারকর্ত্তাকে প্রবেশ করিয়া আঘাত করিতে দিবেন না।” যাত্রা. ১২:২২, ২৩, ২৯.
সেই রাতেই, “সদাপ্রভু সিংহাসনে উপবিষ্ট ফরৌণের প্রথমজাত সন্তান অবধি কারাকূপস্থ বন্দির প্রথমজাত সন্তান পর্য্যন্ত মিসর দেশস্থ সমস্ত প্রথমজাত সন্তানকে ও পশুদের প্রথমজাত শাবকগণকে নিহনন করিলেন।” ইস্রায়েলীয়দের প্রথমজাত সন্তানরা স্থানান্তরিত না হয়েও রক্ষা পেয়েছিল।—যিরীহো নগরে বসবাসকারী একজন বেশ্যা, রাহবের ঘটনাও বিবেচনা করুন। ইস্রায়েলীয়রা তাদের প্রতিজ্ঞাত দেশ জয় করতে যাচ্ছিল। রাহব যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, যিরীহোর ধ্বংস অনিবার্য, তখন তিনি দুজন ইস্রায়েলীয় গুপ্তচরকে বলেছিলেন যে, ইস্রায়েলীয়রা এগিয়ে আসায় সেই নগর ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। তিনি গুপ্তচরদের লুকিয়ে রেখেছিলেন আর তার কাছে তাদেরকে শপথ করতে বলেছিলেন যে, যিরীহো যখন জয় করা হবে, তখন যেন তাকে ও তার পুরো পরিবারকে রক্ষা করা হয়। সেই গুপ্তচরেরা রাহবকে নগর প্রাচীরের ওপর অবস্থিত তার ঘরের মধ্যে তার পরিবারকে একত্রিত করার নির্দেশ দিয়েছিল। ঘর ছেড়ে যাওয়ার অর্থ ছিল নগরের বাকি লোকেদের সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাওয়া। (যিহো. ২:৮-১৩, ১৫, ১৮, ১৯) কিন্তু, যিহোবা পরে যিহোশূয়কে বলেছিলেন যে, “নগরের প্রাচীর স্বস্থানে পড়িয়া যাইবে।” (যিহো. ৬:৫) গুপ্তচরেরা যেটাকে নিরাপদ স্থান হিসেবে শর্ত দিয়েছিল, সেটাকেই এখন ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। রাহব এবং তার পরিবার কীভাবে উদ্ধার লাভ করবে?
যখন যিরীহোকে অধিকার করার সময় এসেছিল, তখন ইস্রায়েলীয়রা চিৎকার এবং তূরী বাজাতে শুরু করেছিল। “[ইস্রায়েলের] লোকেরা তূরীধ্বনি শুনিয়া অতি উচ্চৈঃস্বরে সিংহনাদ করিয়া উঠিল,” যিহোশূয় ৬:২০ পদ বলে, “তাহাতে প্রাচীর স্বস্থানে পড়িয়া গেল।” কোনো মানুষই সেই প্রাচীরের ভেঙে পড়াকে রোধ করতে পারেনি। তা সত্ত্বেও, অলৌকিকভাবে নগরের পুরো প্রাচীরটাই ভেঙে পড়েনি। প্রাচীরের যে-অংশে রাহবের ঘর ছিল, সেই অংশ দাঁড়িয়ে ছিল। যিহোশূয় সেই দুজন গুপ্তচরকে আদেশ দিয়েছিলেন: “তোমরা সেই বেশ্যার গৃহে গমন কর, এবং তাহার কাছে যে দিব্য করিয়াছ, তদনুসারে সেই স্ত্রীলোককে ও তাহার সমস্ত লোককে বাহির করিয়া আন।” (যিহো. ৬:২২) রাহবের পরিবারের সকলেই রক্ষা পেয়েছিল।
কোন বিষয়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
নোহের, লোটের, মোশির দিনের ইস্রায়েলীয়দের এবং রাহবের উদ্ধার লাভ করা থেকে আমরা কী শিখতে পারি? বর্তমান দুষ্ট বিধিব্যবস্থা যখন শেষ হবে, তখন আমাদের কোথায় থাকা উচিত, সেই বিষয়টা নির্ধারণ করতে এই বিবরণগুলো কীভাবে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে?
এটা ঠিক যে, নোহ জাহাজের মধ্যে রক্ষা পেয়েছিলেন। কিন্তু কেন তিনি সেখানে ছিলেন? এই কারণেই কি নয় যে, তিনি বিশ্বাস অনুশীলন করেছিলেন এবং বাধ্য ছিলেন? “নোহ . . . ঈশ্বরের আজ্ঞানুসারেই সকল কর্ম্ম করিলেন,” বাইবেল বলে। তিনি “সেইরূপ করিলেন।” (আদি. ৬:২২; ইব্রীয় ১১:৭) আমাদের সম্বন্ধে কী বলা যায়? ঈশ্বর আমাদেরকে যে-আদেশগুলো দিয়েছেন, আমরা কি সেগুলোর সমস্তই পালন করছি? এ ছাড়া, নোহ “ধার্ম্মিকতার প্রচারক” ছিলেন। (২ পিতর ২:৫) তার মতো, আমরা কি প্রচার কাজে উদ্যোগী, এমনকী লোকেরা যদি শুনতে না চায় তবুও?
সদোম থেকে পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে লোট ধ্বংস থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিলেন। তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন কারণ তিনি ঈশ্বরের দৃষ্টিতে ধার্মিক ছিলেন এবং সদোম ও ঘমোরার অধার্মিক লোকেদের স্বৈরাচারে বা লম্পটতায় ক্লিষ্ট হতেন। আজকে ব্যাপকভাবে বিরাজমান লম্পটতা কি প্রকৃতই আমাদেরকে কষ্ট দেয়? নাকি আমরা এই বিষয়গুলোতে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, তা আমাদেরকে বিব্রত করে না? আমাদের যাতে “নিষ্কলঙ্ক ও নির্দ্দোষ অবস্থায় শান্তিতে” দেখতে পাওয়া যায়, সেইজন্য আমরা কি যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করছি?—২ পিতর ৩:১৪.
মিশরে ইস্রায়েলীয়দের এবং যিরীহোর রাহবের ক্ষেত্রে তাদের ঘরের মধ্যে থাকার ওপরই তাদের উদ্ধার লাভ করা নির্ভর করেছিল। এটার জন্য বিশ্বাস ও বাধ্যতার প্রয়োজন। (ইব্রীয় ১১:২৮, ৩০, ৩১) মিশরে একের পর এক ঘরে যখন “মহাক্রন্দন হইল,” তখন প্রত্যেকটা ইস্রায়েলীয় পরিবার যেভাবে তাদের প্রথমজাত সন্তানকে চোখে চোখে রেখেছিল, তা একটু কল্পনা করুন। (যাত্রা. ১২:৩০) কল্পনা করুন যে, রাহব যখন যিরীহোর প্রাচীর ভেঙে পড়ার শব্দ শুনেছিলেন, তখন তিনি কীভাবে তার পরিবারের সঙ্গে ভয়ে জড়সড় হয়ে ছিলেন। বাধ্য থাকা এবং সেই ঘরের মধ্যে থাকার জন্য তার প্রকৃত বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল।
শীঘ্র শয়তানের দুষ্ট জগতের ওপর শেষ আসবে। সেই ভয়ংকর “ক্রোধের দিনে” যিহোবা তাঁর লোকেদেরকে কীভাবে রক্ষা করবেন, তা আমরা এখনও জানি না। (সফ. ২:৩) কিন্তু, আমরা যেখানেই থাকি না কেন আর সেই সময়ে আমাদের পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি যে, যিহোবার ওপর আমাদের বিশ্বাস ও তাঁর প্রতি বাধ্যতার ওপর আমাদের রক্ষা পাওয়া নির্ভর করবে। ইতিমধ্যে, আমাদের সেই বিষয়ের প্রতি এক সঠিক মনোভাব গড়ে তোলা উচিত, যেটাকে যিশাইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের ‘অন্তরাগার’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
“তোমার অন্তরাগারে প্রবেশ কর”
“হে আমার জাতি, চল, তোমার অন্তরাগারে প্রবেশ কর, তোমার দ্বার সকল রুদ্ধ কর,” যিশাইয় ২৬:২০ পদ বলে। “অল্পক্ষণ মাত্র লুক্কায়িত থাক, যে পর্য্যন্ত ক্রোধ অতীত না হয়।” সা.কা.পূ. ৫৩৯ সালে এই ভবিষ্যদ্বাণী হয়তো প্রথম পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল, যখন মাদীয় ও পারসিকরা বাবিলকে জয় করেছিল। বাবিলে প্রবেশ করার পর, পারস্যের কোরস স্পষ্টতই সকলকে তাদের ঘরের ভিতরে থাকার আদেশ দিয়েছিলেন, কারণ তার সৈন্যদেরকে ঘরের বাইরে থাকা যেকোনো ব্যক্তিকে হত্যা করতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের দিনে, এই ভবিষ্যদ্বাণীর ‘অন্তরাগার,’ যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্বব্যাপী ১,০০,০০০-রও বেশি মণ্ডলীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই মণ্ডলীগুলো আমাদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেগুলো “মহাক্লেশের” মধ্যেও তা করে চলবে। (প্রকা. ৭:১৪) ঈশ্বরের লোকেদেরকে তাদের “অন্তরাগারে” প্রবেশ করতে এবং “যে পর্য্যন্ত ক্রোধ অতীত না হয়,” সেই পর্যন্ত নিজেদেরকে গুপ্ত রাখতে আদেশ দেওয়া হয়েছে। মণ্ডলীর প্রতি আমাদের এক সঠিক মনোভাব গড়ে তোলা ও তা বজায় রাখা এবং এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার দৃঢ়সংকল্প নেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা পৌলের এই পরামর্শে মনোযোগ দিতে পারি: ‘আইস, আমরা পরস্পর মনোযোগ করি, যেন প্রেম ও সৎক্রিয়ার সম্বন্ধে পরস্পরকে উদ্দীপিত করিয়া তুলিতে পারি; এবং আপনারা সমাজে সভাস্থ হওয়া পরিত্যাগ না করি—যেমন কাহারও কাহারও অভ্যাস—বরং পরস্পরকে চেতনা দিই; আর আমরা সেই দিন যত অধিক সন্নিকট হইতে দেখিতেছি, ততই যেন অধিক এ বিষয়ে তৎপর হই।’—ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫.
[৭ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
অতীতে ঈশ্বরের করা উদ্ধারের কাজগুলো থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
আধুনিক দিনে ‘অন্তরাগার’ কোন বিষয়টাকে বোঝাতে পারে?