আমি যিহোবাকে কী ফিরিয়ে দেব?
আমি যিহোবাকে কী ফিরিয়ে দেব?
বলেছেন রূথ ডানে
মা প্রায়ই কিছুটা রসিকতা করে বলতেন যে, ১৯৩৩ সালটা ছিল বিভিন্ন বিপর্যয়ের বছর: হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন, পোপ এটাকে এক পবিত্র বছর হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন আর আমার জন্ম হয়েছিল।
আমার বাবা-মা লোরেনের ইউট্স শহরে বাস করত আর এই লোরেন হল ফ্রান্সের এক ঐতিহাসিক অঞ্চল, যা জার্মানির সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত। আমার মা একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন আর ১৯২১ সালে বাবার সঙ্গে তার বিয়ে হয়, যিনি একজন প্রোটেস্টান্ট ছিলেন। ১৯২২ সালে আমার দিদি হেলেনের জন্ম হয়েছিল আর আমার বাবা-মা শিশু থাকতেই তাকে ক্যাথলিক গির্জায় বাপ্তিস্ম দিয়েছিল।
১৯২৫ সালের কোনো একদিন আমার বাবা ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) বইটির একটি জার্মান কপি পেয়েছিলেন। সেই বইটি পড়ে তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়েছিলেন যে, তিনি সত্য খুঁজে পেয়েছেন। তিনি প্রকাশকদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন, যারা তাকে সেই সময়ে জার্মানিতে বিবেলফরশার নামে পরিচিত যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিল। বাবা যা শিখেছিলেন, তা সঙ্গেসঙ্গে প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। তবে, মা এই বিষয়টা পছন্দ করেননি। “তোমার যা ইচ্ছে তা-ই করো,” তিনি রাগান্বিত হয়ে জার্মান ভাষায় বলতেন, “কিন্তু ওই বিবেলফরশার-দের সঙ্গে মেলামেশা কোরো না!” কিন্তু, বাবা মনস্থির করে ফেলেছিলেন আর তাই ১৯২৭ সালে বাপ্তিস্ম নিয়ে তিনি তাদের একজন হয়েছিলেন।
এর ফল স্বরূপ, আমার দিদিমা আমার মাকে বিবাহবিচ্ছেদ করার জন্য জোরাজুরি করতে শুরু করেছিলেন। একদিন মাস্-এর সময় যাজক তার এলাকার গির্জার সদস্যদের “মিথ্যা ভাববাদী ডানের কাছ থেকে দূরে থাকার” জন্য সাবধান করে দিয়েছিলেন। সেই মাস্ থেকে ফিরে আমার দিদিমা আমাদের বাড়ির ওপরতলা থেকে একটা ফুলের টব বাবার ওপর ছুড়ে মেরেছিলেন। সেই ভারী বস্তুটা তার কাঁধে লেগেছিল আর একটুর জন্য মাথাটা বেঁচে গিয়েছিল। এই ঘটনাটা মাকে এই চিন্তা করতে পরিচালিত করেছিল যে, ‘যে-ধর্ম মানুষকে হত্যাকারীতে পরিণত করতে পারে, তা ভালো হতে পারে না।’ তিনি যিহোবার সাক্ষিদের প্রকাশনাগুলো পড়তে শুরু করেছিলেন। শীঘ্র, তিনি দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়েছিলেন যে, তিনি সত্য খুঁজে পেয়েছেন আর তাই ১৯২৯ সালে তিনি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।
আমার বাবা-মা আমার ও আমার দিদির কাছে যিহোবাকে বাস্তব করে তোলার জন্য তাদের যথাসাধ্য করেছিল। তারা আমাদের সঙ্গে নিয়ে বাইবেলের গল্পগুলো পড়ত আর তারপর আমাদের জিজ্ঞেস করত যে, কেন বাইবেলের এই চরিত্রগুলো এভাবে আচরণ করেছিল। সেই সময় বাবা রাতের বা সন্ধ্যের শিফটগুলোতে কাজ করতে প্রত্যাখ্যান করতেন, এমনকী যদিও তার এই সিদ্ধান্তের অর্থ ছিল আমাদের পরিবারের আয়ের ক্ষেত্রে এক বড়ো রকমের ক্ষতি। তিনি খ্রিস্টীয় সভাগুলো, পরিচর্যা এবং তার সন্তানদের সঙ্গে অধ্যয়নের জন্য সময় করে নিতে চেয়েছিলেন।
কঠিন সময় ঘনিয়ে আসছিল
আমার বাবা-মা সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে আসা ভ্রমণ অধ্যক্ষ এবং বেথেলকর্মীদের প্রতি নিয়মিত আতিথেয়তা দেখাত, যারা আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে জার্মানিতে আমাদের সহবিশ্বাসীরা যে-সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হচ্ছিল,
সেগুলোর বিষয়ে বলত। নাতসি সরকার যিহোবার সাক্ষিদেরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে নির্বাসিত করছিল এবং সন্তানদেরকে তাদের সাক্ষি বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।হেলেন দিদিকে ও আমাকে আমাদের সামনে যে-কঠিন পরীক্ষাগুলো আসতে যাচ্ছিল, সেগুলোর মুখোমুখি হওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের বাবা-মা আমাদেরকে বাইবেলের সেইসমস্ত পদ মুখস্ত করতে সাহায্য করেছিল, যেগুলো আমাদেরকে নির্দেশনা দেবে। তারা হয়তো বলত: “তোমরা যদি না জানো যে কী করতে হবে, তাহলে হিতোপদেশ ৩:৫, ৬ পদ স্মরণ কোরো। স্কুলে বিভিন্ন পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে তোমরা যদি ভয় পাও, তাহলে ১ করিন্থীয় ১০:১৩ পদ ব্যবহার কোরো। আর যদি তোমরা আমাদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাও, তাহলে হিতোপদেশ ১৮:১০ পদ মনে কোরো।” আমি ২৩ এবং ৯১ গীত মুখস্থ করে ফেলেছিলাম আর এটা বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম যে, যিহোবা সবসময় আমাকে সুরক্ষা করবেন।
১৯৪০ সালে নাতসি জার্মানি আ্যলস্যাস-লোরেন দখল করে নিয়েছিল আর নতুন সরকার চেয়েছিল যেন সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নাতসি দলে যোগ দেয়। বাবা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আর তাই গেসটাপো (জার্মানির গোয়েন্দা পুলিশ) তাকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দিয়েছিল। মা যখন সামরিক পোশাক তৈরি করতে অস্বীকার করেছিলেন, তখন গেসটাপো তাকেও হুমকি দিতে শুরু করেছিল।
স্কুল আমার জন্য এক দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছিল। প্রত্যেক দিন, হিটলারের জন্য প্রার্থনা করে অর্থাৎ “হাইল হিটলার” অভিবাদন করে এবং ডান হাত প্রসারিত করে জাতীয় সংগীত গাওয়ার পর আমাদের ক্লাস শুরু হতো। হিটলারকে অভিবাদন করতে নিষেধ করার পরিবর্তে, আমার বাবা-মা আমার বিবেককে প্রশিক্ষিত করতে আমাকে সাহায্য করেছিল। তাই আমি নিজে থেকেই নাতসি অভিবাদন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে চড় মেরেছিল আর স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। একবার সাত বছর বয়সে আমাকে স্কুলের সমস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকা অর্থাৎ ১২ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। তারা আমাকে হিটলারকে অভিবাদন করার জন্য জোর করেছিল। তা সত্ত্বেও, যিহোবার সাহায্যে আমি অটল ছিলাম।
একজন শিক্ষিকা আমার আবেগ নিয়ে খেলা করতে শুরু করেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমি একজন ভালো ছাত্রী, তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন আর আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হলে তিনি খুবই দুঃখ পাবেন। তিনি বলেছিলেন: “তোমাকে হাত প্রসারিত করতে হবে না। শুধু সামান্য একটু উঠিয়ে রাখো। আর তোমাকে ‘হাইল হিটলার’ বলতে হবে না! শুধু ঠোঁট নেড়ে বলার ভান করো।”
আমার শিক্ষিকা যা করছিলেন তা যখন আমি মাকে বলেছিলাম, তখন তিনি আমাকে বাবিলের রাজার দ্বারা স্থাপিত প্রতিমার সামনে তিন জন ইব্রীয় যুবক সম্বন্ধে বাইবেলের বিবরণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। “তাদের কী করতে বলা হয়েছিল?” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন। “মাথা নত করতে,” আমি উত্তর দিয়েছিলাম। “যে-মুহূর্তে তাদেরকে সেই প্রতিমার সামনে মাথা নত করতে হতো, সেই সময় যদি তারা তাদের জুতোর ফিতে বাঁধার জন্য ঝুঁকত, তাহলে সেটা কি ঠিক হতো? তুমি স্থির করো; যা তোমার কাছে সঠিক বলে মনে হয়, তা-ই করো।” শদ্রক, মৈশক ও অবেদ্নগোর মতো আমিও কেবলমাত্র যিহোবার প্রতি আনুগত্য দেখাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।—দানি. ৩:১, ১৩-১৮.
শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাকে বেশ কয়েক বার স্কুল থেকে বের করে দিয়েছিল আর আমাকে আমার বাবা-মার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিল। আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু আমার বাবা-মা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিত। আমি যখন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতাম, তখন আমার মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে প্রার্থনা করতেন, আমার সুরক্ষার জন্য যিহোবার কাছে সাহায্য চাইতেন। আমি জানতাম যে, সত্যের প্রতি দৃঢ় থাকার জন্য তিনি আমাকে শক্তি দেবেন। (২ করি. ৪:৭) আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন যে, যদি খুব বেশি চাপ আসে, তাহলে আমি যেন ঘরে ফিরে আসতে ভয় না পাই। “আমরা তোমাকে ভালোবাসি। তুমি আমাদের মেয়ে আর তুমি সবসময় আমাদের মেয়েই থাকবে,” তিনি বলেছিলেন। “বিষয়টা তোমার এবং যিহোবার মধ্যে।” সেই কথাগুলো “নীতিনিষ্ঠা” বজায় রাখার জন্য আমার আকাঙ্ক্ষাকে দৃঢ় করেছিল।—ইয়োব ২৭:৫, NW.
সাক্ষিদের প্রকাশনাগুলো খোঁজার জন্য এবং আমার বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য গেসটাপো প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত। তারা কয়েক ঘন্টার জন্য আমার মাকে নিয়ে যেত আর আমার বাবা ও দিদিকে তাদের কাজের জায়গা থেকে তুলে নিয়ে আসত। আমি কখনোই জানতাম না যে, আমি যখন স্কুল থেকে ফিরব, তখন মা ঘরে থাকবেন কি না। কখনো কখনো কোনো প্রতিবেশী আমাকে বলতেন: “তারা তোমার মাকে নিয়ে গিয়েছে।” তখন আমি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে পড়তাম ও নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম: ‘তারা কি তাকে নির্যাতন করছে? আমি কি তাকে আবারও কখনো দেখতে পাবো?’
নির্বাসন
১৯৪৩ সালের ২৮ জানুয়ারি, গেসটাপো ভোর সাড়ে তিনটেয় আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল। তারা বলেছিল যে, আমার বাবা-মা, দিদি ও আমি যদি নাতসি দলে যোগ দিই, তাহলে রোমীয় ৮:৩৫-৩৯.
আমাদের নির্বাসিত করা হবে না। নির্বাসনের জন্য প্রস্তুত হতে আমাদেরকে তিন ঘন্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। মা এই পরিস্থিতির জন্য তৈরিই ছিলেন আর এক সেট করে জামাকাপড় ও একটি করে বাইবেল আমাদের ব্যাগে ভরে রেখেছিলেন, তাই আমরা সেই সময়টা প্রার্থনা ও একে অন্যকে উৎসাহিত করার জন্য ব্যবহার করেছিলাম। বাবা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘কিছুই ঈশ্বরের প্রেম হইতে আমাদিগকে পৃথক করিতে পারিবে না।’—গেসটাপো ফিরে এসেছিল। আমি বয়স্ক বোন আঁগ্লাডের কথা কখনো ভুলে যাব না, যিনি কাঁদতে কাঁদতে হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানিয়েছিলেন। গেসটাপো আমাদেরকে গাড়িতে করে মেট্জ স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল। ট্রেনে তিন দিন যাত্রা করার পর, আমরা পোল্যান্ডের আউশভিটসের অধীনস্থ এক শিবির, কখ্অভিট্সায় পৌঁছেছিলাম। দু-মাস পরে, আমাদেরকে গ্লিভিট্সায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, যেখানে একটা মঠকে একটা বন্দি শিবিরে পরিণত করা হয়েছিল। নাতসিরা আমাদেরকে বলেছিল যে, আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের বিশ্বাসকে অস্বীকার করে একটা সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করি, তাহলে তারা আমাদের ছেড়ে দেবে এবং আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেবে। বাবা ও মা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল আর সৈন্যরা বলেছিল, “তোমরা কখনো ঘরে ফিরতে পারবে না।”
জুন মাসে আমাদেরকে শ্ফাইয়েনটখঅভিট্সায় স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, যেখানে থাকাকালীন আমার মাথাব্যথা শুরু হয়েছিল আর এখনও পর্যন্ত তা আমাকে কষ্ট দেয়। আমার হাতের আঙুলগুলোতে সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল আর একজন ডাক্তার আঙুল অবশ না করেই আমার বেশ কয়েকটা আঙুলের নখ তুলে ফেলেছিলেন। তবে ইতিবাচক বিষয়টা ছিল, রক্ষীদের জন্য ছোটোখাটো কাজ করার সূত্রে আমাকে প্রায়ই একটা রুটির দোকানে যেতে হতো। সেখানে একজন ভদ্রমহিলা আমাকে কিছু খাবার দিতেন।
সেই সময় পর্যন্ত আমরা অন্য বন্দিদের থেকে আলাদা একটা পরিবার হিসেবে ছিলাম। কিন্তু, ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসে আমাদেরকে জম্পকভিট্সার একটা শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। আমরা একটা চিলেকোঠার মধ্যে দু-তিন তলা বিছানায় ঘুমাতাম আর সেখানে আমাদের সঙ্গে প্রায় আরও ৬০ জন পুরুষ, নারী এবং বাচ্চা ছিল। এসএস (নাতসি পুলিশবাহিনী) এটা নিশ্চিত করেছিল যে, আমরা যে-খাবার পেতাম, তা যেন নিম্নমানের এবং প্রায় অখাদ্য হয়।
কষ্ট সত্ত্বেও, আমরা কখনো আশা ছাড়িনি। আমরা প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় পড়েছিলাম যে, যুদ্ধের পরে ব্যাপক প্রচার কাজ সম্পন্ন করা হবে। তাই আমরা জানতাম যে, আমরা কেন কষ্ট ভোগ করছি আর খুব শীঘ্র আমাদের কষ্ট দূর হবে।
আমরা যখন শুনতে পেয়েছিলাম যে, মিত্রবাহিনী এগিয়ে আসছে, তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, নাতসিরা যুদ্ধে হারছিল। ১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে, এসএস আমাদের শিবির ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি আমাদেরকে পায়ে হেঁটে এক যাত্রা করার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল, যা প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ছিল। চার সপ্তাহ পরে আমরা জার্মানির শ্টাইনফেল্সে এসে পৌঁছেছিলাম, যেখানে রক্ষীরা বন্দিদের দলবদ্ধ করে
একটা খনিতে নিয়ে গিয়েছিল। অনেকে ভেবেছিল যে, আমাদেরকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু সেই দিনই মিত্রবাহিনী এসে পৌঁছেছিল, এসএস পালিয়ে গিয়েছিল আর এর ফলে আমাদের কঠোর পরীক্ষাও শেষ হয়েছিল।আমার লক্ষ্যগুলোতে পৌঁছানো
১৯৪৫ সালের ৫ মে, প্রায় আড়াই বছর পর আমরা নোংরা ও উকুনে ভরা শরীর নিয়ে ইউট্সে আমাদের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিলাম। আমরা ফেব্রুয়ারি মাস থেকে জামাকাপড় বদলাইনি, তাই আমরা সেইসমস্ত পুরোনো কাপড়চোপড় পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে যে, মা আমাদেরকে বলছেন: “এটা যেন তোমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন হয়। আমাদের কিছুই নেই। এমনকী আমরা যে-কাপড়চোপড় পরে রয়েছি, সেগুলোও আমাদের নয়। কিন্তু, আমরা চার জনই বিশ্বস্তভাবে ফিরে এসেছি। আমরা আপোশ করিনি।”
পরবর্তী তিন মাস সুইজারল্যান্ডে সুস্থ হওয়ার পর, আমি স্কুলে ফিরে গিয়েছিলাম, তবে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার আর কোনো ভয় ছিল না। এখন আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা করতে এবং খোলাখুলিভাবে প্রচার করতে পারতাম। ১৯৪৭ সালের ২৮ আগস্ট ১৩ বছর বয়সে, আমি বেশ কয়েক বছর আগে যিহোবার সঙ্গে করা অঙ্গীকারের প্রতীককে লোকেদের সামনে প্রকাশ করেছিলাম। আমার বাবা আমাকে মোজেল নদীতে বাপ্তিস্ম দিয়েছিলেন। আমি সঙ্গেসঙ্গে একজন অগ্রগামী হতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার বাবা চেয়েছিলেন যেন আমি কোনো একটা কাজ শিখি। তাই আমি দর্জির কাজ শিখেছিলাম। ১৯৫১ সালে ১৭ বছর বয়সে আমাকে কাছাকাছি টিয়ঁভিল এলাকায় একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল।
সেই বছর আমি প্যারিসে একটা সম্মেলনে যোগদান করেছিলাম আর মিশনারি সেবার জন্য আবেদন করেছিলাম। যদিও সেই সময়ে আমার যথেষ্ট বয়স হয়নি, তবুও ভাই নেথেন নর বলেছিলেন যে, তিনি “পরবর্তী সময়ের জন্য” আমার আবেদনপত্রটি রেখে দেবেন। ১৯৫২ সালের জুন মাসে, আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যানসিংয়ে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অভ্ গিলিয়েড-এর ২১তম ক্লাসে যোগদান করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।
গিলিয়েড এবং এর পরের জীবন
কী এক অভিজ্ঞতা! আমি প্রায় সময়ই এমনকী আমার নিজের ভাষায় জনসাধারণ্যে প্রচার করাকে বেশ কঠিন বলে মনে করতাম। আর তখন আমাকে ইংরেজিতে কথা বলতে হয়েছিল। কিন্তু, নির্দেশকরা আমাকে প্রেমের সঙ্গে সমর্থন করেছিল। লজ্জা পেলে আমার চেহারায় যে-হাসি দেখা যেত, সেই হাসিকে ইঙ্গিত করে একজন ভাই আমাকে একটা ডাকনাম দিয়েছিলেন।
১৯৫৩ সালের ১৯ জুলাই, নিউ ইয়র্কের ইয়াংকি স্টেডিয়ামে আমাদের গ্র্যাজুয়েশন কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছিল আর আমাকে আইডা কানডুসোর (পরে সেনিয়বস হয়েছিলেন) সঙ্গে প্যারিসে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। প্যারিসের বিত্তশালী লোকেদের কাছে প্রচার করা ভীতিকর ছিল কিন্তু আমি অসংখ্য নম্র ব্যক্তির সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে পেরেছিলাম। আইডার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর তিনি ১৯৫৬ সালে আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলেন কিন্তু আমি প্যারিসেই থেকে গিয়েছিলাম।
১৯৬০ সালে আমি বেথেলের একজন ভাইকে বিয়ে করি এবং আমরা বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে শোমঁ ও ভিশিতে সেবা করি। পাঁচ বছর পরে, আমি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হই এবং অগ্রগামীর কাজ ছাড়তে বাধ্য হই। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল কারণ ছোটোবেলা থেকেই আমার লক্ষ্য ছিল পূর্ণসময়ের পরিচর্যাকে গ্রহণ করা এবং সবসময় তা করে চলা। এর অল্প সময় পর, অন্য একজন মহিলার জন্য আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে আমার আধ্যাত্মিক ভাই ও বোনেদের সমর্থন আমাকে সাহায্য করেছিল আর যিহোবা ক্রমাগত আমার ভার বহন করে চলেছেন।—গীত. ৬৮:১৯.
এখন আমি ফ্রান্সের শাখা অফিসের কাছে নর্মান্ডির লুভিয়েতে থাকি। স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলো সত্ত্বেও, আমার জীবনে যিহোবার সাহায্য দেখতে পেয়েছি বলে আমি খুশি। আমাকে যেভাবে মানুষ করা হয়েছিল তা আমাকে এমনকী আজও সঠিক মনোভাব বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমার বাবা-মা আমাকে শিখিয়েছিল যে, যিহোবা হলেন একজন বাস্তব ব্যক্তি, যাঁকে আমি ভালোবাসতে পারি, যাঁর সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি এবং যিনি আমার প্রার্থনাগুলোর উত্তর দেন। সত্যিই, “আমি সদাপ্রভু হইতে যে সকল মঙ্গল পাইয়াছি, তাহার পরিবর্ত্তে তাঁহাকে কি ফিরাইয়া দিব?”—গীত. ১১৬:১২.
[৬ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
“আমার জীবনে যিহোবার সাহায্য দেখতে পেয়েছি বলে আমি খুশি”
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
ছয় বছর বয়সে আমার গ্যাস মাস্কসহ
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
যখন আমার বয়স ১৬ বছর, তখন এক বিশেষ প্রচার অভিযানের জন্য লুক্সেমবুর্গে মিশনারি ও অগ্রগামীদের সঙ্গে
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৫৩ সালের একটা সম্মেলনে আমার বাবা ও মায়ের সঙ্গে