সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

তিনটে সম্মেলন যেভাবে আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে

তিনটে সম্মেলন যেভাবে আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে

তিনটে সম্মেলন যেভাবে আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে

বলেছেন জর্জ ওয়রিনচুক

 আপনি কি কখনো আমাদের কোনো একটা জেলা সম্মেলনে কোনো বিষয় শুনে এতটাই প্রভাবিত হয়েছেন যে, এটা আপনাকে জীবনে বড়ো বড়ো পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত করেছে? আমার ক্ষেত্রে তা হয়েছে। অতীতের দিনগুলোর কথা ভেবে আমি উপলব্ধি করতে পারি যে, বিশেষ করে তিনটে সম্মেলন আমার জীবনধারাকে প্রভাবিত করেছিল। প্রথমটা আমাকে ভীরু মনোভাব কাটিয়ে উঠতে; দ্বিতীয়টা অধিক সন্তুষ্ট থাকতে; তৃতীয়টা নিজেকে আরও বেশি করে বিলিয়ে দিতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু, এইসমস্ত পরিবর্তন সম্বন্ধে বলার আগে আমি আপনাদের এমন কিছু ঘটনা সম্বন্ধে বলছি, যেগুলো এই সম্মেলনগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ারও কয়েক বছর আগে ঘটেছিল—যে-ঘটনাগুলো আমার ছেলেবেলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

আমার জন্ম ১৯২৮ সালে আর তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোটো। আমার দিদি মার্জি ও অল্‌গা এবং আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির সাউথ বাউন্ড ব্রুকে বড়ো হয়ে উঠেছি, যে-শহরে সেই সময় প্রায় ২,০০০ অধিবাসী বাস করত। যদিও আমরা দরিদ্র ছিলাম, তবুও মা ছিলেন উদারমনা। তার হাতে পয়সা থাকলেই তিনি ভালো কোনো খাবার প্রস্তুত করে প্রতিবেশীদেরও তা দিতেন। আমার বয়স যখন নয় বছর ছিল, তখন একজন সাক্ষি বোন মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যিনি আমার মায়ের মাতৃভাষা, হাংগেরীয় ভাষায় কথা বলেছিলেন আর এই বিষয়টাই মাকে বাইবেলের বার্তা শুনতে পরিচালিত করেছিল। পরে, বার্থা নামে একজন বোন, যার বয়স ২০-র কোঠার প্রথম দিকে ছিল, তিনি বাইবেল অধ্যয়ন চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং মাকে যিহোবার একজন সেবক হতে সাহায্য করেছিলেন।

আমি মার মতো ছিলাম না বরং ভীরু স্বভাবের ছিলাম ও আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। এর চেয়েও খারাপ বিষয়টা হল, মা আমাকে সবসময় ছোটো করতেন। যখন আমি কেঁদে কেঁদে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, “কেন তুমি সবসময় আমার সমালোচনা করো?” তখন তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, তিনি আমাকে ভালোবাসেন, কিন্তু তিনি চান না যেন আমি নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড়ো মনে করি। মায়ের উদ্দেশ্য ভালো ছিল, কিন্তু প্রশংসার অভাবে আমি নিজেকে সবসময় ছোটো মনে করতাম।

একদিন, একজন প্রতিবেশী যিনি প্রায়ই আমার সঙ্গে সদয়ভাবে কথা বলতেন, তিনি আমাকে তার ছেলেদের সঙ্গে গির্জার সানডে স্কুলে যেতে বলেন। আমি জানতাম যে, সেখানে গেলে আমি যিহোবাকে অসন্তুষ্ট করব, কিন্তু সেই সদয় প্রতিবেশীকে অসন্তুষ্ট করতে ভয় পাচ্ছিলাম। তাই কয়েক মাস আমি গির্জায় গিয়েছিলাম, যদিও আমি এই ব্যাপারে লজ্জিত বোধ করতাম। একইভাবে, লোকভয় স্কুলেও আমাকে আমার বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করতে পরিচালিত করেছিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক যিনি একজন দাম্ভিক ব্যক্তি ছিলেন, তিনি এই বিষয়টাকে নিশ্চিত করেছিলেন যেন সব শিক্ষক ছেলে-মেয়েদেরকে পতাকাকে অভিবাদন করায়। আমিও পতাকাকে অভিবাদন করেছিলাম। প্রায় এক বছর এভাবেই চলেছিল আর এরপর একটা পরিবর্তন ঘটেছিল।

আমি সাহসী হতে শিখেছিলাম

১৯৩৯ সালে, একটা বই অধ্যয়ন দল আমাদের বাড়িতে সভা করতে শুরু করে। বেন মিস্‌কাল্‌স্কি নামে একজন যুবক অগ্রগামী ভাই সেটা পরিচালনা করতেন। আমরা তাকে বিগ্‌ বেন বলে ডাকতাম আর সেটা ডাকার সঠিক কারণও ছিল। আমার কাছে মনে হতো যেন তিনি আমাদের সদর দরজার মতোই লম্বা এবং চওড়া ছিলেন। লম্বা-চওড়া গড়ন সত্ত্বেও, তার এক কোমল হৃদয় ছিল আর তার আন্তরিক হাসির কারণে শীঘ্র আমি তার সঙ্গে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করি। তাই, যখন বেন আমাকে তার সঙ্গে ক্ষেত্রের পরিচর্যায় যোগ দিতে বলেছিলেন, তখন আমি আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিলাম। আমরা দুজনে বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। যখন আমি মনমরা থাকতাম, তখন তিনি আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতেন, যেভাবে একজন যত্নবান বড়ো ভাই তার ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। এটা আমার কাছে বিরাট অর্থ রেখেছিল আর আমি তাকে খুবই ভালোবাসতাম।

১৯৪১ সালে বেন আমাদের পরিবারকে তার গাড়িতে করে মিসৌরীর সেন্ট লুইসে একটা সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি কত রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, তা একটু কল্পনা করুন! আমি কখনোই আমাদের বাড়ি থেকে ৮০ কিলোমিটারের বেশি দূরে যাত্রা করিনি, কিন্তু তখন আমি এমন একটা জায়গায় যাচ্ছিলাম, যেটা ১,৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে ছিল! তবে, সেন্ট লুইসে নানারকম সমস্যা ছিল। পাদরিরা তাদের এলাকার অন্তর্ভুক্ত লোকেদের আদেশ দিয়েছিল যেন তারা তাদের বাড়িতে সাক্ষিদের থাকার জন্য যে-ব্যবস্থা করেছিল, সেগুলো বাতিল করে দেয়। অনেকে বাতিল করে দিয়েছিল। যে-বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেই পরিবারকেও হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তবুও, তারা আমাদের স্বাগত জানিয়েছিল। সেখানকার গৃহকর্তারা বলেছিল যে, একটা রুম দেওয়ার ব্যাপারে তাদের প্রতিজ্ঞা তারা ভঙ্গ করবে না। তাদের সাহসিকতা আমাকে অভিভূত করেছিল।

আমার দিদিরা ওই সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। সেই দিনই, ব্রুকলিন বেথেলের ভাই রাদারফোর্ড এক উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যেটাতে তিনি ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করতে চায় এমন সমস্ত ছেলে-মেয়েকে উঠে দাঁড়াতে বলেছিলেন। প্রায় ১৫,০০০ জন উঠে দাঁড়িয়েছিল। আমিও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। এরপর তিনি আমাদের মধ্যে যারা প্রচার কাজে তাদের যথাসাধ্য করতে চায়, তাদেরকে “হ্যাঁ” বলতে বলেছিলেন। অন্যান্য ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আমিও চিৎকার করে বলেছিলাম, “হ্যাঁ!” এরপর তুমুল হাততালি দেওয়া হয়েছিল। আমি উদ্দীপিত হয়েছিলাম।

সম্মেলনের পর আমরা পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে একজন ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি বর্ণনা করেছিলেন যে, একবার তিনি যখন প্রচার করছিলেন, তখন ক্রুদ্ধ জনতা তাকে মারধর করেছিল এবং তার শরীরে আলকাতরা ঢেলে পালক দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল। আমি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে তা শুনছিলাম। “কিন্তু তবুও আমি প্রচার করে চলব,” সেই ভাই বলেছিলেন। আমরা যখন সেই ভাইকে ছেড়ে আসি, তখন আমার দায়ূদের মতো লেগেছিল। আমি গলিয়াতের—আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের—মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলাম।

স্কুলে ফিরে আমি সেই প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়েছিলেন। সাহায্যের জন্য আমি নিঃশব্দে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম। তারপর সঙ্গেসঙ্গে আমি বলেছিলাম: “আমি যিহোবার সাক্ষিদের সম্মেলনে গিয়েছিলাম। আমি আর কখনো পতাকাকে অভিবাদন করব না!” এই কথার পর এক দীর্ঘ নিস্তব্ধতা বিরাজ করেছিল। প্রধান শিক্ষক ধীরে ধীরে তার ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হেঁটে আসেন। তার মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছিল। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন: “পতাকাকে অভিবাদন করো, তা না হলে তোমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে!” এইবারে আমি আপোশ করিনি আর ভিতরে ভিতরে আমি এতটা আনন্দিত ছিলাম, যেমনটা আগে কখনো বোধ করিনি।

কী হয়েছিল, তা বেনকে না বলে আমি থাকতে পারছিলাম না। তাকে কিংডম হলে দেখামাত্রই আমি চিৎকার করে বলি: “আমাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে! কারণ আমি পতাকাকে অভিবাদন করিনি!” বেন আমার কাঁধে হাত রাখেন এবং হেসে বলেন: “কিন্তু, নিশ্চিতভাবে যিহোবা তোমাকে ভালোবাসেন।” (দ্বিতীয়. ৩১:৬) সেই কথাগুলো আমাকে কতই না প্রেরণা দিয়েছিল! ১৯৪২ সালের ১৫ জুন আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

সন্তুষ্ট থাকার রহস্যটা শেখা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার হঠাৎ করেই উন্নতি হয়েছিল আর তাই দেশজুড়ে বস্তুবাদিতার ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। আমার ভালো মাইনের একটা চাকরি ছিল আর আমি সেই জিনিসগুলো কিনতে পেরেছিলাম, যেগুলো নিয়ে আগে শুধুমাত্র স্বপ্নই দেখতে পারতাম। আমার কয়েক জন বন্ধুর মোটরসাইকেল ছিল; অন্যেরা তাদের বাড়ি মেরামত করেছিল। আমি একটা নতুন গাড়ি কিনেছিলাম। শীঘ্র, আরও বস্তুগত আরামআয়েশের প্রতি আমার আকাঙ্ক্ষা রাজ্যের বিষয়গুলোর জন্য আমার চিন্তাকে একপাশে সরিয়ে দিয়েছিল। আমি জানতাম যে, আমি ভুল পথে যাচ্ছি। আনন্দের বিষয় যে, ১৯৫০ সালে নিউ ইয়র্ক শহরের একটা সম্মেলন আমাকে আমার চিন্তাধারাকে পুনঃসমন্বয় করতে সাহায্য করেছিল।

সেই সম্মেলনে একের পর এক বক্তা শ্রোতাদের প্রচার কাজে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। “সামান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে ধাবনক্ষেত্রে দৌড়ান,” একজন বক্তা জোরালো পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছিল যেন তিনি শুধু আমার সঙ্গেই কথা বলছেন। এ ছাড়া, আমি একটা গিলিয়েড ক্লাসের গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানও দেখেছিলাম, যেটা আমাকে এইরকম ভাবতে পরিচালিত করেছিল যে, ‘আমার বয়সি এই সাক্ষিরা যদি বিদেশে সেবা করার জন্য বস্তুগত আরামআয়েশ ত্যাগ করতে পারে, তাহলে আমার তো নিজের দেশে বসে একইরকম কাজ করতে ইচ্ছুক হওয়া উচিত।’ সেই সম্মেলনের শেষে, আমি একজন অগ্রগামী হওয়ার ব্যাপারে আমার মনকে স্থির করেছিলাম।

এই সময়ের মধ্যে, আমি আমার মণ্ডলীর একজন উদ্যোগী বোন ইভলিন মনডাকের সঙ্গে ডেটিং করতে শুরু করেছিলাম। ইভলিনের মা, যিনি ছয় সন্তানকে বড়ো করে তুলেছিলেন, তিনি একজন নির্ভীক মহিলা ছিলেন। তিনি এক বিরাট রোমান ক্যাথলিক গির্জার সামনে রাস্তায় প্রচার কাজ করতে পছন্দ করতেন। ক্রুদ্ধ যাজক যে তাকে অনেক বার সেখান থেকে চলে যেতে বলেছিলেন কিন্তু তিনি সেখান থেকে সরে যাননি। তার মায়ের মতো ইভলিনের মধ্যেও লোকভয় ছিল না।—হিতো. ২৯:২৫.

১৯৫১ সালে ইভলিন এবং আমি বিয়ে করি, আমাদের চাকরি ছেড়ে দিই আর অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করি। একজন সীমা অধ্যক্ষ আমাদেরকে নিউ ইয়র্ক শহর থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে অবস্থিত একটা গ্রাম আ্যমাগানসেটে চলে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। যখন মণ্ডলী আমাদের জানিয়েছিল যে, আমাদের থাকতে দেওয়ার মতো জায়গা তাদের নেই, তখন আমরা একটা ট্রেইলারের খোঁজ করেছিলাম কিন্তু আমাদের সাধ্যের মধ্যে একটাও খুঁজে পাইনি। এরপর আমরা একটা নষ্ট ট্রেইলার খুঁজে পেয়েছিলাম। মালিক এটার দাম চেয়েছিলেন ৯০০ ডলার—ঠিক এই পরিমাণ অর্থই আমরা বিয়ের উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। আমরা এটা কিনে মেরামত করি এবং আমাদের নতুন এলাকা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাই। কিন্তু, আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন আমাদের কাছে কোনো পয়সাই ছিল না আর আমরা ভাবছিলাম যে, কীভাবে আমরা অগ্রগামী হিসেবে কাজ করব।

ইভলিন বাড়ি পরিষ্কার করার কাজ করত আর আমি একটা ইতালীয় রেস্টুরেন্টে গভীর রাতের দিকে পরিষ্কার করার কাজ পাই। মালিক বলেছিলেন যে, “কোনো খাবার বেঁচে গেলে তোমার স্ত্রীর জন্য নিয়ে যাবে।” তাই আমি যখন রাত দুটোয় ঘরে ফিরে আসতাম, তখন আমাদের ট্রেইলার পিৎজা এবং পাস্তার সুগন্ধে ভরে যেত। পুনরায় গরম করা সেই খাবারগুলো ছিল ভোজের মতো, বিশেষ করে শীতকালে যখন তুষারাবৃত ট্রেইলারের ভিতরে আমরা শীতে কাঁপতে থাকতাম। এ ছাড়া, কখনো কখনো মণ্ডলীর ভাইয়েরা ট্রেইলারের সিঁড়িতে একটা বড়ো মাছ রেখে যেত। আ্যমাগানসেটে সেই প্রিয় ভাইদের সঙ্গে সেবা করার সময়কার সেই বছরগুলোতে আমরা শিখেছিলাম যে, মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার ফল হল এক পরিতৃপ্তিদায়ক জীবন। সেই বছরগুলো খুবই আনন্দপূর্ণ ছিল।

নিজেদেরকে আরও বিলিয়ে দিতে অনুপ্রাণিত হই

১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে আমরা শত শত মিশনারিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলাম, যারা নিউ ইয়র্ক শহরে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করার জন্য বিদেশের কার্যভারগুলো থেকে এসেছিল। তারা চমৎকার সব অভিজ্ঞতা বলেছিল। তাদের রোমাঞ্চকর অনুভূতি বেশ প্রভাববিস্তারকারী ছিল। অধিকন্তু, সম্মেলনের একজন বক্তা যখন এই বিষয়ে জোর দিয়েছিলেন যে, অনেক জায়গাতে এখনও রাজ্যের বার্তা পৌঁছায়নি, তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদেরকে কী করতে হবে—পরিচর্যাকে বাড়ানোর মাধ্যমে নিজেদেরকে আরও বিলিয়ে দিতে হবে। সেই সম্মেলনেই আমরা মিশনারি হিসেবে প্রশিক্ষণ লাভ করার জন্য আবেদন করেছিলাম। সেই একই বছরে আমাদেরকে গিলিয়েড স্কুল-এর ২৩তম ক্লাসে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যা ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল। সেটা কী এক বিশেষ সুযোগই না ছিল!

আমরা রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম যখন আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, আমাদেরকে ব্রাজিলে সেবা করার জন্য কার্যভার দেওয়া হয়েছে। আমরা স্টিমারে করে ১৪ দিনের সমুদ্র যাত্রা শুরু করার আগে বেথেলের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাই আমাকে বলেছিলেন: “নয়জন অবিবাহিত মিশনারি বোন তোমার ও তোমার স্ত্রীর সঙ্গে ব্রাজিলে যাবে। তাদের দিকে খেয়াল রেখো!” আপনারা কি নাবিকদের চোখে-মুখে কৌতূহলের ছাপ সম্বন্ধে কল্পনা করতে পারছেন, যখন তারা দেখেছিল যে, দশজন যুবতী আমার পিছন পিছন আসছে? তবে, সেই পরিস্থিতিকে সামলাতে বোনদের কোনো অসুবিধাই হয়নি। তা সত্ত্বেও, নিরাপদে ব্রাজিলের মাটিতে পা রাখার পরই আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম।

পর্তুগিজ ভাষা শেখার পর, আমাকে দক্ষিণ ব্রাজিলের রিও গ্র্যান্ডো ডো সুল রাজ্যে সীমার কাজ করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। যে-সীমা অধ্যক্ষের জায়গায় আমাকে কাজ করতে হয়েছিল, তিনি ছিলেন একজন অবিবাহিত ভাই আর তিনি আমার স্ত্রী এবং আমাকে বলেছিলেন: “এক বিবাহিত দম্পতিকে এখানে পাঠানো হয়েছে দেখে আমি খুবই আশ্চর্য হয়েছি। এই জায়গাটা খুবই এবড়োখেবড়ো প্রকৃতির।” মণ্ডলীগুলো এক বিশাল গ্রাম্য এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এবং কোনো কোনো মণ্ডলীতে শুধুমাত্র ট্রাক দিয়েই যাওয়া যেত। আপনি যদি চালকের জন্য খাবার কিনে দেন, তাহলে তিনি আপনাকে তার ট্রাকে ওঠার অনুমতি দিতেন। আরোহীরা যেভাবে ঘোড়ার পিঠে চড়ে থাকে, সেভাবে আমরা মালপত্রের ওপরে পা ছড়িয়ে বসতাম এবং যে-দড়িগুলো দিয়ে মালপত্র বাঁধা থাকত, সেগুলোকে দু-হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রাখতাম। যখনই ট্রাকটা আচমকা বাঁক নিত, তখন হেলে যাওয়া উঁচু মালপত্রের ওপর থেকে আমরা নীচের গভীর খাদ দেখতে পেতাম এবং জীবন বাঁচানোর জন্য শক্ত করে দড়িগুলো ধরে রাখতাম। কিন্তু, সেই ভাইদের আনন্দিত মুখগুলো দেখা আমাদের সারাদিনের যাত্রার সমস্ত প্রচেষ্টাকে সার্থক করত, যে-ভাইয়েরা আমাদের আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকত।

আমরা ভাইবোনদের ঘরে থাকতাম। তারা খুবই দরিদ্র ছিল কিন্তু সেটা তাদেরকে দান করার ক্ষেত্রে বিরত করতে পারেনি। একটা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে সব ভাই মাংস প্যাকেটজাত করার কারখানায় কাজ করত। তাদের বেতন এত কম ছিল যে, তারা দিনে শুধুমাত্র এক বেলা খেতে পারত। যদি তারা কোনো দিন কাজ না করত, তাহলে তারা বেতনও পেত না। তবুও, আমাদের পরিদর্শনের সময়ে তারা কাজ থেকে দু-দিনের জন্য ছুটি নিয়েছিল, যাতে তারা মণ্ডলীর কাজকর্মে সমর্থন করতে পারে। তারা যিহোবার ওপর নির্ভর করেছিল। সেই নম্র ভাইয়েরা আমাদেরকে ঈশ্বরের রাজ্যের জন্য ত্যাগস্বীকার করতে শিখিয়েছিল, যে-শিক্ষাটা আমরা কখনো ভুলে যাব না। তাদের মধ্যে থেকে আমরা এমন শিক্ষাগুলো লাভ করেছিলাম, যেগুলো কোনো স্কুলে গিয়ে পাওয়া যাবে না। আমি যখন আগের কথা চিন্তা করি, তখন সেই ভাইদের কথা স্মরণ করে এখনও আমার চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে ওঠে।

আমার অসুস্থ মায়ের দেখাশোনা করার জন্য ১৯৭৬ সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসি। ব্রাজিল ছেড়ে চলে আসা কঠিন ছিল, কিন্তু সেই দেশে রাজ্যের প্রকাশক ও মণ্ডলীগুলোর অসাধারণ বৃদ্ধি দেখতে পেয়েছি বলে আমরা কৃতজ্ঞ। যখনই আমরা ব্রাজিল থেকে কোনো চিঠি পাই, তখন আমাদের জীবনের সেই অপূর্ব সময়ের অনেক মধুর স্মৃতি আবারও ভেসে ওঠে।

অপূর্ব পুনর্মিলনগুলো

মায়ের দেখাশোনা করার সময় আমরা অগ্রগামীর কাজ করতাম ও পরিষ্কার করার চাকরি করতাম। ১৯৮০ সালে, আমার মা মারা যান আর তিনি মৃত্যু পর্যন্ত যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। এরপর আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে সীমার কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ১৯৯০ সালে আমার স্ত্রী এবং আমি কানেকটিকাটে একটা মণ্ডলীতে পরিদর্শন করেছিলাম আর সেখানে আমাদের খুবই বিশেষ একজন ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই মণ্ডলীর প্রাচীনদের মধ্যে একজন ছিলেন বেন—হ্যাঁ, সেই বেন, যিনি প্রায় ৫০ বছর আগে যিহোবার পক্ষ নিতে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। আমরা যখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, তখন আমরা কতটা আনন্দিত হয়েছিলাম তা কি আপনারা কল্পনা করতে পারেন?

১৯৯৬ সাল থেকে ইভলিন এবং আমি শারীরিকভাবে দুর্বল বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে নিউ জার্সির এলিজাবেথ এলাকায় পর্তুগিজ ভাষার মণ্ডলীতে সেবা করছি। আমার শারীরিক সমস্যা রয়েছে, কিন্তু আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর সাহায্যে আমি যতটা সম্ভব পরিচর্যায় অংশ নিই। ইভলিন একজন দুর্বল, বয়স্ক প্রতিবেশীকে সাহায্য করে। তার নাম জানতে চান? বার্থা—হ্যাঁ, সেই বার্থা যিনি ৭০ বছরেরও বেশি সময় আগে আমার মাকে যিহোবার একজন সেবক হতে সাহায্য করেছিলেন! আমার পরিবারকে সত্য শিখতে সাহায্য করার জন্য তিনি যা-কিছু করেছিলেন, সেগুলোর প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত।

আমি কৃতজ্ঞ যে, প্রথম দিকের সেই সম্মেলনগুলো আমাকে সত্য উপাসনার পক্ষ নিতে, আমার জীবনকে সাধাসিধে করতে এবং আমার পরিচর্যাকে বাড়াতে পরিচালিত করেছিল। হ্যাঁ, ওই সম্মেলনগুলো আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে।

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

ইভলিনের মা (বাম দিকে) এবং আমার মা

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার বন্ধু বেন

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

ব্রাজিলের মাটিতে

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আজকে ইভলিনের সঙ্গে