সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

বিস্ময়কর প্রসারের এক সময়ে সেবা করা

বিস্ময়কর প্রসারের এক সময়ে সেবা করা

বিস্ময়কর প্রসারের এক সময়ে সেবা করা

বলেছেন হার্লি হ্যারিস

সময়টা ছিল ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরীর কেনেট শহরে। আমরা একটা সীমা সম্মেলনে ছিলাম এবং আমাদেরকে জনতা ঘিরে রেখেছিল। আমাদেরকে সেই অশান্ত জনতার হাত থেকে সুরক্ষা করার জন্য মেয়র সেনাবাহিনী নিয়ে এসেছিলেন। তাক করা রাইফেল ও বেয়নেট সহকারে সৈন্যরা রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছিল। অনেক অপমানজনক মন্তব্য শুনতে শুনতে আমরা আমাদের গাড়ির কাছে হেঁটে গিয়েছিলাম এবং সম্মেলনের বাকি অধিবেশনগুলোর জন্য মিসৌরীর কেপ গিরারডোতে গিয়েছিলাম। সেখানেই আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম আর তখন আমার বয়স ছিল চোদ্দো বছর। তাহলে শুনুন যে, কীভাবে আমি এই ধরনের চরম গোলযোগের সময়ই যিহোবাকে সেবা করতে শুরু করেছিলাম।

উনিশ-শো ত্রিশ সালের প্রথম দিকে আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা এবং তাদের আট ছেলে-মেয়ে, ভাই রাদারফোর্ডের কিছু বক্তৃতার রেকর্ডিং শুনেছিল ও এই বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়েছিল যে, তারা সত্য খুঁজে পেয়েছে। আমার বাবা-মা বে ও মিলড্রেড হ্যারিস ১৯৩৫ সালে ওয়াশিংটন ডি.সি.-র সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। ঠিক সেই সম্মেলনেই শনাক্তকৃত ‘বিস্তর লোকের’ অংশী হতে পেরে তারা কত আনন্দিতই না হয়েছিল!—প্রকা. ৭:৯, ১৪.

পরের বছর আমার জন্ম হয়েছিল। আর এর এক বছর পর, আমার বাবা-মা মিসিসিপির একটা বিছিন্ন এলাকায় চলে গিয়েছিল। সেই এলাকাতে থাকার সময় আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য এমনকী কোনো ভ্রমণ অধ্যক্ষও ছিলেন না। আমার পরিবার বেথেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সম্মেলনগুলোতে যোগ দিত এবং কিছু সময়ের জন্য, আমাদের ভ্রাতৃসমাজের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য সেটাই ছিল একমাত্র সময়।

তাড়নার মধ্যেও ধৈর্য বজায় রাখা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যিহোবার সাক্ষিরা তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে অনেক তাড়না ভোগ করেছে। আমরা আরকানসাসের মাউন্টেন হোমে চলে গিয়েছিলাম। একদিন, বাবা ও আমি রাস্তায় সাক্ষ্যদান করছিলাম। তখন একজন ব্যক্তি হঠাৎ করে বাবার কাছ থেকে পত্রিকাগুলো কেড়ে নিয়ে সেগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে সেখানেই পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। যুদ্ধে অংশ নিই না বলে তিনি আমাদের কাপুরুষ বলেছিলেন। আমার বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর আর তাই আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। সেই লোক চলে না যাওয়া পর্যন্ত আমার বাবা কোনো কথা না বলে শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

এ ছাড়া, কিছু ভালো লোকও ছিল, যারা আমাদের পক্ষে কথা বলত। একবার, এক দল লোক যখন আমাদের গাড়ির চারপাশে ঘিরে ধরেছিল, তখন একজন স্থানীয় সরকারি উকিল তা লক্ষ করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এখানে কী হচ্ছে?” একজন ব্যক্তি উত্তর দিয়েছিলেন: “এই যিহোবার সাক্ষিরা নিজেদের দেশের জন্য যুদ্ধে অংশ নেয় না!” এই কথা শুনে সেই উকিল লাফ দিয়ে আমাদের গাড়ির পাদানির ওপরে উঠে জোরে জোরে বলেছিলেন: “আমি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছি আর এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নেব! আপনারা এই লোকেদের যেতে দিন। তারা তো কারো ক্ষতি করছে না!” সেই জনতা নীরবে চলে গিয়েছিল। আমরা সেই ভালো লোকেদের প্রতি কতই না কৃতজ্ঞ, যারা আমাদের প্রতি সৌজন্য বা দয়া দেখিয়েছিল!—প্রেরিত ২৭:৩.

সম্মেলনগুলো আমাদের শক্তিশালী করে

১৯৪১ সালে মিসৌরীর সেন্ট লুইসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনটা আমাদের জন্য একেবারে উপযুক্ত ছিল। একটা হিসাব অনুযায়ী, ১,১৫,০০০-রেরও বেশি লোক এতে যোগ দিয়েছিল। ৩,৯০৩ জন বাপ্তিস্ম নিয়েছিল, যা সত্যিই অবাক করে দেওয়ার মতো এক সংখ্যা! ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতাটা আমাদের ভালো করেই মনে রয়েছে, যেটার শিরোনাম ছিল, “রাজার সন্তান।” তিনি সরাসরি আমরা যারা অল্পবয়সি তাদের উদ্দেশে কথা বলেছিলেন আর আমরা সকলে বিনামূল্যে সন্তান (ইংরেজি) নামক চমৎকার নীল বইয়ের একটি করে কপি পেয়েছিলাম। এই সম্মেলন আমাকে পরের বছর অর্থাৎ যে-বছর আমাকে প্রাইমারি স্কুলে যোগ দিতে হবে, সেই বছরে যা ঘটেছিল, সেটার মুখোমুখি হতে শক্তিশালী করেছিল। জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন না করার কারণে আমাকে ও আমার কাকাতো বোনকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। স্কুলের পরিচালকবর্গের মন পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য আমরা প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। অনেক দিন সকাল বেলা আমরা বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম—কিন্তু আমাদের শুধু ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। তবে, আমি মনে করতাম যে, এটা ছিল ঈশ্বরের রাজ্যের প্রতি আমাদের আনুগত্য দেখানোর উপায়।

কিন্তু অল্প সময় পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত এই আইন জারি করেছিল যে, পতাকা অভিবাদন করা বাধ্যতামূলক নয়। অবশেষে, আমরা স্কুলে যোগ দিতে পেরেছিলাম। শিক্ষক অনেক সদয় ছিলেন আর আমরা যে-কাজগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম, সেগুলো করতে দিয়েছিলেন। আমাদের সহছাত্রছাত্রীরাও আমাদের সঙ্গে সম্মানপূর্বক আচরণ করেছিল।

এ ছাড়া, ১৯৪২ সালে ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বিষয়েও মনে আছে, যেখানে ভাই নেথেন এইচ. নর এই শিরোনামের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন, “শান্তি—এটি কি স্থায়ী হতে পারে?” প্রকাশিত বাক্য ১৭ অধ্যায়ের ওপর এই বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তুলনামূলকভাবে এক শান্তির সময়কাল আসবে। তাই, আরও প্রসারের বিষয়ে প্রত্যাশা করা হয়েছিল। এই বৃদ্ধির প্রস্তুতি হিসেবে ১৯৪৩ সালে গিলিয়েড স্কুল-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই সময়ে আমি বুঝতেই পারিনি যে, কীভাবে এই স্কুল ভবিষ্যতে আমার জীবনকে প্রভাবিত করবে। যুদ্ধের পর সত্যিই শান্তি এসেছিল এবং তাড়না হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু, ১৯৫০ সালে যখন কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন আবারও হঠাৎ আমাদের প্রচার কাজের ওপর বিরোধিতা শুরু হয়েছিল, যেমনটা প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে।

প্রসারের কাজে পুরোপুরি অংশ নেওয়া

১৯৫৪ সালে আমি হাইস্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হই আর এর এক মাস পর অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। মিসৌরীর কেনেট, যেখানে ১৯৫০ সালে জনতা আমাদেরকে ঘিরে ধরেছিল, সেখানে সেবা করার পর ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে আমাকে বেথেলে আমন্ত্রণ জানানো হয়। নিউ ইয়র্ক সিটির কেন্দ্রে যে-মণ্ডলীতে আমাকে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল, সেটার এলাকার মধ্যে ছিল টাইম্‌স স্কোয়ার। আমার নিজের বাড়ির জীবন থেকে তা কতই না ভিন্ন ছিল! আমি নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত লোকেদের কাছে পত্রিকা খুলে চিন্তা উদ্রেককারী কোনো প্রবন্ধ দেখিয়ে ও এই প্রশ্ন করে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিলাম যে, “আপনি কি নিজেকে কখনো এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন?” অনেকে পত্রিকা গ্রহণ করত।

বেথেলে আমার প্রিয় সময়ের মধ্যে একটা ছিল, ভাই নরের পরিচালিত সকালের উপাসনা। তিনি বাইবেলের পদগুলোকে কতই না প্রাণবন্ত না করে তুলতে এবং সেগুলোকে আমাদের জন্য ব্যবহারিক উপায়ে প্রয়োগ করে দেখাতে পারতেন! তিনি অবিবাহিত যুবক ভাইদের সঙ্গে একজন বাবা তার ছেলের সঙ্গে যেভাবে কথা বলে সেভাবেই কথা বলতেন, বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, সেই বিষয়ে প্রায়ই চমৎকার পরামর্শ দিতেন। ১৯৬০ সালে, আমি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আমি ৩০ দিনের মধ্যে বেথেল ছেড়ে চলে যাওয়ার নোটিশ দিয়েছিলাম কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি। ৩০ দিন শেষে, আমি লাজুক স্বভাবের হওয়া সত্ত্বেও আমার বেথেল ছেড়ে যাওয়ার নোটিশ তারা পেয়েছে কি না, তা জিজ্ঞেস করার মতো সাহস সঞ্চয় করেছিলাম। ভাই রবার্ট অলেন টেলিফোনে কথা বলেছিলেন এবং আমি যেখানে কাজ করছিলাম, সেখানে এসেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমি বিশেষ অগ্রগামীর কিংবা সীমার কাজ সম্বন্ধে কী চিন্তা করেছি। “কিন্তু, ভাই বব,” আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “আমার বয়স মাত্র ২৪ বছর আর আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।”

সীমার কাজে

সেই রাতে আমার রুমে একটা বিরাট খাম অপেক্ষা করছিল। এটার ভিতরে আবেদন পত্র ছিল, একটা বিশেষ অগ্রগামীদের জন্য এবং অন্যটা সীমার কাজের জন্য। ওয়াউ! আমি একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম! এর ফলে, আমি মিসৌরীর দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে ও কানসাসের পূর্বাঞ্চলে সীমার কাজে আমার ভাইবোনদের সেবা করার অযাচিত সুযোগ পেয়েছিলাম। তবে, বেথেল ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে আমি ভ্রমণ অধ্যক্ষদের জন্য আয়োজিত একটা সভাতে যোগ দিয়েছিলাম। ভাই নর তার শেষ মন্তব্যে বলেছিলেন: “আপনারা সীমা অধ্যক্ষ ও ভ্রমণ অধ্যক্ষ হয়েছেন বলে তার মানে এই নয় যে, আপনারা স্থানীয় ভাইদের চেয়ে আরও বেশি জানেন। কারো কারো আপনাদের চেয়ে আরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু, তারা আপনাদের মতো বিশেষ সুযোগ লাভ করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। তাদের কাছ থেকে আপনারা অনেক কিছু শিখতে পারেন।”

সেই কথা কতই না সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল! কানসাসের পারসন্স শহরের ভাই ফ্রেড মালোহান ও তার স্ত্রী আর সেইসঙ্গে ফ্রেডের দাদা চার্লি ছিল চমৎকার উদাহরণ। তারা ১৯০০ দশকের শুরুর দিকে সত্য শিখেছিল। এমনকী আমার জন্মের আগে তারা যে-অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল, তা শোনা কতই না আনন্দদায়ক ছিল! আরেকজন ভাই ছিলেন জন রিসটেন, যিনি মিসৌরীর জপলিনের একজন সদয় বয়স্ক ভাই আর তিনি অনেক দশক ধরে অগ্রগামীর কাজ করেছিলেন। ঈশতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি এই প্রিয় ভাইদের গভীর সম্মান ছিল। আমার বয়স অল্প হওয়া সত্ত্বেও, তারা আমাকে এটা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, আমি তাদের সীমা অধ্যক্ষ।

১৯৬২ সালে, আমি লাল চুলের অধিকারী একজন প্রাণবন্ত অগ্রগামী ক্লরিস নোকেকে বিয়ে করেছিলাম। আমি ক্লরিসকে সঙ্গে নিয়ে সীমার কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম। ভাইবোনদের বাড়িতে থাকার সময়ে আমরা তাদের সম্বন্ধে আরও ভালোভাবে জানতে পেরেছি। আমরা যুবক-যুবতীদের পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করার জন্য উৎসাহিত করতে সমর্থ হয়েছিলাম। সীমার মধ্যে কিশোরবয়সি দুজন ছেলে-মেয়ে—জে কোসিনস্কি ও জোয়েন কার্সম্যান—এই ধরনের উৎসাহের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তাদের সঙ্গে প্রচারে কাজ করা ও এক আত্মত্যাগী জীবনযাপনের আনন্দ ভাগ করে নেওয়া, তাদেরকে লক্ষ্য স্থাপন করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। জোয়েন একজন বিশেষ অগ্রগামী হয়েছিল এবং জে বেথেলে সেবা করেছিল। পরবর্তী সময়ে, সেই দুজন বিয়ে করেছিল আর এখন তারা প্রায় ৩০ বছর ধরে সীমার কাজে রত আছে।

মিশনারি সেবা

১৯৬৬ সালে, ভাই নর আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমরা বিদেশে সেবা করার ব্যাপারে আগ্রহী কি না। “আমরা যেখানে আছি, সেখানে আমরা সুখী,” আমরা উত্তর দিয়েছিলাম, “তবে অন্য কোথাও প্রয়োজন হলে, আমরা সেখানে যেতে প্রস্তুত আছি।” এক সপ্তাহ পর, আমাদেরকে গিলিয়েড স্কুল-এ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। স্কুলে যোগ দেওয়ার জন্য আবারও বেথেলে ফিরে যাওয়া এবং যাদেরকে আমি ভালোবাসতাম ও সম্মান করতাম এমন অনেকের সঙ্গে থাকতে পারা কতই না রোমাঞ্চকর ছিল! এ ছাড়া, আমরা সহছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলাম, যারা এখন পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে সেবা করে চলেছে।

ক্লরিস ও আমাকে দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরে পাঠানো হয়েছিল আর আমাদের সঙ্গে ছিল ডেনিস ও এডুইনা ক্রিস্ট, অ্যানা রড্রিগুইজ ও ডেলিয়া সানচেজ। ক্রিস্ট দম্পতি রাজধানী কুইটোতে চলে গিয়েছিল। আমাদের মতো অ্যানা ও ডেলিয়াকেও ইকুয়েডরের তৃতীয় বৃহত্তম শহর কুয়েঙ্কাতে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। সেই এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল দুটো প্রদেশ। কুয়েঙ্কার প্রথম মণ্ডলী শুরু হয়েছিল আমাদের ড্রয়িং রুম থেকে। সেখানে মাত্র আমরা চার জন ও আরও দুজন ব্যক্তি ছিলাম। কীভাবে আমরা প্রচার কাজ সম্পন্ন করব, সেই বিষয়ে আমরা অনেক চিন্তা করতাম।

কুয়েঙ্কাতে অনেক গির্জা ছিল আর তথাকথিত ছুটির দিনগুলোতে শহরটা ধর্মীয় শোভাযাত্রায় পূর্ণ হয়ে যেত। তা সত্ত্বেও, কুয়েঙ্কার লোকেদের অনেক প্রশ্ন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, কুয়েঙ্কার একজন চ্যাম্পিয়ন সাইকেল আরোহী মারিও পোলোর সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, তখন তার এই প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, “প্রকাশিত বাক্য বইয়ে উল্লেখিত বেশ্যা কে?”

আরেকবার, মারিও রাতের বেলা কিছুটা উদ্‌বিগ্ন হয়ে আমাদের ঘরে এসেছিলেন। একজন ইভানজেলিক্যাল পাস্টর তাকে কিছু সাহিত্যাদি দিয়েছেন, যেগুলোতে যিহোবার সাক্ষিদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। আমি যুক্তি করেছিলাম যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের পক্ষ সমর্থনের জন্য সুযোগ দেওয়া উচিত। তাই পর দিন, অভিযোগের উত্তর দেওয়ার জন্য মারিও আমাকে ও সেই পাস্টরকে তার ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। সেই আলোচনায় আমি ত্রিত্বের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। সেই পাস্টর যখন যোহন ১:১ পদ পড়েছিলেন, তখন মারিও নিজেই সঠিকভাবে সেই পদের অর্থ ব্যাখ্যা করেছিলেন। আর এই ব্যাখ্যা উল্লেখিত প্রতিটা বাইবেলের পদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তাই যুক্তিসংগতভাবেই, সেই পাস্টর ত্রিত্ব সম্বন্ধে কোনো প্রমাণ না দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। এই বিষয়টা মারিও ও তার স্ত্রীকে দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছিল যে, আমাদের কাছে সত্য রয়েছে আর তারা বাইবেলের শিক্ষাগুলোর চমৎকার সমর্থক হয়ে উঠেছিল। এটা দেখা কতই না আনন্দদায়ক যে, কুয়েঙ্কা শহরের মণ্ডলী বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩টা হয়েছে ও আমাদের প্রথম কার্যভারের সেই বিশাল এলাকাতে মোট ৬৩টা মণ্ডলী হয়েছে—সত্যিই এক বিস্ময়কর প্রসার!

শাখায় থাকাকালীন প্রসার দেখা

১৯৭০ সালে আমাকে আল স্কুলোর সঙ্গে গায়াকুইল শাখায় যেতে বলা হয়েছিল। আমরা দুজন শাখার কাজ দেখাশোনা করতাম। জো সেকেরাক খণ্ডকালীন কাজ করে পুরো দেশের ৪৬টা মণ্ডলীর জন্য সাহিত্যাদি প্যাক করতেন। কিছু সময়ের জন্য, ক্লরিস ক্ষেত্রের পরিচর্যায় এবং আমি বেথেলে কাজ করেছিলাম। সে ৫৫ জন ব্যক্তিকে বাপ্তিস্ম নিতে সাহায্য করেছিল, প্রায় সময়ই সম্মেলনে তার তিন থেকে পাঁচ জন ছাত্র বাপ্তাইজিত হতো।

উদাহরণস্বরূপ, ক্লরিস লুক্রেসিয়া নামে একজন মহিলার সঙ্গে অধ্যয়ন করত, যার স্বামী বিরোধিতা করতেন। তা সত্ত্বেও, লুক্রেসিয়া শেষপর্যন্ত বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন এবং একজন নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করেছিলেন। তিনি তার সন্তানদের যিহোবার পথ সম্বন্ধে শিক্ষা দিয়েছিলেন। এখন তার দুজন ছেলে প্রাচীন ও একজন ছেলে বিশেষ অগ্রগামী; তার মেয়ে একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছে। তার নাতনি একজন চমৎকার ভাইকে বিয়ে করেছে আর তারা দুজনও বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করছে। এই পরিবার অনেক ব্যক্তিকে সত্য শিখতে সাহায্য করেছে।

১৯৮০ সালের মধ্যে ইকুয়েডরে প্রায় ৫,০০০ জন প্রকাশক ছিল। আমাদের ছোটো অফিসের তুলনায় আমরা অনেক বেশি লোক হয়ে গিয়েছিলাম। একজন ভাই আমাদেরকে গায়াকুইলের বাইরে ৮০ একর জায়গা দান করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে আমরা সেই জায়গায় একটা নতুন শাখা অফিস ও একটা সম্মেলন হল নির্মাণ করতে শুরু করেছিলাম, যেগুলোর ১৯৮৭ সালে উৎসর্গীকরণ করা হয়েছিল।

ইচ্ছুক ব্যক্তিরা প্রসারে অবদান রেখেছিল

বছরের পর বছর ধরে, অন্যান্য দেশ থেকে প্রকাশক ও অগ্রগামীদেরকে ইকুয়েডরে এসে সাহায্য করতে দেখা উৎসাহজনক ছিল, যেখানে অনেক রাজ্য প্রচারকদের প্রয়োজন ছিল। যে-একজন ব্যক্তির কথা আমার বেশ ভালো মনে আছে, তিনি হলেন কানাডা থেকে আসা অবসরপ্রাপ্ত একজন স্কুল শিক্ষক অ্যান্ডি কিড। তিনি ১৯৮৫ সালে ৭০ বছর বয়সে ইকুয়েডরে চলে এসেছিলেন আর ২০০৮ সালে ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে সেবা করেছিলেন। আমি যখন প্রথম তার কার্যভারে তাকে দেখেছিলাম, তখন একটা ছোটো মণ্ডলীতে তিনি একমাত্র অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি অনেক কষ্ট করে স্প্যানিশ ভাষায় জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিতেন আর এরপর প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন পরিচালনা করতেন। এ ছাড়া, তিনি ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয় এবং সেইসঙ্গে পরিচর্যা সভা-র অধিকাংশ বিষয় পরিচালনা করতেন! সেই এলাকাতে এখন প্রায় ২০০ জন প্রকাশক ও অনেক স্থানীয় প্রাচীনসহ উন্নতিশীল দুটো মণ্ডলী রয়েছে।

আরনেস্টো ডায়েজ নামে আরেকজন ভাই, যিনি তার পরিবারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিলেন, তিনি ইকুয়েডরে আট মাস সেবা করার পর বলেছিলেন: “আমাদের তিন ছেলে-মেয়ে ভাষা শিখে ফেলেছে এবং চমৎকার শিক্ষক হয়ে উঠেছে। একজন বাবা হিসেবে আমি এমন এক লক্ষ্যে পৌঁছেছি, যা এই বিধিব্যবস্থায় অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল আর তা হল, একজন নিয়মিত অগ্রগামী হওয়া, আমার পরিবারের সঙ্গে পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় অংশ নেওয়া। আমরা সবাই মিলে মোট ২৫টা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করছি। এইসমস্ত বিষয় আরও একতাবদ্ধ এক পরিবার আর সর্বোপরি যিহোবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছে, যা আমি আগে কখনো লাভ করিনি।” আমরা এই প্রিয় ভাইবোনদের প্রতি কতই না কৃতজ্ঞ!

১৯৯৪ সালে শাখা অফিসকে আরও বাড়ানো হয়, ভবনগুলোর সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়। ২০০৫ সালে আমাদের প্রকাশকদের সংখ্যা ৫০,০০০ অতিক্রম করেছিল আর শাখা অফিসকে আরও প্রসারিত করার প্রয়োজন হয়েছিল। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল একটা বড়ো সম্মেলন হল এবং একটা নতুন আবাসিক ভবন ও সেইসঙ্গে অনুবাদ কাজের জন্য অফিস। ২০০৯ সালের ৩১ অক্টোবর এই নতুন ভবনগুলোর উৎসর্গীকরণ করা হয়েছিল।

১৯৪২ সালে আমাকে যখন স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬০,০০০ জন প্রকাশক ছিল। এখন তাদের সংখ্যা দশ লক্ষেরও ওপরে। ১৯৬৬ সালে আমরা যখন ইকুয়েডরে এসেছিলাম, তখন এখানে প্রায় ১,৪০০ জন রাজ্য ঘোষণাকারী ছিল। এখন তাদের সংখ্যা ৬৮,০০০-রেরও বেশি। আর নিশ্চিতভাবেই ১,২০,০০০ বাইবেল অধ্যয়ন ও ২০০৯ সালে খ্রিস্টের মৃত্যুর স্মরনার্থ সভায় উপস্থিত ২,৩২,০০০-রেরও বেশি লোকের মধ্যে থেকে আরও অনেকেই আসবে। সত্যিই, যিহোবা তাঁর লোকেদের এমনভাবে আশীর্বাদ করেছেন, যেমনটা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি। বিস্ময়কর প্রসারের এক সময়ে ও স্থানে বেঁচে থাকা কতই না রোমাঞ্চকর! *

[পাদটীকা]

^ এই প্রবন্ধটি প্রকাশনার জন্য প্রস্তুত করার সময়ে ভাই হার্লি হ্যারিস যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে মারা গিয়েছেন।

[৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

একই জায়গাতে উন্মুক্ত সম্মেলন (১৯৮১) ও গায়াকুইল সম্মেলন হল (২০০৯)