সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আগে আমি মৃত্যুকে ভয় পেতাম—এখন আমি ‘জীবনের উপচয়’ লাভ করার জন্য অপেক্ষা করে আছি

আগে আমি মৃত্যুকে ভয় পেতাম—এখন আমি ‘জীবনের উপচয়’ লাভ করার জন্য অপেক্ষা করে আছি

আগে আমি মৃত্যুকে ভয় পেতাম—এখন আমি ‘জীবনের উপচয়’ লাভ করার জন্য অপেক্ষা করে আছি

বলেছেন পিয়েরো গাত্তি

এক মৃদু গুড়গুড় আওয়াজ ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করেছিল। এরপর, সাইরেনের বিকট আওয়াজ লোকেদেরকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য সতর্ক করে দিচ্ছিল। তার পর, বোমা বিস্ফোরণের, কোনো কিছু ধ্বংস হওয়ার আওয়াজ আর সেইসঙ্গে সেই বিস্ফোরণে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল এমন আতঙ্কিত ব্যক্তিদের প্রচণ্ড চিৎকার শোনা গিয়েছিল।

সেটা ১৯৪৩/৪৪ সালের দিকে ইতালির মিলানে ঘটেছিল। সেখানে অবস্থানরত একজন যুবক সৈনিক হিসেবে আমাকে প্রায়ই জঙ্গিবিমানের নিক্ষিপ্ত বোমায় বিধ্বস্ত আশ্রয়স্থলগুলোতে চাপা পড়া এমন মানুষের দেহাবশেষ সংগ্রহ করার আদেশ দেওয়া হতো, যাদের দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেত ও শনাক্ত করা যেত না। আর আমি কেবল খুব কাছ থেকে অন্যদের মৃত্যুই দেখিনি। মাঝে মাঝে, আমি নিজেই অল্পের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছি। সেই সময়ে আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে প্রতিজ্ঞা করতাম যে, আমি যদি এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাই, তাহলে আমি তাঁর ইচ্ছা পালন করব।

মৃত্যুর ভয় কাটিয়ে ওঠা

আমি ইতালির কমো শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার (৬ মাইল) দূরে সুইস সীমান্তের কাছাকাছি একটা গ্রামে বেড়ে উঠেছিলাম। একেবারে ছোটো থাকতেই তীব্র শোক ও মৃত্যুভয় আমাকে পেয়ে বসেছিল। স্প্যানিশ ফ্লু আমার দুই দিদির জীবন কেড়ে নিয়েছিল। এরপর ১৯৩০ সালে, যখন আমার বয়স ছয় বছর, তখন আমার মা লুইজা মারা গিয়েছিলেন। একজন ক্যাথলিক হিসেবে বেড়ে ওঠায়, আমি ধর্মীয় নিয়মকানুন পালন করতাম এবং প্রতি সপ্তাহে গির্জায় যেতাম। কিন্তু, কয়েক বছর পর আমি সেই ভয় কাটিয়ে উঠেছিলাম, তবে তা গির্জায় গিয়ে নয় বরং একটা চুল কাটার দোকানে গিয়ে।

১৯৪৪ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন এর তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছিল। আমি ছিলাম সেই হাজার হাজার ইতালীয় সৈন্যের মধ্যে একজন, যারা সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরপেক্ষ দেশ সুইরাজল্যান্ডে পালিয়ে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছানোর পর আমাদেরকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। আমাকে সেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শ্তিনাকের কাছাকাছি এক শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে আমাদেরকে কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। শ্তিনাকে একজন ক্ষৌরকারের দোকানে সাময়িকভাবে একজন কর্মচারীর প্রয়োজন হয়েছিল। আমি সেখানে কেবলমাত্র এক মাস কাজ করেছিলাম কিন্তু সেই অল্প সময়ই এমন একজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিল, যে-পরিচয়ের ফলে আমার জীবন বদলে গিয়েছিল।

অ্যাডলফো তেলিনি নামে সুইজারল্যান্ডে বসবাসরত একজন ইতালীয় ব্যক্তি সেই ক্ষৌরকারের দোকানে আসতেন। তিনি একজন যিহোবার সাক্ষি ছিলেন। আমি এই দল সম্বন্ধে কখনোই শুনিনি, তবে না শোনাটা অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় ছিল না কারণ সেই সময়ে পুরো ইতালিজুড়ে ১৫০ জনের বেশি সাক্ষি ছিল না। অ্যাডলফো বাইবেলের বিভিন্ন চমৎকার সত্য সম্বন্ধে বলেছিলেন, যার মধ্যে শান্তি ও ‘জীবনের উপচয়’ বা পূর্ণরূপে জীবন উপভোগ করার প্রতিজ্ঞা ছিল। (যোহন ১০:১০; প্রকা. ২১:৩, ৪) আমি যুদ্ধ ও মৃত্যুবিহীন এক ভবিষ্যতের বার্তা শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। শরণার্থী শিবিরে ফিরে গিয়ে আমি সেই আশা সম্বন্ধে জুসেপ্পে তুবিনি নামে একজন ইতালীয় যুবককে জানিয়েছিলাম আর তিনিও অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর, অ্যাডলফো ও অন্যান্য সাক্ষি আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সময়ে সময়ে শিবিরে আসত।

অ্যাডলফো আমাকে শ্তিনাক থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার (৬ মাইল) দূরে আরবোঁতে নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে যিহোবার সাক্ষিদের একটা ছোটো দল ইতালীয় ভাষায় সভা করত। আমি যা শুনেছিলাম সেই বিষয়ে আমি এতটাই উৎসুক হয়ে উঠেছিলাম যে, পরবর্তী সপ্তাহে আমি পায়ে হেঁটেই সেখানে গিয়েছিলাম। পরে, আমি জুরিখের একটা সম্মেলন হলে অনুষ্ঠিত সাক্ষিদের এক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। আমি বিশেষভাবে একটা স্লাইড শো দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, যেখানে হত্যা শিবিরের মধ্যে মৃতদেহের স্তুপ দেখানো হয়েছিল। আমি জানতে পেরেছিলাম যে, জার্মানির অনেক সাক্ষি তাদের বিশ্বাসের কারণে শহিদ হয়েছে। সেই সম্মেলনে আমার মারিয়া পিৎসাতোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। একজন সাক্ষি হিসেবে তার বিভিন্ন কাজের জন্য ইতালির ফ্যাসিবাদী কর্তৃপক্ষ তাকে ১১ বছরের জন্য কারাদণ্ড দিয়েছিল।

যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর, আমি ইতালিতে ফিরে গিয়েছিলাম এবং কমোর একটা ছোটো মণ্ডলীতে যোগ দিয়েছিলাম। আমি ধারাবাহিকভাবে বাইবেল অধ্যয়ন করিনি কিন্তু মৌলিক সত্যগুলো সম্বন্ধে আমার স্পষ্ট ধারণা ছিল। মারিয়া পিৎসাতোও সেই মণ্ডলীতেই ছিলেন। তিনি আমাকে খ্রিস্টীয় বাপ্তিস্মের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বলেছিলেন এবং আমাকে মারসেল্লো মার্তিনেলির সঙ্গে দেখা করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, যিনি সনদ্রিও প্রদেশের কাস্তিওনি আন্দেভেন্নোতে বাস করতেন। মারসেল্লো ছিলেন একজন বিশ্বস্ত অভিষিক্ত ভাই, যিনি একনায়কতান্ত্রিক সরকারের শাসন আমলে ১১ বছরের জন্য কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাকে ৮০ কিলোমিটার (৫০ মাইল) পথ সাইকেল চালিয়ে যেতে হতো।

মারসেল্লো বাপ্তিস্মের জন্য চাহিদাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য বাইবেল ব্যবহার করেছিলেন আর এরপর আমরা প্রার্থনা করেছিলাম এবং আদ্দা নদীতে গিয়ে আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। তখন ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস। সেটা সত্যিই এক বিশেষ দিন ছিল! যিহোবাকে সেবা করার ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে খুবই রোমাঞ্চিত থাকায় আর ভবিষ্যতের জন্য আমার এক দৃঢ় আশা ছিল বলে যখন সন্ধ্যা হয়েছিল, তখন আমি বুঝতেই পারিনি যে আমি সেই দিন ১৬০ কিলোমিটার (১০০ মাইল) পথ সাইকেল চালিয়েছি!

১৯৪৭ সালের মে মাসে, ইতালির মিলানে যুদ্ধপরবর্তী প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রায় ৭০০ লোক সেখানে যোগ দিয়েছিল, যাদের মধ্যে এমন অনেকে ছিল, যারা ফ্যাসিবাদী তাড়নার সময় রক্ষা পেয়েছিল। সেই সম্মেলনে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছিল। জুসেপ্পে তুবিনি, যার কাছে আমি শরণার্থী শিবিরে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম, তিনি সেখানে বাপ্তিস্মের বক্তৃতা দিয়েছিলেন আর এরপর তিনি নিজেই বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন!

সেই সম্মেলনে, আমার ব্রুকলিন বেথেল থেকে আসা ভাই নেথেন নরের সঙ্গে দেখা করার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল। তিনি জুসেপ্পে ও আমাকে আমাদের জীবন ঈশ্বরের সেবায় ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, আমি এক মাসের মধ্যেই পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করব। বাড়িতে ফিরে আমি আমার পরিবারকে আমার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানিয়েছিলাম আর তারা সকলে আমাকে থামানোর চেষ্টা করেছিল। তা সত্ত্বেও, আমি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। তাই, এক মাস পর আমি মিলানের বেথেলে সেবা করতে শুরু করেছিলাম। সেখানে চার জন মিশনারি সেবা করত: জুসেপ্পে (জোসেফ) রোমানো আর তার স্ত্রী অ্যাঞ্জেলিনা; কারলো বেনান্তি ও তার স্ত্রী কোস্‌তান্তসা। সেই পরিবারের পঞ্চম সদস্য ছিলেন জুসেপ্পে তুবিনি, যিনি সবেমাত্র তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আর ষষ্ঠ সদস্য ছিলাম আমি।

বেথেলে সেবা করার এক মাস পর, আমাকে দেশের প্রথম ইতালীয় সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ভাই জর্জ ফ্রেডিয়ানেলি, যিনি ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইতালিতে আসা প্রথম মিশনারি, তিনি ইতিমধ্যেই ভ্রমণ কাজ দেখাশোনা করছিলেন। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন আর এরপর আমাকেই সেই রোমাঞ্চকর কাজ শুরু করতে হয়েছিল। বিশেষভাবে আমার সেই মণ্ডলীর কথা মনে আছে, যেখানে আমি প্রথম পরিদর্শন করেছিলাম আর সেটা ছিল ফায়েনজা মণ্ডলী। একটু কল্পনা করুন! তখন পর্যন্ত আমি এক বারও মণ্ডলীতে বক্তৃতা দিইনি! তা সত্ত্বেও, আমি সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের পূর্ণসময়ের পরিচর্যা গ্রহণ করার জন্য চিন্তা করতে উৎসাহিত করেছিলাম, যাদের মধ্যে অল্পবয়সিরাও ছিল। পরে, সেই অল্পবয়সিদের মধ্যে কেউ কেউ ইতালীয় ক্ষেত্রে বড়ো বড়ো দায়িত্ব লাভ করেছিল।

আমি ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে এক রোমাঞ্চকর জীবন শুরু করেছিলাম। এটা এমন এক জীবন, যেখানে বিভিন্ন বিস্ময়, রদবদল, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও আনন্দ ছিল আর যেখানে আমি প্রিয় ভাই ও বোনদের কাছ থেকে প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছিলাম।

যুদ্ধপরবর্তী ইতালির ধর্মীয় চিত্র

এখন আমি সেই সময়ের ইতালির ধর্মীয় পরিস্থিতি সম্বন্ধে কিছু বিষয় বলতে চাই। সেখানে ক্যাথলিক গির্জা একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। যদিও ১৯৪৮ সালে এক নতুন সংবিধান কার্যকর করা হয়েছিল, কিন্তু সাক্ষিদেরকে স্বাধীনভাবে প্রচার কাজ করতে বাধা দেওয়ার ব্যাপারে ফ্যাসিবাদী আইনকানুন ১৯৫৬ সালে বাতিল করা হয়েছিল। পাদরিদের কাছ থেকে চাপ আসায় সীমা সম্মেলনগুলো প্রায়ই বিঘ্নিত হতো। কিন্তু, মাঝে মাঝে পাদরিদের চেষ্টা একেবারেই ব্যর্থ হতো, যেমনটা ১৯৪৮ সালে মধ্য ইতালির একটা ছোট্ট শহর সুলমোনায় ঘটেছিল।

সেই সম্মেলন একটা থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রবিবার সকালে আমি সভাপতি ছিলাম আর জুসেপ্পে রোমানো জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সেই সময়ের তুলনায় সেখানে প্রচুর শ্রোতা ছিল। যদিও সেখানে এমনকী ৫০০ জন প্রকাশকও ছিল না, কিন্তু থিয়েটারটা ২,০০০ জন লোকে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বক্তৃতার শেষে, শ্রোতাদের মধ্যে বসে থাকা দুজন যাজকের নির্দেশে একজন যুবক লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে গিয়েছিল। গণ্ডগোল সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে সে গলা ফাটিয়ে চিৎকারচ্যাঁচামেচি করতে শুরু করেছিল। আমি সঙ্গেসঙ্গে তাকে বলেছিলাম যে, “আপনার যদি কিছু বলার থাকে, তাহলে একটা হল ভাড়া করে আপনার যা খুশি বলতে পারেন।” শ্রোতারা তার কথায় পাত্তা দেয়নি বরং সেই যুবকের কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে তাদের অসম্মতি জানিয়েছিল। আর এতে সেই যুবক মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

সেই সময়ে, ভ্রমণের কাজ বেশ রোমাঞ্চকর ছিল। আমি মাঝে মাঝে পায়ে হেঁটে, আমার সাইকেলে চড়ে, ভাঙাচোরা, ভিড় বাসে চড়ে অথবা ট্রেনে করে এক মণ্ডলী থেকে আরেক মণ্ডলীতে ভ্রমণ করতাম। মাঝে মাঝে আমার থাকার জায়গা ছিল আস্তাবল অথবা কোনো ছাউনি। যুদ্ধ শেষ হয়েছে বেশি দিন হয়নি আর তাই অধিকাংশ ইতালীয় দরিদ্র ছিল। ভাইবোনদের সংখ্যা অল্প ছিল আর তারা দরিদ্র ছিল। কিন্তু, যিহোবার সেবায় নিয়োজিত জীবন ঠিক আগের মতোই চমৎকার ছিল।

গিলিয়েড-এ প্রশিক্ষণ

১৯৫০ সালে জুসেপ্পে তুবিনি ও আমাকে মিশনারি গিলিয়েড স্কুলের ১৬তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। একেবারে শুরু থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার পক্ষে ইংরেজি শেখা খুবই কঠিন হবে। যদিও আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সেটা সত্যিই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। আমাদেরকে ইংরেজি ভাষায় পুরো বাইবেল পড়তে হয়েছিল। তা করার জন্য, মাঝে মাঝে আমি জোরে জোরে পড়া অনুশীলন করার জন্য দুপুরের খাবার খেতে যেতাম না। অবশেষে, আমার বক্তৃতা দেওয়ার পালা এসেছিল। নির্দেশকের মন্তব্যটা আমার এমনভাবে মনে আছে, যেন গতকালই তা ঘটেছে আর তিনি বলেছিলেন, “আপনার অঙ্গভঙ্গি ও উদ্যম চমৎকার, তবে আপনার ইংরেজি একেবারেই বোঝা যায় না!” তা সত্ত্বেও, আমি সফলভাবে সেই কোর্স সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। এরপর, জুসেপ্পে ও আমাকে আবার ইতালিতে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। বাড়তি প্রশিক্ষণ লাভ করার কারণে আমরা দুজনেই ভাইবোনদের সেবা করার জন্য আরও বেশি সুসজ্জিত ছিলাম।

আমি ১৯৫৫ সালে লিডিয়াকে বিয়ে করি, সাত বছর আগে আমি যার বাপ্তিস্মের বক্তৃতা দিয়েছিলাম। তার বাবা ডোমেনিকো ছিলেন একজন প্রিয় ভাই, যিনি ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে তাড়িত ও তিন বছরের জন্য নির্বাসিত হওয়া সত্ত্বেও, তার সাত জন সন্তানকেই সত্য গ্রহণ করে নিতে সাহায্য করেছিলেন। লিডিয়াও সত্যের একজন প্রকৃত যোদ্ধা ছিল। আমাদের ঘরে ঘরে প্রচার করার বৈধ অধিকার স্বীকৃত হওয়ার আগে তাকে আদালতে তিনটে মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমাদের বিয়ের ছয় বছর পর, আমাদের প্রথম ছেলে বেনিয়ামিনোর জন্ম হয়েছিল। ১৯৭২ সালে আমাদের আরেক ছেলে হয়েছিল, যার নাম মারকো। আমি আনন্দিত যে, তারা দুজনেই পরিবারসহ উদ্যোগের সঙ্গে যিহোবার সেবা করছে।

যিহোবার সেবায় সক্রিয় থাকা

অন্যদের সেবা করার আনন্দে পূর্ণ এক জীবনে আমার অনেক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে আমার শ্বশুর সেই সময়ে ইতালির রাষ্ট্রপতি সান্দ্রো পারতিনির কাছে চিঠি লিখেছিলেন। ফ্যাসিবাদী একনায়কতান্ত্রিক শাসন আমলে তাদের দুজনকে ভেন্‌ততেনে দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল, যেখানে সরকারের ঘোর শত্রুদের রাখা হতো। আমার শ্বশুর রাষ্ট্রপতির কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তার অনুরোধ গ্রাহ্য হওয়ার পর আমি তার সঙ্গে গিয়েছিলাম আর আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল—যে-বিষয়টার সঙ্গে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত ছিলাম না। রাষ্ট্রপতি আমার শ্বশুরকে জড়িয়ে ধরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এরপর আমরা আমাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে কথা বলেছিলাম আর তাকে কিছু সাহিত্যাদি দিয়েছিলাম।

৪৪ বছর ধরে এক ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার পর ১৯৯১ সালে সীমার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম আর সেই ৪৪ বছরে আমি পুরো ইতালিজুড়ে মণ্ডলী পরিদর্শন করেছিলাম। এর পরের চার বছর আমি সম্মেলন হল অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করেছিলাম, যতক্ষণ পর্যন্ত না গুরুতর অসুস্থতার কারণে আমাকে কাজ কমিয়ে দিতে হয়েছিল। কিন্তু, আমি কৃতজ্ঞ যে, যিহোবার অযাচিত দয়ার কারণে আমি এখনও পর্যন্ত পূর্ণসময়ের সেবা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি সুসমাচার প্রচার ও শিক্ষা দেওয়ার কাজে যথাসাধ্য করে থাকি আর এখন আমি বেশ কয়েকটা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করছি। ভাইবোনেরা এখনও বলে যে, আমি যখন বক্তৃতা দিই, তখন আমার “প্রবল” উদ্যম দেখা যায়। আমি যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞ যে, এই বয়সেও আমার কর্মশক্তি কমে যায়নি।

যদিও তরুণ বয়সে মৃত্যুর ভয় আমাকে গ্রাস করে ফেলেছিল কিন্তু বাইবেলের সঠিক জ্ঞান লাভ করা আমাকে অনন্তজীবনের নিশ্চিত আশা প্রদান করেছে, যে-জীবনকে যিশু ‘জীবনের উপচয়’ বা পূর্ণরূপে জীবন বলে উল্লেখ করেছিলেন। (যোহন ১০:১০) এখন আমি সেই সময়ের—যিহোবার কাছ থেকে প্রচুর আশীর্বাদসহ শান্তি, নিরাপত্তা ও আনন্দে পরিপূর্ণ এক জীবনের—জন্য অধীর অপেক্ষা করে আছি। আমাদের সেই প্রেমময় সৃষ্টিকর্তা মহিমান্বিত হোন, যাঁর নাম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার বিশেষ সুযোগ আমাদের রয়েছে।—গীত. ৮৩:১৮.

[২২, ২৩ পৃষ্ঠার মানচিত্র]

(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)

সুইজারল্যান্ড

বার্ন

জুরিখ

আরবোঁ

শ্তিনাক

ইতালি

রোম

কমো

মিলান

আদ্দা নদী

কাস্তিওনি আন্দেভেন্নো

ফায়েনজা

সুলমোনা

ভেন্‌ততেনে

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]

গিলিয়েড-এ যাওয়ার পথে

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]

গিলিয়েড-এ জুসেপ্পের সঙ্গে

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের বিয়ের দিন

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার প্রিয় স্ত্রী ৫৫ বছর ধরে আমার পাশে রয়েছে