সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

“তোমার দক্ষিণ হস্তে নিত্য সুখভোগ”

“তোমার দক্ষিণ হস্তে নিত্য সুখভোগ”

জীবনকাহিনি

“তোমার দক্ষিণ হস্তে নিত্য সুখভোগ”

বলেছেন লোয়িস দিদুর

‘আমার মনে হয়, আমি যে-বাছাইটা করেছি, সেটা না করলেই ভালো হতো,’ জীবনে আপনি কত বার এইরকম কোনো কিছু বলেছেন? ৫০ বছর ধরে পূর্ণসময়ের সেবায় রত থাকার পর, আমি এমন কোনো স্থায়ী অপ্রীতিকর বিষয়ের কথা চিন্তা করে বের করতে পারি না, যা যিহোবার দক্ষিণ হস্তে থাকার সময় ঘটেছে। এর কারণটা আমি বলছি।

আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৩৯ সালে আর আমি আরও চার জন বোন ও এক জন ভাইয়ের সঙ্গে কানাডার সাসকাচেয়ানের গ্রামাঞ্চলে বড়ো হয়েছি। বিস্তীর্ণ তৃণভূমির খামারে জীবনযাপন করা বেশ আনন্দের ছিল। একদিন, যিহোবার সাক্ষিরা এসে আমার বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল আর আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ঈশ্বরের কোনো নাম আছে কি না। তারা আমাদেরকে গীতসংহিতা ৮৩:১৮ পদ থেকে যিহোবা নামটি দেখিয়েছিল। সেই বিষয়টা আমাকে ঈশ্বর ও তাঁর বাক্য সম্বন্ধে আরও জানতে আগ্রহী করে তুলেছিল।

সেই সময়ে, খামার এলাকার ছেলে-মেয়েরা এক কক্ষবিশিষ্ট পল্লী বিদ্যালয়গুলোতে যেত, যেগুলোতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হতো। স্কুলে যাওয়ার জন্য তাদের ঘোড়ায় চড়ে অথবা হেঁটে হেঁটে অনেক মাইল যেতে হতো। সেই এলাকার বিভিন্ন পরিবার স্কুলের শিক্ষকের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর দেখাশোনা করত। এক বছর, জন দিদুর নামে একজন নতুন শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা করার জন্য আমার বাবা-মায়ের পালা এসেছিল।

আমি জানতাম না যে, এই যুবকেরও ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি অনেক আগ্রহ রয়েছে। একবার আমি সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছিলাম আর আমার বাবাও তখন সেগুলোর সমর্থক ছিলেন। জন শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিল: “কোনো মানুষেরই অন্যের ওপর শাসন করার অধিকার নেই। একমাত্র ঈশ্বরেরই সেই অধিকার রয়েছে।” এরপর আরও অনেক আগ্রহজনক কথাবার্তা হয়েছিল।

জনের জন্ম হয়েছিল ১৯৩১ সালে আর তাই সে যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট দুর্দশা সম্বন্ধে শুনেছিল। ১৯৫০ সালে যখন হঠাৎ কোরিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন সে বিভিন্ন পাদরির কাছে একজন বিশ্বাসীর যুদ্ধে জড়িত হওয়া সঠিক কি না, সেই বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল। সবাই বলেছিল যে, খ্রিস্টানরা অস্ত্র হাতে নিতে পারে। পরে, সে যিহোবার সাক্ষিদের কাছে সেই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিল। তারা তাকে যুদ্ধের ব্যাপারে প্রাথমিক খ্রিস্টানদের গৃহীত শাস্ত্রীয় অবস্থান সম্বন্ধে দেখিয়েছিল। জন ১৯৫৫ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। এর পরের বছর আমিও বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। আমরা দুজনেই জানতাম যে, আমরা আমাদের জীবন ও শক্তি দিয়ে যিহোবার সেবা করতে চাই। (গীত. ৩৭:৩, ৪) ১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে আমাদের বিয়ে হয়।

যেহেতু আমাদের এলাকার জেলা সম্মেলনগুলো জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হতো, তাই আমাদের বিবাহবার্ষিকীর দিন বেশিরভাগ সময়ই আমরা সম্মেলনে থাকতাম। সেই সময়ে আমরা বিয়েকে সম্মান করে এমন হাজার হাজার ব্যক্তির সাহচর্য লাভ করে আনন্দিত হতাম। ১৯৫৮ সালে আমরা প্রথম বারের মতো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা পাঁচ জন সাসকাচেয়ান থেকে গাড়িতে করে নিউ ইয়র্ক সিটির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলাম। এক সপ্তাহ ধরে, আমরা দিনের বেলা গাড়ি চালাতাম এবং প্রতি রাতে তাঁবুতে ঘুমাতাম। পেনসিলভানিয়ার বেথলেহেমে দেখা হওয়া একজন ভাই যখন আমাদেরকে তার পরিবারের সঙ্গে সেই রাতে তাদের ঘরে থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তখন আমরা কতটা অবাক হয়েছিলাম, তা একটু ভেবে দেখুন! তার স্বতঃস্ফূর্ত দয়ার কারণে আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটিভাবে নিউ ইয়র্ক সিটিতে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। সেই বিরাট সম্মেলন আমাদেরকে যিহোবার সেবা করে যে-অসাধারণ আনন্দ লাভ করা যায়, সেটার গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করেছিল! গীতরচক যেমনটা লিখেছিলেন: “তোমার দক্ষিণ হস্তে নিত্য সুখভোগ।”—গীত. ১৬:১১.

অগ্রগামীর কাজ করা

এক বছর পর, ১৯৫৯ সালে আমরা অগ্রগামীর কাজ শুরু করেছিলাম আর আমরা সাসকাচেয়ানের বিস্তীর্ণ তৃণভূমির একটা পাহাড়ের চূড়ায় ছোটো ট্রেলার হাউসে থাকতাম। সেখান থেকে আপনি মাইলের পর মাইল এলাকা দেখতে পাবেন আর এর মধ্যে বেশ কিছু মাইল পর্যন্ত আমাদের প্রচারের এলাকা ছিল।

একদিন, শাখা অফিস থেকে আমাদের কাছে একটা আগ্রহজনক চিঠি আসে। আমি তাড়াহুড়ো করে জনের কাছে যাই। সে তখন ট্র্যাক্টর মেরামত করছিল। সেই চিঠিতে আমাদেরকে অন্টারিওর রেড লেক শহরে বিশেষ অগ্রগামীর কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমরা জানতাম না যে, সেই জায়গাটা কোথায় আর তাই আমরা সেই জায়গাটা খুঁজে বের করার জন্য তাড়াতাড়ি মানচিত্র বের করেছিলাম।

সেই এলাকা খোলামেলা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি থেকে কতই না আলাদা ছিল! সেই সময়ে আমাদের বড়ো বড়ো বনাঞ্চল এবং সোনার খনির কাছাকাছি গড়ে ওঠা ছোটো ছোটো শহর দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রথম দিন, আমরা যখন সেখানে থাকার জায়গা খুঁজছিলাম, তখন একটা ছোট্ট মেয়ে আমাদেরকে তার প্রতিবেশীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুনেছিল। সে দৌড়ে তার মায়ের কাছে গিয়েছিল, যিনি আমাদের সেই রাতটা তার ঘরে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ভূগর্ভস্থ ঘরের মাটির মেঝেতে আমাদের জন্য বিছানা করা হয়েছিল। পরের দিন, আমরা একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম আর সেটা ছিল দুই রুমবিশিষ্ট একটা কাঠের ঘর, যেখানে কোনো জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও আসবাবপত্র ছিল না, শুধু একটা টিনের হিটার ছিল, যেটাতে কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো হতো। আমরা পুরোনো জিনিসপত্রের দোকান থেকে কিছু জিনিস কিনেছিলাম আর অল্পসময়ের মধ্যে সেগুলো নিয়েই নিজেদের বেশ পরিতৃপ্ত বলে মনে করেছিলাম।

আমাদের এলাকার ২০৯ কিলোমিটারের (১৩০ মাইলের) মধ্যে কোনো মণ্ডলী ছিল না। সোনার খনিগুলোতে কর্মরত অনেক শ্রমিক ইউরোপ থেকে এসেছিল আর তারা নিজেদের ভাষায় একটা বাইবেল পেতে পারে কি না, সেই বিষয়ে আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল। অল্পসময়ের মধ্যেই, আমরা ৩০টা চমৎকার বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম। ছয় মাসের মধ্যে, একটা ছোটো মণ্ডলী গঠিত হয়েছিল।

একজন মহিলা, যার সঙ্গে আমরা অধ্যয়ন করতাম, তার স্বামী নিজের স্ত্রীকে সংশোধন করার জন্য ফোন করে তার যাজককে আসতে বলেছিলেন। সেই আলোচনার সময়, যাজক বলেছিলেন যে, আমাদের অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিত্ব সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া উচিত। সেই মহিলা তাদের ক্যাথলিক বাইবেল নিয়ে এসেছিলেন এবং যাজকের বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ দেখাতে বলেছিলেন। সেই যাজক বাইবেলটি নিয়ে টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেছিলেন যে, তার কোনো কিছু প্রমাণ করার দরকার নেই। চলে যাওয়ার সময় তিনি ইউক্রেনিয়ান ভাষায় বলে গিয়েছিলেন যে, তারা যেন আমাদের ঘর থেকে বের করে দেয় এবং আর কোনো দিন ঢুকতে না দেয়। তিনি বুঝতে পারেননি যে, জন ইউক্রেনিয়ান ভাষা বোঝে!

এর কিছু দিন পর, আমরা রেড লেক থেকে চলে যাই কারণ জনকে সীমার কাজের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল। কিন্তু, প্রায় এক বছর পর জন যখন একটা জেলা সম্মেলনের বাপ্তিস্মের বক্তৃতা দিচ্ছিল, তখন বাপ্তিস্মপ্রার্থীদের মধ্যে সেই স্বামীও ছিলেন! যাজকের সঙ্গে সেই ঘটনার কারণে তিনি নিজেও বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেছিলেন।

ভ্রমণ কাজে ব্যস্ত

সীমার কাজ করার সময়, আমরা ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের সঙ্গে থাকার অতুলনীয় আনন্দ লাভ করেছিলাম। আমরা সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম, যারা আমাদেরকে তাদের ঘরে থাকতে দিয়েছিল এবং আমাদের সঙ্গে জীবনের বিভিন্ন বিষয় ভাগ করে নিয়েছিল। একবার আমরা ওপরের এমন একটা ঘরে ছিলাম, যেখানে শীতকালে কোনো উত্তাপের ব্যবস্থা ছিল না। ভোর বেলা আমরা শুনতে পেতাম, সেই ঘরের বয়স্ক বোন নিঃশব্দে আমাদের রুমে ঢুকে ছোট্ট স্টোভে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন। অল্প সময় পরে, তিনি আবার একটা গামলা ও গরম জল নিয়ে ফিরে আসতেন, যাতে আমরা সেই দিনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি। তিনি যেভাবে নিঃশব্দে ও ধীরেসুস্থে কাজ করতেন, তা থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি।

ভ্রমণের কাজ আমাকে যিহোবার আরও নিকটবর্তী হতে সাহায্য করেছিল। আলবার্টার একটা সীমার মধ্যে সুদূর উত্তরের একটা খনির শহর ছিল, যেখানে একজন বোন বাস করতেন। যিহোবার সংগঠন সেই বিচ্ছিন্ন এলাকায় থাকা বোনকে কীভাবে দেখেছিল? প্রতি ছয় মাস পর পর, আমরা প্লেনে করে এক সপ্তাহের জন্য সেখানে যেতাম আর তার সঙ্গে ঠিক সেভাবেই পরিচর্যা ও সভাগুলো করতাম, যেভাবে শহরের একটা বড়ো মণ্ডলীতে করা হতো। এই বিষয়টা ছোট্ট মেষতুল্য প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতি যিহোবার যে কোমল যত্ন রয়েছে, সেই বিষয়ে মনে করিয়ে দিত।

আমাদের জন্য যারা থাকার ব্যবস্থা করেছিল, তাদের অনেকের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রেখেছিলাম। এটা আমাকে জনের দেওয়া প্রথম উপহারগুলোর মধ্যে একটার কথা মনে করিয়ে দেয় আর সেটা ছিল চিঠি লেখার কাগজ ভরতি একটা রঙিন বাক্স। আমরা সেই লেখার সামগ্রী ব্যবহার করে, চিঠির মাধ্যমে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার বিষয়টা খুবই উপভোগ করতাম। আমি সেই চিঠির বাক্সটা এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি।

আমরা যখন টরোন্টোর একটা সীমায় ছিলাম, তখন কানাডার বেথেল থেকে একজন ভাই ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আমরা বেথেলে যাওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করে দেখতে চাই কি না। তিনি কখন আমাদের উত্তর জানতে চেয়েছিলেন? “সম্ভব হলে, পরের দিন!” তিনি উত্তর পেয়েছিলেন।

বেথেল সেবা

কার্যভারের প্রতিটা পরিবর্তন আমাদেরকে যিহোবার হস্তে থাকার ফলে যে-সুখ আসে, সেটার বিভিন্ন দিক দেখতে সাহায্য করেছে। আর ১৯৭৭ সালে আমরা যখন বেথেলে চলে গিয়েছিলাম, তখনও তা দেখতে সাহায্য করেছিল। কয়েক জন অভিষিক্ত ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে আমরা শুধু তাদের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি তাদের উচ্চসম্মানও দেখতে পেয়েছিলাম।

বেথেলের নতুন তালিকা আমাদের বেশ ভালো লেগেছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কাপড়চোপড় তখন সুটকেসের ভিতরে নয় বরং ড্রয়ারে থাকত আর আমরা একটা মণ্ডলীর সদস্য ছিলাম। আমার কার্যভার পালন করার পাশাপাশি, দর্শনার্থী দলগুলোকে বেথেল ঘুরে দেখানোও সবসময় আমার জন্য এক আনন্দদায়ক বিষয় ছিল। আমি বেথেলে যে-কাজ করা হয় তা ব্যাখ্যা করতাম, দর্শনার্থী ভাইবোনদের মন্তব্য শুনতাম এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতাম।

দ্রুত সময় কেটে যায় আর ১৯৯৭ সালে জনকে নিউ ইয়র্কের প্যাটারসনে শাখা কমিটির সদস্যদের জন্য স্কুল-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এরপর, আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, আমরা ইউক্রেনে যাওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করতে চাই কি না। আমাদেরকে বিষয়টা নিয়ে মনোযোগ সহকারে ও প্রার্থনাপূর্বক চিন্তা করতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। সেই দিন সন্ধ্যার মধ্যেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ।

আরও একটা পরিবর্তন—ইউক্রেন

আমরা ১৯৯২ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে আর এরপর ১৯৯৩ সালে ইউক্রেনের কিভে বিশাল আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। এই সম্মেলনগুলো আমাদেরকে পূর্ব ইউরোপের ভাইবোনদের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। ইউক্রেনের লেভিফে আমাদের নতুন থাকার জায়গাটা ছিল, একটা পুরোনো বাড়ির তৃতীয় তলায়। সেখানে জানালা থেকে এমন একটা উঠান দেখা যেত, যেখানে একটা বড়ো লাল মোরগ আর এক ঝাঁক মুরগির বাচ্চা ছিল। আমার মনে হতো যেন আমি সাসকাচেয়ানের খামারেই আছি। সেই বাড়িতে আমরা বারো জন থাকতাম। বেথেলে কাজ করার জন্য আমাদের প্রতিদিন ভোর বেলা শহরের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো।

ইউক্রেনে থাকতে আমাদের কেমন লেগেছিল? এমন অনেক লোকের সঙ্গে থাকা নম্রতা গড়ে তোলার মতো এক বিষয় ছিল, যারা বিভিন্ন পরীক্ষা, নিষেধাজ্ঞা এবং কারাদণ্ড ভোগ করেছিল। তা সত্ত্বেও, তারা তাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় রেখেছিল। আমরা যখন তাদের প্রশংসা করতাম, তখন তারা বলত, “আমরা যিহোবার জন্য তা করেছি।” তারা কখনো এমন মনে করেনি যে, তাদেরকে এমনি এমনি পরিত্যাগ করা হয়েছে। এমনকী এখনও আপনি যদি কাউকে তার দয়ার কারণে ধন্যবাদ জানান, তাহলে তিনি যিহোবাই যে সমস্ত উত্তম বিষয়ের দাতা সেটা স্বীকার করে হয়তো এইরকম উত্তর দেবেন, “যিহোবাকে ধন্যবাদ দিন।”

ইউক্রেনে অনেকে হেঁটে হেঁটে সভাতে যায়, যাতে তারা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলার এবং পরস্পরকে উৎসাহিত করার জন্য সময় পেতে পারে। এর জন্য হয়তো এক ঘন্টা অথবা আরও বেশি হাঁটতে হয়। লেভিফে এখন ৫০টারও বেশি মণ্ডলী রয়েছে আর এগুলোর মধ্যে ২১টা মণ্ডলী বেশ কয়েকটা হলবিশিষ্ট একটা বড়ো কিংডম হল বিল্ডিং ব্যবহার করে থাকে। রবিবারগুলোতে সভার জন্য ভাইবোনেরা যখন স্রোতের মতো আসতে থাকে, তখন তা দেখতে অপূর্ব লাগে।

আমরা অল্পসময়ের মধ্যেই ভাইবোনদের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ বোধ করেছিলাম আর এই ভাইবোনেরা শান্ত স্বভাবের এবং অন্যদের যত্ন নেওয়ার জন্য উৎসুক ছিল। আমার যখন ভাষা বুঝতে সমস্যা হয়—যা এখনও হয়ে থাকে—তখন তারা অনেক ধৈর্য দেখায়। তারা মুখে যা বলে, তাদের চোখেও প্রায়ই সেই অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে।

আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে প্রকৃত নির্ভরতার এক উদাহরণ, ২০০৩ সালে কিভের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেখা গিয়েছিল। আমরা যখন সবেমাত্র ব্যস্ত পাতালরেলের প্ল্যাটফর্মে নেমেছি, তখন একটি ছোটো মেয়ে হেঁটে আমাদের কাছে আসে এবং শান্তভাবে বলে, “আমি হারিয়ে গিয়েছি। আমি আমার দিদিমাকে খুঁজে পাচ্ছি না।” মেয়েটি আমাদের ব্যাজ কার্ড দেখেছিল এবং আমরা যে সাক্ষি তা জানত। সে অনেক সাহসী ছিল আর কান্নাকাটি করেনি। আমাদের সঙ্গে থাকা একজন সীমা অধ্যক্ষের স্ত্রী সেই মেয়েকে নিয়ে স্টেডিয়ামের হারানো এবং প্রাপ্তি বিভাগে গিয়েছিলেন। শীঘ্র মেয়েটি তার দিদিমার সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছিল। এমনকী হাজার হাজার লোকের মধ্যেও, ছোটো মেয়েটি আমাদের প্রতি যে-চমৎকার নির্ভরতা দেখিয়েছিল, সেটা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

২০০১ সালের মে মাসে আমাদের শাখা অফিসের নতুন বিল্ডিংগুলো উৎসর্গীকরণের জন্য অনেক দেশ থেকে বিভিন্ন ভাইবোন ইউক্রেনে এসেছিল। রবিবার সকালে স্টেডিয়ামে একটা বিশেষ বক্তৃতার পর, ভাইবোনদের বিরাট দল রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে নতুন বেথেল দেখতে এসেছিল। সেই দৃশ্য কখনোই ভোলার মতো নয়! আমি সেই ভাইবোনদের দেখে খুবই অভিভূত হয়েছিলাম, যারা অনেক শান্ত ছিল ও শৃঙ্খলা বজায় রেখেছিল। এই বিষয়টা ঈশ্বরকে সেবার করার মাধ্যমে যে-সুখ পাওয়া যায়, সেটার প্রতি আমার উপলব্ধিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

এক বিরাট পরিবর্তন

দুঃখের বিষয় হল, ২০০৪ সালে জনের রোগনির্ণয় করে ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। আমরা তার চিকিৎসার জন্য কানাডায় ফিরে গিয়েছিলাম। তার শরীরের অবস্থা কেমোথেরাপির প্রথম পর্যায়টা সহ্য করার মতো সমর্থ ছিল না আর তাই তাকে কয়েক সপ্তাহ ধরে নিবিড় পরিচর্যার অধীনে থাকতে হয়েছিল। আনন্দের বিষয়টা হল, তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। যদিও সে প্রায় কথাই বলতে পারত না, কিন্তু তার চোখে সেই ব্যক্তিদের জন্য কৃতজ্ঞতার অভিব্যক্তি দেখা যেত, যারা তার সঙ্গে দেখা করতে আসত।

কিন্তু, সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেনি আর সেই বছর নভেম্বর মাসের ২৭ তারিখে সে মারা গিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল যেন আমার দেহের একটা বড়ো অংশ হারিয়ে গিয়েছে। জন আর আমি একসঙ্গে যিহোবার সেবা করাকে অনেক উপভোগ করেছি। আমার তখন কী করার ছিল? আমি ইউক্রেনে ফিরে গিয়েছিলাম। সেখানকার বেথেল পরিবার ও মণ্ডলীর সদস্যরা যে-উষ্ণ ভালোবাসা দেখিয়েছে, সেটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

আমাদের জীবনে কখনো এমন সময় আসেনি, যখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্তগুলোর জন্য আপশোস করেছি। আমরা এক সুখী জীবন ও সেইসঙ্গে সর্বোত্তম মেলামেশা উপভোগ করেছি। আমি জানি যে, যিহোবার মঙ্গলভাব সম্বন্ধে এখনও আমার অনেক কিছু শেখা বাকি আছে আর আমি চিরকাল তাঁর সেবা করে যেতে চাই কারণ আমি সত্যিই ‘সদাপ্রভুর দক্ষিণ হস্তে সুখ’ খুঁজে পেয়েছি।

[৬ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

“আমাদের জীবনে কখনো এমন সময় আসেনি, যখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্তগুলোর জন্য আপশোস করেছি”

[৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

বিয়ের সময় জনের সঙ্গে

[৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমি যখন অন্টারিওর রেড লেকে একজন বিশেষ অগ্রগামী ছিলাম

[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

২০০২ সালে ইউক্রেনে জনের সঙ্গে