সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

সত্তর বছর ধরে এক এক যিহুদির বস্ত্রের অঞ্চল ধরে থাকা

সত্তর বছর ধরে এক এক যিহুদির বস্ত্রের অঞ্চল ধরে থাকা

জীবনকাহিনি

সত্তর বছর ধরে এক এক যিহুদির বস্ত্রের অঞ্চল ধরে থাকা

বলেছেন লেনার্ড স্মিথ

কিশোর বয়সের শুরুর দিকে, বাইবেলের দুটো বাক্যাংশ আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। বর্তমানে ৭০ বছরেরও বেশি সময় পর, আমি এখনও সেই সময়টার কথা মনে করতে পারি, যখন আমি সখরিয় ৮:২৩ পদের অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলাম, যে-পদ বলে, “দশ দশ পুরুষ এক এক যিহূদী পুরুষের বস্ত্রের অঞ্চল” ধরে আছে। তারা যিহুদি পুরুষকে বলে: “আমরা তোমাদের সহিত যাইব, কেননা আমরা শুনিলাম, ঈশ্বর তোমাদের সহবর্ত্তী।”

যিহুদি পুরুষ চিত্রিত করে অভিষিক্ত খ্রিস্টানদেরকে আর “দশ দশ পুরুষ” চিত্রিত করে ‘আরও মেষকে’ বা ‘যিহোনাদবদেরকে,’ যে-নামে তারা তখন পরিচিত ছিল। * (যোহন ১০:১৬) এই সত্যটা যখন আমি উপলব্ধি করেছিলাম, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, পৃথিবীতে আমার চিরকাল বেঁচে থাকার আশা, অভিষিক্ত শ্রেণীর প্রতি আমার অনুগত সমর্থনের ওপর কতটা নির্ভর করে।

মথি ২৫:৩১-৪৬ পদে প্রাপ্ত “মেষ” ও “ছাগ” সম্বন্ধে যিশুর দৃষ্টান্তটাও আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। “মেষ” সেই ব্যক্তিদের চিত্রিত করে, যারা ধ্বংসের সময়ে অনুকূল বিচার লাভ করে কারণ তারা পৃথিবীতে এখনও বিদ্যমান খ্রিস্টের অভিষিক্ত ভাইদের প্রতি সৎকর্ম করে। একজন অল্পবয়সি যিহোনাদব হিসেবে আমি নিজেকে এই কথা বলেছিলাম, ‘লেন, তুমি যদি চাও যে খ্রিস্ট তোমাকে একজন মেষ হিসেবে গণ্য করুক, তাহলে তোমাকে তাঁর অভিষিক্ত ভাইদের সমর্থন করতে হবে, তাদের নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে কারণ ঈশ্বর তাদের সহবর্তী।’ সেই বোধগম্যতা আমাকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্দেশনা দিয়েছে।

‘আমার স্থান কোথায়?’

আমার মা ১৯২৫ সালে বেথেলের একটা সভার হলে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। সেই হলকে লন্ডন ট্যাবার্নাকল বলা হতো আর সেই এলাকার ভাইবোনেরা সেটা ব্যবহার করত। ১৯২৬ সালের ১৫ অক্টোবর আমার জন্ম হয়। আমি ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে একটা সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম, যেটা ইংল্যান্ডের উপকূলবর্তী এলাকা ডোভারে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাইবেলের সত্যের প্রতি আমার ভালোবাসা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল। যেহেতু আমার মা একজন অভিষিক্ত খ্রিস্টান ছিলেন, তাই রূপকভাবে প্রথমে আমি যে-‘যিহূদীর বস্ত্রের অঞ্চল’ ধরেছিলাম, তা ছিল আমার মায়ের বস্ত্রের অঞ্চল। সেই সময়ে, আমার বাবা ও দিদি যিহোবার সেবা করত না। আমরা দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের জিলিংহ্যাম মণ্ডলীর সদস্য ছিলাম, যে-মণ্ডলীর অধিকাংশ সদস্য অভিষিক্ত খ্রিস্টান ছিল। মা প্রচার কাজের প্রতি উদ্যোগ দেখানোর ক্ষেত্রে এক চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন।

১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, লেস্টার শহরে অনুষ্ঠিত একটা সম্মেলনে “নীতিনিষ্ঠা” শিরোনামের একটি বক্তৃতায় নিখিলবিশ্বের শাসন সংক্রান্ত বিচার্য বিষয় সম্বন্ধে তুলে ধরা হয়েছিল। সেই বক্তৃতা আমাকে প্রথম বারের মতো এটা বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, আমরা যিহোবা ও শয়তানের মধ্যে উত্থাপিত বিচার্য বিষয়ে জড়িত রয়েছি। তাই, আমাদের যিহোবার পক্ষসমর্থন করতে হবে এবং নিখিলবিশ্বের সার্বভৌম হিসেবে তাঁর প্রতি আমাদের নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখতে হবে।

সেই সম্মেলনে, অগ্রগামী সেবার ওপর অনেক জোর দেওয়া হয়েছিল এবং অল্পবয়সিদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছিল যেন তারা এই সেবাকে তাদের লক্ষ্য করে তোলে। “সংগঠনের মধ্যে অগ্রগামীদের স্থান” শিরোনামের বক্তৃতাটি আমাকে এইরকমটা ভাবতে পরিচালিত করেছিল, ‘আমার স্থান কোথায়?’ সেই সম্মেলন আমাকে এই বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছিল যে, একজন যিহোনাদব হিসেবে আমার দায়িত্ব হচ্ছে, অভিষিক্ত শ্রেণীকে সাহায্য করার জন্য প্রচার কাজে যথাসাধ্য করা। লেস্টারে থাকতেই আমি একজন অগ্রগামী হওয়ার জন্য আবেদনপত্র পূরণ করেছিলাম।

যুদ্ধ চলাকালীন অগ্রগামী সেবা

১৯৪১ সালে ১ ডিসেম্বর, ১৫ বছর বয়সে আমাকে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। আমার প্রথম অগ্রগামী সঙ্গী ছিলেন আমার মা, কিন্তু প্রায় এক বছর পর স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে অগ্রগামী সেবা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। লন্ডন শাখা তখন আমার সঙ্গী হিসেবে রন পারকিন নামে আরেকজন অগ্রগামীকে কার্যভার দিয়েছিল, যিনি এখন পুয়ের্টো রিকোর শাখা কমিটিতে সেবা করছেন।

আমাদেরকে কেন্ট প্রদেশের উপকূলবর্তী শহর ব্রডস্টার্জ ও রামস্‌গেটে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে আমরা একটা রুম ভাড়া নিয়েছিলাম। বিশেষ অগ্রগামীদের মাসিক হাতখরচ ছিল ৪০ শিলিং (তখন প্রায় ৮ মার্কিন ডলার)। তাই, ভাড়া দেওয়ার পর, জীবনধারণের জন্য আমাদের হাতে সামান্যই অর্থ থাকত আর আমরা সবসময় নিশ্চিত থাকতাম না যে, আমাদের পরের বেলার খাবার কোথা থেকে আসবে। কিন্তু, যিহোবা কোনো না কোনোভাবে আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জুগিয়ে দিতেন।

আমাদের বেশিরভাগ সময়ই সাইকেল চালাতে হতো আর আমরা উত্তর সাগর থেকে আসা প্রচণ্ড বাতাসের বিপরীতে অনেক কষ্ট করে ভারী জিনিসপত্রে বোঝাই সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যেতাম। এ ছাড়া, আমাদেরকে বিমান আক্রমণ এবং জার্মান ভি-ওয়ান ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হতো, যেগুলো লন্ডনকে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য কেন্টের অনেক নীচ দিয়ে উড়ে যেত। একবার, আমাকে সাইকেলের ওপর থেকে রাস্তার পাশের একটা নালায় লাফ দিয়ে পড়তে হয়েছিল, যখন একটা বোমা আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে কাছের একটা মাঠে বিস্ফোরিত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, আমরা কেন্টে অগ্রগামী সেবা করে যে-বছরগুলো কাটিয়েছিলাম, সেগুলো অনেক আনন্দের ছিল।

আমি একজন “বেথেল পরিচারক” হই

আমার মা সবসময়ই বেথেল সম্বন্ধে প্রশংসা করতেন। “আমার মনে হয়, তুমি একজন বেথেল পরিচারক হলে, সেটাই তোমার জন্য সবচেয়ে ভালো হবে,” তিনি বলতেন। তাই, ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসে আমি যখন তিন সপ্তাহের জন্য লন্ডন বেথেলে গিয়ে সেখানকার কাজে সাহায্য করার আমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলাম, তখন আমি কতটা আনন্দিত ও অবাক হয়েছিলাম, তা একটু কল্পনা করুন। তিন সপ্তাহের শেষে, শাখার দাস প্রাইস হিউজ আমাকে বেথেলে থেকে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে আমি যে-প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলাম, তা আমাকে বাকি জীবনের জন্য গড়ে তুলেছিল।

সেই সময়ে লন্ডন বেথেলে প্রায় ৩০ জন সদস্য ছিল, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল অবিবাহিত যুবক ভাই, তবে সেখানে বেশ কয়েক জন অভিষিক্ত ভাইও ছিল, যাদের মধ্যে ছিল প্রাইস হিউজ, এডগার ক্লে এবং জ্যাক বার, যিনি পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হয়েছিলেন। একজন যুবক হিসেবে এইসমস্ত ‘স্তম্ভের’ আধ্যাত্মিক তত্ত্বাবধানে থেকে কাজ করার মাধ্যমে খ্রিস্টের ভাইদের সমর্থন করতে পারাটা কতই না বিশেষ এক সুযোগ ছিল!—গালা. ২:৯.

একদিন বেথেলে, একজন ভাই আমাকে বলেছিলেন যে, আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য দরজায় একজন বোন দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এটা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, আমার মা একটা পার্সেল হাতে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মা বলেছিলেন, আমার কাজ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেইজন্য তিনি ভিতরে যাবেন না, তবে তিনি আমাকে সেই পার্সেলটা দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটা গরম ওভারকোট ছিল। তার প্রেমময় অভিব্যক্তি আমাকে হান্নার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল, যিনি তার ছোট্ট ছেলে শমূয়েল আবাসে কাজ করার সময়, তার জন্য একটা বস্ত্র নিয়ে গিয়েছিলেন।—১ শমূ. ২:১৮, ১৯.

গিলিয়েড—এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা

১৯৪৭ সালে, আমরা যারা বেথেলে সেবা করছিলাম, তাদের মধ্য থেকে পাঁচ জন ভাইবোনকে যুক্তরাষ্ট্রের গিলিয়েড স্কুল-এ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আর পরের বছর আমরা ১১তম ক্লাসে যোগ দিয়েছিলাম। আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন নিউ ইয়র্কের উত্তরাঞ্চলে যেখানে স্কুলটা অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রচণ্ড শীত ছিল। আমার মা আমার জন্য যে-গরম কোটটা নিয়ে এসেছিলেন, সেটা থাকায় আমি কত খুশিই না হয়েছিলাম!

আমি গিলিয়েডে যে-ছয় মাস কাটিয়েছিলাম, তা অবিস্মরণীয় ছিল। ১৬টা দেশ থেকে আসা সহছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মেলামেশা করা আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করেছিল। সেই স্কুল থেকে আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে, আমি পরিপক্ব খ্রিস্টানদের সাহচর্য থেকেও উপকৃত হয়েছিলাম। আমার সহছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একজন ছিলেন লয়েড ব্যারি; নির্দেশকদের মধ্যে একজন ছিলেন অ্যালবার্ট শ্রোডার; আর কিংডম ফার্মের (যেখানে গিলিয়েড স্কুল অবস্থিত ছিল) অধ্যক্ষ ছিলেন জন বুথ, যারা পরে পরিচালকগোষ্ঠীর সদস্য হয়েছিল। এই ভাইদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রেমময় পরামর্শকে এবং যিহোবা ও তাঁর সংগঠনের প্রতি তাদের আনুগত্যের চমৎকার উদাহরণকে আমি মূল্যবান বলে গণ্য করে থাকি।

সীমার কাজ এবং বেথেলে ফিরে যাওয়া

গিলিয়েড শেষ করার পর, আমাকে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওতে সীমার কাজ করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। যদিও আমার বয়স তখন মাত্র ২১ বছর, কিন্তু ভাইবোনেরা আমার তারুণ্যের উদ্যমকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে নিয়েছিল। সেই সীমায়, আমি অভিজ্ঞ বয়স্ক পুরুষদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছিলাম।

কয়েক মাস পর, আমাকে আরও প্রশিক্ষণের জন্য ব্রুকলিন বেথেলে ফিরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সময়, আমি মিলটন হেনশেল, কার্ল ক্লাইন, নেথেন নর, টি. জে. (বাড) সুলেভান এবং লিম্যান সুইংগ্যালের মতো স্তম্ভের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিলাম, যারা সকলে একসময় পরিচালকগোষ্ঠীর সদস্য হয়েছিল। তাদেরকে কাজ করতে দেখা এবং তাদের খ্রিস্টীয় জীবনধারা লক্ষ করা এক অনুপ্রেরণাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল। যিহোবার সংগঠনের প্রতি আমার আস্থা শতগুণ বেড়ে গিয়েছিল। এরপর, আমাকে পরিচর্যার জন্য আবার ইউরোপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আমার মা ১৯৫০ সালে মারা যান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর, আমি আমার বাবা ও দিদি ডোরার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছিলাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, যেহেতু মা এখন আর বেঁচে নেই আর আমিও ঘর থেকে চলে গিয়েছি, তাই সত্যের ব্যাপারে তারা কী করতে চায়। তারা হ্যারি ব্রাউনিং নামে একজন বয়স্ক অভিষিক্ত ভাইকে চিনত ও তাকে সম্মান করত আর তারা তার সঙ্গে সত্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য রাজি হয়েছিল। এক বছরের মধ্যে বাবা ও ডোরা দিদি বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। বাবাকে পরে জিলিংহ্যাম মণ্ডলীর একজন দাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর ডোরা দিদি, রয় মরটন নামে একজন বিশ্বস্ত প্রাচীনকে বিয়ে করেছিল আর ২০১০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যিহোবাকে অনুগতভাবে সেবা করেছিল।

ফ্রান্সে সাহায্য করা

স্কুলে আমি ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও ল্যাটিন ভাষা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম আর এই তিনটে ভাষার মধ্যে ফ্রেঞ্চ ভাষাই আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল। তাই, আমাকে যখন ফ্রান্সের প্যারিস বেথেলে সাহায্য করার জন্য সেখানে যেতে বলা হয়, তখন আমার মধ্যে অনিশ্চয়তার এক অনুভূতি কাজ করেছিল। সেখানে আঁরি জেজ্যা নামে একজন বয়স্ক অভিষিক্ত ভাইয়ের সঙ্গে আমার কাজ করার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল, যিনি শাখা দাস ছিলেন। যদিও সেই কার্যভার সবসময় সহজ ছিল না আর আমি নিঃসন্দেহেই অনেক ভুল করেছি, তবে সেখানে আমি মানবসম্পর্ক সম্বন্ধে অনেক কিছু শিখেছি।

এ ছাড়া, যুদ্ধের পর ১৯৫১ সালে প্যারিসে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল আর সেটা সংগঠিত করার কাজে আমিও জড়িত ছিলাম। আমাকে সাহায্য করার জন্য লেয়পল জনটেস নামে একজন কমবয়সি ভ্রমণ অধ্যক্ষ বেথেলে এসেছিলেন। পরবর্তী সময়ে, লেয়পল শাখা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সম্মেলনটা আইফেল টাওয়ারের কাছাকাছি পালে দে স্পরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২৮টা দেশ থেকে প্রতিনিধি এসেছিল। শেষের দিন, ১০,৪৫৬ জনের উপস্থিতি দেখে ৬,০০০ জন ফ্রেঞ্চ সাক্ষি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল!

আমি যখন প্রথম ফ্রান্সে পৌঁছাই, তখন আমার ফ্রেঞ্চ ভাষা খুব একটা ভালো ছিল না। এর চেয়ে খারাপ বিষয়টা হল, আমি একটা বড়ো ভুল করেছিলাম আর তা হল, আমি শুধুমাত্র তখনই কথা বলার জন্য মুখ খুলতাম, যখন আমি নিশ্চিত থাকতাম যে, আমার ফ্রেঞ্চ ঠিক আছে। কিন্তু, আপনি যদি ভুল না করেন, তাহলে আপনাকে কখনোই সংশোধন করা হবে না আর আপনি উন্নতিও করতে পারবেন না।

সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি এমন একটা স্কুলে ভরতি হয়েছিলাম, যেখানে বিদেশিদের ফ্রেঞ্চ শেখানো হতো। সন্ধ্যা বেলায় যখন সভা থাকত না, তখন আমি ক্লাসে যোগ দিতাম। আমি ফ্রেঞ্চ ভাষাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম আর এত বছরে সেই ভালোবাসা আরও বেড়েছে। আর তা উপকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে কারণ আমি ফ্রান্স শাখায় অনুবাদের কাজে সাহায্য করতে পেরেছি। পরে আমি একজন অনুবাদক হয়েছি, ইংরেজি থেকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় অনুবাদ করেছি। দাস শ্রেণীর জোগানো প্রচুর আধ্যাত্মিক খাদ্য সারা বিশ্বব্যাপী ফ্রেঞ্চভাষী ভাইবোনদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে সাহায্য করতে পারাটা একটা বিশেষ সুযোগ ছিল।—মথি ২৪:৪৫-৪৭.

বিয়ে এবং আরও বিশেষ সুযোগ

১৯৫৬ সালে আমি এস্টার নামে একজন সুইস অগ্রগামীকে বিয়ে করি, যার সঙ্গে কয়েক বছর আগে আমার দেখা হয়েছিল। লন্ডন বেথেলের পাশের কিংডম হলে (সেই পুরোনো লন্ডন ট্যাবার্নাকলে, যেখানে আমার মা বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন) আমাদের বিয়ে হয়েছিল। ভাই হিউজ আমাদের বিয়ের বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এস্টারের মা সেখানে উপস্থিত ছিলেন আর তারও স্বর্গীয় আশা ছিল। বিয়ে করে আমি শুধু প্রেমময় ও অনুগত এক সঙ্গীই পাইনি কিন্তু সেইসঙ্গে আমার চমৎকার, আধ্যাত্মিকমনা শাশুড়ির মূল্যবান সাহচর্যও লাভ করেছিলাম, যিনি ২০০০ সালে তার পার্থিব জীবন শেষ করেছেন।

আমাদের বিয়ের পর এস্টার ও আমি বেথেলের বাইরে থাকতাম। আমি বেথেলে অনুবাদের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম আর এস্টার প্যারিসের উপকণ্ঠে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করেছিল। সে অনেক লোককে যিহোবার দাস হয়ে ওঠার জন্য সাহায্য করেছে। ১৯৬৪ সালে আমাদের বেথেলে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এরপর ১৯৭৬ সালে, যখন প্রথম শাখা কমিটি গঠন করা হয়, তখন আমাকে কমিটির একজন সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। বছরের পর বছর ধরে এস্টার সবসময় প্রেমের সঙ্গে আমাকে সমর্থন করে এসেছে।

“তোমরা আমাকে সর্ব্বদা পাইবে না”

আমি নির্দিষ্ট সময় পর পর নিউ ইয়র্কে বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ পেতাম। সেই পরিদর্শনের সময়ে, আমি পরিচালকগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন সদস্যের কাছ থেকে উত্তম উপদেশ লাভ করতাম। উদাহরণস্বরূপ, একবার আমি যখন একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ সম্পাদন করার ব্যাপারে আমার উদ্‌বিগ্নতা প্রকাশ করেছিলাম, তখন ভাই নর হেসে বলেছিলেন: “চিন্তা করবেন না। কাজ করে চলুন!” এরপর থেকে অনেক বার, যখন আমার হাতে কাজ জমে গিয়েছে, তখন আমি আতঙ্কিত না হয়ে বরং একটার পর একটা কাজ করতে শুরু করেছি আর এর ফলে সাধারণত নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজগুলো শেষ হয়ে গিয়েছে।

যিশু মৃত্যুর ঠিক আগে তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন: “তোমরা আমাকে সর্ব্বদা” তোমাদের কাছে “পাইবে না।” (মথি ২৬:১১) একইভাবে, আমরা অর্থাৎ আরও মেষেরাও জানি যে, আমরা খ্রিস্টের অভিষিক্ত ভাইদের সবসময় পৃথিবীতে আমাদের কাছে পাব না। তাই, আমি ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিষিক্ত ব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করাকে—কৃতজ্ঞতা সহকারে এক এক যিহুদির বস্ত্রের অঞ্চল ধরে থাকাকে—এক অতুলনীয় সুযোগ হিসেবে মনে করি।

[পাদটীকা]

^ “যিহোনাদব” শব্দটির জন্য যিহোবার সাক্ষিরা—ঈশ্বরের রাজ্যের ঘোষণাকারী (ইংরেজি) বইয়ের ৮৩, ১৬৫, ১৬৬ পৃষ্ঠা এবং ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ১৩ পৃষ্ঠার ৫ ও ৬ অনুচ্ছেদ দেখুন।

[২১ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

ভাই নর হেসে বলেছিলেন: “চিন্তা করবেন না। কাজ করে চলুন!”

[১৯ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

(বামে) আমার মা ও বাবা

(ডানে) ১৯৪৮ সালে গিলিয়েডের ক্যাম্পাসে মায়ের দেওয়া গরম ওভারকোট পরা

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৯৭ সালে ফ্রান্স শাখার উৎসর্গীকরণের সময় ভাই লয়েড ব্যারির বক্তৃতা অনুবাদ করছি

[২১ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

(বামে) আমাদের বিয়ের দিন এস্টারের সঙ্গে

(ডানে) একসঙ্গে সাক্ষ্যদান করার সময়