সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমি বিজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম

আমি বিজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম

জীবনকাহিনি

আমি বিজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম

বলেছেন এলভা জার্ডি

প্রায় সত্তর বছর আগে, আমাদের ঘরে আসা একজন ব্যক্তি আমার বাবাকে এমন একটা প্রস্তাব দিয়েছিল, যা আমার জীবনকে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে। সেই স্মরণীয় দিনের পর থেকে, অন্য আরও অনেক ব্যক্তি আমার জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। সেই সময়ে, আমি এক অমূল্য বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিলাম, যেটাকে আমি অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে আরও বেশি মূল্যবান বলে গণ্য করি। এখন আমি আপনাদের তা বলছি।

১৯৩২ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে আমার জন্ম হয়েছিল আর আমার বাবা-মা যদিও ঈশ্বরে বিশ্বাস করত, তবে তারা গির্জায় যেত না। আমার মা আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, ঈশ্বর সবসময়ই আমাকে দেখছেন আর আমি যদি দুষ্টুমি করি তবে তিনি আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন। এই কারণে আমি ঈশ্বরকে ভয় পেতাম। তা সত্ত্বেও, আমি বাইবেলের প্রতি আগ্রহী ছিলাম। আমার মাসি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে যখন আমাদের ঘরে বেড়াতে আসতেন, তখন তিনি আমাকে বাইবেলের অনেক আগ্রহজনক গল্প বলতেন। আমি সবসময় তার আসার অপেক্ষায় থাকতাম।

আমি যখন কিশোর বয়সি, তখন আমার বাবা এক সেট বই পড়তেন, যেগুলো আমার মা একজন বয়স্ক মহিলার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সেই মহিলা একজন যিহোবার সাক্ষি ছিলেন। আমার বাবা সেই খ্রিস্টীয় প্রকাশনাদিতে যা পড়েছিলেন, তাতে তিনি এতটাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে রাজি হয়েছিলেন। একদিন সন্ধ্যা বেলা তিনি যখন বাইবেল অধ্যয়ন করছিলেন, তখন তিনি দেখতে পান যে, আমি আড়ি পেতে তাদের কথা শুনছি। তিনি আমাকে বিছানায় পাঠিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তখন সেই ব্যক্তি বলে ওঠেন, “এলভাকেও বসতে দিন না।” সেই প্রস্তাবের কারণে আমি এক নতুন জীবন শুরু করতে ও সত্য ঈশ্বর যিহোবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিলাম।

এর অল্পসময় পরেই আমি আর বাবা খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দিতে শুরু করেছিলাম। বাবা যা যা শিখেছিলেন, সেগুলো তাকে তার জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তন করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি এমনকী তার মেজাজকেও নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছিলেন। এই বিষয়টা আমার মা আর দাদা ফ্রাঙ্ককে সভায় যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিল। * আমরা চার জনই উন্নতি করেছিলাম আর অবশেষে বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার সাক্ষি হয়েছিলাম। তখন থেকে, বয়স্ক অনেক ব্যক্তি আমার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

যখন কেরিয়ার বাছাইয়ের সময় হয়েছিল

কিশোর বয়সে, আমি আমাদের মণ্ডলীর বয়স্ক ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম। তাদের মধ্যে ছিলেন এলিস প্লেইস নামে একজন বয়স্ক বোন, যিনি আমাদের পরিবারের কাছে প্রথম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আমি তাকে ঠাকুরমার মতো দেখতাম। তিনি আমাকে জনসাধারণ্যের পরিচর্যার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং আমাকে বাপ্তিস্মের লক্ষ্যে পৌঁছাতে উৎসাহিত করেছিলেন। ১৫ বছর বয়সে আমি সেই লক্ষ্যে পৌঁছেছিলাম।

এ ছাড়া, আমি পার্সি ও মাজ [মার্গারেট] ডানহাম নামে বয়স্ক এক দম্পতির সান্নিধ্যে এসেছিলাম। তাদের সাহচর্য আমার ভবিষ্যতের ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আমি গণিত ভালোবাসতাম আর তাই আমি মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে, আমি গণিতের শিক্ষক হব। পার্সি ও মাজ দম্পতি ১৯৩০-এর দশকে লাটভিয়ায় মিশনারি হিসেবে সেবা করেছিল। ইউরোপে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন তাদেরকে অস্ট্রেলিয়ার বেথেলে সেবা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যেটা সিডনির অন্তর্বর্তী এক শহরতলিতে অবস্থিত ছিল। পার্সি ও মাজ দম্পতি আমার প্রতি প্রকৃত আগ্রহ দেখিয়েছিল। তারা এমন অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বলেছিল, যেগুলো তারা তাদের মিশনারি কাজ করার সময় উপভোগ করেছে। আমি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলাম যে, বাইবেল সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া, গণিত শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে আরও অনেক পরিতৃপ্তিদায়ক হবে। তাই, গণিত শিক্ষক হওয়ার পরিবর্তে আমি একজন মিশনারি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

ডানহাম দম্পতি আমাকে অগ্রগামীর কাজ শুরু করার মাধ্যমে মিশনারি সেবার জন্য প্রস্তুত হতে উৎসাহিত করেছিল। তাই, ১৯৪৮ সালে ১৬ বছর বয়সে আমি অন্য দশ জন অল্পবয়সি ভাইবোনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম, যারা সিডনির হার্টস্‌ভিলে আমার নিজের মণ্ডলীতে আনন্দের সঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করছিল।

পরবর্তী চার বছর, আমি ভিন্ন ভিন্ন চারটে শহরে অগ্রগামীর কাজ করেছিলাম আর সেগুলোর সবই নিউ সাউথ ওয়েলস্‌ ও কুইন্সল্যান্ডে অবস্থিত ছিল। আমার প্রথম বাইবেল ছাত্রী ছিলেন বেটি ল (এখন রেমন্যান্ট)। বেটি নামের সেই যত্নশীল মেয়েটি আমার চেয়ে দু-বছরের বড়ো ছিলেন। পরে তিনি আমার অগ্রগামী সঙ্গী হয়েছিলেন আর আমরা সিডনির প্রায় ২৩০ কিলোমিটার (১৪৫ মাইল) পশ্চিমে কাওরা শহরে সেবা করেছিলাম। যদিও আমরা শুধুমাত্র অল্পসময়ের জন্য একসঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করেছিলাম কিন্তু বেটি ও আমি এখনও বন্ধু।

বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কার্যভার লাভ করার পর আমি নারানডেরায়—কাওরা থেকে ২২০ কিলোমিটার (১৩৭ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এক শহরে—চলে গিয়েছিলাম। আমার নতুন সঙ্গী ছিলেন জয় লেনক্স (এখন হান্টার) নামে একজন উদ্যোগী অগ্রগামী আর তিনিও আমার চেয়ে দু-বছরের বড়ো ছিলেন। আমরাই ছিলাম সেই শহরে একমাত্র সাক্ষি। জয় আর আমি, রে ও এস্টার আয়রনস্‌ নামে এক অতিথিপরায়ণ দম্পতির সঙ্গে ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। তারা এবং তাদের এক ছেলে ও তিন মেয়ে সত্যের প্রতি আগ্রহী হয়েছিল। রে এবং তার ছেলে সাপ্তাহিক দিনগুলোতে শহরের বাইরে অবস্থিত ভেড়ার ও গমের খামারে কাজ করত আর এস্টার এবং মেয়েরা একটা স্থানীয় গেস্ট হাউস চালাত। জয় ও আমি প্রতি রবিবার আয়রনস্‌ পরিবার এবং তাদের প্রায় বারো জন গেস্টের জন্য প্রচুর খাবারদাবার রান্না করতাম, যারা সকলে রেল স্টেশনের ক্ষুধার্ত শ্রমিক ছিল। এই সেবার মাধ্যমে আমরা আমাদের ঘর ভাড়ার ব্যয় কিছুটা পূরণ করতাম। পরিষ্কার করার পর, আমরা আয়রনস্‌ পরিবারকে সুস্বাদু আধ্যাত্মিক খাবার—সাপ্তাহিক প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন—পরিবেশন করতাম। রে, এস্টার ও তাদের চার ছেলে-মেয়ে সত্যে এসেছিল এবং নারানডেরা মণ্ডলীর প্রথম সদস্য হয়েছিল।

১৯৫১ সালে আমি সিডনিতে অনুষ্ঠিত যিহোবার সাক্ষিদের একটা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে আমি মিশনারি কাজের ব্যাপারে আগ্রহী এমন অগ্রগামীদের জন্য আয়োজিত একটা বিশেষ সভায় গিয়েছিলাম। একটা বিশাল তাঁবুতে অনুষ্ঠিত সেই সভাতে ৩০০ জনেরও বেশি অগ্রগামী যোগ দিয়েছিল। ব্রুকলিন বেথেল থেকে আসা নেথেন নর সেই দলের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে সুসমাচার নিয়ে যাওয়ার জরুরি প্রয়োজন সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমরা তার বলা প্রতিটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম। সেখানে উপস্থিত অনেক অগ্রগামী পরে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ও অন্যান্য এলাকায় রাজ্যের কাজ করতে শুরু করেছিল। আমি সেই ১৭ জন অস্ট্রেলীয় ভাইবোনের মধ্যে একজন হতে পেরে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম, যাদেরকে ১৯৫২ সালে গিলিয়েড স্কুল-এর ১৯তম ক্লাসে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ঠিক ২০ বছর বয়সে আমার মিশনারি হওয়ার স্বপ্ন সত্য হতে যাচ্ছিল!

যখন পরিশোধনের প্রয়োজন হয়েছিল

গিলিয়েডে আমি যে-নির্দেশনা এবং সাহচর্য লাভ করেছিলাম, সেগুলো কেবল আমার বাইবেলের জ্ঞানকে বৃদ্ধি ও আমার বিশ্বাসকে শক্তিশালীই করেনি কিন্তু সেইসঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বের ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। আমি অল্পবয়সি আর আদর্শবাদী ছিলাম এবং আমার নিজের ও সেইসঙ্গে অন্যদের কাছ থেকে সিদ্ধতা আশা করার প্রবণতা ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত কঠোর ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমি যখন ভাই নরকে অল্পবয়সি বেথেলাইট ভাইদের একটা দলের সঙ্গে প্রীতিম্যাচ খেলতে দেখেছিলাম, তখন আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম।

গিলিয়েড নির্দেশকরা—যারা সকলেই বিচক্ষণ ও অনেক অভিজ্ঞ পুরুষ—নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিল যে, আমি অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। তারা আমার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিল এবং আমাকে আমার চিন্তাভাবনায় রদবদল করতে সাহায্য করেছিল। ধীরে ধীরে, আমি যিহোবাকে একজন কঠোর ও শুধু দাবি করে এমন এক ঈশ্বর হিসেবে নয় বরং একজন প্রেমময় এবং উপলব্ধিপরায়ণ ঈশ্বর হিসেবে দেখতে শুরু করেছিলাম। আমার কয়েক জন সহপাঠীও আমাকে সাহায্য করেছিল। তাদের একজনের কথা আমার মনে আছে, যিনি বলেছিলেন: “এলভা, যিহোবা তো স্বর্গে চাবুক হাতে বসে নেই। নিজের প্রতি এতটা কঠোর হয়ো না!” তার স্পষ্ট কথাগুলো আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল।

গিলিয়েডের পর আমাকে ও আমার চার জন সহপাঠীকে আফ্রিকার নামিবিয়ায় কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। খুব শীঘ্র আমরা ৮০টা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতে শুরু করেছিলাম। আমি নামিবিয়াকে ও মিশনারি জীবন ভালোবাসতাম, কিন্তু আমি গিলিয়েডের এমন একজন সহপাঠীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, যাকে সুইজারল্যান্ডে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। নামিবিয়ায় এক বছর কাটানোর পর, আমি সুইজারল্যান্ডে আমার হবু বরের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। আমাদের বিয়ের পর আমি আমার স্বামীর সঙ্গে তার কাজে যোগ দিয়েছিলাম, যে একজন সীমা অধ্যক্ষ ছিল।

যখন এক চরম সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলাম

সীমার কাজে আনন্দদায়ক পাঁচ বছর কাটানোর পর আমাদেরকে সুইজারল্যান্ডের বেথেলে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে বেথেল পরিবারের মধ্যে আমার চারপাশে আধ্যাত্মিকভাবে পরিপক্ব বয়স্ক অনেক ভাই ও বোনকে পেয়ে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।

কিন্তু, এর অল্পসময় পরেই, আমি এক প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার স্বামী আমার ও যিহোবার প্রতি অবিশ্বস্ত হয়ে পড়েছে। তখন সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আমি একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম! আমি জানি না যে, বেথেল পরিবারে আমার প্রিয় বয়স্ক বন্ধুদের ভালোবাসা ও সমর্থন ছাড়া আমি কীভাবে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারতাম। আমার যখন কথা বলার প্রয়োজন হতো, তখন তারা আমার কথা শুনত আর যখন নীরব থাকার প্রয়োজন হতো, তখন আমাকে নীরব থাকতে দিত। তাদের সান্ত্বনার বাক্য ও সদয় কাজগুলো আমাকে আমার অব্যক্ত কষ্টের সময়ে সমর্থন করেছিল এবং এমনকী যিহোবার আরও নিকটবর্তী হতে সাহায্য করেছিল।

এ ছাড়া, আমি অনেক বছর আগের সেইসমস্ত বিজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের বলা কথাগুলো স্মরণ করি, যারা পরীক্ষা সহ্য করে শক্তিশালী হয়েছিল। মাজ ডানহামের কথাগুলো এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন: “এলভা, যিহোবার সেবা করার সময় জীবনে তুমি অনেক পরীক্ষার মুখোমুখি হবে, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলো এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে আসতে পারে, যারা তোমার অনেক কাছের মানুষ। সেই পরীক্ষাগুলোর সময়ে যিহোবার নিকটবর্তী থেকো। মনে রেখো, তুমি তাঁকে সেবা করো, কোনো অসিদ্ধ মানুষকে নয়!” বোন মাজের পরামর্শ আমাকে অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমি এই বিষয়ে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলাম যে, আমার স্বামীর ভুলগুলোকে আমি কখনোই যিহোবার কাছ থেকে নিজেকে পৃথক করার সুযোগ হতে দেব না।

পরবর্তী সময়ে, আমি আমার পরিবারের কাছাকাছি থেকে অগ্রগামীর কাজ করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সমুদ্রযাত্রা করে দেশে ফেরার সময় আমি নিয়মিতভাবে একদল সহযাত্রীর সঙ্গে বাইবেল থেকে প্রাণবন্ত আলোচনা উপভোগ করেছিলাম। সেই দলের মধ্যে আর্নি জার্ডি নামে একজন শান্ত স্বভাবের নরওয়েজিয়ান ব্যক্তি ছিল। সে যা শুনেছিল, সেগুলো তার ভালো লেগেছিল। আর্নি পরে সিডনিতে আমার পরিবার এবং আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সে দ্রুত আধ্যাত্মিক উন্নতি করেছিল এবং সত্যে এসেছিল। ১৯৬৩ সালে আর্নি ও আমার বিয়ে হয় আর এর দু-বছর পর আমাদের ছেলে গ্যারির জন্ম হয়।

যখন আরেকটা ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিলাম

আর্নি, গ্যারি এবং আমি এক পরিতৃপ্তিদায়ক ও সুখী পারিবারিক জীবন উপভোগ করছিলাম। শীঘ্র আর্নি আমাদের ঘরটাকে আরও বড়ো করে আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে এসেছিল। কিন্তু, বিয়ের ছয় বছর পর আমরা ভিন্ন ধরনের এক ঝড়ের মুখে পড়ে গিয়েছিলাম। আর্নির ব্রেইন ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। হাসপাতালে দীর্ঘসময় ধরে রেডিয়েশন থেরাপি নেওয়ার সময় আমি প্রতিদিন তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। অল্পসময়ের জন্য তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল; এরপর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছিল এবং সে স্ট্রোক করেছিল। আমাকে বলা হয়েছিল যে, সে মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাঁচবে। কিন্তু, আর্নি বেঁচে ছিল। অবশেষে সে ঘরে ফিরে এসেছিল আর আমি ধীরে ধীরে সেবাশুশ্রূষা করে তাকে আবার সুস্থ করে তুলেছিলাম। পরবর্তী সময়ে, সে পুনরায় হাঁটতে পেরেছিল এবং আবারও মণ্ডলীতে প্রাচীন হিসেবে সেবা করতে শুরু করেছিল। তার হাসিখুশি স্বভাব ও রসিকতাবোধ তার সুস্থতার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল আর এটা আমাকে স্বচ্ছন্দে ক্রমাগত তার সেবাযত্ন করে যেতে সাহায্য করেছিল।

কয়েক বছর পর ১৯৮৬ সালে আর্নির স্বাস্থ্য আবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যেই আমার বাবা-মা মারা গিয়েছে আর তাই আমরা সিডনির বাইরে চমৎকার ব্লু মাউন্টেইনে আমাদের বন্ধুবান্ধবের কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। গ্যারি পরে ক্যারিন নামে একজন চমৎকার আধ্যাত্মিকমনা বোনকে বিয়ে করেছিল আর তারা প্রস্তাব দিয়েছিল যে, আমরা চার জন একসঙ্গে একটা বাড়িতে থাকতে পারি। কয়েক মাসের মধ্যে আমরা এমন একটা বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম, যেটা আর্নি ও আমি যে-বাড়িতে থাকতাম, সেটার কাছাকাছিই ছিল।

আর্নি তার জীবনের শেষ ১৮ মাস শয্যাশায়ী ছিল আর তার সর্বক্ষণ যত্নের প্রয়োজন ছিল। আমাকে যেহেতু বেশিরভাগ সময় ঘরেই থাকতে হতো, তাই আমি প্রতিদিন দু-ঘন্টা বাইবেল ও বাইবেলভিত্তিক প্রকাশনা পড়ার জন্য ব্যয় করতাম। সেই অধ্যয়নের সময়, কীভাবে আমার পরিস্থিতির সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেই বিষয়ে আমি অনেক বিজ্ঞতাপূর্ণ পরামর্শ খুঁজে পেয়েছিলাম। এ ছাড়া, আমি আমাদের মণ্ডলীর বয়স্ক সদস্যদের কাছ থেকেও প্রেমময় সাক্ষাৎ লাভ করেছিলাম, যাদের মধ্যে কেউ কেউ একইরকম পরীক্ষা সহ্য করেছিল। তাদের সাক্ষাৎ আমাকে সত্যি সত্যিই অনেক উৎসাহিত করেছিল! আর্নি ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে পুনরুত্থানের প্রতি এক নিশ্চিত আশা রেখে মারা যায়।

আমার সর্বোত্তম সহায়

অল্পবয়সে আমি বাস্তববাদী ছিলাম। কিন্তু, আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের জীবন কদাচিৎ সেভাবে মোড় নেয়, যেভাবে আমরা আশা করে থাকি। আমি প্রচুর আশীর্বাদ উপভোগ করেছি আর সেইসঙ্গে দুটো চরম দুঃখজনক ঘটনা—একজন সাথিকে অবিশ্বস্ততার কারণে এবং আরেকজন সাথিকে অসুস্থতার কারণে হারানোর বেদনা—সহ্য করেছি। এই পর্যন্ত আমি বিভিন্ন উৎস থেকে নির্দেশনা ও সান্ত্বনা লাভ করেছি। তবে, এখনও আমার সর্বোত্তম সহায় হচ্ছেন “অনেক দিনের বৃদ্ধ”—যিহোবা ঈশ্বর। (দানি. ৭:৯) তাঁর পরামর্শ আমার ব্যক্তিত্বকে গঠন করেছে এবং তা আমাকে মিশনারি কাজের পরিতৃপ্তিদায়ক অভিজ্ঞতা লাভ করার দিকে পরিচালিত করেছে। যখন বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তখন ‘সদাপ্রভুর দয়া আমাকে সুস্থির রাখিয়াছিল। তাহার দত্ত সান্ত্বনা আমার প্রাণকে আহ্লাদিত করিয়াছিল।’ (গীত. ৯৪:১৮, ১৯) এ ছাড়া, আমি আমার পরিবার এবং সেই ‘বন্ধু,’ যারা ‘দুর্দ্দশার জন্য জন্মে,’ তাদের ভালোবাসা ও সমর্থন উপভোগ করেছি। (হিতো. ১৭:১৭) তাদের মধ্যে অনেকে ছিল বিজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তি।

“প্রাচীনদের নিকটে প্রজ্ঞা আছে, দীর্ঘায়ু বুদ্ধিসমন্বিত,” কুলপতি ইয়োব বলেছিলেন। (ইয়োব ১২:১২) আমার জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে আমি বলতে পারি যে, সেটা সত্যি। বিজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের উপদেশ আমাকে সাহায্য করেছে, তাদের সান্ত্বনা আমাকে সমর্থন করেছে এবং তাদের বন্ধুত্ব আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। তাদের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি বলে আমি অনেক কৃতজ্ঞ।

এখন ৮০ বছর বয়সে আমি নিজেই একজন বয়স্ক ব্যক্তি। আমার অভিজ্ঞতা আমাকে বিশেষভাবে বয়স্ক ব্যক্তিদের চাহিদাগুলোর প্রতি সংবেদনশীল হতে সাহায্য করেছে। আমি এখনও তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ও তাদের সাহায্য করতে ভালোবাসি। তবে, আমি অল্পবয়সিদের সাহচর্যও উপভোগ করি। তাদের কর্মশক্তি উদ্দীপনাদায়ক এবং তাদের উদ্যম প্রভাববিস্তারকারী। আমি যখন বুঝতে পারি যে, অল্পবয়সিরা নির্দেশনা অথবা সমর্থনের জন্য আমার কাছে আসছে, তখন আমি তাদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াকে পরিতৃপ্তিদায়ক বলে মনে করি।

[পাদটীকা]

^ এলভার ভাই ফ্রাঙ্ক ল্যামবার্ট অস্ট্রেলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন উদ্যোগী অগ্রগামী হিসেবে সেবা করেছিলেন। যিহোবার সাক্ষিদের বর্ষপুস্তক ১৯৮৩ (ইংরেজি) বইয়ের ১১০-১১২ পৃষ্ঠায় তার রোমাঞ্চকর অনেক প্রচার অভিযানের মধ্যে একটা সম্বন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে।

[১৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

নারানডেরায় জয় লেনক্সের সঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করার সময়

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬০ সালে সুইজারল্যান্ড বেথেল পরিবারের সাথে এলভা

[১৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

অসুস্থ আর্নির যত্ন নেওয়ার সময়