সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবা আমাকে তাঁর ইচ্ছা পালন করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন

যিহোবা আমাকে তাঁর ইচ্ছা পালন করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন

জীবনকাহিনি

যিহোবা আমাকে তাঁর ইচ্ছা পালন করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন

বলেছেন ম্যাক্স লয়েড

সময়টা ছিল ১৯৫৫ সালের কোনো এক গভীর রাত। আমার একজন সহমিশনারি এবং আমি দক্ষিণ আমেরিকার প্যারাগুয়েতে আমাদের কার্যভারে ছিলাম, যখন ক্রুদ্ধ জনতা আমাদের বাড়িটা ঘিরে ফেলেছিল এবং চিৎকার করে বলছিল: “আমাদের ঈশ্বর হচ্ছেন একজন রক্তপিপাসু ঈশ্বর আর তিনি গ্রিংগসদের রক্ত চান।” কীভাবে আমরা অর্থাৎ গ্রিংগসরা (বিদেশিরা) এখানে এসেছিলাম?

এই সমস্তকিছুই শুরু হয়েছিল কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে, যেখানে আমি বড়ো হয়েছি এবং যেখানে যিহোবা আমাকে তাঁর ইচ্ছা পালন করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন। ১৯৩৮ সালে, আমার বাবা একজন সাক্ষির কাছ থেকে শত্রুরা (ইংরেজি) নামক বইটি নিয়েছিলেন। বাবা-মা দুজনে ইতিমধ্যেই সেই স্থানীয় পাদরিদের ওপর অসন্তুষ্ট ছিল, যারা বাইবেলের একটা অংশকে পৌরাণিক কাহিনি হিসেবে উল্লেখ করেছিল। প্রায় এক বছর পর, আমার বাবা-মা যিহোবার কাছে তাদের উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। সেই সময়ের পর থেকে, যিহোবার ইচ্ছা পালন করা আমাদের পারিবারিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। এরপর, বাপ্তিস্ম নিয়েছিল আমার দিদি লেসলি, যে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো আর আমি নিয়েছিলাম ১৯৫০ সালে, যখন আমার বয়স ছিল নয় বছর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই, অস্ট্রেলিয়াতে যিহোবার সাক্ষিদের বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদি ছাপানো এবং বিতরণ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তাই, একজন অল্পবয়সি হিসেবে আমি শুধু বাইবেল ব্যবহার করার মাধ্যমে আমার বিশ্বাসের ভিত্তি ব্যাখ্যা করতে শিখেছিলাম। কেন আমি পতাকা অভিবাদন করি না অথবা বিভিন্ন জাতির যুদ্ধকে সমর্থন করি না, তা দেখানোর জন্য আমি স্কুলে বাইবেল নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম।—যাত্রা. ২০:৪, ৫; মথি ৪:১০; যোহন ১৭:১৬; ১ যোহন ৫:২১.

স্কুলের অনেকে আমার সঙ্গে মিশত না কারণ আমাকে “একজন জার্মান গুপ্তচর” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়, স্কুলে বিভিন্ন চলচ্চিত্র দেখানো হতো। চলচ্চিত্র শুরু হওয়ার আগে প্রত্যেককে উঠে দাঁড়িয়ে দেশের জাতীয় সংগীত গাইতে হতো। আমি যখন বসে থাকতাম, তখন দুই কী তিন জন ছেলে আমার চুল ধরে আমাকে ওঠানোর চেষ্টা করত। অবশেষে, আমাকে আমার বাইবেলভিত্তিক বিশ্বাসের কারণে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, আমি বাড়িতে বসেই পত্রযোগে শিক্ষাদানের কোর্স করেছিলাম।

অবশেষে আমি যে-লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলাম

আমার বয়স যখন ১৪ বছর, তখন আমি একজন অগ্রগামী হিসেবে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা শুরু করার বিষয়ে এক ব্যক্তিগত লক্ষ্য স্থাপন করেছিলাম। তাই, সেই সময় আমি খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, যখন আমার বাবা-মা আমাকে প্রথমে একটা চাকরি খুঁজে বের করার এবং কাজে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল। তারা দৃঢ়ভাবে বলেছিল যে, বাড়িতে থাকা-খাওয়ার জন্য আমাকে খরচ দিতে হবে, তবে সেইসঙ্গে এও প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আমার বয়স যখন ১৮ হবে, তখন আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করতে পারব। আর এর ফলে আমি যে-অর্থ উপার্জন করতাম, তা নিয়ে নিয়মিতভাবে আলাপ-আলোচনা হতো। আমি তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম যে, অগ্রগামী কাজের জন্য আমি এই অর্থ জমিয়ে রাখতে চাই, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সেটা নিয়ে নিত।

যখন অগ্রগামীর কাজ করার সময় এসেছিল, তখন বাবা-মা আমার সঙ্গে বসে ব্যাখ্যা করেছিল যে, এতদিন আমি তাদেরকে যে-অর্থ দিয়েছি, সেগুলো তারা একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে রেখেছে। সেই সময় তারা আমাকে অগ্রগামীর কাজের জন্য কাপড়চোপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য সব অর্থ ফিরিয়ে দেয়। তারা আমাকে নিজের যত্ন নিতে এবং এর জন্য অন্যের ওপর নির্ভর না করতে শিখিয়েছিল। সেই সময়ের সেই প্রশিক্ষণ অত্যন্ত মূল্যবান বলে গণ্য হয়েছিল।

লেসলি দিদি এবং আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন প্রায়ই আমাদের ঘরে অগ্রগামীরা থাকত আর তাদের সঙ্গে পরিচর্যায় যেতে আমাদের অনেক ভালো লাগত। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আমরা সাধারণত ঘরে ঘরে পরিচর্যা করতাম, রাস্তায় সাক্ষ্য দিতাম এবং বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতাম। সেই বছরগুলোতে মণ্ডলীর একজন প্রকাশকের লক্ষ্য ছিল মাসে ৬০ ঘন্টা করে কাজ করা। প্রায় সময়ই মা সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারতেন, যেটা লেসলি দিদি এবং আমার জন্য এক চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করেছিল।

তাসমানিয়াতে অগ্রগামীর কাজ করা

আমার প্রথম অগ্রগামী কার্যভার ছিল অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়া দ্বীপে, যেখানে আমি আমার দিদি এবং দাদাবাবুর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু, শীঘ্র তারা গিলিয়েড স্কুল-এর ১৫তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য চলে গিয়েছিল। আমি খুবই লাজুক প্রকৃতির ছিলাম এবং এর আগে কখনো বাড়ি থেকে দূরে কোথাও ছিলাম না। কেউ কেউ ভবিষ্যদ্‌বাণী করে বলেছিল যে, আমি সেখানে তিন মাসের বেশি টিকতে পারব না। কিন্তু, এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৫০ সালে আমাকে একজন কোম্পানি দাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল, যেটাকে এখন প্রাচীনগোষ্ঠীর কোঅর্ডিনেটর বলে অভিহিত করা হয়। পরে, আমাকে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত করা হয় আর আরেকজন যুবক ভাই আমার সঙ্গী হয়ে ওঠে।

আমাদের কার্যভার ছিল এক বিচ্ছিন্ন তামা খনির শহরে, যেখানে কোনো সাক্ষি ছিল না। একদিন বিকেলে আমরা বাসে করে সেখানে উপস্থিত হই। প্রথম দিন রাতে আমরা একটা পুরোনো হোটেলে থাকি। পরের দিন আমরা যখন ঘরে ঘরে সাক্ষ্যদান করার জন্য বের হয়েছিলাম, তখন আমরা গৃহকর্তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, কোথাও কোনো খালি কামরা আছে বলে তারা জানে কি না। দিনের শেষে, একজন ব্যক্তি বলেন যে, প্রেসবিটারিয়ান গির্জার ঠিক পাশেই পরিচারকের ঘর খালি রয়েছে আর আমাদের সেখানকার ডিকনের সঙ্গে কথা বলে দেখা উচিত। সেই ডিকন বন্ধুত্বপরায়ণ ছিলেন এবং আমাদের ব্যবহারের জন্য ঘর খুলে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন সকালে পাদরির বাড়ির মধ্যে দিয়ে প্রচারে যাওয়াটা অনেক অদ্ভুত বলে মনে হতো।

সেই এলাকা ফলপ্রসূ ছিল। আমরা লোকেদের সঙ্গে চমৎকার আলোচনা করতে এবং অনেক বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করতে পেরেছিলাম। রাজধানীতে অবস্থিত গির্জার কর্তৃপক্ষরা যখন এই বিষয়টা জানতে পেরেছিল এবং শুনেছিল যে, যিহোবার সাক্ষিরা পরিচারকের ঘরে থাকে, তখন তারা সঙ্গেসঙ্গে আমাদেরকে বের করে দেওয়ার জন্য ডিকনকে চাপ দিয়েছিল। আবারও আমরা গৃহহীন হয়ে পড়েছিলাম!

পরের দিন দুপুর পর্যন্ত প্রচার করার পর, আমরা রাত কাটানোর জন্য একটা জায়গা খুঁজতে থাকি। সবচেয়ে উত্তম যে-জায়গা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম, তা হল স্টেডিয়ামের ছাউনি দেওয়া গ্যালারি। সেখানে আমরা আমাদের সুটকেসগুলো লুকিয়ে রেখেছিলাম এবং পুনরায় সাক্ষ্য দিতে শুরু করেছিলাম। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল কিন্তু আমরা একটা রাস্তা শেষ করার জন্য আরও কিছু ঘরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। একটা ঘরে একজন ব্যক্তি আমাদেরকে তার বাড়ির পিছনে দুই কামরাবিশিষ্ট একটা ছোটো ঘরে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন!

সীমার কাজ এবং গিলিয়েড

প্রচারের এই কার্যভারে প্রায় আট মাস থাকার পর, একজন সীমা অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য আমি অস্ট্রেলিয়ার শাখা অফিসের কাছ থেকে একটা আমন্ত্রণ লাভ করি। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম কারণ তখন আমার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। কয়েক সপ্তাহ প্রশিক্ষণ লাভ করার পর, আমি মণ্ডলীগুলোকে উৎসাহিত করার জন্য নিয়মিতভাবে পরিদর্শন করতে শুরু করি। আমার চেয়ে বয়সে যারা বড়ো—যাদের মধ্যে বলতে গেলে প্রায় প্রত্যেকেই পড়ে—তারা আমার যৌবনকে তুচ্ছ করে দেখেনি বরং আমি যে-কাজ করছিলাম, সেটার প্রতি সম্মান দেখিয়েছিল।

বিভিন্ন মণ্ডলীতে ভ্রমণ করার মধ্যে কত বৈচিত্র্যই না ছিল! একটা সপ্তাহে আমি যেতাম বাসে করে, আবার পরের সপ্তাহে ট্রামে করে, এরপর গাড়িতে করে অথবা এক হাতে সুটকেস আর অন্য হাতে প্রচারের ব্যাগ নিয়ে মোটরসাইকেলের পিছনে বসে। সহসাক্ষিদের সঙ্গে থাকাটা সত্যিই আনন্দদায়ক ছিল। একজন কোম্পানি দাস আমাকে তার সঙ্গে থাকতে দেওয়ার ব্যাপারে অনেক উৎসুক ছিলেন, যদিও তার বাড়িটা আংশিকভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সপ্তাহে বাথটাবের মধ্যে আমার বিছানা তৈরি করা হয়েছিল কিন্তু আমরা একত্রে আধ্যাত্মিকভাবে কত আনন্দিত সময়ই না কাটিয়েছিলাম!

১৯৫৩ সালে অবাক হওয়ার মতো আরেকটা বিষয় ঘটেছিল, যখন আমি গিলিয়েড স্কুল-এর ২২তম ক্লাসের একটা আবেদনপত্র পেয়েছিলাম। কিন্তু, আমার মধ্যে আনন্দ ও উদ্‌বিগ্নতার মিশ্র অনুভূতি কাজ করেছিল। কারণ আমার দিদি ও দাদাবাবু ১৯৫০ সালে গিলিয়েড থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর, তাদেরকে পাকিস্তানে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। এর এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যেই লেসলি দিদি অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। আমি ভাবছিলাম যে, এই ঘটনার পর এত শীঘ্র আমি যদি অন্য কোথাও যাই, তাহলে আমার বাবা-মা কেমন বোধ করবে? কিন্তু, তারা বলেছিল: “যিহোবা যেখানেই নির্দেশ করুন না কেন, সেখানেই যাও এবং তাঁর সেবা করো।” এরপর আমি আর বাবাকে দেখতে পাইনি। তিনি ১৯৫০ দশকের শেষের দিকে মারা গিয়েছিলেন।

কয়েক দিনের মধ্যেই আমি নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে ছয় সপ্তাহের সমুদ্রযাত্রার জন্য আরও পাঁচ জন অস্ট্রেলিয়ানের সঙ্গে একটা জাহাজে উঠি। যাওয়ার পথে আমরা বাইবেল পাঠ করতাম, অধ্যয়ন করতাম এবং সহযাত্রীদের কাছে সাক্ষ্যদান করতাম। নিউ ইয়র্কের উত্তরে সাউথ ল্যানসিংয়ে অবস্থিত স্কুল বিল্ডিং-এ যাওয়ার আগে, আমরা ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানকার সর্বোচ্চ উপস্থিতি ছিল ১,৬৫,৮২৯ জন!

আমাদের গিলিয়েড ক্লাসের ১২০ জন ছাত্র-ছাত্রী পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্ত থেকে এসেছিল। গ্র্যাজুয়েশন দিনের আগে পর্যন্ত আমাদের বলা হয়নি যে, সেবা করার জন্য আমাদেরকে কোথায় কার্যভার দেওয়া হচ্ছে। আমাদেরকে যে-দেশগুলোতে কার্যভার দেওয়া হয়েছে, সেই দেশগুলো সম্বন্ধে জানার জন্য আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দৌড়ে গিলিয়েড লাইব্রেরিতে যাই। আমি জানতে পারি যে, আমাকে যে-দেশে কার্যভার দেওয়া হয়েছে, সেই প্যারাগুয়ে ছিল এমন একটা দেশ, যেখানে রাজনৈতিক বিপ্লবের এক ইতিহাস রয়েছে। সেখানে পৌঁছানোর পর পরই আমি একদিন সকালে অন্যান্য মিশনারিকে রাতে যে-‘উদ্‌যাপন’ হয়েছিল, সেটা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করি। তারা একটু হেসে বলেছিল: “তুমি তোমার জীবনের প্রথম বিপ্লব সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভ করেছ। সামনের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখো।” প্রতিটা কোণায় সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে!

এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা

একবার, এক বিচ্ছিন্ন মণ্ডলীতে সাক্ষাৎ করার ও সেইসঙ্গে নতুন জগৎ সমাজ কার্যকর (ইংরেজি) চলচ্চিত্র দেখানোর জন্য আমি একজন সীমা অধ্যক্ষের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। আমরা আট বা নয় ঘন্টা ধরে যাত্রা করেছিলাম, প্রথমে ট্রেনে করে এরপর ঘোড়ায় এবং এক্কাগাড়িতে করে আর অবশেষে গরুর গাড়িতে করে। আমরা আমাদের সঙ্গে করে একটা জেনারেটর ও মুভি প্রজেক্টর নিয়ে গিয়েছিলাম। অবশেষে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর পর, আমরা পরের দিনটা খামারগুলো ঘুরে ঘুরে দেখি এবং সবাইকে সেই রাতে চলচ্চিত্র দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। প্রায় ১৫ জন লোক উপস্থিত হয়েছিল।

চলচ্চিত্র দেখতে শুরু করার প্রায় ২০ মিনিট পর, আমাদেরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ির ভিতরে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। আমরা প্রজেক্টরটা সঙ্গে করে নিয়ে তাদের কথামতো কাজ করেছিলাম। সেই সময়ই লোকেরা চিৎকার করছিল, বন্দুক চালাচ্ছিল এবং এই শ্লোগান দিচ্ছিল: “আমাদের ঈশ্বর হচ্ছেন একজন রক্তপিপাসু ঈশ্বর আর তিনি গ্রিংগসদের রক্ত চান।” সেখানে মাত্র দুজন গ্রিংগস ছিল আর তাদের মধ্যে একজন হলাম আমি! যারা সেখানে চলচ্চিত্র দেখতে এসেছিল, তারা সেই উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বাড়ির ভিতরে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু, বিরোধীরা ভোর ৩টা সময় আবারও এসেছিল, তাদের বন্দুক চালিয়েছিল এবং পরে সেই দিনই আমরা যখন শহরে ফিরে যাব, তখন আমাদেরকে দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছিল।

ভাইয়েরা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আর তিনি আমাদেরকে শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেল বেলা দুটো ঘোড়া নিয়ে আসেন। ফিরে যাওয়ার পথে যখনই আমরা ঝোপঝাড় অথবা গাছপালার কাছাকাছি এগিয়ে আসতাম, তখনই তিনি তার বন্দুক তুলে ধরে সেই জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যেতেন। আমি বুঝতে পারি যে, ঘোড়া একটা গুরুত্বপূর্ণ বাহন তাই পরে আমি একটা ঘোড়া কিনি।

আরও মিশনারি আসে

পাদরিরা নিয়মিতভাবে বিরোধিতা করা সত্ত্বেও, প্রচার কাজ ভালোভাবে এগিয়ে চলছিল। ১৯৫৫ সালে, পাঁচ জন নতুন মিশনারি আসে, যাদের মধ্যে এলসি সোয়ানসেন নামে একজন কানাডিয়ান যুবতী বোন ছিলেন, যিনি ২৫-তম গিলিয়েড ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন। তাকে আরেকটা শহরে কার্যভার দেওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা দুজন শাখা অফিসে কিছু সময়ের জন্য ছিলাম। তার বাবা-মা, যারা কখনোই সত্যকে নিজের করে নেয়নি, তাদের কাছ থেকে সামান্য সাহায্য নিয়েই সে যিহোবার সেবায় তার জীবন নিয়োজিত করেছিল। ১৯৫৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর, এলসি ও আমি বিয়ে করি এবং প্যারাগুয়ের দক্ষিণাঞ্চলে নিজেদের খরচে একটা মিশনারি হোমে থাকতে শুরু করি।

আমাদের বাড়িতে জল সরবরাহের কোনো ব্যবস্থা ছিল না; বরং, আমাদের বাড়ির পিছনে একটা কুয়ো ছিল। তাই, ভিতরে কোনো স্নানের ব্যবস্থা অথবা টয়লেট, ওয়াশিং মেশিন আর এমনকী কোনো রেফ্রিজারেটরও ছিল না। আর তাই আমাদের প্রতিদিন খাবার কিনে নিয়ে আসতে হতো। কিন্তু, সাধারণ জীবনযাপন এবং মণ্ডলীর ভাই ও বোনদের সঙ্গে আমাদের প্রেমময় সম্পর্ক এটাকে আমাদের বিবাহিত জীবনের অত্যন্ত আনন্দময় সময় করে তুলেছিল।

১৯৬৩ সালে, আমার মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্ট্রেলিয়াতে আসার কিছু দিন পরই তার হ্যার্ট অ্যাটাক হয় আর তা তার ছেলেকে দশ বছর পর দেখে তিনি অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন বলে হতে পারে। যখন প্যারাগুয়েতে ফিরে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসতে থাকে, তখন আমরা আমাদের জীবনের আরেকটা কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হই। মাকে কেউ যত্ন নেবে এই আশায় আমাদের কি মাকে হাসপাতালে রেখে প্যারাগুয়েতে আমাদের কার্যভারে ফিরে যাওয়া উচিত, যে-কার্যভার আমরা অনেক পছন্দ করতাম? অনেক প্রার্থনার পর এলসি এবং আমি সেখানে থাকার এবং মায়ের যত্ন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৬৬ সালে মা মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা তা করার পাশাপাশি পূর্ণসময়ের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

বেশ কিছু বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়াতে সীমা ও জেলার কাজ করা এবং প্রাচীনদের জন্য রাজ্যের পরিচর্যা বিদ্যালয়-এ শিক্ষা দেওয়া আমার জন্য এক বিশেষ সুযোগ ছিল। এরপর, আমাদের জীবনে আরেকটা রদবদল আসে। আমাকে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শাখা কমিটির একজন সদস্য হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। পরে, আমরা যখন নতুন শাখা অফিস নির্মাণ করতে যাচ্ছিলাম, তখন আমাকে নির্মাণ কমিটির সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। অনেক অভিজ্ঞ এবং সহযোগীপরায়ণ কর্মীর সাহায্যে এক চমৎকার শাখা অফিস নির্মাণ করা হয়েছিল।

এরপর আমাকে পরিচর্যা বিভাগে নিযুক্ত করা হয়, যে-বিভাগ একটা দেশের প্রচার কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলোর দেখাশোনা করে। এ ছাড়া, আমি একজন জোন ওভারসিয়ার (আঞ্চলিক অধ্যক্ষ) হিসেবে সাহায্য করার ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য শাখা পরিদর্শন করার সুযোগও লাভ করেছি। যেসমস্ত দেশের ভাইবোনদের যিহোবার প্রতি অনুগতভাবে বাধ্য থাকার ফলে জেলে ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে কয়েক বছর—এমনকী কয়েক দশক—কাটাতে হয়েছে, সেইসমস্ত দেশ পরিদর্শন করার মাধ্যমে আমার বিশ্বাস বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়েছে।

আমাদের বর্তমান কার্যভার

২০০১ সালে এক ক্লান্তিকর আঞ্চলিক ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর, যুক্তরাষ্ট্রে যে-নতুন শাখা কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেখানকার একজন সদস্য হিসেবে সেবা করার জন্য আমি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে আসার একটা আমন্ত্রণপত্র পাই। এলসি এবং আমি প্রার্থনা সহকারে আমন্ত্রণের ব্যাপারে বিবেচনা করি এবং আনন্দের সঙ্গে সেই কার্যভার গ্রহণ করি। ১১ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা এখনও ব্রুকলিন বেথেলে রয়েছি।

আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমার এমন একজন স্ত্রী রয়েছে, যে যিহোবার ইচ্ছা অনুযায়ী যেকোনো কাজ করতে পেরে আনন্দিত। এলসি এবং আমার বয়স এখন ৮০-র কোঠায় এবং এখনও আমরা যথেষ্ট সুস্থসবল আছি। আমরা চিরকাল ধরে যিহোবার শিক্ষাগুলো ও সেইসঙ্গে প্রচুর আশীর্বাদ উপভোগ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি, যা কিনা সেই ব্যক্তিরা লাভ করবে, যারা ক্রমাগত তাঁর ইচ্ছা পালন করে।

[১৯ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

একটা সপ্তাহে আমি যেতাম বাসে করে, আবার পরের সপ্তাহে ট্রামে করে, এরপর গাড়িতে করে অথবা এক হাতে সুটকেস আর অন্য হাতে প্রচারের ব্যাগ নিয়ে মোটরসাইকেলের পিছনে বসে

[২১ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

আমরা চিরকাল ধরে যিহোবার শিক্ষাগুলো . . . উপভোগ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি

[১৮ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

বাঁদিকে: অস্ট্রেলিয়াতে সীমার কাজের সময়

ডান দিকে: আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর, আমাদের বিয়ের দিন