সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যে-কারণে আমাদের জীবনের এক প্রকৃত অর্থ রয়েছে

যে-কারণে আমাদের জীবনের এক প্রকৃত অর্থ রয়েছে

জীবনকাহিনি

যে-কারণে আমাদের জীবনের এক প্রকৃত অর্থ রয়েছে

বলেছেন প্যাট্রিশিয়া স্মিথ

উনিশ-শো আটান্ন সালে, আমার ছেলে গ্যারি জন্মগ্রহণ করার পর পরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, কোনো একটা সমস্যা রয়েছে। কিন্তু, তার রোগ নির্ণয় করতে ডাক্তারদের দশ মাস সময় লেগেছিল এবং আরও পাঁচ বছর পর, লন্ডনের বিশেষজ্ঞরা বিষয়টা নিশ্চিত করেছিল। গ্যারি জন্মগ্রহণ করার নয় বছর পর যখন আমার মেয়ে লুইজের জন্ম হয়েছিল, তখন তার মধ্যে গ্যারির চেয়ে আরও গুরুতর লক্ষণগুলো দেখে আমি অনেক দুঃখিত হয়ে পড়েছিলাম।

“আপনার দুই সন্তানেরই এলএমবিবি রয়েছে * এবং এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই,” ডাক্তাররা শান্তভাবে আমাকে বলেছিল। সেই সময়, এই বিরল বংশগত রোগ সম্বন্ধে লোকেরা খুব কমই জানত। এই রোগের সাধারণ লক্ষণগুলোর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, ক্ষীণদৃষ্টিশক্তি, যা ধীরে ধীরে অন্ধতার দিকে পরিচালিত করে, স্থূলতা, হাতে এবং/অথবা পায়ে অতিরিক্ত আঙুল, বিকাশের ক্ষেত্রে ধীরতা, অঙ্গগুলোর একসঙ্গে কাজ না করার সমস্যা, ডায়াবিটিস, বাতের রোগ এবং কিডনির অস্বাভাবিকতা। এই কারণে, আমার সন্তানদের যত্ন নেওয়া সহজ হবে না। সাম্প্রতিক একটা গবেষণার অনুমান অনুযায়ী, ব্রিটেনের প্রতি ১,২৫,০০০ জন ব্যক্তির মধ্যে ১ জন ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত তবে আরও অনেক লোকের হয়তো এই রোগ অল্পমাত্রায় রয়েছে।

যিহোবা আমাদের “উচ্চ দুর্গ” হয়ে ওঠেন

বিয়ের পর পরই, যিহোবার একজন সাক্ষির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল আর তখনই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে, এটাই সত্য। কিন্তু, আমার স্বামী কখনোই আগ্রহ প্রকাশ করেনি। তার চাকরির কারণে আমরা বেশি দিন এক জায়গায় থাকতে পারতাম না, তাই আমার কোনো মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু, আমি সবসময় বাইবেল পড়তাম এবং যিহোবার কাছে প্রার্থনা করতাম। এই কথাগুলো পড়ার পর আমি অনেক সান্ত্বনা লাভ করেছিলাম যে, “সদাপ্রভু হইবেন ক্লিষ্টের জন্য উচ্চ দুর্গ, সঙ্কটের সময়ে উচ্চ দুর্গ,” এবং তিনি, ‘তাঁহার অন্বেষণকারীদিগকে পরিত্যাগ করিবেন না’!—গীত. ৯:৯, ১০.

গ্যারির যেহেতু ক্ষীণদৃষ্টি ছিল, তাই ছয় বছর বয়সে তাকে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলবর্তী একটা বোর্ডিং স্কুলে বিশেষ শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তার উদ্‌বিগ্নতার বিষয়গুলো জানানোর জন্য সে নিয়মিতভাবে আমাকে টেলিফোন করত আর টেলিফোনের মাধ্যমে আমি তাকে বাইবেলের মৌলিক নীতিগুলো বুঝতে সাহায্য করতাম। লুইজের জন্মের কয়েক বছর পর, আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ি, আমি মাল্টিপাল স্ক্‌লেরোসিস (কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্ররে রোগ) এবং ফাইব্রোমিয়ালজিয়া (এক ধরনের পেশীর রোগ) রোগে আক্রান্ত হই। গ্যারি ১৬ বছর বয়সে বোর্ডিং স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু, তার দৃষ্টিশক্তির অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং ১৯৭৫ সালে তাকে অন্ধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। ১৯৭৭ সালে আমার স্বামী আমাদের ছেড়ে চলে যায়।

গ্যারি ফিরে আসার পর পরই আমরা একটা প্রেমময় মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করেছিলাম এবং ১৯৭৪ সালে আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। সেই সময় আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলাম, যখন একজন প্রাচীন গ্যারিকে তার কৈশরের বছরগুলোতে বিভিন্ন শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছিল। অন্যান্য সাক্ষিরা আমাকে ঘরের টুকিটাকি কাজে সাহায্য করত এবং একসময় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সেই সাক্ষিদের মধ্যে পাঁচ জনকে আমাদের ঘরের দেখাশোনা করার জন্য নিযুক্ত করেছিল আর এর বিনিময়ে তাদেরকে বেতন দেওয়া হতো। এটা আমাদের জন্য কত উপকারজনকই না হয়েছিল!

গ্যারি সত্যে চমৎকার উন্নতি করে চলছিল এবং ১৯৮২ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। সে মনেপ্রাণে সহায়ক অগ্রগামীর কাজ করতে চেয়েছিল, আর তাই আমিও তার সঙ্গে সেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং বেশ কয়েক বছর তা করেছিলাম। এর কিছু সময় পর যখন সীমা অধ্যক্ষ গ্যারিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, “তুমি নিয়মিত অগ্রগামীর কাজ শুরু করছ না কেন, গ্যারি?” তখন আমার ছেলে অত্যন্ত খুশি হয়েছিল। তার ঠিক এইরকম উৎসাহেরই প্রয়োজন ছিল আর ১৯৯০ সালে তাকে একজন নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

গ্যারিকে দুবার হিপ রিপ্লেসমেন্ট করতে হয়েছিল, প্রথমে ১৯৯৯ সালে এবং পরে ২০০৮ সালে, কিন্তু লুইজের স্বাস্থ্যগত সমস্যা আরও বেশি গুরুতর ছিল। সে পুরোপুরি অন্ধ হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিল এবং আমি যখন তার এক পায়ে একটা অতিরিক্ত বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখেছিলাম, তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তারও এলএমবিবি রোগ আছে। পরীক্ষানিরীক্ষা করে শীঘ্র জানা গিয়েছিল যে, তার ভিতরের অনেক অঙ্গপ্রতঙ্গের মধ্যেও গুরুতর সমস্যা রয়েছে। পরবর্তী বছরগুলোতে, তাকে বড়ো বড়ো অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছিল, যার মধ্যে পাঁচ বার কিডনিতেই করাতে হয়েছিল। গ্যারির মতো তারও ডায়াবিটিস রয়েছে।

যেহেতু লুইজ জানে যে, অস্ত্রোপচারের সময় কোন জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে, তাই সে রক্ত ছাড়া চিকিৎসার বিষয়ে তার বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করার জন্য আগে থেকেই তার সার্জন, এনেস্থিওলজিস্ট এবং হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে। এর ফলে, তার সেইসব ব্যক্তিদের সঙ্গে এক উত্তম সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যারা খুব ভালোভাবে তার শারীরিক সমস্যাগুলোর যত্ন নেয়।

এক অর্থপূর্ণ জীবন উপভোগ করা

যিহোবাকে উপাসনা করার জন্য আমরা ঘরে অনেক কিছু করে থাকি। আধুনিক ইলেকট্রনিক সামগ্রী আসার আগে, আমি সাধারণত গ্যারি এবং লুইজের সামনে জোরে জোরে পাঠ করার জন্য অনেক ঘন্টা ব্যয় করতাম। এখন সিডি, ডিভিডি আর www.pr418.com ওয়েবসাইটের রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে আমরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সাপ্তাহিক বাইবেল অধ্যয়নের তালিকা উপভোগ করতে পারি এবং খ্রিস্টীয় সভাগুলোতেও অর্থপূর্ণ মন্তব্য দিতে পারি।

মাঝে মাঝে গ্যারি মুখস্থ করে উত্তর দেয় এবং ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয়ে তার যদি কোনো বক্তৃতা থাকে, তাহলে সে সেটা নিজের ভাষায় দিয়ে থাকে। ১৯৯৫ সালে তাকে একজন পরিচারক দাস হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং সে সবসময় কিংডম হলে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকে, মণ্ডলীর সদস্যদের অভ্যর্থনা জানায় ও সাউন্ড সিস্টেমের কাজে সহায়তা করে।

সহসাক্ষিরা পরিচর্যায় গ্যারিকে সাহায্য করে থাকে, বাতের ব্যথার কারণে সে যে-হুইলচেয়ার ব্যবহার করে, সেটাকে প্রায়ই ঠেলে নিয়ে যায়। একজন ভাই তাকে একজন আগ্রহী ব্যক্তির সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে সাহায্য করেছেন। এ ছাড়া, গ্যারি এমন একজন সাক্ষি বোনকে উৎসাহিতও করেছে, যিনি ২৫ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সেই আগ্রহী ব্যক্তি এবং এই বোন উভয়ই এখন সভাগুলোতে যোগদান করে।

নয় বছর বয়সে লুইজ তার দিদিমা ও তার যত্ন নিত এমন একজনের কাছ থেকে উল বোনার কাজ শেখে এবং আমি তাকে এমব্রয়ডারি করা শিখিয়েছিলাম। যেহেতু সে এইরকম হাতের কাজ অনেক পছন্দ করে, তাই সে বাচ্চাদের এবং মণ্ডলীর বয়স্ক সদস্যদের জন্য বিভিন্ন রঙের কম্বল বোনে। এ ছাড়া, সে আঠা দিয়ে ছোটো ছোটো ছবি লাগিয়ে শুভেচ্ছা কার্ডও তৈরি করে। সে যাদেরকে এই কার্ডগুলো দেয়, তারা সেগুলোকে অত্যন্ত মূল্যবান বলে গণ্য করে। কিশোর বয়সের প্রথম দিকে, সে টাচ-টাইপিং শিখেছিল। বর্তমানে, বিশেষ টকিং কম্পিউটারের সাহায্যে সে নিয়মিতভাবে ই-মেইলের মাধ্যমে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। লুইজ ১৭ বছর বয়সে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। বিশেষ প্রচার অভিযানের সময় আমরা একত্রে সহায়ক অগ্রগামীর কাজ উপভোগ করি। গ্যারির মতো লুইজও এমন এক জগৎ সম্বন্ধে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর তার বিশ্বাস প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন শাস্ত্রপদ মুখস্ত করে থাকে, যে-জগতে “অন্ধদের চক্ষু খোলা যাইবে” এবং “নগরবাসী কেহ বলিবে না, আমি পীড়িত।”—যিশা. ৩৩:২৪; ৩৫:৫.

যিহোবার অনুপ্রাণিত বাক্যে যে-মূল্যবান সত্যগুলো রয়েছে, সেগুলোর জন্য আমরা কতই না কৃতজ্ঞ! আমাদের মণ্ডলীর প্রেমময় সাহায্যের জন্য আমাদের হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে কারণ মণ্ডলীর সাহায্য ছাড়া বেশিরভাগ কাজ করাই আমাদের পক্ষে অসম্ভব হতো। আর বিশেষভাবে যিহোবা সাহায্য করেছেন বলে আমাদের জীবনের এক প্রকৃত অর্থ রয়েছে।

[পাদটীকা]

^ লরেন্স-মুন-বারডে-বিডল্‌ রোগটা সেই চার জন ডাক্তারের নামে নামকরণ করা হয়েছিল, যারা এই রোগটাকে শনাক্ত করেছিল। বর্তমানে এই রোগটাকে বারডে-বিডল্‌ বলা হয়। এর কোনো চিকিৎসা নেই।

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

[২৫ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

যিহোবার অনুপ্রাণিত বাক্যে যে-মূল্যবান সত্যগুলো রয়েছে, সেগুলোর জন্য আমরা কতই না কৃতজ্ঞ!