সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবা তাদেরকে পর্বতের ছায়ায় সুরক্ষা করেছিলেন

যিহোবা তাদেরকে পর্বতের ছায়ায় সুরক্ষা করেছিলেন

ভোর বেলা ঘরের সদর দরজা থেকে বের হয়েই একজন মহিলা তার দরজার সামনে একটা প্যাকেট দেখতে পান। তিনি সেটা তুলে নেন এবং চারিদিকে তাকান কিন্তু রাস্তায় কাউকে দেখতে পান না। কোনো অপরিচিত ব্যক্তি হয়তো রাতে এটা এখানে রেখে গিয়েছেন। তিনি প্যাকেটটা একটু খুলে দেখার সঙ্গেসঙ্গে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন। কিন্তু কেন? কারণ সেই প্যাকেটটার মধ্যে এমন বাইবেল সাহিত্যাদি রয়েছে, যেগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে! প্যাকেটটা জড়িয়ে ধরে তিনি নীরবে প্রার্থনা করেন, যিহোবাকে সেই মূল্যবান আধ্যাত্মিক খাদ্যের জন্য ধন্যবাদ জানান।

১৯৩০ এর দশকে জার্মানিতে এইরকম দৃশ্য দেখা যেত। ১৯৩৩ সালে নাতসি ক্ষমতায় আসার পর, দেশের বেশিরভাগ জায়গায় যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। “আমরা এই বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলাম যে, মানুষের তৈরি এই ধরনের কোনো আইন, যিহোবা এবং তাঁর নাম সম্বন্ধে ঘোষণা করার বিষয়টা থামাতে পারবে না,” রিচার্ট রুডল্ফ বলেন, যার বয়স এখন ১০০ বছরের ওপরে। * “আমাদের অধ্যয়ন এবং পরিচর্যার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যাদি। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে, সেগুলো আর সহজে পাওয়া যেত না। কীভাবে এই কাজ চলবে, সেটা নিয়ে আমরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।” রিচার্ট শীঘ্র বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি এক অস্বাভাবিক উপায়ে সেই চাহিদা পূরণ করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারেন। এটা পর্বতের ছায়ায় করতে হবে।—বিচার. ৯:৩৬.

চোরাচালানকারীদের পথে

আপনি যদি এলবে (বা লাবে) নদীর স্রোতের বিপরীত দিকে যেতে থাকেন, তাহলে এক সময় আপনি দৈত্যাকৃতি এক পর্বতমালার (কারকোনশির) সামনে উপস্থিত হবেন, যেটা চেক প্রজাতন্ত্র এবং পোল্যান্ডের বর্তমান সীমানার মধ্যে অবস্থিত। যদিও পর্বতের উচ্চতা মাত্র ১,৬০০ মিটারের (৫,২৫০ ফুটের) মতো, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটাকে ইউরোপের মধ্যবর্তী সুমেরুবৃত্তের দ্বীপ বলা হতো। ৩ মিটার (১০ ফুট) ঘন তুষারপাতের কারণে পর্বতের চূড়াগুলো বছরের অর্ধেক সময়ই তুষারাবৃত থাকে। যারা এই অস্থিতিশীল আবহাওয়াকে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় না, তারা হয়তো ঘন কুয়াশার ফাঁদে পড়ে, যেটার কারণে পর্বতের চূড়াগুলো হঠাৎ করে ঢেকে যেতে পারে।

শত শত বছর ধরে এই পর্বতমালা বিভিন্ন প্রদেশ, রাজ্য এবং রাষ্ট্রের মধ্যে এক প্রাকৃতিক সীমানা তৈরি করেছে। এই দুর্গম এলাকা পাহারা দেওয়া অনেক কঠিন ছিল, তাই অতীতে সেই এলাকার অনেকেই পর্বতমালার ওপর দিয়ে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী পাচার করত। ১৯৩০-এর দশকে, যখন সেই দৈত্যাকৃতি পর্বতের এক অংশ চেকোস্লোভাকিয়ায় এবং আরেক অংশ জার্মানিতে বিভক্ত হয়ে যায়, তখন দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ সাক্ষিরা চোরাচালানকারীদের পরিত্যক্ত পথ ব্যবহার করতে শুরু করে। কীসের জন্য? যেখানে আরও সহজে মূল্যবান বাইবেল সাহিত্যাদি পাওয়া যায়, সেখান থেকে সেগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যুবক রিচার্ট ছিলেন সেই সাক্ষিদের মধ্যে একজন।

বিপদজনক “পর্বতারোহণ”

“সপ্তাহান্তে আমরা সাত জনের মতো যুবক ভাইদের একটা দল পর্বতে ওঠার জন্য পর্বতারোহীদের মতো পোশাক পড়তাম,” রিচার্ট স্মরণ করে বলেন। জার্মান থেকে পর্বত পার হয়ে স্পিনডেলরুভ মালিন পৌঁছাতে আমাদের প্রায় তিন ঘন্টা লাগত। এটা ছিল একটা রিসোর্ট, যেটা চেক প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত থেকে প্রায় ১৬.৫ কিলোমিটার (১০ মাইল) ভিতরে ছিল। সেই সময়ে এই এলাকায় অনেক জার্মানি বাস করত। তাদের মধ্যে একজন কৃষক ভাইদের সাহায্য করার জন্য রাজি হয়েছিলেন। বেড়াতে আসা ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহার করা হতো এমন একটা ঘোড়ার গাড়িতে করে তিনি কাছাকাছি একটা শহর থেকে সাহিত্যাদির বাক্সগুলো নিয়ে আসতেন আর এই বাক্সগুলো প্রাগ থেকে ট্রেনে করে সেই শহরে পাঠানো হতো। তিনি বাক্সগুলো তার খামারের পিছনে নিয়ে যেতেন এবং জার্মানিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভাইয়েরা না আসা পর্যন্ত সেগুলো খড়ের গাদার মধ্যে লুকিয়ে রাখতেন।

রিচার্ট বলে চলেন: “সেই খামারে পৌঁছানোর পর, আমরা আমাদের পিঠের ব্যাগে সাহিত্যাদি ভরতাম, যে-ব্যাগগুলো বিশেষভাবে ভারী জিনিস বহন করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। আমরা প্রত্যেকেই প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম (১০০ পাউন্ড) করে বহন করতাম।” ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে, তারা রাতের অন্ধকারে ভ্রমণ করত অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময় যাত্রা শুরু করত এবং সূর্য ওঠার আগেই বাড়ি ফিরে আসত। আর্নস্ট ভেসনার, যিনি সেই সময়ে জার্মানির সীমা অধ্যক্ষ ছিলেন, তিনি কিছু নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সম্বন্ধে এভাবে বর্ণনা করেছিলেন: “দু-জন ভাই আগে আগে যেত এবং যখনই তাদের সঙ্গে কারো দেখা হতো, তখনই তারা তাদের টর্চলাইট ব্যবহার করে সংকেত দিত। এটা সেই ভাইদের জন্য রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ার একটা সংকেত হিসেবে কাজ করত, যারা প্রায় ৩২৮ ফুট (১০০ মিটার) দূরত্ব বজায় রেখে তাদের পিছনে পিছনে আসত। সামনের সেই দুই ভাই তাদের কাছে ফিরে এসে নির্দিষ্ট একটা পাসওয়ার্ড না বলা পর্যন্ত, তারা সেখানে লুকিয়ে থাকত আর এই পাসওয়ার্ড প্রতি সপ্তাহে পরিবর্তন করা হতো।” কিন্তু, নীল পোশাকধারী জার্মান পুলিশরাই যে একমাত্র বিপদ ছিল এমন নয়।

“একদিন সন্ধ্যায় আমাকে একটু বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয়েছিল,” রিচার্ট স্মরণ করে বলেন, “তাই আমি চেক প্রজাতন্ত্রে যাওয়ার জন্য আমার ভাইদের চেয়ে একটু দেরিতে রওনা দিয়েছিলাম। তখন অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল এবং চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল আর বৃষ্টির মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় আমি ঠাণ্ডায় কাঁপছিলাম। আমি পাইন বনের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম এবং কয়েক ঘন্টা ধরে আমার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক পর্বতারোহী এভাবে মারা গিয়েছে। ভাইয়েরা যখন ভোর বেলা সেই পথ দিয়ে ফিরে আসছিল, তখন আমি তাদের দেখা পেয়েছিলাম।”

প্রায় তিন বছর ধরে, সাহসী ভাইদের এই ছোট্ট দল প্রতি সপ্তাহে পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে। শীতকালে, তারা স্কী ব্যবহার করে এবং ব্যাগে করে তাদের মূল্যবান সাহিত্যাদি নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে ২০ জনের মতো ভাই-বোনের একটা দল আরোহীদের জন্য চিহ্ন দেওয়া রাস্তা দিয়ে দিনের বেলা সীমান্ত পার হতো। তারা কেবল সাধারণ পর্বতারোহীর দল, এই ধারণা দেওয়ার জন্য কয়েক জন বোনও তাদের সঙ্গে যেত। তাদের মধ্যে কয়েক জন সামনে থাকত এবং যখন তারা কোনো বিপদের আশঙ্কা করত, তখন তাদের টুপিগুলো ওপরের দিকে ছুড়ে দিত।

রাতের ভ্রমণ শেষ করে ভাইয়েরা ফিরে আসার পর কী হতো? সাহিত্যাদি দ্রুত বিতরণ করার ব্যবস্থা করা হতো। কীভাবে? প্রকাশনাগুলো সাবানের প্যাকেটের মতো করে প্যাকেট করা হতো এবং হির্সবার্গের রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হতো। সেই প্যাকেটগুলো জার্মানির বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হতো আর সেখান থেকে ভাই-বোনেরা বিচক্ষণতার সঙ্গে সেগুলো সহবিশ্বাসীদের কাছে পৌঁছে দিত, যেমনটা শুরুতে বলা হয়েছে। গোপনে করা এই বিতরণের কাজ পরস্পরের সঙ্গে এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল যে, কোনো কিছু প্রকাশ হয়ে গেলে তা মারাত্মক পরিণতি নিয়ে আসতে পারত। কিন্তু, একদিন এক অপ্রত্যাশিত বিপদ এসেছিল।

১৯৩৬ সালে, বার্লিনের কাছাকাছি সাহিত্যাদির একটা ভাণ্ডার প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে হির্সবার্গের এক অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছ থেকে পাঠানো তিনটে প্যাকেট পাওয়া গিয়েছিল। পাচারকারী দলের মূল হোতাকে শনাক্ত করার জন্য পুলিশ হাতের লেখা পরীক্ষা করেছিল এবং তাকে আটক করেছিল। এর পর পরই আরও দু-জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে রিচার্ট রুডল্ফও ছিলেন। যেহেতু সেই ভাইয়েরা সমস্ত কিছুর দায় নিজেদের মাথায় নিয়েছিল, তাই কিছু সময়ের জন্য অন্যেরা দিন দিন বিপদজনক হয়ে ওঠা সেই যাত্রা চালিয়ে যেতে পেরেছিল।

আমাদের জন্য শিক্ষা

দৈত্যাকৃতি পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে ব্যাগে করে নিয়ে আসা প্রকাশনাগুলো জার্মানির সাক্ষিদের জন্য বাইবেল সাহিত্যাদির এক বিরাট সরবরাহ হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু, সেই দৈত্যাকৃতি পর্বতমালার মধ্যে দিয়েই যে কেবল সাহিত্যাদি নিয়ে আসা হতো এমন নয়। ১৯৩৯ সালে জার্মান বাহিনী চেকোস্লোভাকিয়া দখল করার আগে পর্যন্ত, সেই দেশের সীমান্তে একই রকম পথ ব্যবহার করা হত। জার্মানির সীমান্তবর্তী অন্যান্য দেশ যেমন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস এবং সুইজারল্যান্ডের সাক্ষিরা ও সেইসঙ্গে জার্মানির সাক্ষিরা তাড়িত সহবিশ্বাসীদের আধ্যাত্মিক খাদ্য সরবরাহ করার জন্য বিরাট ঝুঁকি নিয়ে কাজ করত।

বর্তমানে আমাদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই পর্যাপ্ত পরিমাণে এবং বিভিন্ন উপায়ে যেমন ছাপানো, অডিও/ভিডিও অথবা ইলেকট্রনিক আকারে বাইবেল সাহিত্যাদি পেতে পারে। একটা নতুন প্রকাশনা আপনি কিংডম হল থেকে লাভ করুন কিংবা jw.org ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করুন, যা-ই হোক না কেন, সেটার পিছনে কী কী কাজ জড়িত রয়েছে, তা নিয়ে চিন্তা করে দেখুন না কেন? এটা ঠিক যে, সেই কাজ হয়তো মাঝরাতে তুষারাবৃত পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে পার হওয়ার মতো নাটকীয় নয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এর পিছনে সেই সহবিশ্বাসীদের কঠোর পরিশ্রম জড়িত, যারা নিঃস্বার্থভাবে আপনার জন্য কাজ করে থাকে।

^ তিনি সিলেসিয়ার হির্সবার্গ মণ্ডলীতে সেবা করতেন। বর্তমানে হির্সবার্গ শহরের নাম হল ইয়েলেনিয়া গুরা, যেটা পোল্যান্ডের দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত।