সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

 জীবনকাহিনি

পূর্ণসময়ের পরিচর্যা​—⁠এটা আমাকে যেখানে নিয়ে এসেছে

পূর্ণসময়ের পরিচর্যা​—⁠এটা আমাকে যেখানে নিয়ে এসেছে

আমি যখন আমার ৬৫ বছরের পূর্ণসময়ের পরিচর্যার দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, আমার জীবনটা অনেক আনন্দপূর্ণ হয়েছে। তবে তার মানে এই নয় যে, আমার জীবনে কখনো দুঃখের এবং হতাশার দিন আসেনি। (গীত. ৩৪:১২; ৯৪:১৯) কিন্তু, সব দিক বিবেচনা করলে, আমার জীবন অত্যন্ত পরিতৃপ্তিদায়ক এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়েছে!

আমি ১৯৫০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ব্রুকলিন বেথেল পরিবারের একজন সদস্য হই। সেই সময়, বেথেল পরিবারে বিভিন্ন জাতি থেকে আসা ৩৫৫ জন ভাই এবং বোন ছিল। এই ভাই-বোনদের বয়স ছিল ১৯ থেকে ৮০-র কোঠার মধ্যে। তাদের মধ্যে অনেকেই অভিষিক্ত খ্রিস্টান ছিল।

যেভাবে আমি যিহোবাকে সেবা করতে শুরু করি

১০ বছর বয়সে, আমার বাপ্তিস্মের সময়

আমি আমার মায়ের কাছ থেকে আমাদের সুখী বা “ধন্য ঈশ্বরের” সেবা করার বিষয়ে শিখেছিলাম। (১ তীম. ১:১১) আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন থেকেই তিনি যিহোবাকে সেবা করতে শুরু করেন। ১৯৩৯ সালের ১ জুলাই, দশ বছর বয়সে আমি যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাসকার কলাম্বাসে অনুষ্ঠিত একটা আঞ্চলিক সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিই (এই সম্মেলনকে এখন সীমা সম্মেলন বলা হয়)। আমরা প্রায় এক-শো জন ব্যক্তি জোসেফ রাদারফোর্ডের দেওয়া “ফ্যাসিবাদ অথবা স্বাধীনতা” শিরোনামের বক্তৃতার রেকর্ডিং শোনার জন্য ভাড়া করা একটা জায়গায় মিলিত হয়েছিলাম। বক্তৃতার অর্ধেক শেষ হতে না হতেই একদল লোক যেখানে আমরা সভা করছিলাম, সেই ছোট্ট হলের বাইরে সমবেত হয়। তারা জোর করে ভিতরে ঢুকে আমাদের সভা ভেঙে দেয় আর আমাদেরকে শহরের বাইরে বের করে দেয়। তখন আমরা সেই শহরের কাছাকাছি একজন ভাইয়ের খামারে মিলিত হয়ে কার্যক্রমের বাকি অংশ শুনি। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কেন আমি আমার বাপ্তিস্মের দিনটা কখনো ভুলে যাইনি!

আমার মা আমাকে সত্যে বড়ো করে তোলার জন্য অনেক প্রচেষ্টা করেছিলেন। আমার বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন আর বাবা হিসেবেও তিনি খুব ভালো ছিলেন। তবে, ধর্ম অথবা আমার আধ্যাত্মিক মঙ্গলের ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। আমার মা ও সেইসঙ্গে ওমাহা মণ্ডলীর অন্যান্য সাক্ষি আমাকে প্রয়োজনীয় অনেক উৎসাহ জুগিয়েছিল।

জীবনে এক পরিবর্তন

আমি যখন হাই স্কুলে পরীক্ষা (উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা) দিতে যাচ্ছিলাম, তখন আমাকে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, জীবনে আমি কী করতে চাই। প্রতি বার গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়, আমি আমার সমবয়সি বন্ধুদের সঙ্গে অবকাশ অগ্রগামীর কাজ করতাম (এখন এটাকে সহায়ক অগ্রগামী বলা হয়)।

সেই সময়ে আমাদের এলাকায় ভ্রমণের কাজ করার জন্য জন চিমিক্লিস এবং টেড জারাস নামে দু-জন অবিবাহিত ভাইকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। আর তারা সবেমাত্র গিলিয়েড স্কুল-এর সপ্তম ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিল। তাদের বয়স যে মাত্র ২০-এর কোঠার প্রথম দিকে, তা শুনে আমি অনেক অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন ১৮ বছর আর শীঘ্র আমি হাই স্কুল পাশ করতে যাচ্ছিলাম। আমার এখনও ভাই চিমিক্লিসের কথাগুলো মনে পড়ে, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি জীবনে কী  করতে চাই। আমার উত্তর শোনার পর তিনি আমাকে এই কথা বলে উৎসাহিত করেছিলেন: “হ্যাঁ, এক্ষুনি পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করে দাও। এটা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না।” সেই উপদেশ আর সেই ভাইদের উদাহরণ আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। তাই, ১৯৪৮ সালে হাই স্কুল পাশ করার পর আমি অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করেছিলাম।

যেভাবে আমি বেথেলে আসি

১৯৫০ সালের জুলাই মাসে, আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে আমি নিউ ইয়র্ক সিটির ইয়াংকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। সেই সম্মেলনের সময়, আমি বেথেল সেবার প্রতি আগ্রহী এমন ব্যক্তিদের জন্য অনুষ্ঠিত সভায় যোগ দিই। এরপর, বেথেলে সেবা করার জন্য আমার আগ্রহের কথা উল্লেখ করে আমি একটা আবেদনপত্র জমা দিই।

যদিও বাবা আমার অগ্রগামীর কাজ এবং তার বাড়িতে থাকার বিষয়ে কোনো বিরোধিতা করতেন না, কিন্তু তিনি মনে করতেন, আমার রুমের ভাড়া ও খাবার বাবদ ন্যায্য খরচটা আমার দেওয়া উচিত। তাই, আগস্ট মাসের প্রথম দিকে, একদিন কাজ খোঁজার জন্য বাইরে যাওয়ার সময় প্রথমে আমি আমাদের চিঠির বাক্সটা খুলি। সেখানে আমি আমার জন্য ব্রুকলিন থেকে আসা একটা চিঠি পাই। সেই চিঠিতে ভাই নেথেন এইচ. নরের স্বাক্ষর ছিল আর তিনি লিখেছিলেন: “বেথেল সেবার ব্যাপারে আপনার আবেদনপত্র আমরা পেয়েছি। আমি বুঝতে পারছি, আপনি আপনার জীবনের বাকিটা সময় বেথেলে সেবা করে যেতে ইচ্ছুক। তাই, ১৯৫০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে ১২৪ কলম্বিয়া হাইটসের বেথেলে আসার জন্য আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।”

বাবা যখন সেই দিন কাজ থেকে ফিরে এসেছিলেন, তখন আমি তাকে বলেছিলাম, আমি একটা কাজ খুঁজে পেয়েছি। তিনি বলেছিলেন, “খুব ভালো, কিন্তু কোথায়?” আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “ব্রুকলিন বেথেলে, বেতন মাসে ১০ ডলার।” তিনি কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি বলেছিলেন, আমি যদি সেটাই বেছে নিয়ে থাকি, তাহলে আমার এতে সফল হওয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা করা উচিত। এর অল্প সময় পরে, ১৯৫৩ সালে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত একটা সম্মেলনে তিনি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন!

আমার অগ্রগামী সঙ্গী আলফ্রেড নুসরালার সঙ্গে

আনন্দের বিষয় হল, আমার অগ্রগামী সঙ্গী আলফ্রেড নুসরালাকেও বেথেলে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল আর আমরা একসঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। সে পরে বিয়ে করেছিল আর তার স্ত্রী জোয়েনের সঙ্গে গিলিয়েড-এ যোগ দিয়ে লেবাননে মিশনারি সেবা করেছিল। তারপর, তারা আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসে ভ্রমণের কাজ করেছিল।

বেথেলে বিভিন্ন কাজ

বেথেলে আমার প্রথম কাজ ছিল বাঁধাই বিভাগ-এ বই সেলাই করা। প্রথম যে-প্রকাশনা নিয়ে আমি কাজ করেছিলাম, তা হল মানবজাতির জন্য ধর্ম কী করেছে? (ইংরেজি) নামক একটি বই। বাঁধাই বিভাগ-এ আট মাস কাজ করার পর আমাকে সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট-এ ভাই থমাস জে. সুলিভানের অধীনে কাজ করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার সঙ্গে কাজ করে এবং বছরের পর বছর ধরে সংগঠন থেকে তিনি যে-আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন, সেখান থেকে উপকার লাভ করে আমি অনেক আনন্দ পেয়েছি।

সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট-এ প্রায় তিন বছর সেবা করার পর একদিন ফ্যাক্টরি অধ্যক্ষ ভাই ম্যাক্স লারসন আমাকে বলেছিলেন, ভাই নর আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি ভাবছিলাম, আমার কোনো ভুল হয়েছে কি না। কিন্তু, ভাই নর যখন শুধু জানতে চেয়েছিলেন, ভবিষ্যতে আমার বেথেল সেবা ছেড়ে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তখন আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। তার অফিসে সাময়িকভাবে কাজ করার জন্য কাউকে প্রয়োজন ছিল এবং তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, আমি সেই দায়িত্ব পালন করতে পারব কি না। আমি তাকে জানিয়েছিলাম, বেথেলের কাজ ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে আমার কোনো পরিকল্পনা নেই। আর এর ফলে, আমি পরবর্তী ২০ বছর তার অফিসে কাজ করার বিশেষ সুযোগ লাভ করেছিলাম।

আমি মাঝে মাঝে বলি, ভাই সুলিভান এবং ভাই নর আর সেইসঙ্গে বেথেলে অন্যদের সঙ্গে যেমন, মিলটন হেনশেল, ক্লস জেনসেন, হুগো রিমার ও গ্র্যান্ট সুইটারের সঙ্গে কাজ করার ফলে আমি যে-শিক্ষা লাভ করতে পেরেছি, সেটার ঋণ আমি কখনোই শোধ করতে পারব না। *

 আমি যে-ভাইদের সঙ্গে সেবা করেছি, তারা সংগঠনে নিজ নিজ কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে অনেক সুসংগঠিত ছিল। ভাই নর ছিলেন একজন অক্লান্ত কর্মী। তিনি যতটা সম্ভব পূর্ণরূপে রাজ্যের কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য আগ্রহী ছিলেন। যারা তার অফিসে কাজ করত, তারা খুব সহজেই তার সঙ্গে কথা বলতে পারত। এমনকী, কোনো বিষয়ে আমাদের মধ্যে যদি ভিন্নমত থাকত, তবুও আমরা সহজেই তা প্রকাশ করতে পারতাম এবং তিনি আমাদের প্রতি আস্থা দেখাতেন।

একবার, ভাই নর ছোটোখাটো বলে মনে হয় এমন বিষয়ের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি যখন ফ্যাক্টরি অধ্যক্ষ ছিলেন, তখন ভাই রাদারফোর্ড তাকে ফোন করে বলতেন: “ভাই নর, আপনি দুপুরের খাবারের জন্য ফ্যাক্টরি থেকে আসার সময় আমার জন্য কয়েকটা রাবার নিয়ে আসবেন। সেগুলো আমার টেবিলে রেখে দেবেন।” ভাই নর বলেছিলেন, তিনি প্রথমেই স্টোর রুমে যেতেন এবং কয়েকটা রাবার নিয়ে তার পকেটে রেখে দিতেন। তারপর, দুপুর বেলা তিনি সেগুলো ভাই রাদাফোর্ডের অফিসে রেখে আসতেন। এটা ছোটো একটা কাজ ছিল, কিন্তু তা করলে ভাই রাদারফোর্ডের জন্য অনেক সাহায্যকারী হতো। এরপর, ভাই নর আমাকে বলেছিলেন: “আমি চাই আমার টেবিলে পেনসিলগুলো যেন সবসময় শার্প করা থাকে। তাই, দয়া করে প্রতিদিন এখানে শার্প করা পেনসিল রাখবেন।” অনেক বছর ধরে আমি তার পেনসিলগুলো শার্প করা আছে কি না, তা খেয়াল রেখেছিলাম।

আমাদেরকে যখন কোনো নির্দিষ্ট কাজ করতে বলা হতো, তখন ভাই নর প্রায়ই মনোযোগ দিয়ে কথা শোনার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। একবার, তিনি আমাকে একটা নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করার জন্য বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি মনোযোগ দিয়ে তা শুনিনি। ফল স্বরূপ, আমি তাকে অনেক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার খুবই খারাপ লেগেছিল, তাই আমি সংক্ষেপে তাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে, আমি আমার কাজের জন্য অনেক দুঃখিত আর আমার মনে হয় আমাকে আপনার অফিস থেকে বদলি করে দিলেই ভালো হয়। সে-দিন সকালেই ভাই নর আমার ডেস্কে আসেন। “রবার্ট,” তিনি বলেছিলেন, “আমি আপনার চিঠিটা পেয়েছি। আপনার একটা ভুল হয়েছে আর আমরা এই ব্যাপারে কথা বলেছি। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে আপনি আরও মনোযোগ দিয়ে কথা শুনবেন। এখন চলুন আমরা কাজ শুরু করি।” আমার প্রতি তিনি সদয়ভাবে যে-বিবেচনা দেখিয়েছিলেন, তা আমি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলাম।

বিয়ে করার আকাঙ্ক্ষা

বেথেলে আট বছর সেবা করার পর, আমার বেথেলে কাজ করা ছাড়া অন্য আর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু, সেই পরিকল্পনা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৮ সালে ইয়াংকি স্টেডিয়াম ও পোলো গ্রাউন্ডে যখন আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন লোরেন ব্রুকসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ১৯৫৫ সালে সে যখন কানাডার মনট্রিলে অগ্রগামীর কাজ করত, তখন আমি তাকে দেখেছিলাম। লোরেনের পূর্ণসময়ের পরিচর্যার প্রতি আগ্রহ ছিল এবং যিহোবার সংগঠন তাকে যেখানেই পাঠাক না কেন, সেখানেই যাওয়ার ব্যাপারে ইচ্ছুক মনোভাব ছিল। তার এই মনোভাব দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। লোরেন গিলিয়েড স্কুল-এ যাওয়ার ব্যাপারে লক্ষ্যস্থাপন করেছিল। ১৯৫৬ সালে তার বয়স যখন ২২ বছর, তখন ২৭তম ক্লাসে তাকে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। গ্র্যাজুয়েশনের পর তাকে ব্রাজিলে একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে লোরেন আর আমি নতুন করে যোগাযোগ শুরু করি এবং সে আমার সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়। আমরা পরের বছর বিয়ে করার জন্য পরিকল্পনা করেছিলাম এবং আশা করছিলাম যে, আমরা একত্রে মিশনারি সেবা শুরু করতে পারব।

 আমি ভাই নরকে যখন আমার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলাম, তখন তিনি আমাকে তিন বছর অপেক্ষা করতে বলেছিলেন এবং বিয়ে করার পর ব্রুকলিন বেথেলে সেবা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই সময়ে, বিয়ের পর কোনো দম্পতি যদি বেথেলে থাকতে চাইত, তাহলে তাদের মধ্যে একজনকে দশ বছর বা তার চেয়েও বেশি এবং অন্যজনকে কমপক্ষে তিন বছর বেথেলে সেবা করতে হতো। তাই, লোরেন বিয়ের আগে ব্রাজিল বেথেলে দুই বছর আর ব্রুকলিন বেথেলে আরও এক বছর সেবা করার জন্য রাজি হয়েছিল।

আমাদের বাগ্‌দানের পর প্রথম দুই বছর পর্যন্ত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। টেলিফোন করা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ ছিল এবং সেই দিনগুলোতে ই-মেল করার কোনো উপায়ই ছিল না! ১৯৬১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আমরা যখন বিয়ে করেছিলাম, তখন ভাই নর আমাদের বিয়ের বক্তৃতা দিয়েছিলেন আর এতে আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম। নিশ্চিতভাবেই, অপেক্ষার সেই কয়েকটা বছর অনেক দীর্ঘ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন, বিবাহিত জীবনের ৫০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর আমরা যখন পরিতৃপ্তি এবং আনন্দ নিয়ে পিছনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমরা এই ব্যাপারে একমত হই যে, আমাদের অপেক্ষা করা সার্থক হয়েছে!

আমাদের বিয়ের দিন। বাম দিক থেকে: নেথেন এইচ. নর, প্যাট্রিশিয়া ব্রুকস্‌ (লোরেনের ছোটো বোন), লোরেন এবং আমি, কার্টিস জনসন, ফে এবং রয় ওঅলেন (আমার বাবা-মা)

সেবার বিশেষ সুযোগ

১৯৬৪ সালে, আমাকে অন্য দেশগুলোতে একজন আঞ্চলিক অধ্যক্ষ হিসেবে পরিদর্শন করার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়, স্ত্রীরা তাদের স্বামীদের সঙ্গে ভ্রমণের কাজে যেতে পারত না। ১৯৭৭ সালে এই ব্যবস্থায় রদবদল করা হয় আর স্ত্রীরাও তাদের স্বামীদের সঙ্গে ভ্রমণ করতে শুরু করে। সেই বছর লোরেন এবং আমি, গ্র্যান্ট এবং ইডিথ সুইটারের সঙ্গে জার্মানি, অস্ট্রিযা, গ্রিস, সাইপ্রাস, তুরস্ক এবং ইজরায়েলের শাখা অফিসে পরিদর্শন করি। সব মিলিয়ে, আমি বিশ্বের প্রায় ৭০টা দেশে পরিদর্শনের কাজ করেছি।

১৯৮০ সালে ব্রাজিলে এইরকম একটা পরিদর্শনের সময় ভ্রমণপথে আমরা বেলেমে গিয়েছিলাম। এটা হল নিরক্ষরেখা বরাবর একটা শহর, যেখানে লোরেন মিশনারি হিসেবে কাজ করেছিল। এ ছাড়া, আমরা মানাসে আমাদের ভাই-বোনদের দেখার জন্য থেমেছিলাম। একটা স্টেডিয়ামে বক্তৃতা চলাকালীন আমরা একটা দলকে একত্রে বসে থাকতে দেখেছিলাম। ব্রাজিলের মহিলারা সাধারণত পরস্পরের গালে চুম্বন করে এবং ভাইয়েরা পরস্পর হাত মেলায়। কিন্তু, এই ব্যক্তিরা সেই সাধারণ রীতি অনুসরণ করছিল না। কেন?

তারা ছিল আমাদেরই প্রিয় সহসাক্ষি, যারা আমাজনের বৃষ্টিবহুল অরণ্যাঞ্চলের ভিতরে কুষ্ঠ রোগীদের একটা কলোনি থেকে এসেছিল। অন্যদের সুরক্ষার বিষয়ে চিন্তা করে তারা উপস্থিত ব্যক্তিদেরকে স্পর্শ করা এড়িয়ে চলছিল। কিন্তু, তারা নিশ্চিতভাবেই আমাদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল এবং আমরা কখনো তাদের চেহারায় যে-আনন্দ ফুটে উঠেছিল, তা ভুলে যাব না! যিশাইয়ের এই কথাগুলো কতই-না সত্য: “আমার দাসেরা চিত্তের সুখে আনন্দরব করিবে।”—যিশা. ৬৫:১৪.

পরিতৃপ্তিদায়ক ও উদ্দেশ্যপূর্ণ এক জীবন

লোরেন ও আমি যিহোবার সেবায় ষাট বছরেরও বেশি সময় নিয়োজিত করেছি আর আমরা প্রায়ই এই ব্যাপারে চিন্তা করে থাকি। যিহোবা তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে আমাদেরকে পরিচালনা দিয়েছেন। তা মেনে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা যে-উপায়গুলোতে আশীর্বাদ লাভ করেছি, সেগুলোর জন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। যদিও আমি আগের মতো আর বিশ্বব্যাপী ভ্রমণের কাজ করতে পারি না, কিন্তু এখনও আমি প্রতিদিন পরিচালকগোষ্ঠীর কোঅর্ডিনেটরস্‌ (সমন্বয়কারী) কমিটি এবং সার্ভিস (পরিচর্যা) কমিটি-র সঙ্গে কাজ করতে পারছি। এভাবে আমি বিশ্বব্যাপী আমাদের ভ্রাতৃসমাজের সেবায় ছোট্টো অবদান রাখার যে-বিশেষ সুযোগ পেয়েছি, সেটাকে আমি অনেক উপলব্ধি করি। আমরা সবসময় সেই অসংখ্য যুবক-যুবতীকে দেখে অভিভূত হই, যারা যিশাইয়ের মতো এই মনোভাব নিয়ে পূর্ণসময়ের পরিচর্যা গ্রহণ করে নিয়েছে: “এই আমি, আমাকে পাঠাও।” (যিশা. ৬:৮) এই ধরনের হাজার হাজার ব্যক্তি সেই সীমা অধ্যক্ষের কথাগুলোর সত্যতাকে প্রতিফলিত করে, যিনি বহু বছর আগে আমাকে বলেছিলেন: “এক্ষুনি পূর্ণসময়ের সেবা শুরু করে দাও। এটা তোমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ বলতে পারে না।”

^ অনু. 20 এই ভাইদের মধ্যে কয়েক জনের জীবনকাহিনি পড়ার জন্য প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার এই সংখ্যাগুলো দেখুন: থমাস জে. সুলিভান (আগস্ট ১৫, ১৯৬৫); ক্লস জেনসেন (অক্টোবর ১৫, ১৯৬৯); ম্যাক্স লারসন (সেপ্টেম্বর ১, ১৯৮৯); হুগো রিমার (সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৬৪); এবং গ্র্যান্ট সুইটার (সেপ্টেম্বর ১, ১৯৮৩).