সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

জীবনকাহিনি

“দ্বীপসমূহ আনন্দ করুক”

“দ্বীপসমূহ আনন্দ করুক”

সেই দিনটার কথা আমি কখনো ভুলব না। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বেশ কয়েক জন ভাই ও আমি চাপা উত্তেজনা নিয়ে পরিচালকগোষ্ঠী-র কনফারেন্স রুমে অপেক্ষা করছিলাম। রাইটিং (লিখন সংক্রান্ত) কমিটি-র সদস্যরা সেখানে আসতে যাচ্ছিলেন আর তাদের সামনে একটা উপস্থাপনা তুলে ধরার জন্য আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর আগের কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা এমন সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করেছি, অনুবাদকরা যেগুলোর মুখোমুখি হচ্ছিল। এখন আমাদের সেই সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়ে প্রস্তাব তুলে ধরতে হবে। দিনটা ছিল ২০০০ সালের ২২ মে। কিন্তু, কেন এই সভা এতটা গুরুত্বপূর্ণ? তা ব্যাখ্যা করার আগে, আমি নিজের সম্বন্ধে আপনাদের কিছু বলছি।

আমি কুইন্সল্যান্ডে বাপ্তিস্ম নিই আর এরপর তাসমানিয়ায় অগ্রগামী সেবা এবং টুভালু, সামোয়া ও ফিজিতে মিশনারি সেবা উপভোগ করি

উনিশ-শো পঞ্চান্ন সালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে আমার জন্ম হয়। আমার জন্মের অল্পসময় পর, আমার মা এস্টেল জ্যাকসন যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন। পরের বছর তিনি বাপ্তিস্ম নেন। তবে আমার বাবা রন জ্যাকসন এর ১৩ বছর পর সত্য গ্রহণ করেন। আমি ১৯৬৮ সালে কুইন্সল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত শহর, সেন্ট জর্জে অনুষ্ঠিত একটা সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিই।

ছোটোবেলা থেকেই আমি বই পড়তে পছন্দ করতাম আর ভাষার প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। আমি যখন পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে যেতাম, তখন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার পরিবর্তে গাড়ির পিছনের সিটে বসে বই পড়তাম। এটা দেখে আমার বাবা-মার নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত লাগত। কিন্তু আমার পড়ার নেশা, আমাকে স্কুলে ভালো ফলাফল লাভ করতে সাহায্য করেছে। তাসমানিয়া দ্বীপের গ্লেনর্‌কি শহরের হাই স্কুলে আমি পড়াশোনায় সাফল্যের জন্য অনেক পুরস্কার লাভ করেছি।

কিন্তু তারপর, একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসে। আমি কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য বৃত্তি গ্রহণ করব? বই এবং জ্ঞানলাভের প্রতি আমার যতটা ভালোবাসা ছিল, আমার মা আমাকে যিহোবার প্রতি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসা গড়ে তোলার জন্য সাহায্য করেছিলেন আর এই কারণে আমার মায়ের প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ। (১ করি. ৩:১৮, ১৯) তাই, হাই স্কুলের মৌলিক শিক্ষা শেষ করার পর, আমি আমার বাবা-মার অনুমতি নিয়ে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে ১৫ বছর বয়সে অগ্রগামী সেবা শুরু করি।

পরবর্তী আট বছর আমি তাসমানিয়ায় অগ্রগামী সেবা করার বিশেষ সুযোগ লাভ করেছি। সেই সময়ে আমি তাসমানিয়ার এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করি। তার নাম জেনি অ্যলকক। আমরা চার বছর স্মিথ্‌টেন ও কুইন্সটাউনের বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে একসঙ্গে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করেছি।

আমরা প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে যাই

আমরা ১৯৭৮ সালে পাপুয়া নিউ গিনির পোর্ট মোর্জবিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। সেই বারই আমরা প্রথম দেশের বাইরে যাই। আমার এখনও মনে আছে, আমরা একজন মিশনারি ভাইকে হিরি মোতু ভাষায় বক্তৃতা দিতে শুনেছিলাম। যদিও আমি তার একটা কথাও বুঝতে পারিনি কিন্তু তার বক্তৃতা আমাকে একজন মিশনারি হওয়ার জন্য, অন্যান্য ভাষা শেখার জন্য এবং সেইরকম একটা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। অবশেষে, আমি যিহোবা এবং ভাষার প্রতি আমার ভালোবাসা একত্রে যুক্ত করার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছিলাম।

অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার পর অবাক করার মতো একটা ঘটনা ঘটেছিল। আমাদেরকে টুভালুর ফুনাফুটি দ্বীপে মিশনারি হিসেবে সেবা করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যেটাকে আগে এলিস দ্বীপপুঞ্জ বলা হতো। আমরা ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের নতুন কার্যভারের এলাকায় পৌঁছাই। সেই সময়ে পুরো টুভালুতে মাত্র তিন জন বাপ্তাইজিত প্রকাশক ছিলেন।

টুভালুতে জেনির সঙ্গে

টুভালুয়ান ভাষা শেখা সহজ ছিল না। সেই ভাষায় শুধুমাত্র একটাই বই ছিল আর তা হল “নূতন নিয়ম।” সেই ভাষায় কোনো অভিধান অথবা ভাষা শেখার কোর্স ছিল না আর তাই আমরা প্রতিদিন ১০টা থেকে ২০টা শব্দ শেখার চেষ্টা করতাম। তবে শীঘ্রই আমরা বুঝতে পারি, আমরা যে-সমস্ত শব্দ শিখেছি, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই সঠিক অর্থ আমরা বুঝতে পারিনি। ভবিষ্যৎকথন ভুল, লোকেদের এটা বলার পরিবর্তে আমরা আসলে তাদের বলছিলাম, তারা যেন পরিমাপ করার যন্ত্র এবং হাঁটার জন্য লাঠি ব্যবহার করা এড়িয়ে চলে! কিন্তু, আমাদের সেই ভাষা শেখা প্রয়োজন ছিল কারণ আমরা অনেক বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম। তাই, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই। কয়েক বছর পর, আমাদের সঙ্গে প্রথম দিকে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলেন এমন একজন মহিলা আমাদের বলেন: “আপনারা এখন আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারেন, তাই আমরা অনেক খুশি। প্রথম প্রথম, আপনারা যা বলতেন, সেগুলোর কিছুই আমরা বুঝতে পারতাম না!”

অন্যদিকে, আমরা এমন এক পরিবেশে ছিলাম, যেটাকে অনেকে হয়তো একটা নতুন ভাষা শেখার জন্য আদর্শ পরিবেশ বলবে। যেহেতু সেখানে ভাড়া নেওয়ার মতো কোনো বাড়ি ছিল না, তাই আমরা মূল গ্রামে একটা সাক্ষি পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিলাম। এর অর্থ হচ্ছে, আমরা সেই ভাষা এবং পল্লিগ্রামের জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে গিয়েছিলাম। কয়েক বছর ধরে ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা না থাকায়, টুভালুয়ান আমাদের প্রধান ভাষা হয়ে ওঠে।

অল্পসময়ের মধ্যে, অনেকে সত্যের প্রতি আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছিল। কিন্তু, তাদের সঙ্গে অধ্যয়ন করার জন্য আমরা কী ব্যবহার করব? আমাদের কাছে তাদের ভাষায় কোনো প্রকাশনা ছিল না। কীভাবে তারা ব্যক্তিগত অধ্যয়ন করবে? তারা যখন সভাতে আসতে শুরু করবে, তখন তারা কোন গান গাইবে, কোন বিষয়বস্তু ব্যবহার করবে আর সভার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবে? কীভাবেই-বা তারা বাপ্তিস্ম নেওয়ার মতো উন্নতি করবে? এই নম্র ব্যক্তিদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় আধ্যাত্মিক খাদ্য প্রয়োজন ছিল! (১ করি. ১৪:৯) আমরা চিন্তা করেছিলাম, ‘টুভালুয়ান ভাষায় কি কখনো কোনো প্রকাশনা প্রস্তুত করা হবে, যে-ভাষায় কিনা পনেরো হাজারেরও কম লোক কথা বলে?’ যিহোবা এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন আর এর ফলে আমরা দুটো বিষয়ের প্রমাণ পেয়েছিলাম: (১) তিনি চান, যেন তাঁর বাক্য “দূরস্থ উপকূল সমূহে” ঘোষিত হয় এবং (২) তিনি চান, যেন সেইসমস্ত ব্যক্তি তাঁর নামের শরণ নেয়, যাদেরকে জগৎ “নীচ” ও “তুচ্ছ” বলে মনে করে।—যির. ৩১:১০; ১ করি. ১:২৮.

আধ্যাত্মিক খাদ্য অনুবাদ করা

১৯৮০ সালে শাখা অফিস আমাদেরকে অনুবাদক হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়। আমরা নিজেদের এই কাজের জন্য একেবারে অযোগ্য বলে মনে করেছিলাম। (১ করি. ১:২৮, ২৯) প্রথমে, আমরা সরকারের কাছ থেকে একটা পুরোনো মিমিওগ্রাফ যন্ত্র কিনেছিলাম আর এটা দিয়ে আমাদের সভার জন্য আমরা বিষয়বস্তু ছাপাতাম। এমনকী যে সত্য অনন্তজীবনে লইয়া যায় বইটা আমরা টুভালুয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছিলাম এবং এই যন্ত্র ব্যবহার করে তা ছাপিয়েছিলাম। ছাপানোর সময় কালির কড়া গন্ধ কেমন ছিল, তা আমি কখনো ভুলব না। আর গ্রীষ্ম মণ্ডলীয় এলাকার প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, হাতে এই বই ছাপানোর জন্য আমাদের যে-পরিশ্রম করতে হতো, তা আমার এখনও মনে আছে। সেই সময়ে সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না!

টুভালুয়ান ভাষায় অনুবাদ করা অনেক কঠিন ছিল কারণ আমাদের কাছে অল্প কয়েকটা তথ্যগ্রন্থ ছিল। কিন্তু, মাঝে মাঝে আমরা অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে সাহায্য পেয়েছি। একদিন সকালে, আমি ভুল করে এমন একজন ব্যক্তির বাড়িতে ফোন করি, যিনি সত্যের বিরোধিতা করতেন। সেই বয়স্ক গৃহকর্তা একজন শিক্ষক ছিলেন আর তিনি সঙ্গেসঙ্গে আমাকে মনে করিয়ে দেন, তার ঘরে আমাদের ফোন করা উচিত হয়নি। তারপর তিনি বলেছিলেন: “আমি শুধু একটা বিষয় বলতে চাই। আপনাদের অনুবাদে বাক্য গঠনের জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় কর্মবাচ্য ব্যবহার করা হয়। টুভালুয়ান ভাষায় সাধারণত কর্মবাচ্য বেশি ব্যবহার করা হয় না।” আমি অন্যদের কাছে বিষয়টা যাচাই করি এবং বুঝতে পারি, তিনি ঠিক কথাই বলেছেন। তাই, আমরা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করেছিলাম। তবে এই বিষয়টা চিন্তা করে আমি অবাক হয়েছিলাম, যিহোবা একজন বিরোধীর মাধ্যমে আমাদের সাহায্য করেছেন আর নিশ্চিতভাবেই সেই ব্যক্তি আমাদের সাহিত্যাদি পড়তেন!

টুভালুয়ান ভাষায় রাজ্য সংবাদ নং ৩০

জনসাধারণের কাছে বিতরণ করার জন্য টুভালুয়ান ভাষায় সর্বপ্রথম যে-প্রকাশনা ছাপানো হয়েছিল তা হল, স্মরণার্থ সভার আমন্ত্রণপত্র। এরপর, টুভালুয়ান ভাষায় রাজ্য সংবাদ নং ৩০, ইংরেজি ভাষার সঙ্গে একই সময়ে প্রকাশ করা হয়েছিল। লোকেদের হাতে তাদের মাতৃভাষায় কিছু দিতে পেরে আমরা কতই-না আনন্দিত হয়েছিলাম! ধীরে ধীরে, কয়েকটা ব্রোশার আর এমনকী কয়েকটা বই টুভালুয়ান ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৮৩ সালে অস্ট্রেলিয়া শাখা অফিস ২৪ পৃষ্ঠার ত্রৈমাসিক প্রহরীদুর্গ পত্রিকা ছাপাতে শুরু করেছিল, যে-পত্রিকা থেকে সপ্তাহে আমরা গড়ে সাতটা অনুচ্ছেদ পড়তাম। এর ফলে এলাকায় কেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল? যেহেতু টুভালুর লোকেরা পড়তে পছন্দ করত, তাই আমাদের সাহিত্যাদি অনেক জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটা নতুন প্রকাশনা পৌঁছানোর পর, সরকারি রেডিও স্টেশন থেকে সংবাদ বুলেটিনে তা ঘোষণা করা হতো আর এমনকী মাঝে মাঝে তা সংবাদপত্রের শিরোনামেও আসত! *

একেবারে শুরুতে, টুভালুয়ান ভাষার জন্য হাতে লিখে অনুবাদ করা হতো। পরবর্তী সময়ে, অনুবাদ করা পাণ্ডুলিপি ছাপানোর জন্য অস্ট্রেলিয়া শাখা অফিসে পাঠানোর আগে, অনুবাদের বিষয়বস্তু সংশোধনের জন্য বার বার টাইপ করা হতো। একটা সময়ে, শাখা অফিসে দু-জন বোনকে দিয়ে আলাদাভাবে প্রতিটা পাণ্ডুলিপি কম্পিউটারে ঢুকানো হতো, তবে সেই বোনেরা টুভালুয়ান ভাষা বুঝতেন না। এই পদ্ধতিতে বিষয়বস্তু দু-বার ঢুকানোর পর আর এরপর কম্পিউটারে সেগুলোর কমপেয়ার বের করার পর, খুব অল্পসংখ্যক ভুল বের হতো। তারপর কম্পোজ করা বিষয়বস্তু সংশোধন করার জন্য এয়ার মেলের মাধ্যমে অনুবাদকদের কাছে পাঠানো হতো। অনুবাদকরা সংশোধন করার পর, আবার তা ছাপানোর জন্য শাখা অফিসে পাঠানো হতো।

এখন কত পরিবর্তনই-না দেখা যায়! এখন অনুবাদ দলগুলো সরাসরি তাদের কম্পিউটারের মাধ্যমে অনুবাদ কাজ করে। অধিকাংশ জায়গায়, সংশোধিত বিষয়বস্তু স্থানীয়ভাবে কম্পোজ করা হয় এবং এমন ফাইল প্রস্তুত করা হয়, যেগুলো ছাপানোর জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন শাখা অফিসে পাঠানো যায়। এখন আর ডাকযোগে পাণ্ডুলিপি পাঠানোর জন্য তড়িঘড়ি করে পোস্ট অফিসে দৌড়াতে হয় না।

অন্যান্য কার্যভার

সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, জেনি আর আমাকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে আমাদের টুভালু শাখা অফিস থেকে সামোয়া শাখা অফিসে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেখানে আমরা টুভালুয়ান ভাষার পাশাপাশি সামোয়ান, টোংগান, টোকেলুয়ান ভাষার কাজেও সহযোগিতা করেছি। * এরপর, ১৯৯৬ সালে আমাদের ফিজি শাখা অফিসে একইরকম দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আর সেখানে আমরা ফিজিয়ান, কিরিবাটি, নারুয়ান, রোটুম্যান এবং টুভালুয়ান ভাষার অনুবাদ কাজে সাহায্য করেছি।

অন্যদের সাহায্য করার জন্য টুভালুয়ান সাহিত্যাদি ব্যবহার করছি

আমাদের সাহিত্যাদি যারা অনুবাদ করেন, তাদের উদ্যোগ দেখে আমি সবসময় অবাক হয়ে যাই। এই কাজ একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর হতে পারে। কিন্তু, এই বিশ্বস্ত ব্যক্তিরা ‘প্রত্যেক জাতি ও বংশ ও ভাষা ও প্রজাবৃন্দের’ কাছে সুসমাচার প্রচার করার বিষয়ে যিহোবার আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করার চেষ্টা করে। (প্রকা. ১৪:৬) উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যখন টোংগান ভাষায় প্রথম প্রহরীদুর্গ পত্রিকা অনুবাদ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তখন আমি টোংগার সকল প্রাচীনের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করি, কাকে অনুবাদক হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। সেই প্রাচীনদের মধ্যে একজন, যিনি মেকানিক হিসেবে ভালো চাকরি করতেন, তিনি তখন প্রস্তাব দেন, পরের দিন তিনি চাকরি ছেড়ে দেবেন এবং একজন অনুবাদক হিসেবে কাজ শুরু করবেন। এই ভাইয়ের বিশ্বাস দেখে আমি অনেক উৎসাহিত হয়েছিলাম কারণ তার পরিবার ছিল আর তিনি কোথা থেকে আয় করবেন, সেই বিষয়ে তার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু, যিহোবা তার এবং তার পরিবারের যত্ন নিয়েছিলেন এবং সেই ভাই অনেক বছর ধরে অনুবাদ কাজ করেছিলেন।

এইরকম একনিষ্ঠ অনুবাদকরা, পরিচালকগোষ্ঠীর সদস্যদের মতো একইরকম দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করেন। পরিচালকগোষ্ঠীর সদস্যরা সেইসমস্ত ভাষার লোকেদের আধ্যাত্মিক চাহিদার বিষয়েও গভীরভাবে চিন্তা করেন, যে-ভাষাগুলোতে অল্পসংখ্যক লোক কথা বলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা পর্যায়ে এইরকম একটা প্রশ্ন উঠেছিল, টুভালুয়ান ভাষায় সাহিত্যাদি তৈরি করার জন্য যে-সমস্ত প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তা আদৌ সার্থক হয়েছে কি না। আমি পরিচালকগোষ্ঠী-র কাছ থেকে পাওয়া এই উত্তর পড়ে অনেক উৎসাহিত হয়েছিলাম: “টুভালুয়ান ভাষায় অনুবাদ কাজ কেন বন্ধ করা হবে, সেই ব্যাপারে আমরা কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। অন্যান্য ভাষার দলের তুলনায় টুভালুয়ান ক্ষেত্র হয়তো ছোটো, তা সত্ত্বেও লোকেদের কাছে নিজেদের মাতৃভাষায় সুসমাচার পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন।”

একটা হ্রদে বাপ্তিস্ম দেওয়া হচ্ছে

২০০৩ সালে, জেনি ও আমাকে ফিজি শাখা অফিসের অনুবাদ বিভাগ থেকে বদলি করে নিউ ইয়র্কের প্যাটারসনে ট্রান্সলেশন সার্ভিসেস ডিপার্টমেন্ট-এ নিয়ে আসা হয়। মনে হয়েছিল যেন একটা স্বপ্ন সত্যি হয়েছে! সেখানে আমরা এমন একটা দলের অংশ হয়েছিলাম, যে-দলটা আমাদের সাহিত্যাদি নতুন নতুন ভাষায় অনুবাদ করার জন্য সাহায্য করে থাকে। পরবর্তী দু-বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় আমরা বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করার বিশেষ সুযোগ পেয়েছিলাম, যেন সেইসমস্ত দেশের অনুবাদ দলগুলোকে প্রশিক্ষণ দিতে পারি।

কিছু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত

এখন আমি আবার শুরুতে উল্লেখিত উপস্থাপনার বিষয়ে বলছি। ২০০০ সালের মধ্যে, পরিচালকগোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী অনুবাদ দলগুলোকে সাহায্য করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এর আগে অধিকাংশ অনুবাদক অনেক অল্প প্রশিক্ষণ লাভ করেছিল। আমরা রাইটিং কমিটি-র সামনে সেই উপস্থাপনা তুলে ধরার পর, পরিচালকগোষ্ঠী সকল অনুবাদকের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে অনুমতি দিয়েছিল। এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হল, ইংলিশ কমপ্রিহেনশন (ইংরেজি বোঝার দক্ষতা বৃদ্ধি), ট্রান্সলেশন টেকনিক (অনুবাদ কৌশল) এবং কোঅপারেটিভ টিম অ্যপ্রোচ (সহযোগিতামূলক দলগত অনুবাদ পদ্ধতি) সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ।

অনুবাদ কাজের উপর এভাবে জোর দেওয়ার কারণে কী ফলাফল লাভ করা গিয়েছে? একটা বিষয় হল, অনুবাদের মান আরও উন্নত হয়েছে। এখন আমরা যে-ভাষাগুলোতে সাহিত্যাদি প্রকাশ করি, সেই ভাষাগুলোর সংখ্যাও অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা যখন ১৯৭৯ সালে মিশনারি হিসেবে আমাদের প্রথম কার্যভারের এলাকায় পৌঁছাই, তখন প্রহরীদুর্গ পত্রিকা মাত্র ৮২টা ভাষায় পাওয়া যেত। অধিকাংশ ভাষার সংস্করণ ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মাস পর পাওয়া যেত। কিন্তু এখন, প্রহরীদুর্গ পত্রিকা ২৪০টারও বেশি ভাষায় বিতরণ করা হয় আর এগুলোর অধিকাংশই ইংরেজি সংস্করণের সঙ্গে একই সময়ে প্রকাশ করা হয়। আধ্যাত্মিক খাদ্য এখন বিভিন্ন উপায়ে ৭০০-রও বেশি ভাষায় পাওয়া যায়। কয়েক বছর আগে, এইরকম বিষয় আমাদের কাছে কেবল স্বপ্নের মতোই ছিল।

২০০৪ সালে, পরিচালকগোষ্ঠী আরেকটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর তা হল, বাইবেল অনুবাদ ত্বরান্বিত করা। এর কয়েক মাস পর, সাধারণ অনুবাদ কাজের অংশ হিসেবে বাইবেল অনুবাদ করা শুরু হয়েছিল আর এর ফলে নতুন জগৎ অনুবাদ (ইংরেজি) বাইবেল আরও অনেক ভাষায় পাওয়ার সুযোগ খুলে গিয়েছিল। ২০১৪ সালে, এই বাইবেল সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে ১২৮টা ভাষায় ছাপানো হয়েছে আর এর মধ্যে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বেশ কয়েকটা ভাষাও রয়েছে।

টুভালুয়ান ভাষায় খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্রের নতুন জগৎ অনুবাদ বাইবেল প্রকাশ করা হচ্ছে

২০১১ সালে আমার জীবনে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। সেই বছর আমি টুভালুর সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিশেষ সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই দেশে এর আগের কয়েক মাস প্রচণ্ড খরা ছিল আর মনে হয়েছিল, সম্মেলন হয়তো বাতিল করতে হবে। কিন্তু যে-দিন আমরা সেখানে পৌঁছাই, সে-দিন সন্ধ্যায় প্রবল বৃষ্টি শুরু হয় আর অবশেষে আমরা সম্মেলন করতে পারি! সেখানে আমি খ্রিস্টান গ্রিক শাস্ত্রের নতুন জগৎ অনুবাদ (ইংরেজি) বাইবেল টুভালুয়ান ভাষায় প্রকাশ করার অতুলনীয় সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সময়ে টুভালুয়ান ছিল সবচেয়ে ছোটো ভাষাভাষী দল, যারা এই অপূর্ব উপহার লাভ করেছিল। সম্মেলনের শেষে আবারও প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। তাই সকলে প্রচুর পরিমাণ আধ্যাত্মিক জল ও আক্ষরিক জল লাভ করে কার্যক্রম শেষ করেছিল!

২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার টাউনস্‌ভিলে একটা সম্মেলনে আমি আমার বাবা-মা, রন ও এস্টেল জ্যাকসনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি

দুঃখের বিষয় হল, আমার ৩৫ বছরের বিশ্বস্ত সাথি জেনি এই স্মরণীয় ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষি হতে পারেনি। দশ বছর ধরে স্তন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করার পর, ২০০৯ সালে সে হেরে গিয়েছিল। সে যখন পুনরুত্থিত হবে, তখন টুভালুয়ান ভাষায় বাইবেল প্রকাশের খবর শুনে নিঃসন্দেহে অনেক আনন্দিত হবে।

সেই সময় থেকে, যিহোবা আমাকে আরেকজন চমৎকার সাথি দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। তার নাম লরেনি সিকিভো। লরেনি এবং জেনি ফিজি বেথেলে একসঙ্গে কাজ করত আর লরেনি ফিজিয়ান ভাষায় একজন অনুবাদক হিসেবে সেবা করত। তাই, এখন আমার আরেকজন বিশ্বস্ত সাথি রয়েছে আর আমরা একসঙ্গে যিহোবার সেবা করি এবং আমাদের দু-জনেরই ভাষার জন্য ভালোবাসা রয়েছে!

ফিজিতে লরেনির সঙ্গে সাক্ষ্যদান করছি

অতীতের দিকে ফিরে তাকালে, আমাদের স্বর্গীয় পিতা যিহোবা যেভাবে ছোটো-বড়ো সকল ভাষাভাষী দলের চাহিদার যত্ন নিয়ে যাচ্ছেন, তা দেখে আমি অনেক উৎসাহিত হই। (গীত. ৪৯:১-৩) তাঁর প্রেম আমি সেইসমস্ত ব্যক্তির আনন্দিত চেহারায় ফুটে উঠতে দেখেছি, যারা প্রথম বার তাদের ভাষায় আমাদের কিছু সাহিত্য দেখেছে অথবা তাদের প্রাণের ভাষায় যিহোবার প্রশংসাগান গেয়েছে। (প্রেরিত ২:৮, ১১) সাউলো টিসি নামে একজন বয়স্ক টুভালুয়ান ভাইয়ের বলা কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজে। তার ভাষায় প্রথম বার রাজ্যের গান গাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন: “পরিচালকগোষ্ঠীকে বলবেন এই গানগুলো ইংরেজির চেয়ে টুভালুয়ান ভাষায় শুনতে আরও ভালো লাগে।”

২০০৫ সাল থেকে, আমি যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালকগোষ্ঠীর একজন সদস্য হিসেবে সেবা করার অপ্রত্যাশিত বিশেষ সুযোগ পেয়েছি। যদিও আমি এখন আর একজন অনুবাদক হিসেবে সেবা করতে পারি না, কিন্তু যিহোবা আমাকে বিশ্বব্যাপী অনুবাদ কাজে সাহায্য করার ক্ষেত্রে জড়িত থাকার সুযোগ দিয়েছেন। তাই আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিই। যিহোবা তাঁর সকল লোকের—এমনকী প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জের লোকেদের—আধ্যাত্মিক চাহিদার যত্ন নেন, এই বিষয়টা জানা কতই-না আনন্দদায়ক! হ্যাঁ, গীতরচকের কথা অনুযায়ী, “সদাপ্রভু রাজত্ব করেন; পৃথিবী উল্লাসিত হউক, দ্বীপসমূহ আনন্দ করুক।”—গীত. ৯৭:১.

^ অনু. 18 আমাদের সাহিত্যাদির বিষয়ে প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, তা জানার জন্য ২০০০ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ৩২ পৃষ্ঠা, ১৯৮৮ সালের প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ২২ পৃষ্ঠা এবং ২০০০ সালের সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকার ৯ পৃষ্ঠা দেখুন।

^ অনু. 22 সামোয়ায় অনুবাদ কাজের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য বর্ষপুস্তক ২০১২ (ইংরেজি) বইয়ের ১২০-১২১, ১২৩-১২৪ পৃষ্ঠা দেখুন।