সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

তিনি “হৃদয় মধ্যে আন্দোলন” করেছিলেন

তিনি “হৃদয় মধ্যে আন্দোলন” করেছিলেন

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন

তিনি “হৃদয় মধ্যে আন্দোলন” করেছিলেন

 মরিয়ম অস্বস্তির সঙ্গে তার শরীরের ভার ছোট্ট মালবাহী পশুটার ওপর ছেড়ে দেন। তিনি অনেক সময় ধরে এই পশুর পিঠে চড়ে যাত্রা করছেন। কিছুটা সামনেই, যোষেফ হেঁটে চলেছেন, দূরবর্তী বৈৎলেহমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। মরিয়ম আরেকবার টের পান যে, তার গর্ভের শিশুটি নড়ে উঠেছে।

বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মরিয়মের প্রসবের সময় এগিয়ে এসেছে। (লূক ২:৫, ৬) এই দম্পতি একটার পর একটা শস্য খেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, কিছু কৃষক সম্ভবত জমি চাষ করার কিংবা বীজ বোনার সময় তাদের দিকে তাকিয়েছিল এবং অবাক হয়ে ভেবেছিল যে, এইরকম অবস্থায় এই মহিলা কেন যাত্রা করছেন। কোন বিষয়টা মরিয়মকে তার নিজ এলাকা নাসরৎ থেকে এত দূরে যাত্রা করতে পরিচালিত করেছিল?

এই সমস্তকিছু কয়েক মাস আগে শুরু হয়েছিল, যখন এই যিহুদি যুবতী একটা কার্যভার পেয়েছিলেন, যেটা সমস্ত মানব ইতিহাসে অদ্বিতীয় ছিল। তিনি যে-সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছিলেন, সেই সন্তান হবেন মশীহ, ঈশ্বরের পুত্র! (লূক ১:৩৫) সন্তান প্রসবের সময় যখন ঘনিয়ে এসেছিল, তখনই এই যাত্রা করার প্রয়োজন হয়েছিল। এই যাত্রার সময়, মরিয়মকে বিভিন্ন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যা তার বিশ্বাসকে পরীক্ষায় ফেলেছিল। আসুন আমরা দেখি, কী তাকে আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী থাকতে সাহায্য করেছিল।

বৈৎলেহমের উদ্দেশে যাত্রা

কেবলমাত্র যোষেফ ও মরিয়মকেই এই যাত্রা করতে হয়নি। আগস্ত কৈসর সেই সময়ে সমগ্র দেশে নাম লেখানোর বা রেজিস্ট্রি করার আদেশ জারি করেছিলেন আর সেই আদেশ পালন করার জন্য লোকেদেরকে তাদের নিজ নিজ জন্মস্থানে যেতে হয়েছিল। যোষেফ কীভাবে সাড়া দিয়েছিলেন? বিবরণ বলে: “আর যোষেফও গালীলের নাসরৎ নগর হইতে যিহূদিয়ায় বৈৎলেহম নামক দায়ূদের নগরে গেলেন, কারণ তিনি দায়ূদের কুল ও গোষ্ঠীজাত ছিলেন।”—লূক ২:১-৪.

সেই সময়ে কৈসরের এমন আদেশ জারি করা কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। প্রায় সাত শতাব্দী আগে লিখিত একটা ভবিষ্যদ্‌বাণীতে বলা হয়েছিল যে, মশীহ বৈৎলেহমে জন্ম নেবেন। ঘটনা হচ্ছে, নাসরৎ থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে বৈৎলেহম নামে একটা নগরও ছিল। কিন্তু, ভবিষ্যদ্‌বাণী নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছিল যে, মশীহ ‘বৈৎলেহম-ইফ্রাথায়’ জন্মগ্রহণ করবেন। (মীখা ৫:২) বর্তমান সময়ের রাস্তার পরিমাপ অনুযায়ী, পাহাড়ি ভূখণ্ডের ওপর প্রায় ১৫০ কিলোমিটার রাস্তা নাসরৎকে এর দক্ষিণের সেই ছোট্ট গ্রাম থেকে আলাদা করেছে। এই বৈৎলেহমেই যোষেফকে উপস্থিত হওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল, কারণ এটা ছিল রাজা দায়ূদের গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষদের বাসস্থান আর যোষেফ ও তার স্ত্রী দুজনেই সেই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।

মরিয়ম কি যোষেফের এইরকম সিদ্ধান্তকে মেনে নেবেন? কারণ এই যাত্রা তার জন্য খুবই কঠিন হবে। সম্ভবত বছরের সেই সময়টা ছিল শরৎকালের প্রথমদিক, তাই শুষ্ক মৌসুম ধীরে ধীরে শেষ হয়ে তখন হালকা বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এ ছাড়া, বৈৎলেহম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৬০ মিটারেরও বেশি উঁচুতে অবস্থিত ছিল আর কয়েক দিনের যাত্রার শেষ দিকে বেশ খাঁড়া, দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হতো। এইবার হয়তো সাধারণ সময়ের চেয়ে আরও বেশি সময় লাগবে, কারণ মরিয়মের শারীরিক অবস্থার জন্য সম্ভবত অনেকবার বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন হবে। গর্ভাবস্থার এই শেষ সময়ে, একজন যুবতী হয়তো তার ঘরেই থাকতে চাইবেন, যেখানে তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধব রয়েছে, যারা কিনা তার প্রসববেদনা শুরু হলে তাকে সাহায্য করার জন্য তৈরি থাকে। নিঃসন্দেহে, এই যাত্রা করার জন্য তার সাহসের দরকার ছিল।

যাই হোক, লূক লিখেছেন যে, যোষেফ “মরিয়মের সহিত নাম লিখিয়া দিবার জন্য” গিয়েছিলেন। এ ছাড়া, তিনি মরিয়মকে “[যোষেফের] বাগ্দত্তা স্ত্রী” বলে উল্লেখ করেন। (লূক ২:৪, ৫) এই সময়ের মধ্যে, মরিয়ম যোষেফের স্ত্রী হয়ে যাওয়ায় তা মরিয়মের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ওপর অনেক প্রভাব ফেলেছিল। তিনি তার স্বামীকে পরিবারের মস্তক হিসেবে গণ্য করেছিলেন, স্বামীর সিদ্ধান্তগুলোকে সমর্থন করার মাধ্যমে তার সহকারিণী হিসেবে মরিয়ম নিজের ঈশ্বরদত্ত ভূমিকাকে পালন করেছিলেন। * তাই, শুধুমাত্র বাধ্য হওয়ার মাধ্যমে তিনি তার বিশ্বাসের এই সম্ভাব্য পরীক্ষাকে মোকাবিলা করেছিলেন।

আর কোন বিষয়টা হয়তো মরিয়মকে বাধ্য হতে অনুপ্রাণিত করেছিল? তিনি কি মশীহের জন্মস্থান হিসেবে বৈৎলেহমের বিষয়ে ভবিষ্যদ্‌বাণী জানতেন? বাইবেল এই বিষয়ে কিছু জানায় না। আমরা এই সম্ভাবনাকে বাতিলও করে দিতে পারি না কারণ সেই বিষয়ে ধর্মীয় নেতারা আর এমনকী সাধারণ লোকেরাও স্পষ্টতই জানত। (মথি ২:১-৭; যোহন ৭:৪০-৪২) আর শাস্ত্র সম্বন্ধে মরিয়মও নিশ্চয়ই অজ্ঞ ছিলেন না। (লূক ১:৪৬-৫৫) মরিয়ম তার স্বামীর প্রতি, সরকারি এক আদেশের প্রতি বা যিহোবার নিজের ভবিষ্যদ্‌বাণীর প্রতি—অথবা অন্যান্য যে-কারণেই—বাধ্য হয়ে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিন না কেন, তা করে তিনি এক অসাধারণ উদাহরণ স্থাপন করেছেন। যিহোবা পুরুষ ও নারী উভয়ের নম্র, বাধ্যতার মনোভাবকে উচ্চমূল্য দেন। আমাদের সময়ে, যখন বাধ্যতাকে প্রায়ই অবজ্ঞা করা হয়, তখন সব জায়গার বিশ্বস্ত লোকেদের জন্য মরিয়মের উদাহরণ এক অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

খ্রিস্টের জন্ম

দূর থেকে বৈৎলেহমকে দেখতে পেয়ে মরিয়ম নিশ্চয়ই এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠার সময়, জলপাই বাগানগুলোর পাশ দিয়ে—কাটার উপযোগী শেষ ফসলের খেতের মধ্যে দিয়ে—যাওয়ার সময় হয়তো মরিয়ম ও যোষেফ এই ছোট্ট গ্রামের ইতিহাস সম্বন্ধে ভেবেছিল। এটা যিহূদার নগরগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র বলে অগণিত ছিল, যেমনটা ভাববাদী মীখা বলেছিলেন; কিন্তু, এক হাজার বছরেরও বেশি আগে এখানেই বোয়স, নয়মী এবং পরে দায়ূদের জন্ম হয়েছিল।

মরিময় ও যোষেফ দেখেছিল যে, গ্রামটা লোকে পরিপূর্ণ। নাম রেজিস্ট্রি করার জন্য অন্যেরা তাদের আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল, তাই পান্থশালায় তাদের জন্য জায়গা ছিল না। * রাতে থাকার জন্য একটা আস্তাবলে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায়ই ছিল না। আমরা যোষেফের উদ্‌বিগ্নতার বিষয় কল্পনা করতে পারি, যখন তিনি তার স্ত্রীকে তীব্র ব্যথায় কষ্ট পেতে দেখেছিলেন, যে-সম্বন্ধে মরিয়মের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না ও তা ক্রমশ বাড়ছিল। আর এতসব জায়গা থাকতে এখানেই কিনা মরিয়মের প্রসববেদনা শুরু হয়েছিল।

সব জায়গার নারীরা মরিয়মের প্রতি সমবেদনা দেখাতে পারে। সেই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪,০০০ বছর আগে, যিহোবা ভবিষ্যদ্‌বাণী করেছিলেন যে, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পাপের কারণে সমস্ত নারীই সন্তান প্রসবের সময় বেদনা ভোগ করবে। (আদিপুস্তক ৩:১৬) এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, মরিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ব্যতিক্রম ছিল। তার প্রসববেদনার কষ্ট সম্বন্ধে লূক নির্দিষ্টভাবে কোনো বর্ণনা না দিয়ে কেবল এটুকু বলেন: “তিনি আপনার প্রথমজাত পুত্ত্র প্রসব করিলেন।” (লূক ২:৭) হ্যাঁ, তার “প্রথমজাত” সন্তানের—মরিয়মের অনেক সন্তানের মধ্যে, কমপক্ষে সাত সন্তানের মধ্যে প্রথমজনের—জন্ম হয়েছিল। (মার্ক ৬:৩) কিন্তু, এই প্রথম সন্তান অন্যদের চেয়ে আলাদা হবে। এই সন্তান কেবলমাত্র মরিয়মেরই প্রথমজাত সন্তান ছিলেন না কিন্তু তিনি যিহোবারও “সমুদয় সৃষ্টির প্রথমজাত,” ঈশ্বরের একজাত পুত্র ছিলেন!—কলসীয় ১:১৫.

এই পর্যায়ে এসে সেই বিবরণ সুপরিচিত এক বর্ণনা যুক্ত করে: ‘তিনি তাঁহাকে কাপড়ে জড়াইয়া যাবপাত্রে শোয়াইয়া রাখিলেন।’ (লূক ২:৭) পৃথিবীব্যাপী যিশুর জন্ম বিষয়ক বিভিন্ন নাটক, ছবি এবং দৃশ্যগুলো এই পরিবেশকে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ করে ও অবাস্তবভাবে তুলে ধরে। কিন্তু, প্রকৃত বিষয়টা বিবেচনা করুন। মরিয়ম শিশুটিকে যাবপাত্রে শুইয়ে রেখেছিলেন। এই পরিবার আস্তাবলে থেকেছিল আর তাই তখন হোক বা এখন, এইরকম পরিবেশে উত্তম বায়ু চলাচল করতে বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অবস্থা থাকতে পারে না। সত্যিই, কোন বাবা-মাই বা সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য এমন একটা স্থান বেছে নেবে, যদি তাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প থাকত? অধিকাংশ বাবা-মা তাদের সন্তানদের জন্য সর্বোত্তমটাই চায়। মরিয়ম এবং যোষেফ ঈশ্বরের পুত্রের জন্য আরও কত উত্তম পরিবেশই না জোগাতে চেয়েছিল!

কিন্তু, তারা তাদের সীমাবদ্ধতাগুলোর জন্য তিক্তবিরক্ত হয়ে যায়নি; তাদের কাছে যা ছিল, তা দিয়েই তারা তাদের যথাসাধ্য করেছিল। উদাহরণ হিসেবে লক্ষ করুন, মরিয়ম নিজেই শিশুটির যত্ন নিয়েছিলেন, তাঁকে আরামদায়কভাবে কাপড় দিয়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন, এরপর ঘুমানোর জন্য শিশুটিকে যত্নের সঙ্গে যাবপাত্রে শুইয়ে দিয়েছিলেন আর নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, শিশুটি উষ্ণ ও নিরাপদ থাকবে। মরিয়ম তখনকার পরিস্থিতির কারণে উদ্‌বিগ্নতাকে, তার যথাসাধ্য করা থেকে তাকে বিক্ষিপ্ত করতে সুযোগ দেননি। তিনি এবং যোষেফ উভয়েই জানতেন যে, এই সন্তানের জন্য তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-বিষয়টা করতে পারে তা হচ্ছে, আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর যত্ন নেওয়া। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৬-৮) আজকে, আধ্যাত্মিকভাবে অধঃপতিত এই জগতে বিজ্ঞ বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে মানুষ করে তোলার সময় একই অগ্রাধিকারগুলো স্থাপন করে।

এক পরিদর্শন উৎসাহিত করে

হঠাৎ এক হইচই সেই শান্ত পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছিল। মেষপালকরা তাড়াহুড়ো করে সেই আস্তাবলে ঢুকে পড়ে, তারা সেই পরিবার এবং বিশেষ করে শিশুটিকে দেখার জন্য উৎসুক ছিল। তারা অত্যন্ত আনন্দিত ছিল, তাদের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক দেখা যাচ্ছিল। তারা পাহাড়ের ঢালু পাদদেশ থেকে ছুটে এসেছিল, যেখানে তারা তাদের পালের সঙ্গে থাকত। * তাদের সবেমাত্র যে-চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই বিষয়ে তারা বিস্ময়ে অভিভূত সেই বাবা-মাকে বলেছিল। পাহাড়ের পাদদেশে রাতের বেলা তাদের সামনে হঠাৎ একজন স্বর্গদূত উপস্থিত হয়েছিলেন। যিহোবার প্রতাপ চারিদিকে দেদীপ্যমান হয়েছিল আর সেই স্বর্গদূত তাদেরকে বলেছিলেন যে, খ্রিস্ট বা মশীহ বৈৎলেহমে জন্ম নিয়েছেন। তারা শিশুটিকে কাপড়ে জড়ানো, যাবপাত্রে শোয়ানো অবস্থায় দেখতে পাবে। এরপর, আরও বেশি আশ্চর্যজনক এক বিষয় ঘটে—স্বর্গদূতদের এক বিশাল গায়কদল উপস্থিত হয়েছিল, যিহোবার প্রশংসা গান করেছিল!

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই নম্র মানুষগুলো তাড়াহুড়ো করে বৈৎলেহমে এসেছিল! তারা নিশ্চয়ই স্বর্গদূতের বর্ণনা অনুযায়ী, এক নবজাত শিশুকে শোয়ানো অবস্থায় দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছিল। তারা এই সুসংবাদ নিজেদের কাছে রেখে দেয়নি। “যে কথা তাহাদিগকে বলা হইয়াছিল, তাহা জানাইল। তাহাতে যত লোক মেষপালকগণের মুখে ঐ সব কথা শুনিল, সকলে এই সকল বিষয়ে আশ্চর্য্য জ্ঞান করিল।” (লূক ২:১৭, ১৮) সেই সময়কার ধর্মীয় নেতারা স্পষ্টতই মেষপালকদের নিচু চোখে দেখত। কিন্তু, যিহোবা স্পষ্টতই এই নম্র, বিশ্বস্ত লোকেদের মূল্য দিয়েছিলেন। কিন্তু, এই পরিদর্শন মরিয়মকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?

মরিয়ম নিশ্চিতভাবেই সন্তান প্রসবের কষ্টের কারণে পরিশ্রান্ত ছিলেন কিন্তু তিনি প্রতিটা কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন। আর তিনি আরও বেশি কিছু করেছিলেন: “মরিয়ম সেই সকল কথা হৃদয় মধ্যে আন্দোলন করিতে করিতে মনে সঞ্চয় করিয়া রাখিলেন।” (লূক ২:১৯) সত্যিই এই যুবতী এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতেন। তিনি জানতেন যে, স্বর্গদূতের এই বার্তা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার ঈশ্বর যিহোবা চেয়েছিলেন যে, তিনি যেন নিজের সন্তানের পরিচিতি ও গুরুত্বকে উপলব্ধি করেন। তাই, মরিয়ম শুধুমাত্র শোনার চেয়ে আরও বেশি কিছু করেছিলেন। তিনি কথাগুলো তার হৃদয়ে সঞ্চয় করে রেখেছিলেন, যাতে আসন্ন মাস ও বছরগুলোতে সেই বিষয়ে বার বার চিন্তা করতে পারেন। এখানেই বিশ্বাসের এক অসাধারণ চাবিকাঠি রয়েছে, যা মরিয়ম জীবনভর দেখিয়েছিলেন।

আপনি কি মরিয়মের উদাহরণ অনুসরণ করবেন? যিহোবা অতীব গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক সত্যগুলো দিয়ে তাঁর বাক্যের পৃষ্ঠাগুলো পূর্ণ করেছেন। কিন্তু, যদি আমরা প্রথমে সেগুলোতে মনোযোগ না দিই, তাহলে সেই সত্যগুলো আমাদের সামান্যই উপকার করবে। আমরা তা করে থাকি নিয়মিত বাইবেল পড়ে—শুধুমাত্র এক সাহিত্যকর্ম হিসেবে দেখে নয় বরং এটিকে ঈশ্বর নিশ্বসিত বা অনুপ্রাণিত এক বাক্য হিসেবে দেখে। (২ তীমথিয় ৩:১৬) তাই, মরিয়মের মতো আমাদেরকে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো নিজেদের হৃদয়ে সঞ্চয় করতে হবে, সেগুলোকে আন্দোলিত করতে হবে। আমরা বাইবেল থেকে যা পড়ি, তা নিয়ে যদি ধ্যান করি এবং যিহোবার পরামর্শ আরও পূর্ণরূপে কাজে লাগানোর উপায়গুলো মনোযোগের সঙ্গে বিবেচনা করি, তাহলে আমরা আমাদের বিশ্বাসকে বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় চালিকাশক্তি জোগাতে পারব।

সঞ্চয় করে রাখার মতো আরও বিষয়

শিশুটির বয়স আট দিন হলে, মরিয়ম ও যোষেফ মোশির ব্যবস্থানুযায়ী তাঁকে ত্বক্‌চ্ছেদ করিয়েছিল, নির্দেশমতো তাঁর নাম যিশু রেখেছিল। (লূক ১:৩১) এরপর, ৪০তম দিনে তারা তাঁকে বৈৎলেহম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে যিরূশালেমের মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল এবং শুচিকরণ বলি হিসেবে দরিদ্র লোকেদের জন্য ব্যবস্থায় অনুমোদিত দুটো ঘুঘু অথবা দুটো কবুতর উৎসর্গ করেছিল। অন্য বাবা-মায়েরা যা উৎসর্গ করতে সমর্থ ছিল, যেমন একটা মেষ ও একটা ঘুঘু, তারা তা উৎসর্গ করতে না পারার কারণে তাদের মধ্যে যদি কোনোরকম লজ্জা এসেও থাকে, তারা সেই অনুভূতিকে উপেক্ষা করেছিল। যেকোনোভাবেই হোক, সেখানে থাকাকালীন তারা প্রচুর উৎসাহ লাভ করেছিল।—লূক ২:২১-২৪.

শিমিয়োন নামে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তাদের কাছে এসেছিলেন এবং মরিয়মের হৃদয়ে সঞ্চয় করে রাখার জন্য আরও কিছু বিষয় বলেছিলেন। শিমিয়োনের কাছে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল যে, তিনি তার মৃত্যুর আগেই মশীহকে দেখতে পাবেন আর যিহোবার পবিত্র আত্মা তাকে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, ছোট্ট যিশুই ছিলেন সেই ভবিষ্যদ্‌বাণীকৃত ত্রাণকর্তা। এ ছাড়া, মরিয়মকে যে একদিন কষ্ট সহ্য করতে হবে, সেই বিষয়েও শিমিয়োন তাকে আগেই জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, মরিয়ম এমন অনুভব করবেন যেন তার মধ্যে এক খড়্গ বিদ্ধ হয়েছে। (লূক ২:২৫-৩৫) পূর্বাভাস হিসেবে বলা এই কথাগুলোই হয়তো মরিয়মকে তিন দশকেরও বেশি সময় পরে যে-কঠিন সময় এসেছিল, তা সহ্য করতে সাহায্য করেছিল। শিমিয়োনের পর, হান্না নামে একজন ভাববাদিনী ছোট্ট যিশুকে দেখেছিলেন এবং যিরূশালেমের মুক্তির আশায় ছিল এমন প্রত্যেকের কাছে তাঁর সম্বন্ধে বলতে শুরু করেছিলেন।—লূক ২:৩৬-৩৮.

যোষেফ এবং মরিয়ম তাদের সন্তানকে যিরূশালেমে যিহোবার মন্দিরে নিয়ে এসে কী চমৎকার এক সিদ্ধান্তই না নিয়েছিল! এটা করার মাধ্যমে, তারা তাদের ছেলেকে সারাজীবন ধরে যিহোবার মন্দিরে বিশ্বস্তভাবে উপস্থিত থাকার অভ্যাসের সূত্রপাত করেছিলেন। সেখানে থাকাকালীন, তারা তাদের যথাসাধ্য করেছিল এবং নির্দেশনামূলক ও উৎসাহজনক বাক্য লাভ করেছিল। নিশ্চিতভাবেই মরিয়ম সেদিন বিশ্বাসে আরও শক্তিশালী হয়ে মন্দির ত্যাগ করেছিলেন আর ধ্যান করার জন্য এবং অন্যদের বলার জন্য আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো দিয়ে তার হৃদয় পূর্ণ হয়েছিল।

আজকে বাবা-মায়েদের সেই উদাহরণ অনুসরণ করতে দেখা দেখা এক চমৎকার বিষয়। যিহোবার সাক্ষিদের মাঝে, বাবা-মায়েরা বিশ্বস্তভাবে তাদের সন্তাদেরকে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে নিয়ে আসে। এই বাবা-মায়েরা তাদের সহবিশ্বাসীদের জন্য উৎসাহজনক কথাবার্তা বলে ঈশ্বরের সেবায় তাদের যথাসাধ্য করে। আর তারা খ্রিস্টীয় সভাগুলো থেকে চলে যাওয়ার সময় আরও বেশি সবল ও সুখী হয় এবং অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মতো অনেক উত্তম বিষয় তাদের থাকে। আপনিও তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য সাদরে আমন্ত্রিত। আপনি যদি তা করেন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন যে, মরিয়মের মতো আপনার বিশ্বাসও আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী হবে। (w০৮ ১০/১)

[পাদটীকাগুলো]

^ এই যাত্রার বর্ণনা এবং পূর্বের আরেকটা যাত্রার বর্ণনার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করুন: ইলিশাবেতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য “মরিয়ম উঠিয়া . . . গেলেন।” (লূক ১:৩৯) বাগ্‌দত্তা অথচ অবিবাহিত একজন নারী হিসেবে মরিয়ম সেই সময়ে হয়তো যোষেফের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা ছাড়াই কাজ করেছিলেন। বিয়ের পর, এই দম্পতির একত্রে যাত্রার বন্দোবস্ত মরিয়ম নয় বরং যোষেফই করেছিলেন।

^ ভ্রমণকারীদের এবং যাযাবর লোকেদের থাকার জন্য একটা ভাড়া করা ঘরের ব্যবস্থা করা সেই সময়কার নগরগুলোর রীতি ছিল।

^ সেই সময়ে এই মেষপালকরা যে পাল নিয়ে মাঠে ছিল, সেই বিষয়টা বাইবেলের কালনিরূপণবিদ্যা যা ইঙ্গিত করে, সেটাকে নিশ্চিত করে: খ্রিস্টের জন্ম ডিসেম্বর মাসে, যখন কিনা পালগুলো ঘরের কাছেই ছাউনিতে থাকত, সেই সময় হয়নি বরং অক্টোবর মাসের প্রথমদিকের কোনো একসময়ে হয়েছিল।

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

শিমিয়োন ভবিষ্যদ্‌বাণীকৃত ত্রাণকর্তাকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন