উপবাস করা এটা কি আপনাকে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী করে?
উপবাস করা এটা কি আপনাকে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী করে?
‘উপবাস করা হল এমন কিছু, যা আপনাকে আধ্যাত্মিকতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করে এবং আপনাকে মনে করিয়ে দেয় যে, বস্তুগত জিনিসগুলো আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।’—একজন ক্যাথলিক ভদ্রমহিলা। ‘উপবাস করা আপনাকে ঈশ্বরের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।’—একজন যিহুদি রব্বি।
‘আমার বিশ্বাস অনুযায়ী উপবাস করা হল এক বাধ্যবাধকতা, ঈশ্বরের প্রতি আমার ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা দেখানোর এক প্রধান উপায়। আমি উপবাস করি কারণ আমি ঈশ্বরকে ভালোবাসি।’—বাহাই বিশ্বাসের একজন অনুসারী।
বৌ দ্ধ, হিন্দু, ইসলাম, জৈন ও যিহুদি ধর্মসহ জগতের অনেক ধর্মের মধ্যে উপবাস করা হল এক সাধারণ প্রথা। অনেক লোক বিশ্বাস করে যে, নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা একজনকে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী করে।
আপনি কী মনে করেন? আপনার কি উপবাস করা উচিত? এই বিষয়ে ঈশ্বরের বাক্য বাইবেল কী বলে?
বাইবেলের সময়ে উপবাস
বাইবেলের সময়ে, লোকেরা বিভিন্ন কারণে উপবাস করত, যেগুলোতে ঐশিক অনুমোদন ছিল। কেউ কেউ প্রচণ্ড দুঃখ অথবা পাপের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করতে (১ শমূয়েল ৭:৪-৬), ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রার্থনা করতে বা তাঁর নির্দেশনা খুঁজতে (বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ২০:২৬-২৮, লূক ২:৩৬, ৩৭) কিংবা ধ্যান করার সময় কারো মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে উপবাস করেছিল।—মথি ৪:১, ২.
কিন্তু, বাইবেল এমন উপবাসগুলোর বিষয়েও বলে, যেগুলো ঈশ্বর অনুমোদন করেননি। একজন ভূতুড়িয়ার সঙ্গে পরামর্শ করার আগে রাজা শৌল উপবাস করেছিলেন। (লেবীয় পুস্তক ২০:৬; ১ শমূয়েল ২৮:২০) দুষ্ট লোকেরা, যেমন ঈষেবল এবং সেইসঙ্গে যে-ধর্মান্ধ লোকেরা প্রেরিত পৌলকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল, তারা উপবাস ঘোষণা করেছিল। (১ রাজাবলি ২১:৭-১২; প্রেরিত ২৩:১২-১৪) ফরীশীরা তাদের নিয়মিত উপবাস করার জন্য সুপরিচিত ছিল। (মার্ক ২:১৮) তা সত্ত্বেও, যিশু তাদের নিন্দা করেছিলেন এবং তারা ঈশ্বরকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। (মথি ৬:১৬; লূক ১৮:১২) একইভাবে, যিহোবা কিছু ইস্রায়েলীয়ের উপবাসকে তাদের মন্দ আচরণ এবং খারাপ উদ্দেশ্যের জন্য অগ্রাহ্য করেছিলেন।—যিরমিয় ১৪:১২.
এই উদাহরণগুলো দেখায় যে, শুধুমাত্র উপবাস করাই ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করে না। কিন্তু, ঈশ্বরের অনেক আন্তরিক
দাস যারা উপবাস করেছিল, তারা ঐশিক অনুমোদন লাভ করেছিল। তাই খ্রিস্টানদের কি উপবাস করা উচিত?খ্রিস্টানদের জন্য উপবাস করা কি বাধ্যতামূলক?
মোশির ব্যবস্থা যিহুদিদেরকে বছরে একবার প্রায়শ্চিত্তের দিনে “আপন আপন প্রাণকে দুঃখ” দিতে অর্থাৎ উপবাস করতে আদেশ দিয়েছিল। (লেবীয় পুস্তক ১৬:২৯-৩১; গীতসংহিতা ৩৫:১৩) যিহোবা তাঁর লোকেদের একমাত্র এই উপবাস করার জন্যই আদেশ দিয়েছিলেন। * যে-যিহুদিরা মোশির ব্যবস্থার অধীনে ছিল, তারা নিশ্চয় সেই আদেশ মেনে চলত। কিন্তু, খ্রিস্টানদের মোশির ব্যবস্থা পালন করার প্রয়োজন নেই।—রোমীয় ১০:৪; কলসীয় ২:১৪.
যদিও যিশু ব্যবস্থা অনুসারে উপবাস করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা করার জন্য সুপরিচিত ছিলেন না। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন যে, তারা যদি উপবাস করতে চায়, তাহলে তাদের কেমন আচরণ করতে হবে, তবে তিনি কখনো তাদের উপবাস করার আদেশ দেননি। (মথি ৬:১৬-১৮; ৯:১৪) তাহলে কেন যিশু বলেছিলেন যে, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা উপবাস করবে? (মথি ৯:১৫) এটা কোনো আদেশ ছিল না। যিশুর কথাগুলো কেবল ইঙ্গিত করে যে, তাঁর মৃত্যুতে তাঁর শিষ্যরা প্রচণ্ড দুঃখ অনুভব করবে এবং খাওয়াদাওয়া করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলবে।
উপবাস করেছিল এমন প্রাথমিক খ্রিস্টানদের সম্বন্ধে বাইবেলের দুটো বিবরণ দেখায় যে, কোনো ব্যক্তি যদি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা বেছে নেন, তাহলে তা ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য। (প্রেরিত ১৩:২, ৩; ১৪:২৩) * তাই, খ্রিস্টানরা আর উপবাস করার বাধ্যবাধকতার অধীন নয়। তবে, একজন ব্যক্তি যিনি তা করা বেছে নেন, তার কিছু বিপদ সম্বন্ধে সাবধান থাকা উচিত।
ফাঁদগুলো থেকে সাবধান থাকুন
উপবাস করার বিষয়ে একটা যে-ফাঁদ এড়িয়ে চলতে হবে, তা হল আত্মধার্মিকতা। বাইবেল আমাদের ‘নম্রতার [‘বিনয়ের ভান করার,’ বাংলা ইজি-টু-রিড ভারসন]’ বিরুদ্ধে সাবধান করে। (কলসীয় ২:২০-২৩) নিয়মিত উপবাস করার কারণে নিজেকে অন্যদের চেয়ে নৈতিক দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন এমন এক অহংকারী ফরীশী সম্বন্ধে যিশুর দৃষ্টান্ত এই বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই রাখে না যে, ঈশ্বর এই ধরনের মনোভাবকে প্রত্যাখ্যান করেন।—লূক ১৮:৯-১৪.
এ ছাড়া, আপনি যে উপবাস করেন তা জনসমক্ষে বলে বেড়ানো কিংবা অন্য কেউ আপনাকে তা করতে বলেছে বলে যদি আপনি উপবাস করেন, তাহলে তা ভুল হবে। মথি ৬:১৬-১৮ পদ অনুসারে যিশু পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, উপবাস করার বিষয়টা আপনার এবং ঈশ্বরের মধ্যে এক ব্যক্তিগত বিষয় হওয়া উচিত আর আপনার তা অন্যদের কাছে প্রচার করা উচিত নয়।
একজন ব্যক্তির কখনো এটা চিন্তা করা উচিত নয় যে, উপবাস করা কোনো না কোনোভাবে পাপের ক্ষতিকে পুষিয়ে দেবে। ঈশ্বরের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হলে, উপবাস যিশাইয় ৫৮:৩-৭) উপবাস করা নয় বরং আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়াই পাপের ক্ষমা লাভের দিকে পরিচালিত করে। (যোয়েল ২:১২, ১৩) বাইবেল এই বিষয়টার ওপর জোর দেয় যে, আমরা খ্রিস্টের বলিদানের মাধ্যমে প্রকাশিত যিহোবার অনুগ্রহ বা অযাচিত দয়ার দ্বারাই ক্ষমা লাভ করি। উপবাস করাসহ কোনো কাজের দ্বারাই ক্ষমা লাভ করা সম্ভব নয়।—রোমীয় ৩:২৪, ২৭, ২৮; গালাতীয় ২:১৬; ইফিষীয় ২:৮, ৯.
করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আইনগুলোর প্রতি বাধ্য থাকতে হবে। (যিশাইয় ৫৮:৩ পদ আরেকটা সাধারণ ভুলের বিষয়ে ব্যাখ্যা করে। ইস্রায়েলীয়রা মনে করেছিল যে, তাদের উপবাস করার প্রতিদানে যিহোবা তাদেরকে কিছু দিতে বাধ্য, যেন উপবাস করার দ্বারা তারা ঈশ্বরকে কোনো অনুগ্রহ করছে। তারা জিজ্ঞেস করেছিল: “আমরা উপবাস করিয়াছি, তুমি কেন দৃষ্টি কর না? আমরা আপন আপন প্রাণকে দুঃখ দিয়াছি, তুমি কেন তাহা জান না?” বর্তমানেও অনেকে একইরকমভাবে চিন্তা করে, উপবাস করার কারণে তারা আশা করতে পারে যে, ঈশ্বর এর প্রতিদানে তাদের কোনো অনুগ্রহ করবেন। আমরা যেন কখনো এইরকম এক অসম্মানজনক এবং অশাস্ত্রীয় মনোভাবকে অনুকরণ না করি!
অন্যেরা বিশ্বাস করে যে, উপবাস করার, নিজেদেরকে চাবুক মারার বা এইরকম কিছু করার দ্বারা শরীরকে কষ্ট দিয়ে ঈশ্বরের অনুমোদন লাভ করা সম্ভব। ঈশ্বরের বাক্য এই ধারণাকে নিন্দা করে, দেখায় যে, ‘দেহের প্রতি নির্দ্দয়তা’ মন্দ আকাঙ্ক্ষাগুলোর “বিরুদ্ধে কিছুর মধ্যে গণ্য নহে।”—কলসীয় ২:২০-২৩.
এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি
উপবাস করা বাধ্যতামূলক নয়; কিংবা এটা করা ভুলও নয়। যদি ওপরে উল্লেখিত বিপদগুলো এড়িয়ে চলা হয়, তাহলে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে এটা উপকারজনক হতে পারে। কিন্তু, গ্রহণযোগ্য উপাসনার জন্য উপবাস করা কোনো প্রধান বিষয় নয়। যিহোবা হলেন ‘পরম ধন্য [“সুখী,” NW] ঈশ্বর’ আর তিনি চান যেন তাঁর দাসেরাও সুখী হয়। (১ তীমথিয় ১:১১) তাঁর নিজের বাক্য বলে: “[ইহা] ব্যতীত আর মঙ্গল তাহাদের হয় না। . . . প্রত্যেক মনুষ্য যে ভোজন পান ও সমস্ত পরিশ্রমের মধ্যে সুখভোগ করে, ইহাও ঈশ্বরের দান।”—উপদেশক ৩:১২, ১৩.
আমাদের উপাসনা আনন্দপূর্ণ হওয়া উচিত কিন্তু বাইবেল কখনো উপবাস করাকে সুখের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে না। অধিকন্তু, খাদ্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা যদি আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে অথবা আমাদের নির্মাতা সত্য খ্রিস্টানদেরকে আস্থা সহকারে যে-আনন্দপূর্ণ কাজ—রাজ্যের সুসমাচার ঘোষণা করার কাজ—করতে দিয়েছেন, সেটা করার জন্য আমাদের শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়, তাহলে স্পষ্টতই তা করা নিষ্ফল হবে।
আমরা উপবাস করা বেছে নিই বা না নিই, আমাদের অন্যদের বিচার করা এড়িয়ে চলা উচিত। সত্য খ্রিস্টানদের মধ্যে এই বিষয় নিয়ে কোনো মতবিরোধ থাকা উচিত নয়, “কারণ ঈশ্বরের রাজ্য ভোজন পান নয়, কিন্তু ধার্ম্মিকতা, শান্তি এবং পবিত্র আত্মাতে আনন্দ।”—রোমীয় ১৪:১৭. (w০৯ ৪/১)
[পাদটীকাগুলো]
^ ইষ্টেরের উপবাস সম্বন্ধে ঈশ্বর আদেশ করেননি, তবে তার উপবাসকে তিনি অনুমোদন করেছিলেন বলে মনে হয়। বর্তমানে, যিহুদি পূরীম পর্বের আগে রীতিগতভাবে ইষ্টেরের উপবাস পালন করা হয়।
^ কিছু বাইবেল ভুলভাবে উপবাসের বিষয়ে উল্লেখ করে কিন্তু এই সংযোজনগুলো সবচেয়ে পুরোনো গ্রিক পাণ্ডুলিপিগুলোতে পাওয়া যায় না।—মথি ১৭:২১; মার্ক ৯:২৯; প্রেরিত ১০:৩০; ১ করিন্থীয় ৭:৫, কিং জেমস ভারসন।
[২৬ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
ফরীশীরা উপবাস করার সময় বিনয়ের ভান করেছিল
[২৭ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
“ঈশ্বরের রাজ্য ভোজন পান নয়, কিন্তু ধার্ম্মিকতা, শান্তি এবং পবিত্র আত্মাতে আনন্দ”
[২৭ পৃষ্ঠার বাক্স]
খ্রিস্টানদের চল্লিশ দিনব্যাপী উপবাস সম্বন্ধে কী বলা যায়?
বলা হয়ে থাকে যে, খ্রিস্টের ৪০ দিনব্যাপী উপবাসকে স্মরণ করার জন্য খ্রিস্টানরা ৪০ দিনব্যাপী উপবাস করে থাকে। কিন্তু, যিশু কখনোই তাঁর শিষ্যদেরকে তাঁর উপবাস স্মরণ করতে আদেশ দেননি কিংবা তারা যে তা পালন করত, সেটারও কোনো প্রমাণ নেই। মনে করা হয়ে থাকে যে, ইস্টারের পূর্বে ৪০ দিনব্যাপী উপবাস করার প্রথম নির্ভরযোগ্য উল্লেখ, সা.কা. ৩৩০ সালের আথানেসিয়াসের চিঠিগুলোতে পাওয়া যায়।
যেহেতু যিশু তাঁর মৃত্যুর আগে নয় কিন্তু তাঁর বাপ্তিস্মের পরে উপবাস করেছিলেন, তাই কোনো কোনো ধর্ম যে ইস্টারের পূর্বের সপ্তাহগুলোতে চল্লিশ দিনব্যাপী উপবাস পালন করে থাকে, তা অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু, বছরের প্রথম দিকে ৪০ দিনব্যাপী উপবাস করার বিষয়টা প্রাচীন বাবিলীয়, মিশরীয় এবং গ্রিকদের মধ্যে সাধারণ ছিল। এই “খ্রিস্টীয়” প্রথাটা স্পষ্টতই তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে।