সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

তিনি করুণার বিষয়ে এক শিক্ষা লাভ করেছিলেন

তিনি করুণার বিষয়ে এক শিক্ষা লাভ করেছিলেন

তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন

তিনি করুণার বিষয়ে এক শিক্ষা লাভ করেছিলেন

 চিন্তা করার জন্য যোনার হাতে নিশ্চয়ই পর্যাপ্ত সময় ছিল। তিনি ৮০০ কিলোমিটারেও বেশি পথ যাত্রা করতে যাচ্ছিলেন, হেঁটে গেলে সেই পথ পার হতে প্রায় এক মাস বা তারও বেশি সময় লাগবে। যাত্রার শুরুতে, তাকে সংক্ষিপ্ত পথ এবং অধিক নিরাপদ কিন্তু দীর্ঘ পথের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হয়েছিল আর এরপর অগণিত উপত্যকা ও পাহাড়-পর্বতের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করতে হয়েছিল। তাকে বিশাল সিরীয় মরুভূমির পাশ দিয়ে যাত্রা করতে হয়েছিল, তেজস্বিনী ইউফ্রেটিস নদীর মতো বিভিন্ন নদী পার হতে হয়েছিল এবং সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া ও অশূরিয়ার শহর ও গ্রামগুলোর মধ্যে যে-বিদেশিরা ছিল, তাদের মাঝে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছিল। যাত্রা করার সময়, তিনি নিশ্চয়ই তার গন্তব্যস্থলের বিষয়ে, যে-নগর সম্বন্ধে তিনি খুবই ভীত ছিলেন এবং যে-নগরের কাছাকাছি তিনি চলে এসেছিলেন, সেই নীনবীর বিষয়ে চিন্তা করেছিলেন।

একটা বিষয় সম্বন্ধে যোনা নিশ্চিত ছিলেন: তিনি তার কার্যভার থেকে সরে দাঁড়াতে ও সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারবেন না। তিনি এর আগে তা করার চেষ্টা করেছিলেন। যিহোবা প্রথমে যখন তাকে পরাক্রমী অশূরীয় দুর্গে গিয়ে তাদের কাছে বিচারের বার্তা জানাতে বলেছিলেন, তখন যোনা সঙ্গেসঙ্গে এর বিপরীতগামী একটা জাহাজে চড়েছিলেন। এরপর যিহোবা এক প্রচণ্ড ঝড় এনেছিলেন ও যোনা শীঘ্র বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার বিদ্রোহের কারণে জাহাজের প্রত্যেককে মৃত্যুবরণ করতে হবে। সেই সাহসী নাবিকদের বাঁচানোর জন্য তিনি তাদেরকে বলেছিলেন যে, তারা যেন তাকে জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা তা করেছিল আর যোনা নিশ্চিত ছিলেন যে, তার মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু যিহোবা এক বৃহৎ মাছকে পাঠিয়েছিলেন, যাতে সেটা যোনাকে গিলে ফেলে এবং তিন দিন পর তাকে অক্ষত অবস্থায় তীরে বমন করে আর এই ঘটনা যোনাকে একজন বিস্মিত ও অধিক বাধ্য ব্যক্তি করে তুলেছিল। *—যোনা, ১, ২ অধ্যায়।

যিহোবা যখন যোনাকে দ্বিতীয় বার নীনবীতে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন, তখন সেই ভাববাদী বাধ্য হয়ে পূর্ব দিকে এই দীর্ঘ যাত্রা করেছিলেন। (যোনা ৩:১-৩) কিন্তু, যিহোবার শাসন কি তাকে পুরোপুরি পালটে দিতে পেরেছিল? উদাহরণস্বরূপ, যিহোবা তাকে করুণা দেখিয়েছিলেন, তাকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন, তার বিদ্রোহের কারণে তাকে শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন এবং তার কার্যভার সম্পাদন করার জন্য তাকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দিয়েছিলেন। এই সমস্তকিছুর পর কি যোনা অন্যদের প্রতি করুণা দেখাতে শিখেছিলেন? করুণা হচ্ছে এমন একটা শিক্ষা, যা অসিদ্ধ মানুষদের পক্ষে শেখা প্রায়ই কঠিন হয়ে থাকে। আসুন আমরা দেখি যে, যোনার এই কঠোর প্রচেষ্টা থেকে আমরা কী শিখতে পারি।

বিচারের এক বার্তা এবং এক বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া

যোনা নীনবী নগরকে যিহোবার মতো করে দেখেননি। আমরা পড়ি: “নীনবী ঈশ্বরের দৃষ্টিতে মহানগর” ছিল। (যোনা ৩:৩) যোনার বিবরণ দেখায় যে, যিহোবা তিন বার ‘নীনবীকে সেই মহানগর’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (যোনা ১:২; ৩:২; ৪:১১) কেন এই নগর যিহোবার কাছে মহানগর বা গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল?

নীনবী এক প্রাচীন নগর ছিল, জলপ্লাবনের পর প্রথম দিকে নিম্রোদ যে-নগরগুলোর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে এটা একটা ছিল। এটা ছিল এক বিশাল, রাজধানী অঞ্চল, যেখানে স্পষ্টতই আরও কয়েকটা শহর ছিল, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে যেতে তিন দিন লাগত। (আদিপুস্তক ১০:১১; যোনা ৩:৩) নীনবী আসলেই এক প্রভাবশালী নগর ছিল, যেখানে বিভিন্ন নজরকাড়া মন্দির ছিল, প্রকাণ্ড প্রাচীর ও বড়ো বড়ো অট্টালিকা ছিল। কিন্তু, এগুলোর কোনোটাই সেই নগরকে যিহোবা ঈশ্বরের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলেনি। সেখানকার লোকেরা ছিল তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে নীনবীতে প্রচুর জনসংখ্যা ছিল। তারা মন্দ কাজগুলো করা সত্ত্বেও, যিহোবা তাদের প্রতি চিন্তা দেখিয়েছিলেন। তিনি মানব জীবনকে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির যে অনুতাপ করার ও যা সঠিক তা করার সম্ভাবনা রয়েছে, সেটাকে মূল্যবান বলে গণ্য করেন।

শেষপর্যন্ত যোনা যখন নীনবীতে প্রবেশ করেছিলেন, তখন এই নগরের ১,২০,০০০-রেরও বেশি জনসংখ্যা দেখে তিনি হয়তো আরও বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। * তিনি একদিনের পথ হেঁটে গিয়েছিলেন, সেই জনাকীর্ণ নগরের আরও ভিতরে ঢুকেছিলেন, সম্ভবত তার বার্তা জানানোর কাজ শুরু করার জন্য এলাকার কেন্দ্রস্থলে কোনো উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিলেন। এই লোকেদের কাছে তিনি কীভাবে পৌঁছাবেন? তিনি কি অশূরীয় ভাষা শিখেছিলেন? নাকি যিহোবা তাকে অলৌকিকভাবে সেই ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন? আমরা তা জানি না। এইরকম হতে পারে যে, যোনা তার মাতৃভাষা ইব্রীয়তে বিচারের বার্তা জানিয়েছিলেন এবং নীনবীর লোকেদের কাছে এটা বর্ণনা করার জন্য একজন অনুবাদককে ব্যবহার করেছিলেন। যাই হোক, তার বার্তা সহজ-সরল ছিল এবং “চল্লিশ দিন গত হইলে নীনবী উৎপাটিত হইবে,” এই বার্তা সম্ভবত তাকে জনপ্রিয় করে তোলেনি। (যোনা ৩:৪) তিনি নির্ভীকভাবে ও বার বার তা ঘোষণা করেছিলেন। তা করে তিনি উল্লেখযোগ্য সাহস ও বিশ্বাস প্রদর্শন করেছিলেন, যে-গুণগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আজকে খ্রিস্টানদের আরও বেশি প্রয়োজন।

যোনা নীনবীয়দের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, তিনি বিদ্বেষপূর্ণ ও হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখার বিষয়ে নিজেকে তৈরি করে রেখেছিলেন। এর পরিবর্তে, উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেছিল। লোকেরা তার কথা শুনেছিল! তার কথাগুলো দাবানলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। শীঘ্র সমগ্র নগরে ধ্বংস সম্বন্ধীয় যোনার ভবিষ্যদ্‌বাণী নিয়ে বলাবলি হচ্ছিল। যোনার বিবরণ আমাদের জানায়: “নীনবীয় লোকেরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করিল; তাহারা উপবাস ঘোষণা করিল, এবং মহান্‌ হইতে ক্ষুদ্র পর্য্যন্ত সকলে চট পরিধান করিল।” (যোনা ৩:৫) ধনী-দরিদ্র, বলবান ও দুর্বল, ছোটো-বড়ো সকলেই একইরকম অনুতপ্ত মনোভাব দেখিয়েছিল। প্রজাদের এই তৎপরতার কথা শীঘ্র রাজার কানে পৌঁছেছিল।

ফলে, রাজাও ঈশ্বরকে ভয় করতে শুরু করেছিলেন। তিনি তার সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, তার জাঁকালো রাজকীয় পোশাক পরিহার করে তার প্রজাদের মতো সাদামাটা পোশাক পরেছিলেন আর এমনকী ‘ভস্মে বসিয়াছিলেন।’ তিনি তার “অধ্যক্ষগণের” বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে একটা আদেশ জারি করেছিলেন, যেটার মাধ্যমে তিনি তার প্রজাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত উপবাসকে সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করেছিলেন। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন যে, সকলেই এমনকী গৃহপালিত পশুরাও যেন চট পরিধান করে। * তিনি নম্রভাবে স্বীকার করেছিলেন যে, তার লোকেরা তাদের কুপথ ও দৌরাত্ম্যের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। সেইসঙ্গে তিনি এই আশাও করেছিলেন যে, সত্য ঈশ্বর তাদের অনুতাপ দেখে তাদের প্রতি করুণা দেখাবেন, তাই তিনি বলেছিলেন: “হয় ত, ঈশ্বর . . . আপন প্রজ্বলিত ক্রোধ হইতে নিবৃত্ত হইবেন, তাহাতে আমরা বিনষ্ট হইব না।”—যোনা ৩:৬-৯.

নীনবীয়দের মধ্যে এত দ্রুত মনপরিবর্তন হয়েছে কি না, সেই বিষয়ে কিছু সমালোচক সন্দেহ প্রকাশ করে। কিন্তু, বাইবেল পণ্ডিত ব্যক্তিরা উল্লেখ করেছে যে, এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও প্রাচীনকালের এইরকম অস্থির প্রকৃতির লোকেদের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। যাই হোক, পরবর্তী সময়ে যিশু খ্রিস্ট নিজে নীনবীর লোকেদের অনুতাপের কথা উল্লেখ করেছিলেন। (মথি ১২:৪১) তিনি যে-বিষয়ে কথা বলেছিলেন, তা তিনি জানতেন কারণ তিনি স্বর্গ থেকে এই ঘটনাগুলো দেখেছিলেন। (যোহন ৮:৫৭, ৫৮) কিন্তু, নীনবীয়দের অনুতাপের প্রতি যিহোবা কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?

ঐশিক করুণা ও মানব কঠোরতার মধ্যে এক বৈসাদৃশ্য

পরে যোনা লিখেছিলেন: “ঈশ্বর তাহাদের ক্রিয়া, তাহারা যে আপন আপন কুপথ হইতে বিমুখ হইল, তাহা দেখিলেন, আর তাহাদের যে অমঙ্গল করিবেন বলিয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে অনুশোচনা করিলেন; তাহা করিলেন না।”—যোনা ৩:১০.

তার মানে কি এই যে, যিহোবা বুঝতে পেরেছিলেন, নীনবী সম্বন্ধে তাঁর নিজের বিচার ভুল ছিল? না। বাইবেল যিহোবা সম্বন্ধে বলে: “তাঁহার কর্ম্ম সিদ্ধ, কেননা তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য; তিনি বিশ্বাস্য ঈশ্বর, তাঁহাতে অন্যায় নাই।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪) নীনবীর বিরুদ্ধে যিহোবার ন্যায্য ক্রোধ স্বাভাবিকভাবেই দূর হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেই লোকেদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন এবং দেখেছিলেন যে, তিনি তাদের ওপর যে-শাস্তি আনার বিষয়ে মনস্থ করেছিলেন, তা আনা আর উপযুক্ত হবে না। এটাই ছিল ঐশিক করুণা প্রদর্শনের এক সময়।

যিহোবা কঠোর, উদাসীন বা এমনকী কর্কশ ঈশ্বর নন, যাঁকে ধর্মীয় নেতারা প্রায়ই এভাবেই তুলে ধরে। এর পরিবর্তে, তিনি হলেন যুক্তিবাদী, নমনীয় এবং করুণাময়। তিনি যখন দুষ্টদের ওপর শাস্তি আনতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন, তখন তিনি প্রথমে পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিদের ব্যবহার করে এই বিষয়ে সাবধান করেন, কারণ তিনি এটা দেখতে উৎসুক যে, নীনবীয়রা যা করেছিল—অনুতপ্ত হয়েছিল ও তাদের পথ পরিবর্তন করেছিল—দুষ্ট ব্যক্তিরাও যেন তা-ই করে। (যিহিষ্কেল ৩৩:১১) যিহোবা তাঁর ভাববাদী যিরমিয়কে বলেছিলেন: “যখন আমি কোন জাতির কিম্বা রাজ্যের বিষয়ে উন্মূলনের, উৎপাটনের ও বিনাশের কথা বলি, তখন আমি যে জাতির বিষয়ে কথা বলিয়াছি, তাহারা যদি আপন দুষ্টতা হইতে ফিরে, তবে তাহাদের যে অমঙ্গল করিতে আমার মনস্থ ছিল, তাহা হইতে আমি ক্ষান্ত হইব।”—যিরমিয় ১৮:৭, ৮.

তাই, যোনার ভবিষ্যদ্‌বাণী কি মিথ্যা ছিল? না; কারণ যিহোবার উদ্দেশ্য অনুযায়ী এটা লোকেদের জন্য সাবধানবাণী হিসেবে কাজ করেছিল। সেই সাবধানবাণী নীনবীয়দের মন্দ কাজগুলোর ওপর ভিত্তি করে ছিল, যেগুলোর জন্য পরবর্তী সময়ে তারা অনুতাপ করেছিল। নীনবীয়রা যদি তাদের মন্দ কাজগুলো আবার শুরু করে, তাহলে ঈশ্বরের বিচার তাদের ওপর আসবে। পরবর্তী সময়ে ঠিক সেটাই ঘটেছিল।—সফনিয় ২:১৩-১৫.

যোনা কীরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, যখন তিনি যে-সময়ে আশা করেছিলেন, সেই সময়ে ধ্বংস আসেনি? আমরা পড়ি: “কিন্তু ইহাতে যোনা মহা বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হইলেন।” (যোনা ৪:১) এমনকী যোনা একটা প্রার্থনা করেছিলেন, যা শুনে মনে হচ্ছিল যেন তিনি সর্বশক্তিমানকে সংশোধন করছেন! যোনা এইরকম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তার নিজের বাড়িতে, নিজের দেশেই থাকা উচিত ছিল। তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি আগেই জানতেন, যিহোবা নীনবীর ওপর ধ্বংস আনবেন না, এমনকী এই বিষয়টাকেই প্রথমে তর্শীশে পালিয়ে যাওয়ার পিছনে অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছিলেন। এরপর, তিনি তার মৃত্যু কামনা করেছিলেন ও বলেছিলেন যে, বেঁচে থাকার চেয়ে বরং মরে যাওয়া আরও ভালো।—যোনা ৪:২, ৩.

কী যোনাকে বিরক্ত করছিল? কোন বিষয় নিয়ে তার মনের মধ্যে তোলপাড় হয়েছিল, সেই সম্বন্ধে আমরা সবকিছু জানি না কিন্তু আমরা জানি যে, যোনা সব লোকের সামনে নীনবীর ধ্বংস সম্বন্ধে ঘোষণা করেছিলেন। তারা তার কথা বিশ্বাস করেছিল। আর এরপর কোনো ধ্বংসই আসেনি। তিনি কি এই ভেবে ভয় পেয়েছিলেন যে, তাকে উপহাস করা হবে বা একজন মিথ্যা ভাববাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? তিনি যা-ই ভাবুন না কেন, লোকেদের অনুতাপ দেখে বা যিহোবার করুণা দেখে তিনি আনন্দিত হননি। এর পরিবর্তে, এইরকম মনে হয় যেন তিনি তিক্ততা, আত্মকরুণা ও ক্ষতিকর গর্বের পঙ্কে তলিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, যোনার করুণাময় ঈশ্বর তখনও এই বিরক্ত লোকের মধ্যে ভালো কিছু দেখেছিলেন। তাঁকে অসম্মান করার কারণে যোনাকে শাস্তি না দিয়ে যিহোবা স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে একটা মৃদু কিন্তু মর্মভেদী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন: “তুমি ক্রোধ করিয়া কি ভাল করিতেছ?” (যোনা ৪:৪) যোনা কি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিয়েছিলেন? বাইবেল এই সম্বন্ধে আমাদের কিছু জানায় না।

যিহোবা যেভাবে যোনাকে একটা শিক্ষা দিয়েছিলেন

এই বিমর্ষ ভাববাদী নীনবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তবে তার নিজ দেশের দিকে নয় কিন্তু পূর্বাঞ্চলে, যেখানে অবস্থিত পাহাড়গুলোর ওপর থেকে নীনবী দেখা যেত। তিনি সেখানে একটা ছোট্ট কুটির নির্মাণ করেছিলেন এবং সেখান থেকে নীনবীর কী দশা হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সম্ভবত তিনি তখনও সেই নগরের ধ্বংস দেখবেন বলে আশা করছিলেন। কীভাবে যিহোবা এই ক্ষমাহীন ব্যক্তিকে করুণাময় হতে শিক্ষা দেবেন?

এক রাতের মধ্যে যিহোবা একটা এরণ্ড গাছকে বৃদ্ধি পেতে দিয়েছিলেন। যোনা ঘুম থেকে উঠে এই ফলবান গাছটাকে দেখেছিলেন যে, এটার ছড়ানো পাতা তার ভঙ্গুর কুটিরের চেয়ে আরও বেশি ছায়া দিয়েছিল। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। সেই গাছটা দেখে “যোনা . . . বড় আহ্লাদিত হইলেন,” সম্ভবত এটার অলৌকিক প্রকাশকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও অনুমোদনের এক চিহ্ন হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু, যিহোবা যোনাকে শুধুমাত্র তাপ থেকে স্বস্তি দেওয়ার ও তার নিজের অযৌক্তিক ক্রোধ থেকে মুক্ত করার চেয়ে আরও বেশি কিছু করতে চেয়েছিলেন। তিনি যোনার হৃদয়ে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। তাই, ঈশ্বর একটা কীটকে ব্যবহার করেছিলেন ও সেই গাছকে শুকিয়ে যেতে দিয়েছিলেন। এরপর, তিনি “উষ্ণ পূর্ব্বীয় বায়ু” প্রেরণ করেছিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না যোনা তাপের কারণে ‘পরিক্লান্ত হইলেন।’ আবারও যোনা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন এবং তিনি ঈশ্বরকে বলেছিলেন যেন তার মৃত্যু হয়।—যোনা ৪:৬-৮.

আরেকবার যিহোবা যোনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, তার রাগ করা ঠিক হয়েছে কি না আর এবারে একটা এরণ্ড গাছ মরে যাওয়ার কারণে। অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে, যোনা নিজের কাজকে সঠিক মনে করে বলেছিলেন: “মৃত্যু পর্য্যন্ত আমার ক্রোধ করাই ভাল।” এর ফলে, সেই শিক্ষণীয় বিষয়টাকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য যিহোবার কাছে সুযোগ খুলে গিয়েছিল।—যোনা ৪:৯.

ঈশ্বর যোনার সঙ্গে যুক্তি করেছিলেন, তাকে বলেছিলেন যে, ভাববাদী এমন একটা সামান্য গাছের জন্য দুঃখ করছিলেন, যেটা এক রাতের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছিল অথচ সেই গাছটাকে তিনি নিজে রোপণও করেননি বা বৃদ্ধিও দেননি। এরপর ঈশ্বর উপসংহারে বলেছিলেন: “তবে আমি কি নীনবীর প্রতি, ঐ মহানগরের প্রতি, দয়ার্দ্র হইব না? তথায় এমন এক লক্ষ বিংশতি সহস্রের অধিক মনুষ্য আছে, যাহারা দক্ষিণ হস্ত হইতে বাম হস্তের প্রভেদ জানে না; আর অনেক পশুও আছে।”—যোনা ৪:১০, ১১. *

আপনি কি যিহোবার এই বাস্তব উদাহরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা বুঝতে পারছেন? যোনা সেই গাছের যত্ন নেওয়ার জন্য কোনো কিছুই করেননি। অন্যদিকে, যিহোবা ছিলেন সেই নীনবীর লোকেদের জীবনের উৎস এবং তিনি তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, যেমনটা তিনি পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির বেলায় করে থাকেন। কীভাবে যোনা সেই ১,২০,০০০ মানুষের চেয়ে ও সেইসঙ্গে তাদের পশুদের চেয়ে একটা গাছকে অধিক মূল্য দিতে পারেন? এই কারণেই কি নয় যে, যোনা তার চিন্তাভাবনায় স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলেন? তিনি সেই গাছের জন্য দুঃখ পেয়েছিলেন কারণ তিনি ব্যক্তিগতভাবে সেই গাছ থেকে উপকার লাভ করেছিলেন। নীনবীর প্রতি তার ক্রোধ কি স্বার্থপর উদ্দেশ্য—নিজের মুখরক্ষা করা বা নিজেকে সঠিক বলে প্রমাণিত করার জন্য উদ্ধত আকাঙ্ক্ষার—থেকে উদ্ভূত হয়নি?

এক গভীর শিক্ষাই বটে! প্রশ্ন হল, যোনা কি সেই অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শিখেছিলেন? তার নামে যে-বইটি রয়েছে, সেটির শেষ পদে যিহোবার সেই প্রশ্নটি রয়েছে, যেটার উত্তর এখনও দেওয়া হয়নি। কিছু সমালোচক হয়তো অভিযোগ করতে পারে যে, যোনা কখনোই উত্তর দেননি। কিন্তু সত্য বিষয়টা হল, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন। আসলে, তার বইটিই সেই উত্তর। সাক্ষ্যপ্রমাণ ইঙ্গিত করে যে, যোনাই তার নামের বইটি লিখেছিলেন। একটু কল্পনা করুন যে, সেই ভাববাদী আরেকবার রক্ষা পেয়ে তার নিজ দেশে বসে এই বিবরণটি লিখছেন। আমরা কল্পনা করতে পারি যে, একজন বৃদ্ধ, আরও বিজ্ঞ ও নম্র ব্যক্তি তার নিজের ভুলগুলো, তার বিদ্রোহ ও করুণা দেখানোর বিষয়ে তার একগুঁয়ে প্রত্যাখ্যানের বিবরণ লেখার সময় অনুতপ্তভাবে মাথা নাড়াচ্ছেন। স্পষ্টতই, যোনা যিহোবার বিজ্ঞ নির্দেশনা থেকে শিখেছিলেন। তিনি করুণাময় হতে শিখেছিলেন। আমরাও কি তা-ই শিখব? (w০৯ ৪/১)

[পাদটীকাগুলো]

^ ২০০৯ সালের এপ্রিল - জুন প্রহরীদুর্গ পত্রিকার “তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন—তিনি তার ভুলগুলো থেকে শিখেছিলেন” শিরোনামের প্রবন্ধটি দেখুন।

^ অনুমান করে দেখা গিয়েছে যে, যোনার দিনে ইস্রায়েলের রাজধানী শমরিয়ায় প্রায় ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ অধিবাসী ছিল—নীনবীর জনসংখ্যার চেয়ে এক চতুর্থাংশ কম। নীনবী যখন সমৃদ্ধশালী ছিল, তখন এটা হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো নগর ছিল।

^ এই বিস্তারিত বর্ণনা অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে কিন্তু প্রাচীনকালে আসলে এমনটা হতো। গ্রিক ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটাস বলেছিলেন যে, প্রাচীন পারসিকরা একজন জনপ্রিয় সেনাপতির মৃত্যুতে তাদের শোক করার প্রথায় নিজেদের গৃহপালিত পশুদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

^ সেই লোকেরা তাদের দক্ষিণ হস্ত থেকে বাম হস্তের প্রভেদ জানে না, ঈশ্বরের এই কথা ঐশিক মানগুলোর বিষয়ে তাদের প্রকৃত অজ্ঞানতাকে বোঝায়।

[১৬ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

ঈশ্বর এই বিষয়টা দেখতে আকুল আকাঙ্ক্ষী যে, দুষ্টরা যেন নীনবীর লোকেদের মতো অনুতপ্ত হয় ও তাদের পথ পরিবর্তন করে

[১৭ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

ঈশ্বর যোনাকে করুণার বিষয়ে এক শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটা এরণ্ড গাছ ব্যবহার করেছিলেন