সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

 জীবনকাহিনি

দুর্বলতা সত্ত্বেও শক্তি লাভ করা

দুর্বলতা সত্ত্বেও শক্তি লাভ করা

উনত্রিশ কিলোগ্রাম (৬৫ পাউন্ড) ওজনের এই জীর্ণ দেহটাকে একটা হুইল চেয়ারে দেখলে কেউই বলবে না যে, আমি মানসিকভাবে শক্তিশালী। কিন্তু আমার শরীর ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকলেও, মনের জোরে আমি বেঁচে আছি। আমার মনের জোর ও দুর্বলতা কীভাবে আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে, আসুন তা আপনাদের জানাই।

চার বছর বয়সে

ছোটোবেলার কথা চিন্তা করলে, ফ্রান্সের দক্ষিণে অবস্থিত গ্রামের সেই ছোট্ট বাড়ির সুখের দিনগুলোর কথা আমার মনে পড়ে, যেখানে আমার বাবা-মা থাকত। আমার বাবা আমাকে একটা দোলনা বানিয়ে দিয়েছিলেন আর আমি বাগানের চারপাশে ছোটাছুটি করতে পছন্দ করতাম। ১৯৬৬ সালে, যিহোবার সাক্ষিরা আমাদের বাড়িতে আসে আর তাদের সঙ্গে আমার বাবার দীর্ঘসময় ধরে আলোচনা হয়। মাত্র সাত মাসের মধ্যেই সে একজন সাক্ষি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার মা-ও শীঘ্র একই সিদ্ধান্ত নেয় এবং তারা আমাকে এক প্রেমময় পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ করে তোলে।

আমার বাবা-মায়ের দেশ, স্পেনে ফিরে যাওয়ার কিছু সময় পরই আমার বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। আমি আমার দুই হাতে এবং পায়ের গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতে শুরু করি। দু-বছর ধরে অনেক ডাক্তার দেখানোর পর আমরা অবশেষে একজন নামকরা বাত রোগ বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাই, যিনি অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, “অনেক দেরি করে ফেলেছেন।” এটা শোনার সঙ্গেসঙ্গে আমার মা কাঁদতে শুরু করে। সেই ঠাণ্ডা, বিষণ্ণ ঘরের পরিবেশে “অটোইমিউন ক্রনিক ইলনেস্‌” এবং “জুভেনাইল পলিআর্থ্রাইটিস” *-এর মতো অদ্ভূত শব্দগুলো যেন চারপাশে প্রতিধবনিত হতে থাকে। দশ বছর বয়সি একটা ছোটো মেয়ে হিসেবে খুব একটা না বুঝলেও আমি এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে, সংবাদটা বেশি ভালো ছিল না।

ডাক্তার আমাকে একটা শিশু চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন। সেখানে গিয়ে অতি সাধারণ এক দালান দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়ি। সেখানকার নিয়মকানুন খুব কড়া ছিল: নানরা আমার চুল ছোটো করে দেয় এবং বেঢপ ইউনিফর্ম পরিয়ে দেয়। ‘আমি এখানে থাকব কী করে?’ এটা চিন্তা করেই আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।

আমি যিহোবার যত্ন উপলব্ধি করি

যেহেতু আমার বাবা-মা আমাকে যিহোবার সেবা করতে শিক্ষা দিয়েছিল, তাই আমি সেখানকার ক্যাথলিক রীতিনীতিতে অংশ নিতাম না। কিন্তু, নানরা এটা বুঝতে পারছিল না যে, কেন আমি অংশ নিই না। আমি যিহোবার কাছে মন খুলে প্রার্থনা করি, যাতে তিনি আমাকে পরিত্যাগ না করেন আর শীঘ্র আমি তাঁর প্রেমময় বাহুর সুরক্ষা অনুভব করি, এটা ঠিক এমন যেন একজন প্রেমময় বাবা আন্তরিকভাবে এবং শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছেন।

আমার বাবা-মাকে প্রতি শনিবার অল্পসময়ের জন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হতো। তারা আমার জন্য বাইবেলভিত্তিক প্রকাশনা নিয়ে আসত, যাতে সেগুলো পড়ার মাধ্যমে আমার বিশ্বাস দৃঢ় হয়। সাধারণত ছেলে-মেয়েরা তাদের কাছে বই রাখতে পারত না কিন্তু নানরা আমাকে বাইবেলের পাশাপাশি সেগুলোও রাখার অনুমতি দিয়েছিল আর  আমি প্রতিদিন বাইবেল পড়তাম। এ ছাড়া, আমি অন্যান্য মেয়েদের কাছে পরমদেশ পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকার আশা সম্বন্ধে বলতাম, যেখানে কেউই অসুস্থ হবে না। (প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) যদিও মাঝে মাঝে আমার খুব খারাপ লাগত এবং আমি একাকীত্ব বোধ করতাম, কিন্তু তারপরও আমি আনন্দিত ছিলাম যে, যিহোবার ওপর আমার বিশ্বাস এবং নির্ভরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

দীর্ঘ ছ-মাস পর ডাক্তাররা আমাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেয়। যদিও আমার অসুস্থতা দূর হয়ে যায়নি কিন্তু বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসতে পেরে আমি খুব আনন্দিত ছিলাম। আমার গাঁটগুলো আরও বেশি বেঁকে গিয়েছিল আর এর ফলে যন্ত্রণাও বেড়ে গিয়েছিল। কিশোর বয়সে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও, ১৪ বছর বয়সে আমি বাপ্তিস্ম নিই এবং আমার স্বর্গীয় পিতাকে যথাসাধ্য সেবা করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হই। কিন্তু, মাঝে মাঝে তাঁর ওপর আমি অসন্তুষ্ট হয়ে যেতাম। প্রার্থনায় আমি এই কথাগুলো বলতাম, “কেন আমার প্রতিই এমনটা ঘটল? দয়া করে আমাকে সুস্থ কর। আমি কত কষ্ট পাচ্ছি, তুমি কি তা দেখতে পাচ্ছ না?”

কিশোর বয়সটা আমার জন্য এক কঠিন সময় ছিল। আমাকে এটা মেনে নিতে হয়েছিল যে, আমার অবস্থার উন্নতি হবে না। আমি নিজেকে আমার বন্ধুদের সঙ্গে তুলনা না করে থাকতে পারতাম না কারণ তারা সুস্থ ছিল এবং জীবন উপভোগ করত। তাদের তুলনায় নিজেকে ছোটো বলে মনে হতো এবং আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু, আমার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবরা আমাকে সাহায্য করত। এদের মধ্যে আমার প্রিয় বন্ধু এলিসিয়ার কথা খুব মনে পড়ে, যিনি আমার চেয়ে ২০ বছরের বড়ো ছিলেন। তিনি আমাকে আমার অসুস্থতার বিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করার পরিবর্তে অন্যদের বিষয়ে চিন্তা করতে শিখিয়েছিলেন।

আমার জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার বিভিন্ন উপায় খোঁজা

আমার বয়স যখন ১৮ বছর, তখন আমার অবস্থা আবার খারাপ হয়ে যায় আর এর ফলে খ্রিস্টীয় সভাগুলোতে যোগ দিলেও আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তবে, বাড়িতে বসে মনোযোগের সঙ্গে বাইবেল পড়ার জন্য আমার হাতে “প্রচুর সময়” ছিল বলে আমি সেটার সদ্‌ব্যবহার করতাম। ইয়োব এবং গীতসংহিতা বই আমাকে এই বিষয়টা বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, বর্তমানে যিহোবা ঈশ্বর আমাদের দৈহিকভাবে যত্ন নেওয়ার পরিবর্তে মূলত আধ্যাত্মিকভাবে যত্ন নেন। ক্রমাগত প্রার্থনা করার মাধ্যমে আমি “পরাক্রমের উৎকর্ষ [“অসাধারণ মহাশক্তি,” বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন]” এবং “সমস্ত চিন্তার অতীত যে ঈশ্বরের শান্তি, তাহা” লাভ করেছিলাম।—২ করিন্থীয় ৪:৭; ফিলিপীয় ৪:৬, ৭.

আমার বয়স যখন ২২ বছর, তখন থেকে আমি হুইল চেয়ার ব্যবহার করতে শুরু করি আর আমাকে এই জীবনটাই মেনে নিতে হয়। আমি এই চিন্তা করে ভয় পেয়েছিলাম যে, লোকেরা আমাকে নয় বরং একটা হুইল চেয়ারকে দেখবে, যার মধ্যে একজন অসুস্থ মহিলা বসে আছেন। কিন্তু, হুইল চেয়ার কিছু কিছু দিক দিয়ে আমার স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিল এবং সেই “অভিশাপ” এক আশীর্বাদে পরিণত হয়েছিল। ইসাবেল নামে আমার একজন বান্ধবী আমাকে পরামর্শ দেন, যেন আমি এক মাস প্রচার কাজে তার সঙ্গে ৬০ ঘণ্টা ব্যয় করার লক্ষ্য স্থাপন করি।

প্রথম প্রথম, এই বিষয়টা আমার কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু, আমি যিহোবার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম এবং আমার পরিবার ও বন্ধুদের সাহায্যে আমি তা করতে পেরেছিলাম। সেই ব্যস্ত মাসটা খুব দ্রুত কেটে গিয়েছিল এবং আমি আমার ভয় ও জড়তা কাটিয়ে উঠেছিলাম। আমি সেই প্রচার কাজ এতটাই উপভোগ করেছিলাম যে, ১৯৯৬ সালে আমি একজন নিয়মিত অগ্রগামী হওয়ার অর্থাৎ প্রতি মাসে পরিচর্যায় ৯০ ঘণ্টা ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিই। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে একটা, যা আমাকে ঈশ্বরের আরও নিকটবর্তী করে তুলেছিল আর এমনকী দৈহিকভাবেও সবল করেছিল। পরিচর্যায় রত থাকার ফলে আমি অনেক লোককে আমার বিশ্বাস সম্বন্ধে জানাতে এবং কাউকে কাউকে ঈশ্বরের বন্ধু হয়ে ওঠার জন্য সাহায্য করতে পেরেছি।

যিহোবা আমাকে ধরে রেখেছেন

২০০১ সালের গ্রীষ্ম কালে মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার দুটো পা-ই ভেঙে যায়। তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি আন্তরিকভাবে নীরবে প্রার্থনা করেছিলাম: “যিহোবা, দয়া করে আমাকে পরিত্যাগ কোরো না!” ঠিক তখনই পাশের বিছানায় শুয়ে থাকা একজন মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি কি একজন যিহোবার সাক্ষি?” উত্তর দেওয়ার মতো কোনো শক্তি আমার ছিল না, তাই আমি কেবল মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিলাম। “আমি আপনাদের সম্বন্ধে জানি! আমি সাধারণত আপনাদের পত্রিকা পড়ি,” তিনি বলেছিলেন। এই কথাগুলো আমাকে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছিল। এমনকী সেই করুণ অবস্থার মধ্যেও আমি যিহোবা সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিতে পেরেছিলাম। এটা কতই-না এক সম্মানের বিষয়!

আমি যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি, তখন আমি আরও অনেকের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার দু-পায়েই প্লাস্টার করা ছিল কিন্তু সেই অবস্থাতেই আমার মা আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঘোরাত। প্রতিদিন আমরা কয়েক জন রোগীর কাছে যেতাম, তাদের খবরাখবর জিজ্ঞেস করতাম এবং তাদেরকে বাইবেলভিত্তিক কিছু সাহিত্যাদি দিয়ে আসতাম। এভাবে কাজ করা যদিও ক্লান্তিকর ছিল কিন্তু যিহোবা আমাকে প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়েছিলেন।

২০০৩ সালে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে

গত কয়েক বছরে আমার ব্যথা ও যন্ত্রণা আরও বেড়ে গিয়েছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাবাকে মৃত্যুতে হারানোর যন্ত্রণা। তারপরও,  আমি এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। কীভাবে? যখনই সম্ভব হয়, তখনই আমি বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি এবং এটা আমাকে আমার সমস্যাগুলো নিয়ে চিন্তা না করতে সাহায্য করে। আর আমি যখন একা থাকি, তখন কিছু-না-কিছু পড়ি, বাইবেল অধ্যয়ন করি অথবা টেলিফোনের মাধ্যমে অন্যদের কাছে প্রচার করি।

প্রায়ই আমি দু-চোখ বন্ধ করে “মনশ্চক্ষে” ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাত নতুন জগৎ দেখি

এ ছাড়া, আমি ছোটো ছোটো বিষয়ে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি যেমন, মুখের ওপর বয়ে যাওয়া বাতাস অথবা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। এই বিষয়গুলো আমাকে কৃতজ্ঞ হওয়ার কারণ জোগায়। হাসিঠাট্টা করাও আমার ওপর ভালো প্রভাব ফেলে। একদিন প্রচার করার সময় আমার বন্ধু যিনি আমার হুইল চেয়ারটা ঠেলছিলেন, তিনি কিছু লিখে নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে আমার হুইল চেয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে নীচের দিকে গড়িয়ে যায় আর আমি পার্ক করা একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্বা খাই। আমরা দু-জনেই হতভম্ব হয়ে যাই কিন্তু যখন আমরা দেখি যে, গুরুতর কিছু ঘটেনি, তখন আমরা হাসতে থাকি।

এমন অনেক কিছু আছে, যেগুলো আমি করতে পারি না। সেগুলো আমি ভবিষ্যতে করব বলে আশা করি। প্রায়ই আমি দু-চোখ বন্ধ করে “মনশ্চক্ষে” ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাত নতুন জগৎ দেখি। (২ পিতর ৩:১৩) আমি নিজেকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করি, যে সুস্থসবল, হেঁটে বেড়াচ্ছে এবং পূর্ণরূপে জীবন উপভোগ করছে। রাজা দায়ূদের এই কথাগুলো আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে: “সদাপ্রভুর অপেক্ষায় থাক; সাহস কর, তোমার অন্তঃকরণ সবল হউক।” (গীতসংহিতা ২৭:১৪) যদিও আমার শরীর দিনের পর দিন আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু যিহোবা আমাকে সবল করেছেন। দুর্বলতার মধ্যেও আমি ক্রমাগত শক্তি লাভ করে চলছি। ▪ (w14-E 03/01)

^ অনু. 6 জুভেনাইল পলিআর্থ্রাইটিস এমন একটা দীর্ঘস্থায়ী বাতের রোগ, যার দ্বারা সাধারণত ছোটো ছেলে-মেয়েরা আক্রান্ত হয়। এতে দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায় এবং শরীরের ভালো কোষগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আর এর ফলে গাঁটে গাঁটে ব্যথা হয় এবং সেগুলো ফুলে যায়।